শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য - কমলেন্দু সূত্রধর



[১]

‘বিশ্ব যখন নিদ্রা মগন গগন অন্ধকার
কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার’।

এ গান যখন লিখেছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ঊনপঞ্চাশ। আর আটচল্লিশ বছর বয়সে চৈতন্য যখন বলছেন, ‘গোবিন্দ বিরহে আমার কাছে মুহূর্ত হয় যুগের মতন সুদীর্ঘ, চোখে নেমে আসে ঘন বরষা, সমস্ত সংসার আমার কাছে হয়ে যায় শূন্য’, তখন তার অন্তর্ধান ঘটে।

চৈতন্যের অন্তর্ধান নিয়ে প্রচুর গবেষণা হওয়া সত্ত্বেও কবে-কোথায়-কিভাবে তিনি অন্তর্হিত হয়েছিলেন, অন্তর্ধানের পর তিনি আদৌ বেঁচে ছিলেন কিনা, বেঁচে থাকলেও পরবর্তীতে কোথায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, কোথায়ই বা তাঁর সমাধিক্ষেত্র – এই প্রশ্নগুলির কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়না। ভাবলে অবাক হতে হয়, শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধানের সঠিক তারিখ নিয়েও প্রচুর মতভেদ আছে পণ্ডিতমহলে। কেউ বলেন ২৯ জুন ১৫৩৩ সাল(৩১শে আষাঢ় ১৪৫৮৫ শক) বেলা ৩টে থেকে রাত ১০টার মধ্যে তাঁর অন্তর্ধান ঘটে; আবার কারও মতে ১৭-১৮ এপ্রিল ১৫৩৩ সাল(২-৩রা বৈহাখ ১৪৫৫ শক) রাত ১০ টা থেকে ১১টার মধ্যে অথবা অতি ভোরে তিনি অন্তর্হিত হন। অন্তর্ধানের বছর হিসাবে ১৪৫৪ এবং ১৪৫৬ শকের কথাও শোনা যায়। এমন মতামতও বর্তমান যে, বৈশাখ বা আষাঢ়ে নয়, মহাপ্রভু বিলীন হন ফাল্গুনের কোনো এক সন্ধ্যা বেলা। চৈতন্যের অন্তর্ধান সম্পর্কে এমন মতামতগুলির প্রবক্তাদের মধ্যে একাধিক চৈতন্যচরিতকারও বিদ্যমান যারা নিজেদের হয় চৈতন্যের অন্তর্ধানের প্রত্যক্ষদর্শী কিম্বা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ তুলে ধরেছেন বলে দাবী করেছেন। তা সত্ত্বেও, এই প্রত্যক্ষদর্শীদের পরস্পরের বক্তব্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। প্রথমে এই চরিতকারদের রচনার দিকে একবার নজর দেওয়া যাক।

এখানে বলে রাখা দরকার, শ্রীচৈতন্যের জীবনাশ্রিত প্রথম সাহিত্যকর্ম কিন্তু বাংলাতে নয়, রচিত হয়েছিল সংস্কৃত ভাষাতে, নাম ‘মুরারী গুপ্তের কড়চা’। মুরারী গুপ্ত ছিলেন শ্রীহট্টের অধিবাসী। শ্রীচৈতন্যের থেকে বছর পনেরো বড়ো মুরারী গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন। শ্রীচৈতন্যের বাল্য থেকে তিরোধান পর্যন্ত প্রায় পুরো সময়টাকেই মুরারী গুপ্ত তাঁর কড়চায় তুলে ধরেছিলেন। বলানাহুল্য, এই কড়চাই চৈতন্য জীবনী গ্রন্থ সমূহের মধ্যে আদিতম ও আকরগ্রন্থ; কবি কর্ণপুর, দামোদর পণ্ডিত, জয়ানন্দ, লোচন দাস, বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজাদি পরবর্তী চরিতকারগণ এই মুরারী গুপ্তের কড়চা অবলম্বনেই চৈতন্যদেবের বাল্যলীলার বর্ণনা করেছেন। তবে, আশ্চর্যজনক ভাবে, এই গ্রন্থে চৈতন্যের তিরোধানের উল্লেখ থাকলেও কবে কোথায় তাঁর তিরোধান হয়েছিল তাঁর কোনো উল্লেখ নেই। নিজের গ্রন্থে চৈতন্য অন্তর্ধান সম্পর্কে মুরারী গুপ্ত লিখেছেন-

"তারয়িত্বা জগৎ কৃৎস্নং বৈকুন্ঠস্থো প্রসাধিতঃ।
জগাম নিলয়ং হৃষ্টো নিজমেব মহাদ্ধিমৎ।।"

এরপর, যিনি সংস্কৃতে চৈতন্যজীবনী রচনা করেছিলেন, তাঁর নাম কবিকর্ণপূর পরমানন্দ সেন। কবি চৈতন্যদেবের অন্যতম প্রধান পার্ষদ শিবানন্দ সেনের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। কবির বয়স যখন সাত, তখন পিতা শিবানন্দের সাথে তিনি পুরীধাম ভ্রমণ করেন এবং শ্রীচৈতন্যের সান্নিধ্যে আসেন। মহাপ্রভুর পাদস্পর্শ করে বালক কবি বিশুদ্ধ সংস্কৃতে শ্লোক উচ্চারণ করে মহাপ্রভুর বন্দনা করেন। বালকের কবিত্ব প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে চৈতন্য তাঁর নতুন নামকরণ করেন ‘কবিকর্ণপূর’ (কবিদের কর্ণের অলঙ্কার তুল্য)। কবিকর্ণপূর নাট্যাকারে চৈতন্যজীবনী রচনা করেন, নাম ‘চৈতন্য চন্দ্রোদয়’। এছাড়াও তিনি ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ নামে একটি কাব্যও রচনা করেন। নিজের নাটকে কবিকর্ণপূর চৈতন্যদেবের শেষ জীবনের কাহিনী পরিবেশিত করেছেন অথচ তাতে তিরোধানের কোনোরূপ উল্লেখমাত্র নেই। তিরোধানের প্রসঙ্গে নাট্যকার কেমন যেন অদ্ভুত বাকসংযম করে গিয়েছেন।

এরপর নাম করতে হয় প্রবোধানন্দ সরস্বতীর। নিজের গ্রন্থ ‘চৈতন্যচন্দ্রামৃত’-তে ১৪৩ টি শ্লোকে তিনি নিজের চৈতন্যভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। বলাবাহুল্য শ্লোকগুলিতে চৈতন্য-তিরোধানের ইঙ্গিত মাত্রও নেই।

এবার উল্লেখ করতে হয় স্বরুপ দামোদরের, প্রকৃত নাম পুরুষোত্তম আচার্য। সন্ন্যাস গ্রহণ করলে ‘যোগপট্ট’ ধারণ করাই বিধেয়, কিন্তু পুরুষোত্তম তা করতেন না। সন্ন্যাস নিয়েও তিনি ছিলেন নিজের পূর্বরূপে বা ‘স্বরূপে’- তাই তাঁর নাম হয়েহিল স্বরূপ দামোদর। বয়সে চৈতন্যদেবের থেকে বড়ো স্বরূপ পুরীধামে প্রভুর নিয়ত রক্ষণাবেক্ষণ করতেন, চৈতন্যদেবের নীলাচল লীলার অন্তরঙ্গ সাক্ষী, বাঙালি পরিকরদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এর স্থানে স্থানে স্বরূপ দামোদরের সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছেন-

“দামোদর স্বরূপ আর গুপ্ত মুরারি। 
মুখ্য মুখ্য লীলাসূত্র লিখিয়াছে বিচারি।।”

শ্রীচৈতন্যের ছায়াসঙ্গী স্বরূপ প্রভুর শেষলীলার একটি বিবরণ কড়চা আকারে লিখেছিলেন, যা ‘স্বরূপ দামোদরের কড়চা’ বলে পরিচিত। কৃষ্ণদাসের ভাষায়-

“দামোদর স্বরূপের কড়চা অনুসার।
রামানন্দ মিলন লীলা করিল প্রচার।।
প্রভুর যে শেষ লীলা স্বরূপ দামোদর।
সূত্রে করি গাঁথিলেন গ্রন্থের ভিতর।।”

এহেন অতি মূল্যবান তথ্যভাণ্ডারটির কোনো খোঁজ আজ অব্ধি পাওয়া যায়নি। মূলপুঁথি দুরস্থান, গ্রন্থটির একটি অনুলিপিরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। অথচ গ্রন্থটির অস্তিত্ব ছিল এবং কবিকর্ণপূর ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ উভয়ই স্বরূপের গ্রন্থটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁর প্রমান তাদের লেখাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু যেহেতু তারা নিজেরাই চৈতন্য অন্তর্ধান বিষয়ে নির্বাক, সেহেতু স্বরূপের কড়চায় এ বিষয়ে কোনো তথ্য ছিল কিনা বা থাকলেও কি তথ্য ছিল তা তাঁরা উল্লেখ করেননি। বলাইবাহুল্য,‘স্বরূপ দামোদরের কড়চা’ পুঁথিটি বর্ত্তমানে চৈতন্যগবেষকদের কাছে ‘Holy grail’ এর থেকে কম নয়, পুঁথিটি আবিষ্কৃত হলে চৈতন্যগবেষণায় যে এক নতুন ধারার উন্মোচন ঘটবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।


[২]
 
শ্রীচৈতন্যের প্রভাবকে কেন্দ্র করেই বাংলায় এক সম্পুর্ণ নতুন ধরণের সাহিত্যধারার উন্মেষ ঘটে, যেটি হল জীবনীকাব্য। অবশ্য, চৈতন্যের জীবন নিয়ে কাব্য প্রথমে বাংলায় নয়, সংস্কৃতে রচিত হয়েছিল তাঁর উল্লেখ ও দৃষ্টান্ত পূর্বেই দেওয়া হয়েছে। বাংলা ভাষায় সর্বপ্রাচীন চৈতন্যজীবনী হল ‘চৈতন্যভাগবত’, রচয়িতা বৃন্দাবন দাস ঠাকুর। প্রভু নিত্যানন্দের আদেশে তিনি এই গ্রন্থের অবতারণা করেন-

“নিত্যানন্দ স্বরূপের আজ্ঞা করি শিরে।
সূত্রমাত্র লিখি আমি কৃপা অনুসারে।।”

তবে, বৃন্দাবন দাস তাঁর এই চরিতগ্রন্থ সম্পুর্ণ করেননি। নবম (পুঁথিভেদে দশম) অধ্যায়ে রূপ-সনাতনের সঙ্গে মিলনের পরে পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির কথার পর আচম্বিতে গ্রন্থটি সমাপ্ত হয়। এমন না যে গ্রন্থকার গ্রন্থ অসমাপ্ত রেখেই অকালে প্রয়াত, গ্রন্থ রচনার পরেও বহুদিন ধরাধামে ছিলেন, অথচ অসমাপ্ত গ্রন্থটিতে চৈতন্যদেবের শেষলীলা নেই।

তবে, পরবর্তীতে চৈতন্যভাগবতের দুটি নতুন পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই দুটি পুঁথির উপর ভিত্তি করে বর্ধমান জেলার দেনুড় শ্রীপাটের অধিকারী অম্বিকাচরণ ব্রহ্মচারী ৪২৪ চৈতন্যাব্দে ‘চৈতন্যভাগবতের অপ্রকাশিত অধ্যায়ত্রয়’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই নতুন প্রকাশিত অতিরিক্ত তিনটি অধ্যায়ের শেষ চতুর্দশ অধ্যায়ে আছে শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান কাহিনী, যদিও উক্ত পুঁথির প্রামাণিকতা বিতর্কিত। এই অতিরিক্ত চৈতন্যভাগবত থেকে জানা যায়, বৃন্দাবন ভ্রমনান্তে শ্রীচৈতন্য রূপ-সনাতনকে বৃন্দাবনের অধিকারী করে দিয়ে গদাধরকে সঙ্গে করে প্রভু ফিরে আসেন নীলাচলে। একদিন নীলাচলে জগন্নাথ মন্দিরে প্রেমোন্মত্ত মহাপ্রভু নিজের বাহ্যজ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরলে শ্রীচৈতন্য গদাধরকে বলেন, “আমি আগে যাই তুমি আসিহ পশ্চাতে।”  অতঃপর-

এত বলি শ্রীদেউলে প্রবেশ কৈল নাথে।।
পরিছা বলে – কোথা যাহ বলহ সন্ন্যাসী।
প্রভু কহে - জগন্নাথ পরশিয়া আসি।।
রহ রহ - বলে সবে বেত্র লয় করে।
নিষেধ না শুনি প্রভু চলিলা ভিতরে।।
জগন্নাথ পরশিয়া হৈলা অন্তর্ধান।
দেখিতে না পায় প্রভু গেলা নিজ স্থান।।
কেহ বলে – সন্ন্যাসী হৈল অন্তর্ধান।
নিশ্চয় জানিল সবে প্রভু ভগবান।।
এইরূপে গৌরচন্দ্র হৈল অন্তর্ধান।”

কিন্তু তা কি করে হয়, জলজ্যান্ত মানুষটা জগন্নাথ বিগ্রহ স্পর্শ করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন? পর মুহুর্তেই কবি বলছেন,

“এথা সে যখন প্রভু হৈলা অন্তর্ধান।
ন্যাসী রূপে গেলা মদনগোপালের স্থান।
অধিকারী সকল দেখিল তানে যাইতে।
পূনঃ কোথা গেল প্রভু না পারে লখিতে।।
সেই দিন বৈশাখ পূর্ণিমা ত্রয়োদশী।”

অস্যার্থ, প্রভু জগন্নাথে মিলিয়ে যাননি। অধিকারীরা দেখেছেন, সন্ন্যাসীবেশে কে যেন মদনগোপাল মন্দিরের দিকে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তারপর প্রভু যে কোথায় গেলেন তা আর লক্ষ্য করা গেল না অর্থাৎ, তিনি ‘অদৃশ্য’ হলেন। অন্তর্ধানের সময় বৈশাখ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী।  


চিত্রঃ- গুণ্ডিচা মন্দির

বৃন্দাবন দাসের এই গল্প স্মরণে রেখেই এবার আরেকজন চরিতকারের দিকে নজর দেওয়া যাক। লোচন দাস ছিলেন চৈতন্য পার্ষদ নরহরি ঠাকুরের শিষ্য। তাঁর লেখা কাব্য ‘চৈতন্যমঙ্গল’। প্রায় ১১০০০ ছত্রের এই কাব্যটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত- সূত্র, আদি, মধ্য ও শেষ খণ্ড। চৈতন্যমঙ্গলের শেষ খণ্ড থেকে জানা যাচ্ছে, ১৪৫৫ শকের আষাঢ় মাসের সপ্তমী তিথিতে  নীলাচলে প্রভুর কাছে নবদ্বীপ থেকে ভক্তসমাগম ঘটেছে। ভক্তদের সাথে কথা বলছেন বটে, কিন্তু প্রভু যেন ভাবে তন্ময়। হঠাৎ তিনি নীরব হলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ও জগন্নাথ দর্শনের জন্য ‘গুঞ্জাবাড়ি’ বা গুণ্ডিচা মন্দিরের[1] দিকে ধাবমান হলেন। ভক্তগণ তাঁর পিছনে পিছনে চললেন। ক্রমে তিনি সিংহদ্বার পেরিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেন  এবং ঠিক সেই মুহুর্তেই-

“তখন দুয়ারে নিজ লাগিল কপাট।
সত্ত্বরে চলিয়া গেল অন্তরে উচাট।।
আষাঢ় মাসের তিথি সপ্তমী দিবসে।
নিবেদন করে প্রভু ছাড়িয়া নিশ্বাসে ।
কৃপা কর জগন্নাথ পতিত পাবন।
কলিযুগ আইল এই দেহ ত শরণ।।
এ বোল বলিয়া সেই ত্রিজগত রায়।
বাহু ভিড়ি আলিঙ্গন তুলিল হিয়ায়।
তৃতীয় প্রহর বেলা রবিবার দিনে।
জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে।।”

প্রভু জগন্নাথে লীন হলেন। এদিকে বাইরে ভক্তরা চিন্তিত। অত বড়ো কপাট আপনা আপনি তো বন্ধ হতে পারে না। একাকী একজনের পক্ষে অন্তত তা অসম্ভব। এমন সময় গুণ্ডিচা মন্দিরের পাণ্ডারা অন্য দরজা দিয়ে মন্দিরের প্রবেশ করলেন। তখন ভক্তরা-

    “বিপ্রে দেখি ভক্ত কহে শুনহ পড়িছা।
ঘুচাহ কপাট প্রভু দেখি বড় ইচ্ছা।।”

ভক্তদের এই আকুল আবেদনে ‘পড়িছা’ বা প্রধান সেবক মূল দরজা না খুলেই বেড়িয়ে আসে এবং ভক্ত কুলের সামনে ঘোষণা করে-

“গুঞ্জাবাড়ীর মধ্যে প্রভুর হৈল অদর্শন।।
সাক্ষাতে দেখিনু গৌর প্রভুর মিলন।
নিশ্চয় করিয়া কহি শুন সর্বজন।।”

অর্থাৎ, লোচন দাসের ভাষ্য মতে, চৈতন্য আষাঢ়ের সপ্তমী তিথিতে গুণ্ডিচা মন্দিরে জগন্নাথদেহে লীন হন।

এবার অপর এক চৈতন্যচরিতকার জয়ানন্দের লেখার অবতারণা করা যাক। কবির পিতা সুবুদ্ধি মিশ্র, মাতা রোদনী, নিবাস বর্ধমানের আমাইপুরা গ্রাম। নীলাচল থেকে নবদ্বীপ ফেরার পথে শ্রীচৈতন্য বর্ধমানে সুবুদ্ধি মিশ্রের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। জয়ানন্দের বয়স তখন এক বছর, কিম্বা তারও কম। শ্রীচৈতন্যই সুবুদ্ধি মিশ্রের শিশুপুত্রের ‘জয়ানন্দ’ নামকরণ করেন। তাঁর চরিতগ্রন্থ ‘চৈতন্যমঙ্গল’। জয়ানন্দ তাঁর গ্রন্থের অষ্টম খণ্ডে চৈতন্য তিরোভাবের যে বর্ণনা করেছেন, তা অলৌকিকতা বর্জিত, যা তখনকার সময়ের নিরিখে সত্যিই বিরল। জয়ানন্দ লিখছেন,

“আষাঢ় বঞ্চিতা রথ বিজয় নাচিতে।
ইটাল বাজিল বাম পায় আচম্বিতে।।
নরেন্দ্রের জলে সর্ব পারিষদ সঙ্গে।
চৈতন্য করিল জলক্রীড়া নানারঙ্গে।।
চরণে বেদনা বড় ষষ্টি দিবসে।
সেই লক্ষে টোটাএ শয়ন অবশেষে।।
পন্ডিত গোসাঞিকে কহিল সর্বকথা।
কালি দশ দন্ড রাত্রে চলিব সর্বথা।।
চৈতন্য বৈকুণ্ঠ গেলা জম্বুদ্বীপ ছাড়ি।।
মায়া শরীর থাকিল ভূমে পড়ি।”



চিত্রঃ- টোটা গোপীনাথ মন্দির

অর্থাৎ, আষাঢ়ে রথের সময় নৃত্যরত শ্রীচৈতন্যের বাঁ পায়ে ইটের আঘাত লাগে। ষষ্ঠী তিথিতে ব্যাথা বাড়ায় তিনি টোটাতে(টোটা গোপীনাথ?) মন্দিরে আশ্রয় নেন। পরদিন অর্থাৎ, আষাঢ়ের সপ্তমীতে শ্রীচৈতন্য লোকান্তরিত হন। বাস্তবসম্মত স্বাভাবিক এই বর্ণনা। লক্ষণীয়, প্রভুর মৃত্যুর সময় বিষয়ে জয়ানন্দ লোচন দাসের সাথে একমত।

অপর এক চরিতকার ঈশান নাগর তাঁর ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’-এ জানাচ্ছেন,

“একদিন গোরা জগন্নাথে নিরখিয়া।
শ্রীমন্দিরে প্রবেশিল ‘হা নাথ’ বলিয়া।।
প্রবেশ মাত্রেতে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল।
ভক্তগণ মনে বহু আশঙ্কা জন্মিল।।
কিছুকাল পরে স্বয়ং কপাট খুলিল।
গৌরাঙ্গাপ্রকট সভে অনুমান কৈল।।”

জগন্নাথ মন্দিরে মহাপ্রভু ঢুকেছিলেন, এবং প্রবেশমাত্র কপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কপাট কিছুক্ষণ পরে আপনা আপনি খুলে যায়। এতে সবাই বুঝলেন, চৈতন্য "অপ্রকট" হয়েছেন। যদিও, তিনি অন্তর্ধানের দিনক্ষণ এবং বছর জানাননি। দিনক্ষণ জানাননি আরেক কবি নরহরি চক্রবর্তীও। নিজের ‘ভক্তিরত্নাকর’-এ তিনি এই বিষয়টা সম্পুর্ণ উহ্য রেখে বললেন,

     “ন্যাসিশিরোমণি চেষ্টা বুঝে সাধ্য কার।
অকস্মাৎ পৃথিবীর করিলা অন্ধকার।।
প্রবেশিলা এই গোপীনাথের মন্দিরে।
   হৈলা অদর্শন - পুনঃ না আইলা বাহিরে।।”

অর্থাৎ, তাঁর মতে চৈতন্য টোটা গোপীনাথ মন্দিরে অন্তর্হিত হন।

 শ্রীচৈতন্যের জীবনীকারদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত ও সুপ্রসিদ্ধ হলেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। পূর্বে রচিত সমস্ত চরিতগ্রন্থগুলিতে প্রচলিত কাহিনীর  পুনরাবৃত্তি না করেই একদম নতুনধারায় তিনি চৈতন্যজীবনদর্শন রচনা করলেন তাঁর magnum opus, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’-এর মাধ্যমে। অগাধ পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও শিশুর মতো সরল ও নিরভিমান এই মানুষটি ছিলেন এক কথায় আদর্শ বৈষ্ণব। তাঁর সম্বন্ধে বেশি কিছু বলা বাতুলতা মাত্র এবং প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় তা উহ্য রাখা হল। কৃষ্ণদাস নিজে ভক্ত ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর অন্তরে এক খাঁটি ঐতিহাসিকের সত্ত্বারও অস্তিত্ব ছিল। তাঁর তথ্যনিষ্ঠা ছিল প্রবল, যখনই তিনি চৈতন্য সম্পর্কে নতুন কোনো তথ্য দিয়েছেন, তখনই তাঁর সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে ভুল করেননি। তাই একাধারে, তাঁর ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-কে ইতিহাস, দর্শন ও কাব্যের অপরূপ সমন্বয় বলা যায়। চৈতন্য তিরোধান সম্পর্কে কৃষ্ণদাস প্রথমে পাঠককুলকে আশান্বিত করে জানাচ্ছেন-

 “শেষ লীলার সূত্রগণ         কৈল কিছু বিবরণ
ইহা বিস্তারিতে চিত্ত হয়।
থাকে যদি আয়ু শেষ         বিস্তারিব লীলা শেষ
যদি মহাপ্রভুর কৃপা হয়।।”

 
কিন্তু আশা দিয়েও তিনি আশাহত করলেন। নিজের কাব্যে তিনি চৈতন্যের শেষ লীলা নিয়ে একরকম নীরবই রয়ে গেলেন। চৈতন্যের অন্তর্ধান সম্পর্কে তাঁর একমাত্র বক্তব্য-

 “শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নবদ্বীপে অবতারি
অষ্টচল্লিশ বৎসর প্রকট বিহারি
চৌদ্দশত সাত শকে জন্মের প্রমাণ
চৌদ্দশত পঞ্চান্নে হইল অন্তর্ধান”

অর্থাৎ, ১৪৫৫ শকে ৪৮ বছর বয়সে প্রভুর তিরোধান হয়েছে- এইটুকু জানিয়েই তিনি ক্ষান্ত হলেন।

 বাংলা চরিতকারদের মধ্যে আরও অনেকেই চৈতন্যজীবনীকে নিজেদের কালিকলমে বন্দি করেছিলেন। পুর্বোল্লিখিত ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ লেখক জয়ানন্দ পাঁচালি আকারে লেখা আরও দুটি চরিতগ্রন্থের উল্লেখ করেছেন- পরমানন্দ গুপ্তের ‘গৌরাঙ্গবিজয়’ ও গোপাল বসুর ‘চৈতন্যমঙ্গল’। দুঃখের বিষয় কাব্য দুটি অধুনালুপ্ত। এছাড়াও ‘গোবিন্দদাসের কড়চা’ ও চূড়ামণি দাসের ‘গৌরাঙ্গবিজয়’ নামের দুটি লেখার কথা জানা যায়। এর মধ্যে ‘গোবিন্দদাসের কড়চা’-কে প্রামাণিকতাকে আধুনিক গবেষকগণ নাকচ করেছেন। চুড়ামণি দাসের একটি মাত্র খণ্ডিত পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু তাতে চৈতন্যের শেষলীলা সম্পর্কে কোনো নতুন তথ্য নেই।


[৩]


নিজের জীবৎকালের একটা বড় অংশ শ্রীচৈতন্য অতিবাহিত করেছিলেন নীলাচলে। শ্রীচৈতন্যের ভাবান্দোলন উড়িষ্যাবাসীদেরও আকৃষ্ট করেছিল সহজেই। চৈতন্যের প্রেমধর্ম প্রচারে ফলেই উড়িয়া এবং বাঙালিদের মধ্যে ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িকতা লোপ পেয়েছিল। বলাবাহুল্য, এই সময় উড়িয়া ভাষাতেও বেশ কয়েকটি চৈতন্যজীবনী প্রণীত হয়েছিল। পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের অচ্যুতানন্দ তাঁর ‘শূন্যসংহিতা’ গ্রন্থে জগন্নাথের কালো অঙ্গে কৃষ্ণস্বরূপ চৈতন্যের মিশে যাওয়া মতবাদটিকেই পোক্ত করেছেন, সঙ্গে তাঁর দাবী, অক্ষয় তৃতীয়ার রাতে অন্যান্য ভক্তদের সাথে তিনি নিজেও চৈতন্যের এহেন দারুব্রহ্মে লয় প্রাপ্তিকে সচক্ষে অবলোকনও করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি দিবাকরদাস তাঁর ‘জগন্নাথচরিতামৃত’-তে লিখে গেছেন, কলিকালে বেঁচে থাকা নিরর্থক বিবেচনায় নিজধামে গমন করবার বাসনা থেকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন চৈতন্য লীন হয়েছিলেন জগন্নাথ অঙ্গে। ‘শ্রীচৈতন্যচকড়া’য় লেখক গোবিন্দদাস বাবাজী প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ জানাচ্ছেন যে, আষাঢ়ের শুক্লাসপ্তমীর সন্ধ্যায় গরুড় স্তম্ভের পেছনে চৈতন্য জগন্নাথ দেহে জ্যোতিরূপে বিলীন হয়ে যান।

 ঈশ্বরদাস তাঁর ‘চৈতন্যভাগবত’-এ বলছেন, চন্দনযাত্রার সময় ভাবাবিষ্ট শ্রীচৈতন্য জগন্নাথকে চন্দন দেওয়ার সময় চন্দনপাত্র পড়ে যায় তাঁর হাত থেকে। সেই সময় মহাপ্রভু প্রবেশ করেন শ্রীজগন্নাথের বিস্তৃত শ্রীমুখে। লীন হয়ে যান জগন্নাথ বিগ্রহের গর্ভে। তাঁর সঙ্গে তিনি এটাও বলছেন,

 “শ্রী জগন্নাথ কলেবর। একাত্মা একাঙ্গ শরীরে।
সমস্তে এমন্ত দেখন্তি। মায়া শরীর ন জাণন্তি।।
চৈতন্য পিন্ড সিংহাসন। দেখন্তি ত্রৈলোক্য মোহন।
ক্ষেত্র পালঙ্কু আজ্ঞা দেই।  এ পিণ্ড নিঅ বেগ কই।।
অন্তর্ক্ষে নেই গঙ্গাজল। মেলিণ দিঅ ক্ষেত্রপাল।।
শ্রীজগন্নাথ আজ্ঞা পাই। অন্তর্ক্ষে মেলে শব বহি।।
গঙ্গারে মেলি দেলে শব। সে শব হোইলাক জীব ।
চৈতন্য রূপ প্রকাশিলে। গঙ্গারে লীন হোই গলে।।
লেখন নাহি শাস্ত্র পোথা। অত্যন্ত গুপ্ত এহু কথা।।
এহা ন জাণি বিদুজন। য়েকা জাণন্তি সংকর্ষণ।।
সাধু জ্ঞানী এ জাণন্তি। গতানুগতিকু বিস্মরন্তি।।
এঁহিঁ কি গোপ্য কথা মুহিঁ। তো আগে প্রকাশ কলই।।”

অর্থাৎ, জগন্নাথের সামনেই পড়েছিল মহাপ্রভুর দেহ। তখন জগন্নাথদেবের আজ্ঞায় শবদেহ অন্তরীক্ষে (কাঁধে করে) বহন করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় (প্রাচী নদীতে) বিসর্জন দেওয়া হল। তারপর সেই দেহ জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং পুরনায় নদীতে লীন হয়ে যায়। এসব অত্যন্ত গোপন কথা। একথা জানতেন একমাত্র সুসাধু জ্ঞানীরা কিন্তু কালক্রমে তা বিস্মৃত হয়। কবি গোপন সংবাদ ভক্তমুখে শুনেছেন। কোনো শাস্ত্র গ্রন্থাদিতে এই গোপ্য তথ্য নেই।



চিত্রঃ- পুরী জগন্নাথ মন্দির


চৈতন্য সমসাময়িক ওড়িয়া কবি মাধব পট্টনায়ক তাঁর ‘বৈষ্ণবলীলামৃত’ গ্রন্থে লিখছেন, অক্ষয় তৃতীয়ার আগের অমাবস্যায় (রুক্মিণী অমাবস্যা) পথে নামসংকীর্তনে নৃত্যরত চৈতন্যর পায়ে ইঁটের খোঁচা লাগে,এবং ফলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হন। তাঁকে ধরাধরি করে জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং সেখানে তাঁর শুশ্রূষা চলে, যদিও কোনও কবিরাজ-বৈদ্যকে ডাকা হয়নি (গরম জলের সেঁক দেওয়া হয়েছিল মাত্র)। তাঁর শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে, সারা দেহ ফুলে যায়। অবশেষে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ব্রাহ্মক্ষণে (খুব ভোরে) জগন্নাথ মন্দিরেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। পরে পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্র সম্মতি জানালে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চৈতন্যর নশ্বর দেহটিকে সমাধিস্ত করার হয়।

 এবার একটি বিশেষ ওড়িয়া পুঁথির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৬২ সালে ওড়িশার গঞ্জাম জেলায় শ্রী রাধাকৃষ্ণ পাণ্ডার বাড়ী থেকে জনৈক বৈষ্ণবদাসের লেখা ‘চৈতন্য গৌরাঙ্গ চকড়া’ নাম একটি জীর্ণ পুঁথি উদ্ধার করা হয়। প্রাচীন উৎকলকরণী লিপিতে লেখা পুঁথিটির আবিষ্কর্তা ছিলেন পদ্মশ্রী সদাশিব রথশর্মা। যেখানে পুর্বোক্ত বেশিরভাগ কবিই  দারুব্রহ্মে বিলীন হওয়ার তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে এই পুঁথিটি থেকে এক বিষ্ময়কর খবর জানা যায়। কবি বৈষ্ণবদাস দৃঢ় বিশ্বাসে জানাচ্ছেন,

 “এমন্ত প্রভু যে অন্তলীলা বাণী
কহিলে বৈষ্ণবদাস প্রত্যক্ষ তাহা জানি।।”
 

ঠিক কী তিনি ‘প্রত্যক্ষ’ জানতেন? না, শ্রী চৈতন্য জগন্নাথ দেহে বিলীন হননি। বৈষ্ণবদাস লিখছেন,

 “বূড়ো লেংকা যাই বালি নবরে প্রবেশিল।
রাজা আজ্ঞা ছামুয়ে একথা নিবেদিল।।
আজ্ঞা দিলে বিলোপিনো রাজা শ্রী অঙ্গকু।
সমাধি করলি সর্বে নাম রতন ঘোষি।।”

 অর্থাৎ, বুড়ো লেংকা বালিসাহি রাজপ্রাসাদে শ্রীচৈতন্যের মৃত্যু সংবাদ রাজার কাছে নিবেদন করল। শোকে মুহ্যমান রাজা তখন আদেশ দিলেন যে প্রভুর শ্রীঅঙ্গকে যেন নামসংকীর্তন করতে করতে সমাধিস্থ করা হয়। সঙ্গে বৈষ্ণবদাস আরও একটি চাঞ্চল্যকর  তথ্য জানাচ্ছেন আমাদের-

 “রাত্র দশ দণ্ডে চন্দন বিজয় যখন হল।।
তখন পড়িলা প্রভুর অঙ্গ স্তম্ভ পছ আড়ে।
কান্দিল বৈষ্ণবগণ কুহাড়ে কুহাড়ে।।”

অর্থাৎ, রাত্রি দশ দণ্ডে জগন্নাথের চন্দন বিজয়ের পর গরুড় স্তম্ভের পিছনে মহাপ্রভুর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখ গেল। তাই দেখে চৈতন্য-পারিষদবর্গ বুক চাপড়ে হাহাকার করে কাঁদতে লাগলেন। এরপর তিনি এও জানাচ্ছেন যে, মৃতদেহকে ‘টোটা’-য় বা টোটা গোপিনাথের মন্দিরে আনা হয় এবং সেখানেই সমাধিস্ত করা হয়। লক্ষণীয় বিষয়, কবি স্বচক্ষে মৃতদেহ দেখার দাবী করেছেন; কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তিনি নীরব-

 ১.  কীভাবে এবং কখন মহাপ্রভুর মৃত্যু হয়েছে?

২.  মৃতদেহ গরুড় স্তম্ভের পিছনে কি করে এল?

৩.  মৃতদেহ কি স্বাভাবিক ছিল?

৪.  টোটা গোপীনাথে সমাধিস্ত করা হলেও তাঁর সমাধি সেখানে নেই কেন?
 

[৪]

এতোক্ষণ আলোচনার ফলে চৈতন্যের সম্ভাব্য যে কটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল, তাঁর মধ্যে থেকে দেখা যাচ্ছে জগন্নাথ বিগ্রহে লীন হওয়াকেই বেশির ভাগ চরিতকাররা মান্যতা দিয়ে এসেছেন। তবে, প্রত্যেক চরিতকারেরই বক্তব্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। বস্তুত, এঁরা সবাই দারুব্রহ্মে বিলীন হওয়াটা একবাক্যে স্বীকার করলেও আনুষাঙ্গিক অন্য কোনো বিষয়েই এঁদের বিন্দুমাত্র মিল পাওয়া যায়না। লোচনের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি,

১. অন্তর্ধানের ঘটনাস্থল গুণ্ডিচাবাড়ি।

২. চৈতন্য পরিকররাও তাঁর সঙ্গে মন্দিরে প্রবেশ করেন।

৩. অকস্মাৎ চৈতন্য একাই মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করলে গৃহের কপাট আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়।

৪. এই কপাট দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। পরে পরিছা এসে পাশের কোনো দরজা দিয়ে গর্ভগৃহে ঢোকেন ও বেড়িয়ে এসে চৈতন্যের লয়প্রাপ্তির ঘটনা জানান দেন।

৫. ঘটনাকাল আষাঢ় শুক্লাসপ্তমী তিথির তৃতীয় প্রহর, দিনটি ছিল রবিবার।


    কিন্তু, ঈশান নাগরের মতে ঘটনাস্থল জগন্নাথ মন্দির, গুণ্ডিচা বাড়ি নয়। নরোত্তম চক্রবর্তী আবার টোটা গোপিনাথের মন্দিরের সপক্ষে মত দিয়েছেন।

ওড়িয়া কবি অচ্যুতানন্দ চৈতন্যের সমসাময়িক এবং নিজের ‘শূন্যপুরাণ’-এ তিনি নিজেকে চৈতন্য অন্তর্ধানের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ব্যক্তি করেছেন। তিনি বলছেন, চৈতন্য জগন্নাথ মন্দিরের গর্ভ গৃহে প্রবেশ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু একা নন। রাজা প্রতাপরুদ্র ও পাত্রমিত্রগণও সেই সময় গর্ভগৃহের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাজার সামনেই চৈতন্য দারুব্রহ্মে মিশে যান। অবশ্য অচ্যুতানন্দ দিনক্ষণ সরাসরি জানাননি। তবে তাঁর মতে, ঘটনাটি ঘটে ‘বড়শৃঙ্গার ধুপ’ এর ঠিক আগে, এবং পরদিন ছিল জগন্নাথের স্নান যাত্রা। জগন্নাথের নৈশভোগ মোটামুটি রাত ১১টা নাগাদ। অর্থাৎ, সম্ভবত ঘটনাটি ঘটে অক্ষয় তৃতিয়ার আগের দিন রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। দিবাকরদাসও প্রায় একই কথা জানাচ্ছেন, তবে তিনি অক্ষয়ার তৃতীয়ার আগের দিন নয়, অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই ঘটনাটি ঘটে বলে জানান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ জানানোর দাবিদার গোবিন্দদাস বাবাজি ‘চৈতন্যচকড়া’-য় আবার স্থান কাল দুটোই বদলে যায়। তাঁর লেখায়, অন্তর্ধানের স্থান গরুড়স্তম্ভের পেছনে এবং কাল ১৪৫৬ শকের আষাঢ় শুক্লাসপ্তমী।

 সবকটি বক্তব্য পর্যালোচনা করলে প্রথমেই প্রশ্ন আসে যে, একই ঘটনার বিভিন্নজনের বর্ণনায় এতো বিভিন্নতা কেন? সামান্য স্থান এবং কালের বিষয়েই সবার মতামত ভিন্নভিন্ন কেন? অসঙ্গতির এখানেই শেষ নয়। ঘটনাস্থল জগন্নাথ মন্দিরই হোক বা গুণ্ডিচাবাড়িই হোক, সুবৃহৎ কপাট বন্ধ করতে বেশ কয়েকজন বলিষ্ঠ লোকের প্রয়োজন হয়। তর্কের খাতিরে যদি বলা হয়, লোচন ও ঈশান তাদের বর্ণনায় অলৌকিকত্ব আরোপন করেছেন, আসলে মন্দিরের সেবাইতরাই কপাট বন্ধ করেছিলেন, তাহলেও প্রশ্ন আসে, তাঁরা দরজা বন্ধ করলেনই বা কেন? প্রসঙ্গত চৈতন্য জগন্নাথ বিগ্রহের নিকটে যেতেন না, দূর থেকেই দর্শন করতেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে জগন্নাথের স্পর্শে তিনি ভাবপ্লাবিত হতেন।  প্রথমবার পুরী গিয়ে তিনি যখন জগন্নাথকে আলিঙ্গন করতে যান, তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল পাণ্ডারা, এবং বাসুদেব সার্বভৌম এসে না বাঁচালে হয়ত সেদিনই চৈতন্যকে পাণ্ডারা মেরে ফেলত, অতএব চৈতন্যের জগন্নাথ সন্নিকটে না যাওয়ার রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে। যাই হোক, সেই চৈতন্য, যিনি দীর্ঘ চব্বিশ বছর নীলাচলবাসের সময় জগন্নাথকে স্পর্শ করলেন না, গর্ভগৃহেই প্রবেশ করলেন না, তিনি হঠাৎ এই স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেনই বা কেন? আর সেই দিনই যে চৈতন্য গর্ভগৃহে প্রবেশ করবেন, সেটা কি পাণ্ডারা জানত? দীর্ঘক্ষণ দরজার আড়ালেই বা কি ঘটেছিল? পুরো ঘটনার মধ্যেই একটা যেন ষড়যন্ত্রের আভাস আছে।

 রাজা প্রতাপরুদ্রের উপস্থিতি সম্পর্কেও সন্দেহ থেকেই যায়, কারণ লোচন, গোবিন্দদাস বাবাজি ও মাধব পট্টনায়েক জানাচ্ছেন গর্ভগৃহে প্রতাপরুদ্র উপস্থিত ছিলেন না। অথচ অচ্যুতানন্দই অন্য কথা জানাচ্ছেন। কাজেই এখানেও প্রশ্ন- প্রতাপরুদ্র কি সত্যি সেখানে উপস্থিত ছিলেন? যদি তাঁর উপস্থিতিতেই চৈতন্যের মৃত্যু ঘটতো তাহলে তিনি কী উপযুক্ত মর্যাদাসহ চৈতন্যের সমাধির ব্যবস্থা করতেন না? আর যদি অনুপস্থিতই থাকেন, তাহলে এতো বড়ো একটি সন্দেহজনক ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা কঠোর নীরবতা কেন পালন করলেন? অনেকেই সেই সময় দারুব্রহ্মের ঘটনা বিশ্বাস করেননি, সম্ভবত রামানন্দ ও প্রতাপরুদ্রেরও এই রটনা বিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিলনা।

 সব থেকে বড়ো কথা, একজন রক্তমাংসের জীবের পক্ষে সশরীরে দেবমূর্তিতে লীন হওয়াটা যুক্তিগত দিক থেকেই একেবারে অসম্ভব এবং সেইযুগেই এই কথা অনেকে বিশ্বাস করেনি তা বলাই বাহুল্য। প্রমাণস্বরূপ, বৃন্দাবনদাসের যে অতিরিক্ত পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছে বর্ধমানের দেনুড় শ্রীপাট থেকে, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রভু অন্তর্হিত হলেন ঠিকই, কিন্তু পরমুহুর্তেই সন্ন্যাসীর বেশে তিনি মদনগোপালের মন্দিরের দিকে চলে গেলেন এবং ‘অদৃশ্য’ হলেন। ‘চৈতন্যচকড়া’ থেকেই জানা যায়, মন্দির  হঠাৎ তীব্র আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ায়, কেউই সরাসরি চৈতন্যকে জ্যোতিরূপে মিলিয়ে যেতে দেখেননি। দৃষ্টির স্বাভাবিক হলে তাঁরা সম্ভাব্য সকল স্থানে চৈতন্যকে অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এই অনুসন্ধান, বলাই বাহুল্য, ব্যর্থ হয়।

 এমনকি ঈশ্বরদাস তাঁর ‘চৈতব্যভাগবত’ গ্রন্থ সমাপান্তে ভক্তবৃন্দের সামনে তা পাঠ করছেন, তখন সন্ন্যাসী বাসুদেব তীর্থ চৈতন্যের জগন্নাথ বিগ্রহে মিশে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। নিভৃতে তিনি ঈশ্বরদাস কে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি একথা লিখলে কেন?” ঈশ্বরদাস উত্তর দেন যে, গুরুবচন অনুসারে একথা লিখেছেন ও কথাটিকে তত্ত্বগত দিক থেকেই দেখা উচিত-

“বোলিই শুণিমা গোঁসাই। চিত্তকু বোধ যাউ নাহি ।।
তহিঁ কি প্রবোধ কহিবি। সমস্তে শুণ আত্মা ভাবি।।
এথকু শ্রীগুরুবচন। শূন্যে দর্শন তত্ত্বজ্ঞান।।”

তারপর জনান্তিকে তিনি এক ‘অতি গোপন’ তথ্য দিলেন যা ‘সুসাধু’রা জানতেন এবং কালক্রমে যা বিস্মৃত হয়। তিনি জানালেন যে, জগন্নাথের সামনেই পড়েছিল মহাপ্রভুর দেহ, এবং তাকে সবার অলক্ষে প্রাচী নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। (বিস্তারিত ইতিপুর্বে বর্ণিত)

 ঈশ্বরদাসের এই বক্তব্যকে সত্য ধরলে, বলা যায় ঈশ্বরদাস প্রমুখ পঞ্চসখাই দারুব্রহ্মে লীন হওয়ার ঘটনাটি প্রচার করেছিলেন, এবং বাস্তবে তা নিছকই তত্ত্বজ্ঞান মাত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়-

 ১. সত্যিই কি সেদিন চৈতন্যের মৃত্যু ঘটে? যদি ঘটেই থাকে তাহলে অচুতানন্দেরা তা গোপন করলেন কেন?

২. এই মৃত্যু যদি স্বাভাবিক হয়, তাহলে তো গল্পকথার অবতারণা করা কেন?

৩. মৃতদেহ গোপনে সরিয়ে ফেলার কারণ কি?

৪. রাজাকে না জানিয়েই কেন সৎকার মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হল?

 চৈতন্য গবেষক শান্তিকুমার দাশগুপ্ত ও নির্মলনারায়ণ গুপ্ত এর একটা সম্ভাব্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন,

 “জগন্নাথ অঙ্গে বিলীন হওয়ার সংবাদটি ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কোন চক্রের চতুর পরিকল্পনার অস্তিত্ব কি অসম্ভব? জগন্নাথের ‘সচল বগ্রহ’কে জগন্নাথ আত্মসাৎ করেছেন, ‘সচল বিগ্রহ’বাদী ভক্তরা তা অস্বীকার করতে পারবেন না এবং জগন্নাথ অঙ্গে বিলীন হওয়ার পর মায়া শরীরের খোঁজখবর করা নিতান্ত অশাস্ত্রীয় ও অধার্মিক হবে, সম্ভবত এই ছিল সেই চতুর চক্রের চিন্তাধারা।”


[৫]

শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধানের সবথেকে লৌকিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কবি জয়ানন্দ। তাঁর মতে, রথযাত্রার সময় নাচতে নাচতে তাঁর বাঁ পায়ে ইটের আঘাত লাগে। সেই আঘাত পরে বিষিয়ে ওঠে এবং কোনো এক টোটাতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর সময়ও প্রায় লোচন দাসের বক্তব্যের অনুসারী, আষাঢ় মাসেরই শুক্লা সপ্তমী, রাত্রি দশ দণ্ড। জয়ানন্দের এই মত পরবর্তীতে গবেষক মেলভিল. টি. কেনেডি, ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন, ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন, শ্রী বিমানবিহারী মজুমদার প্রমুখরাও সমর্থন জানিয়েছেন। ওড়িয়া কবি মাধব পট্টনায়কও একই বক্তব্য জানিয়েছেন। তবে, তাঁর গ্রন্থ থেকে কিছু অতিরিক্ত তথ্য পাওয়া যায়- বাঁ পায়ের বূড়ো আঙ্গুলে আঘাত লাগলে সেই স্থান হতে প্রচুর রক্তপাত হয় এবং চৈতন্য জ্ঞান হারিয়ে ওখানেই লুটিয়ে পড়েন। তাকে ধরাধরি করে জগন্নাথ মন্দিরে এনে চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে চৈতন্যের জ্ঞান ফিরলেও তিনি বাকশক্তিরহিত হয়ে পরেন। পরের দিন সকালে চৈতন্যদেবের প্রবল জ্বর আসে। সন্ধের দিকে ক্ষতস্থানের যন্ত্রনা বৃদ্ধি পায়, পা ফুলে যায়। অতঃপর পায়ে গরম জলের সেঁক দেওয়া হয়। রাতে জ্বরের প্রকোপ আরও বেড়ে ওঠে এবং পরের দিন চৈতন্যের সারাদেহ ফুলে যায়। অবশেষে অক্ষয় তৃতীয়ার ব্রাহ্ম মুহুর্তে তিনি মারা যান।



চৈতন্যের মৃত্যুর পর রায় রামানন্দ জগন্নাথের সমস্ত ‘নীতি’ বন্ধ রাখার আদেশ দেন ও রাজা প্রতাপরুদ্রকে চিঠি মারফত এত্তেলা করেন। শোকাহত রাজা দুপুরে শ্রীমন্দিরে আসেন। চৈতন্যের মৃতদেহের সামনেই আলোচনাসভা বসে। রায় রামানন্দ বলেন, গৌড়ীয়রা নানা কুকথা বলবে, হয়ত গৌড়ের 'ম্লেচ্ছ' রাজাকে 'খর' ভাষণ করবে, কাজেই এ শবদেহ বাইরে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। কোইলি বৈকুণ্ঠতে চৈতন্যকে সমাধি দেওয়া হোক। প্রতাপরুদ্র সম্মতি জানালে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চৈতন্যর নশ্বর দেহটিকে পুঁতে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। পঞ্চসখার চারজন, রাজা স্বয়ং, রায় রামানন্দ, বাসুদেব সার্বভৌম ও মাধব পট্টনায়েক প্রমুখ চৈতন্যের কিছু অন্তরঙ্গ পার্ষদ ছাড়া এই খবর কেউ জানলনা, রাজার আদেশেই তাঁরা গোপনীয়তা অবলম্বন করলেন। অতঃপর, মন্দির শোধন করে, মন্দিরের দরজা খুলে চন্দনযাত্রায় আগত ভক্তদের বলা হয়, চৈতন্য জগন্নাথদেহে লীন হয়ে গেছেন।


 উপরোক্ত বক্তব্যগুলি পড়লে সন্দেহের উদয় হয় বৈকি। জয়ানন্দ জানাচ্ছেন, চৈতন্য আহত হওয়ার পরের দিনই অদ্বৈত গৌড়ে প্রস্থান করেন। অর্থাৎ, চৈতন্যের আঘাত মারাত্মক ছিল না; কারণ গুরুতর আহত চৈতন্যকে ফেলে অদ্বৈত আচার্য গৌড়ে ফিরবেন- এটা বিশ্বাস হয়না। আশ্চর্যের বিষয়, জয়ানন্দ বা মাধব; কেউই কিন্তু ‘মরনাপন্ন’ চৈতন্যের চিকিৎসা হয়েছিল এমনটা বলেননি। স্বয়ং রাজা প্রতাপরুদ্র, যার কাছে চৈতন্য ঈশ্বরস্বরূপ, তিনিও ন্যুনতম কোনো চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেননি। জয়ানন্দ প্রভুর মৃত্যুস্থানকে শুধুমাত্র ‘টোটা’ উল্লেখ করে ছেঁড়ে দিয়েছেন। এই ‘টোটা’ কি টোটা গোপীনাথ, নাকি আইটোটা, নাকি গুণ্ডিচাবাড়ি তা তিনি স্পষ্ট করেননি।

 অন্যদিকে মাধব জানাচ্ছেন, চৈতন্যের মৃত্যুর পরই মন্দিরের সিংহদ্বার প্রায় সারাদিন বন্ধ ছিল, যা মন্দিরের ইতিহাসের এক বিরলতম ঘটনা। অথচ, এমন এক ব্যতিক্রমী ঘটনার কথা অন্য কোনো নথিতে পাওয়া যায়না।

 আরও আছে। নীলাচলের রীতি ও অনুশাসন অনুযায়ী, কৈলী বৈকুণ্ঠে রক্তমাংসের মৃতদেহ সমাধিস্ত করা যায়না। চৈতন্যের দেহ সৎকারের সময় উপস্থিত রাজার কুলগুরূ কাশী মিশ্র, শাস্ত্রজ্ঞ রায় রামানন্দ, প্রধান সেবক জগন্নাথদাস এই অশাস্ত্রীয় ও গর্হিত কাজটি মেনে নিলেন কেন? তাছাড়া, দুজন সেবক অতিভোরেই মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন এবং রামানন্দের নির্দেশে তাঁরাই দরজা বন্ধ করেন ও সমাধি খনন করেন। সাধারণত নবকলেবরের সময় শ্রীমূর্তিগুলির জন্য নয় হাত(১৩-১৪ ফিট) গভীর সমাধি খনন করা হয়। সুতরাং, চৈতন্যের সমাধি অন্তত ২০ ফিট বা তারও বেশি গভীর খোঁড়া হয়েছিল, যাতে ভবিষ্যতে শ্রীবিগ্রহের সমাধি খুঁড়তে গিয়ে মৃতের দেহাবশেষ উঠে না আসে। চৈতন্য নিজেও দীর্ঘদেহী ছিলেন, তাঁর উচ্চতা প্রায় ৬ ফিট ৮ ইঞ্চ ছিল। ফলে সমাধি অন্তত ১০ ফিট লম্বা ও ৬ ফিট চওড়া খুঁড়তে হয়েছিল। কাজেই দুপুর নাগাদ মাত্র ২ জন মানুষ ১০ ফিট x ৬ ফিট x ২০ ফিট মাপের সবৃহৎ সমাধি খনন করে, মন্দির শোধন করে সেইদিনই মন্দিরে জগন্নাথের চন্দনযাত্রার আয়োজন করা সম্ভবপর মনে হয়না।

 মাধবের বিবরণের সব থেকে বড়ো অস্বাভাবিকতা হল চৈতন্যের মৃত্যুকালে গদাধরের অনুপস্থিতি। চৈতন্যঅন্তপ্রাণ গদাধর মৃত্যুপথযাত্রী চৈতন্যকে একটি বারের জন্যও দেখতে এলেন না, সেবাশুশ্রুষা করলেন না এমনকি চৈতন্যকে সমাধিস্ত করা হল, সে কথাও জানলেন না- বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বৈকি। এমনকি, স্বরূপ দামোদর, রঘুনাথদাস, কাশীশ্বর- এদেরও উপস্থিতির কোনো চিহ্ন মাধবের লেখায় নেই।

 এতোসব, প্রশ্নের একমাত্র উত্তর যা মাথায় আসে, তা হল ইটের আঘাতে চৈতন্যের মৃত্যু হয়নি এবং যদি ইটের আঘাত লেগেও থাকে, তবে তা মোটেও গুরুতর ছিলনা। আগেই বলা হয়েছে, পঞ্চসখাদের ‘তত্ত্বকথা’ অর্থাৎ, চৈতন্যের দারুব্রহ্মে লীন হওয়ার গপ্পো সে যুগের অনেকেই বিশ্বাস করেনি। সেই জন্যই হয়তো ইটের আঘাতে মৃত্যুর এই ‘দ্বিতীয় গল্প’ ফাঁদা হয়েছিল চৈতন্যের মৃত্যুর আসল সত্যটিকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। এটিও চৈতন্যের অন্তর্ধানকে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচারিত একটি রটনা মাত্র।

 
[৬]

 এবার অপর এক মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা যাক। বৃন্দাবন দাসের যে খণ্ডিত পুঁথিটি বর্ধমানের দেনুড় শ্রীপাট গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়, তাতে বলা হচ্ছে, দারুব্রহ্মে ‘লীন’ হয়ে যাওয়ার পর একজন সন্ন্যাসী মদনগোপাল মন্দিরের দিকে চলে যান এবং ‘অদৃশ্য’ হন। অধিকারীরা এই দৃশ্য দেখেছে বলেও তিনি জানাচ্ছেন। (ইতিপুর্বে উল্লিখিত) অর্থাৎ, সন্ন্যাসীরূপী চৈতন্য সেই দিনই নীলাচল তথা ওড়িশা ত্যাগ করে অন্যত্র আত্মগোপন করেন।

 এই ব্যাখ্যাটির গ্রহণেও কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। কারণ, চৈতন্যের ছদ্মবেশে নীলাচলে ত্যাগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য কারণ গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়না। বৃন্দাবন দাস বলছেন, এই ঘটনা ঘটছে চৈতন্যের বৃন্দাবন ভ্রমণ শেষে পুরী ফেরার পর। চৈতন্য পুরী ফেরেন ১৫১৬ সালের মে মাসে। অর্থাৎ চৈতন্যের বয়স তখন ২৯ বছরের কিছু বেশি। অথচ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে তাঁর অন্তর্ধান ঘটেছিল ৪৭-৪৮ বছর বয়সে। কবি আরও জানাচ্ছেন, রূপ-সনাতনকে বৃন্দাবনের অধিকারী বানিয়ে তারপর চৈতন্য নীলাচলে ফিরলেন। কিন্তু চৈতন্যের প্রমাণিত বৃন্দাবন ভ্রমণের সময় রূপ-সনাতন বৃন্দাবনে যানইনি।

 তাছাড়া, পুঁথির বর্ণনা অনুসারে চৈতন্য গর্ভগৃহে অন্তর্হিত হন। পুরী জগন্নাথ মন্দিরে মন্দির থেকে বাইরে যাওয়ার একটি গোপন পথ আছে বটে, তবে তাঁর অবস্থান গর্ভগৃহে নয়, মন্দিরের দক্ষিণদ্বারের পাশে। যদি ধরে নেওয়া যায়, গোপনপথের একটি মুখ গর্ভগৃহে আছে, সেক্ষেত্রেও পাণ্ডাদের সাহায্য ছাড়া ওই পথে প্রবেশ করা সম্ভবই নয়। আর পাণ্ডারা কোনোরকম সহযোগিতা করেনি তা নিশ্চিত। কারণ, তাঁরা তো চৈতন্যকে চিনতে না পেরে তাঁকে মারার জন্য বেত নিয়ে ধাওয়া করেছিলেন এবং অন্তর্ধানের পরে অনুমান করেন যে ওই সন্ন্যাসী আসলে চৈতন্য মহাপ্রভু। বছরের পর বছর ধরে প্রতিটা দিন তিনবেলা করে চৈতন্যকে দেখার পরেও পাণ্ডা-পরিছারা চৈতন্যকে কেন চিনতে পারলনা, সেটাও আশ্চর্যজনক।

 এরই সঙ্গে বৃন্দাবন দাস এটাও দাবী করেছেন যে, গদাধরও চৈতন্যের সাথেও অন্তর্হিত হন, যেটি সর্বৈব ভুল কথা। কারণ, চৈতন্যের অন্তর্ধানের ১১ মাস পরে ৪৭ বছর বয়সে গদাধরের অন্তর্ধান ঘটে। তাছাড়া, চৈতন্য পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে অন্তর্হিত হয়ে বৃন্দাবনের মদনগোপাল মন্দিরের দিকে প্রস্থান করেন এবং সেখান থেকেই তিনি চিরদিনের মতো নিখোঁজ হন। একই সময়ে চৈতন্যকে প্রথমে পুরীতে তারপর সুদূর বৃন্দাবনে দেখতে পাওয়াটা অসম্ভব। অলৌকিকতার মোড়ক সরিয়ে এবং পুরী-বৃন্দাবনের দূরত্ব বিচার করে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, পুরী ত্যাগের মাস খানেক পর বৃন্দাবনে তাঁকে দেখা গেছে, তাহলেও সেখান থেকেই বা অন্তর্হিত হতে হবে কেন্ তাঁকে? আর যদি বৃন্দাবন থেকে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন, তাহলে আবার পুরীতে ফেরার কি দরকার ছিল? দুর্বল শরীর নিয়ে দুর্গম পথ অতিক্রম করে বৃন্দাবন থেকে একবার পুরীতে ফিরে আবার বৃন্দাবনে গিয়ে অন্তর্ধান করবেন- যুক্তিগত বিচারেই মতামতটি গ্রহণযোগ্য হচ্ছেনা।


 [৭]

 
চৈতন্য অন্তর্ধান সম্পর্কে যে যে অভিমতগুলি বিভিন্ন চরিতকাররা প্রচার করে গেছেন, এতোক্ষণ আলোচনা করে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কোনো মতকেই যুক্তি, তথ্য ও সম্ভাবনার বিচারে গ্রহণ করা যাচ্ছে না। শ্রীচৈতন্যের যে কায়িক মৃত্যু ঘটেছে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সন্দেহ যেটা নিয়ে, তা হল মৃত্যুটা হয়েছে কিভাবে এবং মৃত্যুর পেছনে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত কিনা। এবং ঠিক এই প্রসঙ্গেই উঠে আসে চৈতন্য অন্তর্ধানের সবথেকে আলোচিত, বিতর্কিত সম্ভাবনাটি; যে সম্ভাবনার অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ বাঙালি গবেষক ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়েরও শ্রীচৈতন্যের মতোই অন্তিম পরিণতি হয়েছিল- অর্থাৎ, গুপ্তহত্যা। আধুনিক কালের গবেষকদের একটা বড়ো অংশই মনে করেন যে, চৈতন্যকে গোপনে খুন করে তাঁর মৃতদেহ সংগোপনে সমাধিস্ত করা হয়। এই ধারণা সত্যি হলে চৈতন্য অন্তর্ধান বিষয়ের দুটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায়- প্রথমটি হল, কেন চৈতন্যের সমাধির সন্ধান পাওয়া যায়না ও দ্বিতীয়টি হল, কেনই বা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে মন্দিরের(সে জগন্নাথ মন্দিরই হোক বা গুণ্ডিচাবাড়িই হোক না কেন) দরজা বন্ধ ছিল।

 শ্রীচৈতন্যকে হত্যার পেছনে ঠিক কী কারণ থাকতে পারে, সেটা জানার জন্য প্রথমে তৎকালীন ওড়িশার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করা প্রয়োজন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই শক্তিশালী হিন্দুরাজ্য ওড়িশার সাথে বাংলার মুসলমান শাষকদের বিরোধ ঘটে। বাংলার তৎকালীন সুলতান হোসেন শাহ মসনদে বসেই প্রথমে পুরুষোত্তমদেবের রাজ্য ওড়িশা আক্রমণ করেন বিস্তির্ণ ভুমি দখল করেন। এই পুরুষোত্তমদেবের পুত্রই হলেন প্রতাপরুদ্র দেব। প্রতাপরুদ্রও পরবর্তীতে হৃতরাজ্য পুনর্দখল করেছিলেন। গুন্টুর ও নেল্লোরে প্রাপ্ত ৩টি শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৫০৯-১০ সালে রাজা প্রতাপরুদ্র দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণদেবরায়ের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। রাজার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে হোসেন শাহ একই সময়ে ওড়িশা আক্রমণ করেন।

 প্রথমদিকে সুলতান বাহিনী দারুণ সাফল্য পায়। সুলতানের সেনা পুরী অবধি অধিকার করে নেয়। রাজার অনুপস্থিতিতে ওড়িশা রক্ষার দায়িত্ব ছিল তাঁর সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধরের উপর। কিন্তু গোবিন্দ তাতে ব্যর্থ হন। পরাজিত গোবিন্দ বিদ্যাধর আশ্রয় নেন মহানদীর অপর পারে সারঙ্গগড় দূর্গে। ওড়িশার এহেন শোচনীয় পরিস্থিতিতেই ১৫১০ সালের মার্চে পুরীতে আগমণ হয় শ্রীচৈতন্যের। একই সময়ে দক্ষিণ দিক থেকে মুসলমান আক্রমণ আটকানোর জন্য রাজা প্রতাপরুদ্রও কটকের উপকণ্ঠে। চৈতন্যও এপ্রিলের চার তারিখে দক্ষিণ ভারত যাত্রা করেন। সম্ভবত এই সময়ই তিনি কটকে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করেন।

 প্রতাপরুদ্রের প্রচণ্ড আক্রমণে সুলতানী ফৌজ পিছু হটতে বাধ্য হয়। মহারাজ কিন্তু এতো সহজে ছেঁড়ে দিলেন না। পলায়মান শত্রুর পেছনে ধাবমান হল তাঁর বাহিনী। শাহী সৈন্য পিছু হটতে হটতে অবশেষে সীমান্তবর্তী গড়মান্দারণ দুর্গে আশ্রয় নিলেন। প্রতাপরুদ্রও দুর্গ অবরোধ করলেন। কিন্তু সুলতানী বাহিনীকে আত্মসমর্পন করাতে হলে অনির্দিষ্ট কাল দুর্গ অবরুদ্ধ রাখা প্রয়োজন। ওদিকে বিজয়নগরের যুদ্ধ ছেঁড়ে দীর্ঘকাল মান্দারণে পড়ে থাকা প্রতাপরুদ্রের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই তিনি নিজের একদা পরাজিত সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধর ভৈ এর হাতে দূর্গ অবরোধের ভার দিয়ে দক্ষিণ সীমান্তে চলে যান।

 এই ভরসাই কাল হল। এর কিছুদিনের মধ্যেই টের পাওয়া যায় যে, গোবিন্দের নজর পড়েছে রাজ সিংহাসনের ওপর। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন গোবিন্দ, শত্রুপক্ষের সেনাপতি ইসমাইল গাজির সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া করে গোবিন্দ অবরোধ তুলে নেন। বোঝাপড়া না হলে সম্পূর্ণ জেতা যুদ্ধ ত্যাগ করে মান্দারণের অবরোধ তিনি তুলে নেবেন কেন। আর রাজা প্রতাপরুদ্রের অজ্ঞাতে এই 'বোঝাপড়া' হবেই বা কেন, যদি না গোবিন্দ সিংহাসনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকেন। অবরোধ তুলে নেওয়ার ফলে গড়মান্দারণ দুর্গ কার্যত গৌড়-ওড়িশার ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ হয়ে পরে।

 গোবিন্দর রাজসিংহাসনের প্রতি লোভের কথা হয়তো রাজার কাছে অগোচর ছিল। তাই, অবরোধ তুলে নেওয়ায় তিনি মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও তাঁকে তিনি কোনোরকম শাস্তি দেননি বা রাজপদ থেকে বরখাস্তও করেননি। রাজা গোবিন্দকে ক্ষমা করেছিলেন। এইখানে একটি কথা খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝে নেওয়া দরকার যে, গোবিন্দ বিদ্যাধর ছিলেন দক্ষ চক্রান্তকারী এবং তার মতো একজন মানুষের 'ভালোমানুষীর' ওপর আস্থা রাখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। পরবর্তীকালে এই গোবিন্দধর প্রতাপরুদ্রকে পর্যুদস্ত করার জন্য বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছিলেন।

 যাই হোক, আলোচনার গতিপ্রকৃতি অনুসারে পরবর্তী যে প্রশ্নটি অবশ্যম্ভাবী, সেটি হল, গোবিন্দর 'উচ্চাকাঙ্ক্ষা'র সঙ্গে  চৈতন্যকে হত্যা করার সম্পর্কটি ঠিক কী? এবার সেই ঘটনায় আসা যাক।

 ১৫১৪ সাল নাগাদ প্রতাপরুদ্র খবর পান যে হোসেন শাহ পুনরায় ওড়িশা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই খবর পাওয়া মাত্রই প্রতাপরুদ্র গৌড় আক্রমণ করতে চান। কিন্তু ততদিনে চৈতন্যের সঙ্গে হোসেন শাহর ব্যক্তিগত সচিব দবীর খাস এবং রাজস্ব বিভাগের অধিকর্তা সাকর মল্লিকের গোপন যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। কাজেই চৈতন্য জানতেন হোসেন শাহ তখন কী পরিমাণে শক্তিশালী। তাঁর বুঝতে বাকি থাকেনি যে শাহকে আগবাড়িয়ে আক্রমণ করলে প্রতাপরুদ্রের সমূলে ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না। চৈতন্যের বাঁধায় প্রতাপরুদ্র সেই সময় গৌড় আক্রমণের ইচ্ছা ত্যাগ করেন। এরপর চৈতন্য কৌশলে গৌড়াধিপতিকে দুর্বল করার চেষ্টা শুরু করেন।

 বাংলার ভক্তরা রথযাত্রা উপলক্ষে চারমাস নীলাচলে বাস করতেন। কিন্তু ১৫১৪ সালে রথের পরেই চৈতন্য বাংলার ভক্তদের ফেরত পাঠালেন। তাঁর পর বর্ষা শেষে বিজয়াদশমীর দিন নীলাচল যাচ্ছেন বলে পুরী ত্যাগ করেন। পথে তিনি সুচতুর ভাবে হোসেন শাহের রাজধানী গৌড়ের নিকটস্থ রামকেলিতে সদলবলে ঘাঁটি গাড়লেন। সেখানে রাতে ছদ্মবেশধারী দবীর খাস এবং সাকর মল্লিকের সঙ্গে চৈতন্য গোপনে দেখা করেন। এর কয়েকদিন বাদেই অদ্ভুত ভাবে দেখা যায় হোসেন শাহের এই দুই মন্ত্রীকে গৌড় ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে(পরবর্তী কালে এরাই ষড়গোস্বামীর অন্যতম রূপ ও সনাতন নামে বিখ্যাত হন)। এর ফলে যুদ্ধ পিছিয়ে যায় এবং প্রতাপরুদ্র প্রস্তুতির জন্য বেশ কিছুটা বাড়তি সময় পেয়ে যান। অন্যদিকে দুই মহামন্ত্রীর অনুপস্থিতে হোসেন শাহ দুর্বল হয়ে পড়েন। এরপর, বিশ্বস্ত এই দু-জনকে ছাড়াই হোসেন শাহ ১৫১৫ সালে ওড়িশা আক্রমণ করেন। বলাবাহুল্য, সেই যুদ্ধে যারপরনাই নাস্তানাবুদ হন গৌড়ের অধীশ্বর। এরপর থেকে তিনি আর কোনোদিন ওড়িশার দিকে চোখ তুলে তাকান নি। আর এই ঘটনার ফলেই চৈতন্য হয়ে ওঠেন ‘প্রতাপরুদ্র সংত্রাতা’।

 হোসেন শাহের এমন বিপদ ঘটতে পারে তা গোবিন্দ বিদ্যাধরের হিসেবের বাইরে ছিল। অনেকেই মনে করেন তিনিই নাকি প্রতাপরুদ্রকে প্ররোচিত করেছিলেন আগ বাড়িয়ে গৌড় আক্রমণের জন্য (এই কথা মনে করার সংগত যে কারণটি তা হল, সিংহাসনের দিকে হাত বাড়িয়েছেন যে ব্যক্তি, তিনি যেন তেন প্রকারেণ রাজার সমূলে বিনাশ চাইবেনই।)। কিন্তু মহামতি চৈতনোর জন্য রাজা প্রতাপরুদ্র, গোবিন্দর পাতা ফাঁদে পা দেন নি। ফলে অতি সহজে মহারাজের ধ্বংসের এবং ওড়িশার সিংহাসন দখলের এক সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় গোবিন্দর। আর শুধু তাই নয়, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে, চৈতন্য থাকতে প্রতাপরুদ্রের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। সুতরাং, সবার অলক্ষে চৈতন্যের অলিখিত মৃত্যু পরোয়ানায় সই করলেন গোবিন্দ বিদ্যাধর। প্রতাপরুদ্রের সাথে সাথেই তিনি চৈতন্যকেও নিজের পথের কাঁটা গণ্য করতে লাগলেন।

 চৈতন্যের প্রতি অসন্তোষ একা গোবিন্দ বিদ্যাধরের ছিলনা। চৈতন্যের স্মার্ত অনুশাসন বিরোধী কাজকর্ম ওড়িয়া ব্রাহ্মণরা কোনোদিন মানতে পারেননি। বিশেষ করে বেদান্তের বিরোধিতার মাধ্যমে শঙ্করাচার্যের বিরোধিতা হজম করা তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। নেহাত রাজার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তাঁরা সচরাচর মুখ খুলতেন না। তবে, সন্ন্যাসী চৈতন্য যখন শূদ্র রামানন্দকে আলিঙ্গন করলেন, তখন তারা আর ক্ষোভ গোপন রাখতে পারলেন না। প্রকাশ্যে এসে পড়ল তাঁদের গোপন রোষাগ্নি। বললেন,

“এই ত সন্ন্যাসীর তেজ দেখি ব্রহ্মসম।
শূদ্রে আলিঙ্গিয়া কেন করেন ক্রন্দন।।”

মহাপ্রভুর প্রতি ওড়িশার পাণ্ডাদের এই মনোভাবের কথা রাজা প্রতাপরুদ্রেরও অজানা ছিল না। তিনি এর পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন,

“রাজা কহে শ্রান্ত প্রমাণ চৈতন্য হয় কৃষ্ণ।
তবে কেন পণ্ডিত সব তাহাতে বিতৃষ্ণ।।”

জাতপাতের বিষয়ে জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা যে কতটা কঠোর, তা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট। মহাত্মা গান্ধী নিজে চেষ্টা করেও জগন্নাথ মন্দিরে হরিজনদের প্রবেশাধিকার আদায় করতে পারেন নি। শুধু তাই নয়, মহাত্মার মৃত্যুর পর পুরীর সমুদ্রে তাঁর চিতাভস্ম বিসর্জন দিয়ে হরিজনরা পুরীর মন্দিরে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মাত্র কয়েক দশক আগে, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সব জাতের হিন্দুরা মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পান। কিন্তু মহাপ্রভু নিজ মহিমায় ভাস্বর হয়ে সে কবেই সগর্বে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, ‘আচন্ডালে দেহ কোল'। সেদিন সেই অতি সংকীর্ণ এক সময়ে এই 'কোল' দেওয়ার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে, সে কথা বুঝতে পারাটা খুব কঠিন নয়। তাছাড়া, চৈতন্যের উপস্থিতি ওড়িয়া ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার একটা আশংকা ছিল। উৎকলের শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিক বাসুদেব সার্বভৌম চৈতন্যের শরণ নেন। রাজগুরু কাশী মিশ্র নিজের বাসগৃহে চৈতন্যকে স্থান দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেন। শ্রীমন্দিরের প্রধান দ্বাররক্ষী অনন্ত প্রতিহার চৈতন্যের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে ওঠেন। এমনকি স্বয়ং রাজা প্রতাপরুদ্রও চৈতন্যচরণে আত্মসমর্পণ করলেন। কাজেই শুধু রাজানুগ্রহে ভাটা পড়াই নয়, ওড়িশার ব্রাহ্মণ আধিপত্যও ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত। বিশেষত, রাজার আকর্ষণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণদের বিদ্বেষ ক্রমেই অসূয়াতে পরিণত হয়।

 চৈতন্য আবির্ভাবের আগে থেকেই জগন্নাথদেবের পূজারীরা অকল্পপনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন(রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উভয়ই)। বাস্তবেই তারা ছিল ওড়িশার ‘কিং মেকার’। শেষ গঙ্গবংশীয় রাজা ৪র্থ ভানুদেব এই পূজারীদের ক্ষমতায় রাশ টানতে গিয়েছিলেন। কিন্তু, পূজারীরা তা ভালো চোখে দেখল না। ফলত, তাঁদের প্রভাবেই রাজা ৪র্থ ভানুদেব সিংহাসনচ্যুত হন। ভানুদেবের সূর্যবংশীয় রাজা কপিলেন্দ্রদেব পুজারীদের সাহায্যেই ওড়িশার মসনদে আসীন হয়, বলতে গেলে একরকম পূজারীরাই তাঁকে ক্ষমতায় বসান। বদলে রাজা কপিলেন্দ্র দেবও পুজারীদের ক্ষমতা আর প্রভাববৃদ্ধিতে দারুণ ভাবে সাহায্য করেন। কপিলেন্দ্রের পরে তাঁর ১৮ পুত্রকে পাশ কাটিয়ে অবৈধ সন্তান পুরুষোত্তমও পূজারীদের সাহায্য নিয়েই ভাবে সিংহাসনে বসেন। বিনিময়ে পুরুষোত্তমদেব রথযাত্রার সময় ‘ছেড়াপহরা’ বা রাজা কর্তৃক  সোনার ঝাঁটা দিয়ে রথের রাস্তা পরিস্কার করার প্রথা চালু করেন। এর অর্থ একটাই, রাজা জগন্নাথের সেবক হলেও ঝাড়ুদার হওয়ার কারণে তাঁর স্থান পূজারীদের নীচে। সেইজন্যই রাজা ঝাঁটা হাতে রাজপথে, আর পূজারীরা জগন্নাথের সঙ্গে রথে রাজারও উপরে অবস্থান করেন। বস্তুত, জগন্নাথদেবই ওড়িশার প্রকৃত শাষক, রাজাকে অগ্রবর্তী করে পূজারীদের মাধ্যমে তিনি ‘শাষন চালান’, রাজা জগন্নাথদেবের, স্পষ্ট করে বললে পূজারীদেরই মুখপাত্র মাত্র।

 কিন্তু পুরুষোত্তমদেব একটা সময় পর পূজারীদের এই বাড়বাড়ন্তে নাস্তানাবুদ হয়ে উঠেছিলেন। জগন্নাথের নামে রাজ্য ও রাজনীতির উপর পুরোহিতদের হস্তক্ষেপ তাঁর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তিনি পুরোহিতদের উপর লাগাম টানার জন্য জগন্নাথ মন্দিরের সমস্ত নিয়মকানুন লিপিবদ্ধ করে ‘গোপালরচনাবিধি’ নামে একটি নির্দেশিকা তাঁদের উপর লাগু করেন। চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুরোহিতরা তা মেনে নেন। রাজবংশের সাথে পুরোহিতদের সম্পর্কের এই অবনতির রেশ পুরুষোত্তমদেবের পুত্র প্রতাপরুদ্রদেবের সময়ও আঁচ করা যাচ্ছিল। এই অবস্থাতেই চৈতন্যের সাথে প্রতাপরুদ্রদেবের সাক্ষাৎ হয়। চৈতন্যের সাহস ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করেই প্রতাপরুদ্র পুরোহিতদের দমানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। ফলতঃ, চৈতন্য ও তাঁর পরিকরগণ সমস্ত রকম রাজকীয় সহায়তা পেয়েছিলেন। পরের দিকে রাজা মনেপ্রাণে চৈতন্য ভক্ত হয়ে পরেন বটে, কিন্তু প্রথমদিকে চৈতন্য পৃষ্ঠপোষকতার পেছনে রাজার রাজনৈতিক কারণ ছিল আন্দাজ করা যায়।



চৈতন্য তাতে সফলও হন। চরম জনপ্রিয়তা ও রাজানুগ্রহের জোরে চৈতন্য একসময় জগন্নাথ মন্দিরের নিয়মনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন যা পূজারীদের ক্ষমতার উপর এক অমার্জনীয় আঘাত। চৈতন্যই বোধ হয় জগন্নাথ বিগ্রহকে ‘প্রাণের ঠাকুর’-এ পরিণত করেন, সাধারণত মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের অনুকরনে তিনিই জগন্নাথের নিত্যসেবা চালু করেন। কালক্রমে, চৈতন্য স্বয়ং ভক্তকুলের কাছে ‘সচল জগন্নাথ’-এ পরিণত হলে পুরোহিতরা এক অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের অশনিসংকেত খুঁজে পান। জগন্নাথসেবকরা প্রথম থেকেই চৈতন্যের প্রতি বিরূপ ছিলেন, এবং এই বিরূপতাই কালক্রমে বিদ্বেষে পরিণত হয়। কাজেই, চৈতন্য হত্যার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে গোবিন্দ বিদ্যাধর গোষ্ঠীর সাথে পুরীর পাণ্ডাদের হাত মেলানোটা মোটেই অসম্ভব না।

 এরপর আসা যাক পঞ্চসখাদের কথায়। পঞ্চসখারা ছিলেন ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ'। আরও একটু ভালো করে বলতে গেলে বলা যায় ‘দৃশ্যত বৈষ্ণব'। এই দিক থেকে দেখতে গেলে তারাও ছিলেন স্মার্ত অনুশাসন বিরোধী। ফলে তারাও ছিলেন পাণ্ডাদের বিরোধী। তাঁদের এই অবস্থান এমন একখানি মঞ্চ প্রস্তুত করেছিল বৈকি, যেখানে মহাপ্রভুর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে পারে। এবং তা যে গড়ে ওঠেনি তা নয়। কিন্তু তা উপরে উপরে। ভিতরে ভিতরে ছিল এক বিপরীত চোরাস্রোত। তার কারণ, প্রতাপরুদ্র নিজে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মোটেই পছন্দ করতেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তিনি বৌদ্ধদলন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন; এছাড়াও পঞ্চসখার অন্যতম বলরামদাসকে রাজা তাঁর সভা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। পঞ্চসখাদের মধ্যে আরও এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন জগন্নাথ দাস। তাঁকেও রাজা কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। এক্ষেত্রে অনেক কারণের মধ্যে যেটিকে মূল কারণ বলে মনে করা হয়, তা হল, তিনি নাকি কপট স্ত্রীবেশ ধারণ করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহবধূদের ভাগবত পাঠ করে শোনাতেন। শুধু তাই নয়, ওই ছয়বেশে তিনি রাজাবাড়ির অন্দরমহলেও প্রবেশ করেন এবং অসূর্যস্পর্শা রানিদের দীক্ষাও দেন। এই ‘কপটতা' রাজা বরদাস্ত করতে পারেন নি। বৌদ্ধদলন, বলরামদাসকে রাজসভা থেকে বহিষ্কার, জগন্নাথ দাসকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা- এই ঘটনাগুলির কোনো ক্ষেত্রেই চৈতন্য মহাপ্রভু (রাজার ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও) যে রাজাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, এমন কথা শোনা যায় না। মনে করা হয়, এই ঘটনাগুলির পর থেকেই পঞ্চসখা গোপনে ঘোরতর চৈতন্যবিরোধী হয়ে ওঠেন। কারণ তাঁরা মনে করতেন, মহাপ্রভু চাইলেই এই সংকটগুলি থেকে অনায়াসে তাঁদের উদ্ধার করতে পারতেন, যা তিনি করেননি।

 রাজদরবারের বাইরে, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পঞ্চসখা গোপনে যে শক্তির আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা গোবিন্দ বিদ্যাধর ভৈ-এর নেতৃত্বাধীন চৈতন্য এবং প্রতাপরুদ্রবিরোধী শক্তি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। ইতিপুর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, পঞ্চসখার পক্ষ থেকেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শ্রীচৈতন্যের জগন্নাথ বিগ্রহে লীন হয়ে যাওয়ার উদ্ভট গল্পটি রটানো হয়েছিল। যদি মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পিছনে গোবিন্দ এবং তাঁর সহকারীদের কোনো চক্রান্তমূলক কাজকর্ম থেকেই থাকে, তবে এই কথা বলাই যায় যে, এই আষাঢ়ে গল্প আসলে এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। একদিকে এইখানে যেমন চক্রান্তকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে তেমনি অপরদিকে, পঞ্চসখা এই অদ্ভুত তত্ত্বকে খাড়া করে নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছেন সন্দেহের বাতাবরণ থেকে।

 
[৮]

 উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে এক কথা বলা যায় যে, গোবিন্দ বিদ্যাধর ভৈ, ওড়িশার ব্রাহ্মণবর্গ, জগন্নাথদেবের পূজারী-পাণ্ডা-পড়িছা, পঞ্চসখা তথা ওড়িশার বৌদ্ধদের চৈতন্য হত্যার ষড়ে সামিল হওয়ার যথেষ্ট ‘মোটিভ’ ছিল। তাঁদের এই চাপা ক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছিল ওড়িশার রাজনৈতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। যেমন - 

 ১. চৈতন্যের সান্নিধ্য পাওয়ার আগে থেকেই রায় রামানন্দ, যিনি ঊৎকলরাজের মন্ত্রী ছিলেন, প্রবল কৃষ্ণ ভক্ত ছিলেন। তাঁর এই কৃষ্ণভক্তির এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তিনি নিজের রাজপ্রশাসকের ভুমিকা ঠিক করে পালন করতে পারছিলেন না। রামানন্দের সাথে সাক্ষাতে চৈতন্য বোঝেন যে, এমন চলতে দিলে রামানন্দ ও ওড়িশা দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই চৈতন্য তাঁকে রাজকর্মে ইস্তফা দিয়ে নিজের কাছে পুরীতে থাকতে বলেন। রাজা প্রতাপরুদ্রও তাতে আপত্তি করেননি। তবে রামানন্দের পদত্যাগে সাময়িক ভাবে ওড়িশার প্রশাসনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পরে। রাজনৈতিক মহলেরও নজরে এই বিষয়টি চোখে পড়ে। তাঁরা ভাবলেন রামানন্দ শুধু দুর্বল প্রশাষকই নন, একই সাথে দায়িত্বজ্ঞানহীনও! নাহলে বিজয়নগরের সাথে ওড়িশার যুদ্ধ চলছে এমন সময়ে কি না তিনি পদত্যাগ করলেন। আর রাজাও তাতে হস্তক্ষেপ করলেন না। স্বভাবতই, তাঁরা চৈতন্যকেই দোষ দেয়। 

২. মালজাটা দণ্ডপাটের অধিকারী গোপীনাথ রায় ছিলেন রামানন্দের ভাই ও চৈতন্য অনুসারী ভবানন্দের পুত্র। গোপীনাথ সেই সময়ের হিসেবে একলক্ষ টাকা তহবিল তছরূপ করেন। প্রতাপরূদ্র তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। চৈতন্যের অন্তরঙ্গ কিছু পরিকর একাধিকবার চৈতন্যকে হস্তক্ষেপ করতে অনুগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই তিনি সেই অনুরোধ নাকচ করেন; বরঞ্চ তিনি রাজার পক্ষ অবলম্বন করে গোপীনাথকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। এই রাজসিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের অনুরোধে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিলেন চৈতন্য। এমনকি তিনি পুরী ছেঁড়ে চলে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত নেন। এই কথা কাশী মিশ্র মারফত রাজার কানে পৌঁছালে রাজা তাঁর সম্পূর্ণ ভুল অর্থ বের করেন। রাজা মনে করলেন, চৈতন্য ঘনিষ্ঠ ভবানন্দের পুত্রের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় কুপিত চৈতন্য তাঁকে ত্যাগ করতে চাইছেন। ত্রস্ত রাজা তাই তড়িঘড়ি গোপীনাথের মৃত্যুদণ্ডাদেশ তুলে নেন, সমস্ত ঋণ মকুব করেন ও তাঁকে ‘নেতধটি’ পরিয়ে সসম্মানে দ্বিগুন মাইনেতে পুর্বপদে বহাল করেন। এই ঘটনায় চৈতন্যের কোনো হাতই নেই, অথচ জনমানসে বিষয়টি এরকম দাঁড়িয়ে গেল যে, ভবানন্দ কেবল চৈতন্য ভক্ত হওয়ার কারণেই তাঁর পুত্রের এতো বড়ো অপরাধ রাজা ক্ষমা করলেন। অস্যার্থ, রাজা এটোটাই শিরদাঁড়াহীন হয়ে পড়েছেন যে, চৈতন্যের বিরাগের ভয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার সাহসটুকুও হারিয়েছেন। আবারও, চৈতন্যকেই দোষের ভাগী হতে হল। 

৩. সম্ভবত ১৫১৩ সালে রাজা প্রতাপরুদ্র-চৈতন্যের সাক্ষাৎ হয়। এই সাক্ষাৎ-এর পরপরই ওড়িশা বেশ কয়েকটি যুদ্ধে শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হয়, ওড়িশার বেশ কিছু অঞ্চলহ্রাসও ঘটে। ১৫১৪ সালে প্রতাপরুদ্র বিজয়নগরের কৃষ্ণদেবরায়ের কাছে পরাস্ত হন, অদ্দাংকি, নাগার্জুনকোণ্ডা ও কোট্টারামা দুর্গের পতন ঘটে। ১৫১৫-১৬ সালে ওড়িশার কোণ্ডভিণ্ডূ, বেণীকোণ্ডা দুর্গগুলি কৃষ্ণদেবরায় অধিকার করেন। ১৫১৫-তেই প্রতাপরুদ্রের এক পুত্র বীড়ভদ্র ও বেশ কিছু রাজকর্মচারী বিজয়নগর সেনার হাতে বন্দি হন। ১৫১৭-তে  কৃষ্ণদেবের বাহিনীর হাতে প্রতাপরুদ্রের এক মহিষীম আরও এক পুত্র ও সাতজন প্রধান কর্মচারীকে বন্দি হতে হয়। ফলে, চৈতন্যের সঙ্গদোষেই রাজা দুর্বল হয়ে পড়ায় রাজ্যের এমন দুর্গতি এমনটা প্রচার করার যথেষ্টই সুযোগ ছিল।

 অর্থাৎ, স্বাভাবিক ভাবে চৈতন্যবিরোধীদের কাছে এটাই ফুটে উঠল যে, চৈতন্যভক্তিতে রাজা যতই ডুবছেন, ততই রাজ্যের দুর্দশা বাড়ছে। পক্ষান্তরে, চৈতন্যই ওড়িশার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বলতার প্রধান কারণ।

 
[৯]


চৈতন্যকে গুপ্তহত্যার সপক্ষে আরও একটি বড়ো প্রমান হল অন্তর্ধানের আগে এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটে যার থেকে মনে হয় নীলাচলে আগেও একাধিক বার তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল-

 কৃষ্ণদাস জানাচ্ছেন, জীবনকালের শেষের দিকে একদিন সন্ধ্যাবেলা চৈতন্য ভাবের ঘোরে প্রায় বাহ্যজ্ঞানহীন অবস্থায় ছিলেন। রামানন্দের প্রচেষ্টায় তাঁর বাহ্যজ্ঞান কিছুটা ফিরলে স্বরূপ ও রামানন্দ চৈতন্যকে গম্ভীরায় শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে আসেন এবং আরেকজন চৈতন্য পরিকর গোবিন্দ দরজার সামনে শুয়ে পড়েন। রাতে কোনো একসময় চৈতন্যের সাড়াশব্দ না পেয়ে স্বরূপ দরজা খুলে দেখেন, চৈতন্য নেই কিন্তু টোটার তিনটি উঁচু প্রাচীরের তিনটি দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ। উদ্বিগ্ন পরিকররা অনেক খুঁজে শেষে জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বারের সামনে তাঁকে পরে থাকতে দেখেন। তাঁর জ্ঞান নেই, দেহের অস্থি সন্ধিগুলি আলগা হয়ে হাত-পা যেন আরও লম্বা হয়ে গেছে, মুখে ফেনা, চোখ উলটে গেছে এবং গাত্রবর্ণ বিবর্ণ। এই শারীরিক অবস্থা কী নিছকই সাত্ত্বিক বিকার? নাকি কোনো বিষক্রিয়ার লক্ষণ? টোটার উঁচু প্রাচীরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকা সত্ত্বেও চৈতন্যের অচেতন দেহ জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বারে পৌছালো কিভাবে? আরও একবার এরকম ঘটেছিল, চৈতন্যের অচেতন দেহ আবারও সিংহদুয়ারের সামনে খুঁজে পাওয়া যায়। দেহের বিকারও একরকম- মুখে ফেনা, চোখ উলটে গেছে। বস্তুত, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির ফলে টোটায় পাহাড়া বসানো হয়। এরপর চৈতন্য নিজের গম্ভীরা ছেঁড়ে ‘অলৌকিক ভাবে’ বেরোতে পারতেন না, পাহাড়া বসানোর ফলেই হয়তো সেই অলৌকিক ক্ষমতা লোপ পায়।

 দুইবার একই ঘটনা ঘটায় বিষয়টিকে একটু অন্যভাবে দেখতেই হচ্ছে। এমনটা হতেই পারে যে, রামানন্দ ও স্বরূপ নিজেদের ঘরে চলে যাওয়ার পর দুই বারই রাত্রে চৈতন্যকে পানীয় জলের সাথে বিষাক্ত কিছু খাওয়ানো হয়েছিল, যার গলে তিনি জ্ঞান হারান। তারপর এক বা একাধিক ব্যক্তি অচেতন চৈতন্যকে বহন করে মন্দিরের দিকে নিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে দরজা ভেতরের কেউ খুলে দিয়েছিল, কারণ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।

 এরপরেও আরও একটি ‘দুর্ঘটনায়’ চৈতন্যের মৃত্যু প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। শরতের এক জ্যোতস্নাময় রাতে চৈতন্য তাঁর পরিকরদের নিয়ে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ চাঁদের আলোয় ঝলমল করা উত্তাল সমুদ্র দেখে তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে সমুদ্রকে যমুনা মনে করে তাতে ঝাঁপ দেন। স্রোতের টানে তিনি তলিয়ে যান এবং পরদিন খুব ভোরে এক জেলের জালে মৃতপ্রায়, অচেতন চৈতন্যকে পাওয়া যায়।

 মনে রাখা দরকার, তিনজন মানুষ চৈতন্যের সঙ্গে ছায়ার মতোই উপস্থিত থাকতেন- স্বরূপ দামোদর, চৈতন্যের  ব্যক্তিগত সেবক গোবিন্দ এবং চৈতন্যের দেহরক্ষী কাশীশ্বর। এরা কেউই চৈতন্যকে বাধা দেওয়া দূরে থাক, চৈতন্য যে সমুদ্রে ঝাপ দিয়েছেন সেটাও দেখতে পাননি। কেন পাননি? খুব সম্ভবত এরা কেউই সেই সময় চৈতন্যের কাছাকাছি ছিলেন না। সেইজন্যই এই সম্ভাবনা হয়তো একদমই উড়িয়ে দেওয়া যায়না যে, সেই সময় কৌশলে স্বরূপকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন কোনো পরিকর হয়তো সমুদ্রের প্রতি চৈতন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। চৈতন্যকে একা রেখে কোনো অছিলায় তিনিও সরে পরেন এবং ভাবাবিষ্ট চৈতন্যও সমুদ্রের প্রতি ধাবমান হন।


অবশ্য এটি একটা সম্ভাবনা মাত্র। সেদিন কি ঘটেছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে এই ঘটনার পর থেকেই চৈতন্যকে বিশেষ করে রাতে অত্যন্ত সতর্ক পাহাড়ায় রাখা শুরু হয়েছিল। রাতে তাঁর কেবল গোবিন্দর উপর ভরসা করে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেননি। রাতে স্বরূপ নিজে গম্ভীরায় গোবিন্দের সাথে গম্ভীরার দরজা আগলে শুতেন এবং গম্ভীরার ভেতরে চৈতন্যের পায়ের কাছে শুতেন শংকর পণ্ডিত। এরপর থেকে আর কোনো ‘দুর্ঘটনা’ বা ‘অলৌকিকভাবে’ চৈতন্যের গম্ভীরা ত্যাগের মতো অঘটন ঘটেনি।

এই ঘটনাগুলি থেকে সন্দেহ হয় যে, অন্তত দুজন চৈতন্য পরিকর চক্রান্তকারীদের সাথে যুক্ত ছিলেন। ভয় দেখিয়েই হোক বা প্রলোভন দেখিয়েই হোক গোবিন্দ বিদ্যাধর তাঁদের আনুগত্য আদায় করেছিলেন।

 
[১০]


নীলাচলে চৈতন্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথেই পুরীর একঝাঁক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চৈতন্যভক্ত পরিণত হন। রাজা প্রতাপরুদ্র, বাসুদেব সার্বভৌম, রাজগুরু কাশীমিশ্র, মন্ত্রী রায় রামানন্দ, জগন্নাথ অঙ্গ সেবনকারী জনার্দন, পরিছা প্রধান অনন্ত প্রতিহার প্রমুখ- অর্থাৎ চৈতন্যকে কেন্দ্র করে এমন এক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল যা গোবিন্দ বিদ্যাধরের উচ্চাশায় নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারত। ফলতঃ, প্রতাপরুদ্র বিরোধী গোবিন্দ বিদ্যাধরের নিজের স্বার্থেই চৈতন্যের ঘনিষ্ঠ জনের মধ্যে নিজের চর ঢোকানোর প্রয়োজন পরেছিল, যাতে চৈতন্যগোষ্ঠীর খবরাখবর তাঁর কাছে আসতে থাকে। যদিও কে বা কারা গোবিন্দর চর ছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা অসম্ভব; তবুও চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?

 নীলাচলে চৈতন্যের ঘনিষ্ঠতম পরিকরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন – যবন হরিদাস, স্বরূপ দামোদর, রায় রামানন্দ, গদাধর, পরমানন্দপুরী, চৈতন্যের ব্যক্তিগত সেবক গোবিন্দ এবং দেহরক্ষী কাশীশ্বর। এছাড়াও, দামোদর পণ্ডিত, শংকর পণ্ডিত, রঘুনাথ গোস্বামী প্রমুখরাও চৈতন্যের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। যবন হরিদাস যাতে চৈতন্যের মৃত্যুশোক যাতে সহ্য করতে না হয়, সেই জন্য অনশনে প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। হয়তো যবন হরিদাস চৈতন্যহত্যার ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে আভাস পেয়েছিলেন। গোপীনাথ মুর্তি প্রতিষ্ঠার পর গদাধর সবসময় চৈতন্যকে সঙ্গ দিতে পারতেন না, নিজস্ব মঠ প্রতিষ্ঠার পর পরমানন্দ পুরীও চৈতন্যের কাছে সর্বদা উপস্থিত থাকতেন না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শেষের দিকে চৈতন্যের কাছে সর্বদা উপস্থিত থাকতেন পাঁচজন- স্বরূপ, রামানন্দ, রঘুনাথ, গোবিন্দ ও কাশীশ্বর। এছাড়াও শংকর পণ্ডিতও পরবর্তী কালে চৈতন্যের সাথে রাত্রি বাস করতেন।

 এই পাঁচজনের মধ্যে দুজন ছাড়া প্রত্যেকেরই পরিচয় হয় চৈতন্য কিম্বা তাঁর আস্থাভাজন কেউ না কেউ জানতেন। এই দুজন হলেন চৈতন্যের ব্যক্তিগত ভৃত্য গোবিন্দ ও দেহরক্ষী কাশীশ্বর। এঁদের আসল পরিচয় বাকিরা কেউ জানতেন না। কিন্তু এঁরা দুজনই একে অপরকে ভালোভাবে চিনতেন। পরমানন্দ পুরীর নীলাচলে আসার কয়েকদিন পর সম্পুর্ণ এক অপরিচিত ব্যক্তি এসে চৈতন্যকে জানান যে, তিনি ঈশ্বরপুরীর ভৃত্য, নাম গোবিন্দ, প্রভুর আদেশে চৈতন্যের সেবা করতে এসেছেন। এই গোবিন্দই পরে নিয়ে আসেন কাশীশ্বরকে।

 যাই হোক, গোবিন্দকে দেখে বাসুদেব সার্বভৌমের মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটে। তিনি অত্যন্ত খুঁটিয়ে গোবিন্দকে দেখতে থাকেন এবং অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন যে, “তুমি ঈশ্বরপুরীর সেবক ছিলে?” তারপর তিনি চৈতন্যকে প্রশ্ন করেন, “প্রভু, এই অব্রাহ্মণকে আপনি কিভাবে সেবক রূপে গ্রহণ করবেন?”(চৈতন্যচন্দ্রোদয়) সম্ভবত, সার্বভৌম চাননি যে, গোবিন্দ চৈতন্যের আশেপাশে থাকুক। সেইজন্যই হয়তো, চৈতন্যের বর্ণবাদ বিরোধিতার কথা জানা সত্ত্বেও বর্ণের কথা তোলেন নিজের আপত্তির কথা বলতে না পারার জন্য। যাই হোক, সার্বভৌমের সন্দেহ সত্ত্বেও ঈশ্বরপুরীর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার কারণে চৈতন্য এই সম্পুর্ণ অজ্ঞাতকুলশীলকে আপন অঙ্গসেবার অধিকার দেন। এর কিছু দিনের মধ্যেই গোবিন্দ মারফতই কাশীশ্বরের আগমন ঘটে। এই কাশীশ্বর অত্যন্ত বলশালী ছিলেন, তাই একে চৈতন্যের দেহরক্ষী নিযুক্ত করা হয়।

 চৈতন্যের যে তিনটি ‘দুর্ঘটনা’-র কথা আগে জানানো হয়েছে তাতে এই দুজনের ভুমিকা নিয়ে কিছু গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। যে দুবার মাঝরাতে গম্ভীরা থেকে চৈতন্য নিখোঁজ হন, সে রাত্রে সম্ভবত তাঁকে বিষ দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর অচেতন চৈতন্যকে এক বা একাধিক ব্যক্তি টোটার বাইরে নিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হল- চৈতন্যকে বিষ দেওয়ার সবথেকে বেশি সুযোগ কি গোবিন্দরই ছিল না? দু'বারই টোটার তিনটি প্রাচীরের তিনটি দরজা ভিতর থেকে খোলা এবং বন্ধ করা হয়েছিল। এ কাজ করার সবচেয়ে বেশি সুযোগ কি গোবিন্দরই ছিল না? যদি বাইরের লোকজন না এসে থাকে তবে অবশ্যই ভিতরের লোক অর্থাৎ চৈতন্যের অতি অন্তরঙ্গ পরিকরদের মধ্যে চৈতন্যকে গম্ভীরা থেকে জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বার পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার শারীরিক ক্ষমতা 'কাশী বলবান' ছাড়া অন্য কোনো চৈতন্য পরিকরের ছিল কি? এবং গম্ভীরার দরজা আগলে শুয়ে থাকা গোবিন্দর অজ্ঞাতসারে হতচেতন চৈতন্যকে বার করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু গোবিন্দ সে কথা গোপন করেছিলেন কেন?

 চৈতন্য যখন সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তখন গোবিন্দ ও কাশীশ্বর তাঁর ধারেকাছেও ছিলেন না কেন? ঐ রাতে যদি চৈতন্যকে ত্যাগ করে দু'জনেই একসঙ্গে কোথাও গিয়ে থাকেন তবে তা কি নিছকই কর্তব্যে অবহেলা? কিন্তু দু-দু'বার চৈতন্য গম্ভীরা থেকে রহস্যজনকভাবে উধাও হওয়ার পর স্বরূপরা যে পরিমাণে সতর্ক থাকতেন তাতে ঐ 'দু'জনের মধ্যে যে কোনো একজন অন্তত চৈতন্যের সঙ্গে ছিলেন বলেই স্বরূপরা সাময়িকভাবে তাঁকে কাছছাড়া করতে ভরসা পেয়েছিলেন। তবে কী এই দু'জনের একজন কোনো অছিলায় স্বরূপ-রামানন্দকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং অপরজন চৈতন্যকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে প্ররোচিত করেন?

 এছাড়াও সবথেকে বড়ো প্রশ্ন- চৈতন্য যখনই জগন্নাথ মন্দিরে যেতেন কাশীশ্বর তাঁর সঙ্গে থাকতেন। অথচ অন্তর্ধানের দিন চৈতন্য একা মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন। দিব্যোন্মাদ দশার শেষ পর্যায়ে চরম ভগ্নস্বাস্থ্য চৈতন্যের পক্ষে নিশ্চয়ই অতি শক্তিশালী কাশীশ্বর ও সুস্থসবল গোবিন্দকে পিছনে ফেলে একা দৌড়ে মন্দিরে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে বিষয়টি এরকম দাঁড়ায় যে, হয় এই দু'জনেই সেদিন চৈতন্যের সঙ্গে ছিলেন না অথবা চৈতন্যের মন্দিরে প্রবেশের সময় তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে চৈতন্যের সঙ্গী হন নি। যদি দু'জনেই ঐ বিশেষ সময়টিতে অনুপস্থিত থেকে থাকেন তবে তা কী নিতান্তই কাকতালীয়? আর যদি তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে চৈতন্যের সঙ্গী না হয়ে থাকেন তবে তার কারণ কী? সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব না হলেও গোবিন্দ ও কাশীশ্বরের সঙ্গে চৈতন্যবিরোধী চক্রান্তকারীদের যোগসাজশের সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা কঠিন।

 

[১১]


আগেই বলা হয়েছে, চৈতন্যের দারুব্রহ্মে লীন হওয়ার গল্পটি পঞ্চসখার তরফ থেকে বিখ্যাত করে তোলা হয়, এবং অচ্যুতানন্দ তাঁর ‘শূন্যসংহিতা’-তে প্রথম এই অবাস্তব গল্পে শীলমোহর দেন। তবে, অচ্যুতানন্দ ও অন্যান্য চরিতকারগণের চৈতন্য অন্তর্ধান উপাখ্যানের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য অংশ হচ্ছে চৈতন্য মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন এবং প্রবেশ করা মাত্রই দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল। এরপর ঈশ্বরদাস তাঁর ‘চৈতন্যভাগবত’-এ চৈতন্যের কায়িক মৃত্যুর কথা বললেন সঙ্গে জানালেন মন্দিরের গুপ্তপথ দিয়ে চৈতন্যের দেহ বাইরে নিয়ে গিয়ে ‘জগন্নাথের আদেশে’ (শ্রীজগন্নাথ আজ্ঞা পাই।/অন্তর্ক্ষে নেলে শব বহি/গঙ্গারে মেলি দেলে শব।) প্রাচী নদীর জলে বিসর্জন দেওয়া হয়।

 এই বর্ণনায় ‘জগন্নাথ আজ্ঞা’ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ভগবান জগন্নাথই কৃপা করে পাণ্ডাদের মাথায় চৈতন্যের মৃতদেহ সরিয়ে দেওয়ার বুদ্ধি দিয়েছিলেন। এটা সম্ভব কি অসম্ভব, তা নিয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। এর অপর ব্যাখ্যা হতে পারে, জগন্নাথ নামক কোনো ব্যক্তি সেই সময় মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন যিনি মৃতদেহ লোপাট করার বুদ্ধি পাণ্ডাদের দিয়েছিলেন। কে এই জগন্নাথ? মধ্যযুগে ওড়িয়া সাহিত্যে এক পঞ্চসখার জগন্নাথ দাস ছাড়া অন্য কোনো প্রভাবশালী জগন্নাথের কথা জানা যায়না। এ সম্ভাবনা আরও পোক্ত হয় যখন ঈশ্বরদাস জানান, গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এই গোপন কথা তিনি জেনেছেন। পঞ্চসখার কেউ যদি অকুস্থলে উপস্থিত না থাকেন, তাহলে একমাত্র পঞ্চসখা গোষ্ঠীর মধ্যে এই পরম্পরা চালু হওয়ার কথা নয়। জগন্নাথের খ্যাতি সেই সময় প্রায় চৈতন্যের সমান ছিল বলা যায়, তাছাড়া মন্দিরের অন্যতম প্রধান সেবক হওয়ায় মন্দিরের সর্বত্রই তাঁর অবাধ যাতায়াত। কাজেই গর্ভগৃহে এই জগন্নাথদাসের উপস্থিত থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

 এই অনুমান যদি সত্য হয়, তাহলে অকুস্থলে জগন্নাথদাসের উপস্থিতি নেহাতই কাকতালীয় হতে পারেনা। নীলাচলে জগন্নাথ দাস চৈতন্যের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তা সত্ত্বেও একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা জগন্নাথ দাস চৈতন্য সম্পর্কে একটি কথাও কখনও লিখে জাননি। জগন্নাথ দাসের অকুস্থলে ‘উপস্থিতি’ এবং পরবর্তীতে তারই পঞ্চসখা গোষ্ঠী দ্বারা দারুব্রহ্মে লীনের রটনা এবং চৈতন্যকে সম্পর্কে জগন্নাথের অস্বাভাবিক নীরবতা ‘বিশেষ দিকে’ ইঙ্গিত করে, পঞ্চসখা গোষ্ঠীর শ্রীচৈতন্যের প্রতি ক্ষোভই যার কারণ।

 চৈতন্যের মৃতদেহ সম্পর্কে ঈশ্বরদাস আরও একটি অদ্ভুত কথা জানাচ্ছেন যে, প্রাচীন নদীতে শব বিসর্জন দেওয়া মাত্রই সেই শব জীবিত হয়ে ওঠে। সম্ভবত জলে ফেলে দেওয়ার সময় চৈতন্যের জীবিত ছিলেন। ভাবের ঘোরে তিনি এমনভাবে সমাধিস্ত হয়েছিলেন যে তাঁকে পাণ্ডারা মৃত ভেবে ভুল করে। জলে বিসর্জন দেওয়া হলে জলের সংস্পর্শে সেই সমাধি ভঙ্গ হয় এবং চৈতন্য শেষবারের মতো হয়তো বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু, দুর্বলদেহী চৈতন্য অচিরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন কিম্বা তিনি নদীতে তলিয়ে যান।

 একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় সেদিন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রুদ্ধদ্বারে গর্ভগৃহের মধ্যে যে চরম নাটকটি ঘটেছিল তাঁর কুশীলবরা যে কারণেই হোক চৈতন্যের মৃতদেহ সর্বসমক্ষে আনতে চায়নি। যদি চৈতন্যের আত্মা জগন্নাথে বিলীনই হতো তাহলে সেই শবদেহ লোকচক্ষু থেকে আড়ালের কোনো কারণই থাকতে পারেনা। অথচ বাস্তবে সেদিন তাই হয়েছিল। এর কারণ হতে পারে, চৈতন্যের মৃতদেহ এটোটাই বিকৃত কিম্বা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল যা চৈতন্যভক্তদের সামনে হাজির করা পাণ্ডাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্ভবত সেদিন, চৈতন্যকে নিষ্ঠুর ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

 
[১২]


তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? সংক্ষেপে একবার গোটাটাই ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

নীলাচলে আগমনের পরপরই উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের সাথে পরিচয় হয় চৈতন্যের। গৌড়াধিপতি হুসেন শাহ ওড়িশা আক্রমণ করলে চৈতন্য আপন বুদ্ধিবলে রাজাকে বিপদ থেকে ত্রাণ করেন কিন্তু এতে রাজসিংহাসনলোভী গোবিন্দ বিদ্যাধরের উচ্চাশার পথে বাঁধা পড়ে। গোবিন্দ বিদ্যাধর বুঝলেন যে, চৈতন্যকে না সরালে রাজসিংহাসন পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। এদিকে ওড়িশার জনজীবনে চৈতন্যের প্রভাবের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে শিরে সংক্রান্তি দেখলেন ওড়িশার ব্রাহ্মণগণ। পুরীর নিশ্চল জগন্নাথ বিগ্রহের থেকেও ‘সচল জগন্নাথ’-এর গুরুত্ব লোকমানসে বেড়ে চলেছে দেখে মন্দিরের পাণ্ডা-পড়িছারাও প্রমাদ গনলেন। এদিকে ওড়িশার বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য ঠারেঠোরে চৈতন্যকেই দোষী ঠাওড়ানো হল। ফলে ওড়িশায় এক চৈতন্যবিরোধী চক্রের উৎপত্তি ঘটে, তাঁর নেতৃত্বে ছিলেন গোবিন্দ বিদ্যাধর। গোবিন্দ বিদ্যাধরের দুজন চর আগে থেকেই চৈতন্য ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তাঁদের সহযোগিতায় চৈতন্যের উপর বেশ কয়েকবার হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হলেও তা ব্যর্থ হয়।

 এরই মধ্যে একদিন কাশী মিশ্রের গম্ভীরা থেকে জগন্নাথ দর্শনে চললেন শ্রীচৈতন্য। যে কাজ তিনি গত ২৪ বছরে কখনও করেননি, সেটাই তিনি করে বসলেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে তিনি প্রবেশ করলেন। বিধ্যাধরের লোকেরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তাঁরা চটজলদি কপাট আটকে দিল। প্রভুকে নিস্তার দিলনা মন্দিরের পাণ্ডারা। প্রহারে প্রহারে জর্জরিত করে দেওয়া হল বাংলার সাধের গোঁরাচাদকে। এমনিতেই চৈতন্য ভাবোন্মাদ দশায় ছিলেন, অতিরিক্ত প্রহারে তিনি অচৈতন্য হয়ে মৃতবৎ পড়ে রইলেন। এরপর বদ্ধ দ্বারের পেছনেই বসল সভা, কী করে সেই দেহ লোপাট করা যায়। অকুস্থলে উপস্থিত জগন্নাথদাস নিদান দিলেন যে দেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হোক। চৈতন্যের ক্ষতবিক্ষত দেহ সবার অলক্ষে মন্দিরের গোপন পথ থেকে বের করে প্রাচীন নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। নদীর শীতল জলস্পর্শে শেষবারের মতো চৈতন্যের জ্ঞান ফেরে, এরপরই তিনি নদীতে তলিয়ে যান।

 গোবিন্দ বিদ্যাধরের এই ঘৃণ্য পরিকল্পনা সফল হয়েছিল। চৈতন্য হত্যাকাণ্ডের হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতাপরুদ্র কটকে পলায়ন করেন, সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে চৈতন্যের পর পরবর্তী আঘাত তাঁর উপরই আসতে চলেছে। কটকেই প্রতাপরুদ্র তাঁর প্রধান সেনাপতি ভারু কতৃক পদচ্যুত ও নিহত হন। মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে উৎকলের সিংহাসনে বসেন ষড়যন্ত্রকারী গোবিন্দ বিদ্যাধর। চৈতন্যের মৃত্যুর পর তাঁর অন্যতম পার্ষদ স্বরূপ দামোদরকে আর জীবিত অবস্থায় দেখা যায়নি।  ‘হৃদয় ফেটে’  স্বরূপের ‘প্রাণ বেড়িয়ে যায়’। হয়তো, শত্রুর অস্ত্রের আঘাতে হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ার কথাই চরিতকাররা ঘুণাক্ষরে জানিয়েছেন। চৈতন্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাবৎ চৈতন্যপন্থী ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা উৎকল ছেড়ে বৃন্দাবন চলে যান। মোটামুটি একই সময়ে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধান ঘটে ওনার প্রায় সমস্ত প্রধান পার্ষদদেরও। সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ ৫০ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে ও উৎকলে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সমস্ত রকম প্রচার, এমনকি ন্যূনতম ‘কীর্তন গান’ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল!

পরিশিষ্ট

চৈতন্য অন্তর্ধানের এটাই একমাত্র ব্যখ্যা কিম্বা এটাই শেষ কথা এমনটা দাবী করার কোনো কারণ নেই। চৈতন্য অন্তর্ধানের প্রধান কারণ গুপ্ত হত্যা, এই মতবাদের পক্ষের মতোই বিপক্ষেও অগণিত যুক্তি বর্তমান। বস্তুত, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের মতোই চৈতন্য অন্তর্ধানও ভারতীয় ইতিহাসের এমন এক রহস্যাবৃত, অধ্যায় যার উদ্ঘাটন করা হয়তো সম্ভবই নয়। চৈতন্য সাতচল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন। তাঁর এই স্বল্প জীবনকালে তিনি যা করে গেছেন, তাতে চৈতন্যকে আমাদের জাতির সহস্র সহস্র বছরের তারকাখচিত ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে ভাবতেই পারি আমরা। চৈতন্য আবির্ভাব বাঙালির ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রভা। বাঙালির নিয়তি দ্বারা পূর্বনির্ধারিত ছিলেন চৈতন্য, এই জাতি গৌরচন্দ্রের অপেক্ষায় ছিল, গোরারায়ের আবাহনে সদানিষ্ঠ ছিল। তাঁর অন্তর্ধানের উপযুক্ত অনুসন্ধান হোক, ঐতিহাসিক গবেষণা চলুক, সম্পূর্ণ সত্য সামনে আসুক, দোষীরা জনসমক্ষে উন্মোচিত হোক, বাঙালি হিসেবে এই দাবী তোলা আমাদের অবশ্যকর্তব্য।




তথ্যসূত্রঃ-

১.     চৈতন্যের শেষ প্রহর - তুহিন মুখোপাধ্যায়
২.     চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে – তমাল দাশগুপ্ত।
৩.     চৈতন্যের শেষ কোথায়? - রজত পাল।
৪.    চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্য – যুধিষ্ঠির জানা(মালীবুড়ো)
৫.     চৈতন্যের অন্তর্ধান বিষয়ক দু-একটি কথা - রাজীব রায় গোস্বামী


[1] রথ যাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ তখন গুণ্ডিচা মন্দিরে অবস্থান করছিলেন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন