সময় ও মস্তিষ্কের অযথা রক্তক্ষরণ: "আরক্ত ভৈরব" - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 
  • বই– আরক্ত ভৈরব
  • লেখক– হিমি মিত্র রায়
  • মুদ্রিত মূল্য– ₹১৯৯/-
  • প্রকাশনী– বুকফার্ম
  • প্রকাশকাল– জুলাই ২০২০
  • প্রচ্ছদ– কামিল দাস
  • পৃষ্ঠা– ১৮৪
 

জলপাইগুড়ি শহর। নিস্তরঙ্গ, শান্ত পাহাড়ের কোল ঘেঁষা শহরে এক ভোরবেলা পাওয়া যায় এক যুবতীর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। আগের রাতেই যাকে দেখা গিয়েছিল শহরের সুপরিচিত বিখ্যাত ডাক্তারদের জন্য মেডিকাল রিপ্রেসেন্টেটিভদের তরফ থেকে আয়োজিত এক পার্টিতে, যার উদ্দেশ্য ডাক্তারদের সাথে “রিলেশন তৈরি করা”, তাকেই পরদিন সকালে রাস্তার ধারে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সকলের নজর কেড়ে পার্টিতে যুবতী আলাপচারিতায় নিজের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ছিল, তারই মৃতদেহ পাওয়ার সাথে সাথেই সকলে জানতে পারেন যুবতীর শরীরের কিছু অঙ্গও উধাও রয়েছে।  পার্টি থেকে সামান্য নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নিজের স্কুটি চালিয়ে তাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে অনেকেই বেড়িয়ে যেতে দেখলেও, মৃতদেহের কাছে স্কুটির চিহ্নও কেউ পায়নি। অতএব মৃত্যু রহস্যের কিনারা করতে আসরে উপস্থিত হন জলপাইগুড়ির ডি এস পি রেশমি বসু। যিনি গজদন্ত সমাহারে সজ্জিতা, অবিবাহিতা, চকোলেটের নেশায় মাতোয়ারা, ক্ষুরধার বুদ্ধি সম্পন্না হয়ে এলেন, সরেজমিনে তদন্ত করলেন(?) এবং বেশ অনেকখানি নাকানি চোবানি খেয়ে সাথে বিয়ে না করার জন্য প্রায় বধ্যপরিকর হওয়া সত্ত্বেও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সুদর্শন চেহারা ও অতি ভদ্রচিত ব্যবহারে (অর্থাৎ হঠাৎ হঠাৎ করে যত্রতত্র উদয় হয়ে তাঁর চকোলেট সাপ্লাই দিয়ে যাওয়া) মুগ্ধ হয়ে অল্প স্বল্প প্রেমে টাল খেয়ে গেলেন। তা যেতেই পারেন, বিয়ে করা বা না করার সাথে প্রেমের কোনও সম্পর্ক আজকের দিনে বিশেষ কিছু নেই। তদন্তে শহরের বেশ কিছু গণ্যমান্য বিখ্যাত ব্যক্তি জড়িয়ে পড়লেন। চিকিৎসার সাথে জড়িত কর্মচারী থেকে শুরু করে শহরে নতুন আগত ও জনপ্রিয় ক্ষমতাশালী ডাক্তাররাও এই তদন্তের আওতায় এসে পড়লেন। অতঃপর বিস্তর দৌড়াদৌড়ি করে তন্ত্র - মন্ত্র সাধনা, ভুত-প্রেত, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সংস্কার- কুসংস্কারের জাল ছিঁড়ে, বেশ একটু মোচড় দিয়ে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিকে(দেরকে) খুনী প্রমাণ করে, শেষমেশ অপরাধী ধরা পড়লেন। সাথে সাথে গল্পের পুলিশ এবং বাস্তবের পাঠক দুইই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এই হল গল্পের মূল বিষয়। 

এবার আসি কেমন লেগেছে সেই প্রসঙ্গে। 


ইদানিংকালে বাংলা সাহিত্যে যে এক বিশেষ ধরণের খিচুড়ি লেখার ধারা প্রচলিত হয়েছে, এই বই তারই এক সংযোজন। এই ধারার লেখায় লেখকরা কোনও কিছু বাদ দেওয়ার ঝুঁকি নেন না। অল্প অল্প করে সব ধারা কিছু কিছু করে জুড়ে দেন, সম্ভবত এই ধারনায় যে বইটি যাতে সব পাঠকের জন্যই উপাদেয় হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা প্রকৃত সাহিত্যানুরাগী তৈলমর্দনে একান্ত অনাগ্রহী পাঠকের কাছে বিষবৎ অখাদ্যে পরিণত হয়। তাতে অবশ্য লেখক বা প্রকাশকের কিছু যায় আসে না। কিছু পাঠকের আর্থিক এবং মানসিক ক্ষতি অবশ্যই হয়। এই বইটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।


এক্ষেত্রে অবশ্য প্রকাশনী সংস্থা বড় ভূমিকা পালন করে। আজকাল বাজারে রহস্য – রোমাঞ্চ – ভৌতিক – তন্ত্র – ঐতিহাসিক রহস্য নির্ভর কাহিনীর চাহিদা নাকি বেশি। তাই প্রকাশকদল এর বাইরে কিছু ছাপাতে নাকি সহজে রাজী হন না। ফলত নবীন লেখক – লেখিকাবৃন্দ বাধ্য হয়েই এই ঘরানায় গল্প লেখার চেষ্টা করেন। প্রতিভাবান অল্প সংখ্যকের লেখনী বাদ দিলে অধিকাংশই এই খিচুড়ি ঘরানার গোলকধাঁধায় তাল হারিয়ে ফেলেন। এই বইও ব্যতিক্রম নয়।


পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদে এবং সঠিক ভাবে সঠিক সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতার অভাবে গল্পের সূচনা বেশ ভালো হওয়া সত্ত্বেও তাই মধ্যবর্তী অংশ থেকে গল্পের খেই হারাতে শুরু করেন লেখিকা। ফলত অকারণ প্রসঙ্গের উত্থাপন ও অপ্রয়োজনীয় চরিত্রের আগমন ঘটে গল্পের গতি ও আকর্ষণ সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয়। যেমন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের চরিত্র ও গল্পে তাঁর বিস্তার। নায়িকার বিয়ে করা না করার সাথে প্রেমে পড়া বা প্রেম করার কোনও সম্পর্ক আজকের দিনে একেবারে ততটাই অপ্রাসঙ্গিক, ঠিক যতটা অপ্রাসঙ্গিক গল্পে এই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হঠাৎ হঠাৎ করে আগমনটা। এবং শেষে বিষয়টি উহ্য রেখে হারিয়েই যাওয়াটাও। তবে সম্পূর্ণ গল্পে এই রকম বেশ কিছু চরিত্রের আনাগোনা ঘটেছে যাঁদের সাথে গল্পের কোনও যোগাযোগ বহু দুর অবধি নেই। এমনকি রেশমি বসুর আসামে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে যে খেজুরে গল্প রচনা হয়েছে সেটিও সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। 


বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনা হয়েছে। অথচ অকারণে বাক্যের মধ্যে অফুরন্ত অন্যান্য ভাষার শব্দ গুঁজে দেওয়া হয়েছে। এটি লেখিকার অপারগতা নাকি চরিত্রদের অতিরিক্ত আধুনিক মনস্কতা প্রমাণের চেষ্টা তা বুঝলাম না। কিন্তু ভাষার মাধুর্যের অভাবে বই পড়তে গিয়ে একরাশ বিরক্তি তৈরি হল। 


সমগ্র গল্প জুড়ে অসংখ্য সংলাপ রচনা হয়েছে। যা খুবই স্বাভাবিক। তদন্তমূলক কাহিনী সংলাপ নির্ভর হতেই পারে। কিন্তু এই রকম সংলাপ? একঘেয়ে, বিরক্তিকর, অপ্রয়োজনীয়, একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারংবার বলার মত সংলাপ? যেন পুলিশ প্রশ্নই খুঁজে পাচ্ছে না। বা প্রশ্নের উত্তর বুঝতে না পেরে শিশুতোষ প্রশ্ন করে খেলা করছে? এমনকি বহু জায়গাতেই আগের সংলাপের সাথে পরবর্তী সংলাপের মিলও খুঁজে পাওয়া যায় না। যেন খেয়াল খুশি মত যা হোক বলে গেছেন কেউ।

বইয়ের প্রুফ দেখার সময় বা প্রয়োজন লেখিকা ও প্রকাশক কারোরই হয়নি, তার অজস্র প্রমাণ বইয়ের শুরু থেকে শেষ অবধি পাওয়া যাবে। বানান ভুল থেকে শুরু করে ভুল বাক্য গঠন এবং একই অনুচ্ছেদের পুনঃ লিখন সব বর্তমান। 


এই সব কিছুর সাথে জুড়ে গিয়েছে অত্যন্ত বিসদৃশ্য প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি। গল্পের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ছবি। শিল্পী কামিল দাস এর আগেও বেশ কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন, যা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও তার চিত্রায়ন ভীষণ ভাবে হতাশ করল। প্রচ্ছদের মতই নামকরণের কোনও স্বার্থকতা খুঁজে পেলাম না। প্রচ্ছদপরিকল্পনা ও তার চিত্রায়ন এতই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও দায়সারা যে সন্দেহ জাগে, শিল্পী বই পড়েছেন কিনা বা আদৌ বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানেন কিনা। তবে বইয়ের ভিতরে রাহুল ঘোষের আঁকা অলংকরণ প্রশংসার দাবী রাখে। যথাযোগ্য ও সুন্দর অলংকরণ গল্পের আকর্ষণ বাড়াতে সাহায্য করে।


লেখিকার প্রথম উপন্যাস। বইয়ের ভুমিকায় উনি প্রশংসার তুলনায় নিন্দা শুনতে বেশি আগ্রহী বলে জানিয়েছেন। তাই কিছু ভুল ত্রুটি জানালাম। আশা করব নিরুৎসাহী না হয়ে পরবর্তী সংস্ককরণে ভুলগুলো শুধরে প্রকাশ করবেন এবং এরপরের উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় চরিত্র ও সাবপ্লট লিখে সময় ও পৃষ্ঠা নষ্ট না করে গল্পের মূল বিষয়ের উপরে যত্নশীল হবেন।

বুকফার্ম ইদানিংকালের প্রকাশনার জগতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বেশ কিছু উৎকৃষ্ট বই প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য জগতে অবদানও রাখছে। সেক্ষেত্রে এই প্রকাশনীর বইয়ের ক্ষেত্রে একজন পাঠকের উচ্চ গুণমানের বইয়ের প্রত্যাশা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেখানে যদি এই ধরণের ভুল ভ্রান্তিতে ভরা বই পাঠকের কাছে আসে তখন সেই প্রত্যাশা ভেঙ্গে বিতৃষ্ণা তৈরি হতে বাধ্য। তাই একটি বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে প্রকাশনা সংস্থার দায়ও কিছু কম নয়। আশা করব পাঠকদের আশা – প্রত্যাশা ধরে রাখার চেষ্টা তারাও কিছুটা করবেন বইয়ের গুণগত মানের দিকে নজর দিয়ে।    

 



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন