ব্যস্ত শহুরে জীবনটা যতই আমাদের ঘিরে ফেলছে ততই যেন আমরা
আমাদের সনাতনী সংস্কৃতিগুলোকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। নতুন যান্ত্রিক জীবনে শব্দের
প্রদুষন আর বাতাসের দুষন শুধু পার্থিব শরীরটাকেই দুষিত করে দিচ্ছে, তা নয়, এর
সঙ্গে আমাদের শুদ্ধ চিন্তার বিকাশকেও ফুটতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে যখন একা হয়ে যাই,
নিজেকে খোঁজার একটা চেষ্টা করি। ছোটবেলার কত ছেঁড়া পাতা হাওয়া উড়ে ভেসে ভেসে আসে।
সব তো ধরতে পারিনা। বাইরের গজিয়ে ওঠা শহুরে কৃত্রিম যান্ত্রিক খোলসে ধাক্কা খেয়ে
কোন সুদূরে চলে যায়। তাও যা ধরতে পারি তাই বা কম কি! আজকাল বাড়ির আশেপাশে কচুগাছ
খুঁজলেও পাই না। অথচ সেই পাতার ওপরের ভোরের শিশির যখন প্রথম সূর্যের আলো পড়ে
চিকচিক করে উঠত, তখন মনটাও যেন কোন স্বপ্নের দেশে চলে যেত। শুদ্ধতম শিশির আর আলোর
মত মন আর প্রাণও যেন স্বর্গীয় আনন্দে ভরে যেত।
ছোটবেলাটা আমার হাওড়ার কাসুন্দিয়ায় কেটেছে। শিবশক্তি স্কুলে
ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম। স্কুলটার সামনে একটা ছোট মাঠ আর পাশে একটা বাঁধান
পুকুর ছিল। পুকুরের পশ্চিম দিকে ছিল একটা শিবমন্দির আর উত্তর দিকের মাঠটাতে
চৈত্রের গাজনের মেলা হত। মাঠের পর বড় পাকা রাস্তা আর তার পাশে শীতলা মন্দিরের
আটচালা। ওটাতে সংকীর্তনের দল আসত। চৈত্রের শেষের দিকে একটা বিরাট বড় গাছের কান্ড
মাঠটার মাঝখানে পুঁতে দিত। ওটাকে চড়ক গাছ বলত। সারাবছর ঐ ভারি কাঠটা পুকুরের জলের
তলায় থাকত। কি করে যে ঠিক সময় ঘাটের কাছে চলে আসত, তা বুঝতাম না। কাঠটার মাথায়
অনেকগুলো বাঁশকে একটা মস্ত কাঠের অনেকটা ইংরেজি ‘এ’ র মত কাঠের সঙ্গে বেঁধে চড়ক
গাছটার মাথায় বসিয়ে দিত, যাতে ওটা মাঝের কান্ডটাকে ঘিরে ঘুরতে পারে। ওটার দুই ধার
থেকে দুটো মোটা দড়ি নেমে আসত। যারা সারা চৈত্রমাস ধরে সন্ন্যাস নিয়ে থাকত তারা
তাতে চেপে ঘুরত। গ্রাম বাংলায় এখনও এই উৎসব খুব ঘটা করে পালন করে। প্রধানত শিব,
মনসা আর ধর্মঠাকুরকে কেন্দ্র করে এই মেলা হয়ে আসছে। তবে চৈত্র মাসে যে গাজন উৎসব পালন
করা হয়, তার মূল অংশ হল শিবের উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ ধরে বেশ কিছু মানুষ সন্ন্যাস গ্রহণ করে এই গাজন উৎসব পালন
করে। আর এটি শেষ হয় চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক পুজোর পরে।
চৈত্র মাসের শিব ঠাকুরের আরাধনা, নাচ-গানের বিষয়ের কিছু বিবরণ ব্রহ্মবৈবর্তপূরাণেও
রয়েছে। একবার দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের নাতি আর উষার বিয়েকে নিয়ে শিবের একনিষ্ঠ উপাসক বাণরাজার
সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে মহাদেবের থেকে অমরত্ব লাভ করার জন্য বাণরাজা নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে
মহাদেবকে তুষ্ট করেন এবং ভক্তিমূলক নাচগানও করান। তখন থেকেই এই পুজোর শুরু। তবে অনেকে মনে করেন ১৪৮৫ সালে
রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুর প্রথম এই পুজোর প্রচলন করেন। সেই থেকে শৈব সম্প্রদায়ের মানুষ
এই উৎসব পালন করে আসছেন। এই পুজোর বৈশিষ্ট হল, এতে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য নেই।
গাজন উৎসব সাধারণত তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। ঘাট- সন্ন্যাস, নীলব্রত ও চড়ক। প্রথা মেনে দীর্ঘদিন উপবাসের পর প্রথমে শিবের পুজোর ফুল সংগ্রহ করে প্রতীকী শিবলিঙ্গকে
মাথায় করে ঢাক-ঢোল, কাঁসর বাজিয়ে পরিক্রমায়
বের হয় ভক্ত সন্ন্যাসীরা। এই গাজনের ভক্তরা তাদের শরীরকে
বিভিন্ন ভাবে কষ্ট দেয়। যেমন কেউ লোহার শলা ফিয়ে জিভ ফুটো করে, কেউ বা পিঠে লোহার
আঙটার মত কাঁটা ঢুকিয়ে, সেটা চড়কের দড়িতে বেঁধে ঘোরে। এছাড়াও যেমন, জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটা, ছুরি এবং
কাঁটার ওপর লাফানো, কুমিরের পুজো, শিবঠাকুরের
বিয়ে- এসবও হয়। অবশ্য বৃটিশরা এর অনেক কিছু বন্ধ করে দিয়েছিল। গ্রামীন লোকেরা ভাবত এইভাবে কৃচ্ছসাধন করলে দেবতা সন্তুষ্ট হবেন। এইভাবেই ওরা শোভাযাত্রা
সহকারে শিব মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হত। দূর থেকে ‘—চরণের সেবা লাগে মহাদেব’ আওয়াজ শুনলেই আমরা
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতাম। পকেটে করে লুকিয়ে একটা দুটো আলু নিয়ে নিতাম। দিদি মাঝে
মাঝে জামার মধ্যে করে চালও নিয়ে আসত। ধান, তেল, টাকাও মাঝে মাঝে চাইত। তবে ওসব
আমরা কোথা থেকে পাব! তবে যাই পেত, তাই নিয়েই আবার ডাক ছাড়তে ছাড়তে চলে যেত।
চড়কের থেকেও ঝাঁপান দেখার উৎসাহটা আমাদের মধ্যে বেশি ছিল।
ওটা তার ঠিক একদিন আগেই হত। বাঁশের দুই কিম্বা তিন থাকের উঁচু মাচা করে সামনে কাঠ
রেখে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হত। আগুন প্রায় একতলা পর্যন্ত হয়ে যেত। বাঁশের একদম
ওপরের মাচা থেকে মহাদেবের নামে চিৎকার করতে করতে সেই আগুনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। অতটা
লম্বা না হওয়ায় সামনেটা ভিড়ের আড়ালেই থেকে যেতে হত। আগুনের মধ্যে পড়ে যাওয়াটা আর
দেখতে পারতাম না। তবে কেউই পুড়ে যেত না। লোকে বলত, ওদের ওপর মহাদেবের আশীর্বাদ
রয়েছে যে, আগুন গায়ে লাগবে কেন?
মেলায় কেনাকাটির ব্যাপারে মায়ের কাছ থেকে কিছু পয়সা পেতাম
না। বড়পিশেমশাই এসব ব্যাপারে আমার সঙ্গে ছিল। তাছাড়া বড়পিশেমশাই সঙ্গে না থাকলে
মেলায় ঘোরার অনুমতিই পেতাম না। উনি অবশ্য ঘুরতেন না। শীতলা মন্দিরে বন্ধুদের সঙ্গে
বসে গল্প করতেন। কিছু ভাল লাগলে দৌড়ে এসে পিশেমশায়ের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে যেতাম।
অনেক কিছুই বিক্রি হত। তবে আমার টিনের ড্রাম আর মাটির বেহালা বেশি ভাল লাগত। টিনের
ড্রামটা দুদিনেই ফেটে যেত। দিদি তখন পুতুলগুলো দেখিয়ে বলত, দেখ আমারগুলোর কিচ্ছু
হয়নি। মনটা খারাপ হয়ে যেত। ছোড়দার আবার অনেক রকম দুর্বুদ্ধি মাথায় খেলত। আখের
গুড়ের ক্যানেস্তারা টিন কেটে লাগিয়ে দিত। সে এক বিচ্ছিরি আওয়াজ হত। মা-তো একদিন
ওটাকে ছুঁড়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছিল। পরে বড় হয়ে ঘটনাগুলো মনে এলে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকার ওপরে লেখা গুন্টারগ্রাসের বিখ্যাত টিনড্রাম সিনেমাটার কথা
মনে পড়ে যেত। ছেলেটার সারাক্ষণের ড্রাম পেটানোয় সবাই বিরক্ত হয়ে যেত। অবশ্য
গল্পটায় দুঃখের অংশটাই বেশি ছিল।
ভেবে অবাক লাগে কত অল্প খাবারেই তখন খুশি হয়ে যেতাম। মেলায়
আর যাই হোক পাঁপড় আর জিলিপি থাকবে না, এটা ভাবাই যায় না। দিদির আবার পাঁপড়েই বেশি
ঝোঁক ছিল। খেতে খেতে অন্যদিকে তাকালেই আমারটা থেকে ভেঙে খেয়ে নিত। অবশ্য তার বদলে
একটা জিলিপি বেশি দিয়ে দিত। পকেটে পয়সা পড়ে থাকলে গুড়ের লাঠি কিনে নিতাম। ওটা দিদি
খেত না।
মেলার বিক্রেতাদের সঙ্গে ওদের বাচ্চারাও থাকত। খেলার সুযোগ
যেন ওদেরও হারিয়ে যেত। বসে বসে দেখত খেলার জিনিসগুলো ওদের চোখের সামনে দিয়ে বিক্রি
হয়ে যাচ্ছে। অবাক চোখে বিষ্ময়ের ছোঁয়া। তখন বুঝতাম না। বুঝতে শিখলাম যখন, তখন
অনেকটাই বড় হয়ে গেছি। ছোটবেলার খেলার সময়টা শহুরে কৃত্রিমতায় কেমন যেন ধুসর হয়ে
গেছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন