অম্বুবাচী প্রসঙ্গে… - কমলেন্দু সূত্রধর

     চিত্র সৌজন্যঃ সৌরভ পা
  

সূর্য থেকে আগুন-ঝরা তাপে ধরণী যখন উত্তপ্ত হয়, পৃথিবীর ফসলভরা মাঠ তখন রিক্ত। আষাঢ়ে সেই শুকিয়ে যাওয়া জীবনে করুণাধারায় নেমে আসে বৃষ্টি। মেঘ যেন এক কৃষ্ণবর্ণ বিশালদেহী গম্ভীর পুরুষ। তার বৃষ্টি-ঔরসে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টির বীজ বপন হয়। নদী-নালা ভরে ওঠে। গাছপালা সজীব হয়। আমাদের পৃথিবী-মা যেন সত্যি ঋতুমতী হয়ে ওঠেন। পৃথিবী থেকে সূর্য তার তাপ দিয়ে জল চুরি করে বাষ্পের আকারে। পৃথিবীর শরীরে জল বৃদ্ধি হয় অম্বুবাচীর সময়। অম্বুবাচী আসলে কৃষির উৎসব। নব ফসলের জন্ম দেওয়ার সূচনা। সূর্য আষাঢ় মাসে যে দিন মিথুন রাশিতে আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে গমন করে, সেই সময় থেকে মাতৃস্বরূপা পৃথিবী ঋতুমতী হন। আষাঢ় মাসের প্রথম ছ’দিন চল্লিশ দণ্ডে মৃগশিরা নক্ষত্রের শেষ দুই পাদে সূর্যের ভোগ হয়। তার পরে যে তিন দিন বিশ দণ্ড পর্যন্ত সূর্য আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে থাকেন, তা-ই অম্বুবাচী। সূর্যের দক্ষিণায়নের দিন থেকে তিন দিন অর্থাৎ, আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দিনগুলিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। এই কটি দিন জমিতে লাঙ্গল দেওয়া বা বীজ বোনা নিষেধ - ঋতুকালে  নারীর পুরুষসংসর্গ নিষিদ্ধ যে জন্যে ঠিক সেই কারণেই। এই 'সংযম' পালনের সূত্রেই উপবাস এবং অরন্ধনের প্রথা আরোপিত হয়েছে পরে। ঋতুর ঠিক পরবর্তী দিনগুলি যেমন নারীর পক্ষে সন্তান ধারণের জন্য প্রশস্ততম, ঠিক তেমনই অম্বুবাচীর পরবর্তী সময়টাই ফসল ফলানোর পক্ষে সবচেয়ে শ্রেয়কাল বলে মনে করা হয়েছে।



নতুন বর্ষার মুখপাতে পৃথিবী যখন প্রথম সিক্ত হয়ে ওঠে, তখন তাঁকে প্রথম ঋতুমতী নারীরূপে চিত্রিত করার আদিম সংস্কারই অম্বুবাচীর উৎস। এই সময়ে তাঁকে তিন দিন বিশ্রাম দেওয়া হয়। চাষিরা ওই তিন দিন কোনও কৃষিকাজ করেন না। অম্বুবাচীর তিন দিন ধরিত্রীর ঋতুকাল ধরে নিয়ে চাষে বিরত থাকেন। তাঁরা মনে করেন, এই তিন দিন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ধরিত্রী চাষের উপযোগী হয়ে উঠবে। অম্বুবাচীর আগের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী প্রবৃত্তি’। তিন দিনের পরের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী নিবৃত্তি’। এর পরেই চাষিরা আবার চাষ-আবাদ শুরু করতে পারেন।


আমাদের সামাজিক জীবনেও এই ধর্মীয় আচারটির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যে তিন দিন অম্বুবাচী পালন করা হয় সেই দিনগুলিতে কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, যেমন, গৃহপ্রবেশ, বিবাহ, উপনয়ন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয় না। শুধু তা-ই নয়, কিছু কাজ যেমন, বেদ পাঠ, ভূমি কর্ষণ, বীজ বপন, দেব-পিতৃ তর্পণও বন্ধ রাখা হয়। অম্বুবাচী উপলক্ষে গ্রামবাংলার বিধবা মহিলারা তিন দিন ধরে ব্রত রাখেন। অম্বুবাচীর আগের দিন তাঁরা তিন দিনের প্রয়োজনীয় খাবার রান্না করে রাখেন। এই সময় আগুনের আঁচে গরম করা কোনও খাবার তাঁরা খান না। তবে কোথাও কোথাও সূর্যের তাপে খাবার গরম করে নেওয়ার প্রথাও প্রচলিত আছে। আবার যাঁরা ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাঁরা এই সময়ে আমিষ খাবার খান না। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খেয়ে তাঁরা ব্রত উদ্‌যাপন করেন। এই বিশ্বাস এবং অম্বুবাচীর পারণ, দুটোই আদিম কৌম সমাজের প্রজননশক্তির পূজা এবং তার সাথে সম্পৃক্ত ধ্যান-ধারণার সঙ্গে জড়িত বলে পণ্ডিত গবেষকদের অভিমত। অম্বুবাচীর ক্ষেত্রে উর্বরতাকেন্দ্রিক ভাবনায় নারী এবং ধরিত্রী যেন সমার্থক হয়ে ওঠে। অম্বুবাচী একটি ধর্মীয় আচার হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের আমাদের প্রাচীন কৃষি পদ্ধতিও।


ভারতবর্ষের ইতিহাসে পৃথিবীকে মাতা ও দেবীরূপে দেখার চলন খুবই আদিম। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাতে প্রাপ্ত নারীমূর্তিগুলির অনেকেই প্রাচীন মাতৃকা মূর্তি বলে পণ্ডিতগণরা অনুমান করে থাকেন। এই মাতৃকামূর্তিগুলির মধ্যে অনেকই আবার মাতা পৃথিবীর মূর্তি বলে ধারণা করা যায়। শস্যোৎপাদিনী পৃথিবীই তখন ছিলেন মাতৃদেবতা; প্রাণ শক্তি ও প্রজননশক্তির প্রতীকরূপে তিনি প্রাচীন কাল থেকেই পূজিতা। বৈদিক সাহিত্যে পৃথিবীর মাতৃদেবীরূপে বর্ণনা অতি প্রসিদ্ধ। অবশ্য এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়, ঋগবেদে যেখানেই তিনি মাতারূপে স্তুত হয়েছেন, বেশিরভাগ জায়গাতেই আমরা তাঁকে পিতা 'দ্যৌ' এর সাথে একত্রে দেখতে পাই। ঋগবেদে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বলছেন,


"দ্যৌর্মে পিতা জনিতা নাভিরত্র বন্ধুর্মে মাতা পৃথিবী মহীয়ম্‌।

উত্তানয়োশ্চম্বো র্যোনিরন্তরত্রা পিতা দুহিতুর্গর্ভমাধাৎ।।(১/১৬৪/৩৩)"


 অর্থাৎ, দ্যৌ আমার পিতা, যজ্ঞস্থান আমার বন্ধু, বিস্তির্ণা পৃথিবী আমার মাতা। উত্তানপাত্রদ্বয়ের নধ্যে যোণি আছে, সেখানে পিতা দুহিতার গর্ভ উৎপাদন করেন। সায়ণাচার্য এই ঋকের অর্থ করেছেন যে, দ্যৌ বা আকাশ এবং পৃথিবীর মধ্যে যে অন্তরীক্ষ আছে, তাতে পিতা অর্থাৎ 'দ্যৌ' দুহিতা পৃথিবীর জন্য বৃষ্টি উৎপাদন করেন।


 অন্যত্র দেখতে পাই-

 "ভুরিং দ্বে অচরন্তী চরন্তং পদ্বন্তং গর্ভমপদী দধাতে।

নিত্যং ন সয়নুং পিত্রোরুপস্থে দ্যাবা রক্ষতং পৃথিবী নো অভ্বাৎ।।(১/১৮৫/২)


 অর্থাৎ, পাদরহিতা অবিচলা দ্যাবা-পৃথিবী সচল ও পাদযুক্ত গর্ভস্থিত (প্রাণিসমূহকে) পিতামাতার ক্রোড়ে পুত্রের ন্যায় ধারণ করছেন।


 এইরকমই কতকগুলি সুক্তে দেখা যায়, দ্যৌ-রূপ পিতার বর্ষাই হল রেতঃ, সেই বর্ষা-সিঞ্চনেই মাতা পৃথিবী তাঁর গর্ভে ধারণ করেন সর্বপ্রকারের শস্য। মানব সভ্যতার আদুযুগ থেকেই আমরা প্রায় একটী ধর্মবিশ্বাসরূপে এই ধারণা বহু জাতির মধ্যে প্রচলিত দেখতে পাই যে, বর্ষার মাধ্যমে দ্যৌ-পিতা মাতা পৃথিবীকে গর্ভদান করেন। জননী পৃথিবীর প্রসঙ্গে আরও একজন প্রসিদ্ধা বৈদিক দেবীর কথাও স্মর্তব্য, তিনি হলেন অদিতি। ঋগবেদে অদিতি যেমন আদিত্যগণের জননী হিসেবে বর্ণিতা, তেমনই এই অদিতি স্বয়ং পৃথিবী,


 "মহ্না মহদ্ভিঃ পৃথিবী বি তস্থে মাতা পুত্রৈরদিতির্ধায়সে বেঃ।"(১/৭২/৯)

 অর্থাৎ, অদিতিরূপ জননী পৃথিবী সমস্ত জগৎ ধারণের নিমিত্ত মহানুভব পুত্রদের সাথে বিশেষ মহত্বপ্রকাশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।


 ঋগ্বেদের যুগে অদিতি ছিলেন দেবমাতা, প্রজননের দেবী-

 অদিতির্দৌরদিতিরন্তরিক্ষমদিতির্মাতা স পিতা স পুত্রঃ।

বিশ্বদেবা অদিতিঃ পঞ্চজনা অদিতির্জাতমদিতির্জনিত্বম।।”(১/৮৯/১০)


 অদিতি দ্যুলোক, অদিতি স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী অন্তরীক্ষ । তিনিই মাতা (জগতের জননী), তিনিই (জগতের) পিতা, তিনিই পুত্র। সকল দেবতাই অদিতি, তিনিই পঞ্চজন (নিষাদ ও চারিবর্ণ, অথবা গন্ধর্বগণ, পিতৃগণ, দেবগণ, অসুরগণ ও রক্ষোগণ- সায়ন)।


 এখানে সায়নাচার্য অদিতি শব্দের অর্থ করেছেন- অখণ্ড পৃথিবী বা দেবমাতা- “অদিতিরখণ্ডনীয়া বা পৃথিবী দেবমাতা বা।”

 ঋগ্বেদের অপর একটি ঋকে আছে,

 যথা নো অদিতিঃ করৎ পশ্বে নৃভ্যো যথা গবে যথা তোকায় রুদ্রিয়ম্ ॥ (১/৪৩/২)


 অর্থাৎ, অদিতি আমাদের মহিষাদি পশু, ভৃত্যাদি পুরুষ, গাভী, পুত্রাদির মঙ্গলের জন্য ক্ষুদ্রসম্পর্কিত ওষধি (ভেষজ) দান করুন।


 এই মন্ত্রে অদিতিকে ভূমি বলেই মনে হয়। সায়নাচার্যও লিখেছেন,

 "অদিতি- ভূর্মির্নোহস্মাকং রুদ্রিয়ং রুদ্রসম্বন্ধি ভেষজং যথা যেন প্রকারেণসিধ্যতি করৎ।”

 ভেষজ কামনা করাই স্বাভাবিক, ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে (১/৮৯/৪) পৃথিবীর নিকট থেকেই ভেষজ কামনা করা হয়েছে। অপর একটি ঋকে অদিতির ক্ষিতিরূপতা আরও স্পষ্ট,


 জ্যোতিষ্মতীমদিতিং ধারয়ৎ ক্ষিতিং সর্বতীমাসচেতে দিবে দিবে জাগৃবাংলো দিবে দিবে।

জ্যোতিষ্মৎ ক্ষত্রমাসাতে আদিত্যা দামূনস্পতী মিত্রস্তয়োর্বরুণো যাতযজ্জনোর্যমা যাতযজ্জনঃ ॥ (১/১৩৬/৩)


 অস্যার্থ, যজমান জ্যোতিষ্মতী স্বর্গকরী অদিতিকে স্বয়ং নির্মাণ করেছেন, ক্ষিতি (মৃন্ময়ী-বেদী) সম্পূর্ণ করেছেন। প্রতিদিন জাগ্রত থেকে তোমরা ক্ষাত্র-তেজ লাভ কর। অদিতির পুত্র শ্রেষ্ঠ দানশীল মিত্র ও বরুণ সকলকে স্ব স্বভাবে প্রেরণ করেন, অর্থমাও সর্বপ্রাণীকে স্বকার্যে প্রেরণ করেন। এই ঋকের ভাষ্যে সায়নাচার্য অদিতি সম্পর্কে লিখেছেন,


 জ্যোতিষ্মতীং আহবনীয়াগ্নেস্তেজোযুক্তাৎ অদিতিং অদীনাং সম্পূর্ণলক্ষণাং ক্ষিতিং অগ্নের্বাসযোগ্যাং ভূমিং...।”

 অর্থাৎ, অদিতি শব্দের অর্থ অদীনা অর্থাৎ সম্পূর্ণলক্ষণযুক্ত। (নিখুঁৎভাবে সম্পাদিত বেদী), ক্ষিতি শব্দে বোঝায় অগ্নিয় বাসযোগ্য ভূমি, জ্যোতিষ্মতী অদিতি কথার তাৎপর্য আহবনীয় অগ্নির তেজের দ্বারা দীপ্তিমতী।


 কৃষ্ণযজুর্বেদ পৃথিবীকেই অদিতি বলেছেন,

 "বাজস্য নু প্রসবে মায়তং মহীমদিতিং নাম বচসা করামহে।"

 অর্থাৎ, অন্নের উৎপত্তিভূতা জননী মহী অদিতিকে স্তুতি করি ।


 শতপথ ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণেও পৃথিবীকে অদিতি বলা হয়েছে :

"ইয়ং বাহদিতির্মহী।”– এই পৃথিবীই অদিতি। (শঃ ব্রাঃ ৬/৫/১/১০)

ইয়ং হ্যেবাদিতিঃ।”— এই পৃথিবীই অদিতি। (শঃ ব্রাঃ ৩/২/৩/৬)

ইয়ং বৈ দেব্যদিতিবিশ্বরূপী।”– এই বিশ্বরূপী পৃথিবীটাই অদিতি। (তৈঃ ব্রাঃ ১/৭/৬/৬)

 এই মতানুসারে নিঘন্টুকারও লিখেছেন, “অদিতি ইতি পৃথিবী নাম।"


 প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুপ্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীর ফলোৎপাদিকা শক্তিকে নারীদের সন্তান উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে অভিন্ন করে দেখার রীতি পৃথিবীর সর্বত্রই বিদ্যমান। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর 'ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস' গ্রন্থে বলেছেন, “... যে সকল পূর্ব শর্ত নারীকে ফলপ্রসূ করে তা পৃথিবীরূপী মাতৃদেবীকে ফলপ্রসূ করে। এই বিশ্বাসগত ধারণাই উর্বরতা-কেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাসের মৌল ধারণা। এই ধারণা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় কেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মাতৃদেবীগণ মধ্যে মধ্যে রজঃস্বলা হন (ভারতের ক্ষেত্রে যে সকল দেবীর রজঃস্বলা হবার ঘটনা ও তৎসংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান বিশেষ প্রসিদ্ধ তাঁরা হলেন উত্তর ভারতের পার্বতী, কেরলের ভগবতী ও আসামের কামাখ্যা)। প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকে আয়ত্তে আনার জন্য প্রাচীন মানুষ নরনারীর জননাঙ্গের উপর, ওই একই যুক্তিতে, চরম গুরুত্ব আরোপ করেছিল। লিঙ্গ ও যোনি পূজার ব্যাপকতা তারই ফল, মৈথুন কৃষিকর্মের অনুকরণ, পুরুষাঙ্গ ও তার ক্রিয়া যেখানে লাঙ্গল দেবার প্রতীক, নারী-অঙ্গ শস্যোৎপাদিকা ধরিত্রীর সঙ্গে অভিন্ন। লাঙ্গল ও লিঙ্গ একই ধাতুনিষ্পন্ন। তান্ত্রিক যৌনাচারসমূহের আদিম তাৎপর্য এখানেই নিহিত।”



আবার, প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে রক্তবর্ণ উর্বরতার প্রতীক। হয়তো আরো অনেক কিছুই প্রাচীন জাদুবিশ্বাসে উর্বরতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু রক্তরঙের প্রতীকটিকে প্রাচীন মানবগোষ্ঠির বিভিন্ন জাতি ও সমাজে তাৎপর্যময়রূপে উর্বরাশক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় বলে নৃতত্ত্ববিদেরা মনে করেন। কোথাও ডালিম প্রতীকে, কোথাও সিঁদুর প্রতীকে, কোথাও বা অন্যকিছু। রজ-রক্তের সঙ্গে উর্বরতার প্রসঙ্গ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত- তা সে নারীর হোক বা পৃথ্বীর।


 দেবী উপাসনার ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে যে বিশ্বে প্রায় সর্বত্রই মাতৃদেবীভাবনার পূর্বরূপ ছিলেন দেবী পৃথিবী। ভারত ভূখণ্ডে স্ত্রীদেবতাকেন্দ্রিক আদিম ধর্মের উপর যখন বৈদিক ও পৌরাণিক ধর্ম প্রাধান্য লাভ করে, তখন দেবী পৃথিবীর স্বতন্ত্র মহিমাকে সব দিক দিয়ে খর্ব করা হয়। যদিও বেদে তিনি 'হিরণ্যবক্ষা জগতো নিবেষনী' কিংবা যদিও বৈদিক ঋষি পৃথিবীকে মহিমান্বিত করে বলেন 'মাতা ভূমি পুত্রোহং পৃথিব্যা'; তবু মনে রাখতে হবে যে বেদের এই পৃথিবী মাতা সর্বদাই দ্যু পিতার মুখাপেক্ষিণী। দ্যাবাপৃথিবী রূপী যুগলের ভাবনা মিথুনরত নারীপুরুষের মতো যেখানে পুরুষ বীজ বপন করেন ও নারী তা স্বীয় দেহে ধারণ করেন।


 পরবর্তীকালীন পৌরাণিক সাহিত্যে পৃথিবীকে বারংবার অসুরদের হাতে লাঞ্চিত হতে দেখা যায়। কখনও হিরণ্যাক্ষ তাঁকে অপহরণ করে সমুদ্রে নিমজ্জিত করে, কখনও দানবদের অত্যাচারে জর্জরিতা হয়ে তিনি গো মূর্তি ধারণপূর্বক বিষ্ণুর শরণাপন্না হন। তাঁর অভিভাবক ও রক্ষক রূপে দেখা যায় পৌরাণিক ধর্মের প্রধান দেবতা বিষ্ণুকে, যিনি নানান অবতার গ্রহণ করেন পৃথিবীকে উদ্ধার করতে। ধীরে ধীরে  বিষ্ণুর পত্নী রূপে গৃহীতা হন ভূদেবী। তবে বিষ্ণুপত্নী হিসেবে  ভূদেবীর প্রতিষ্ঠা লক্ষ্মীর তুলনায় দ্বিতীয় স্থানে এবং প্রচলিত ভাবনায় শ্রীদেবী ও ভূদেবী উভয়ই পতির চরণাশ্রিতা দাসী। শক্তিমান বিষ্ণুর সঙ্গে ভূ-শ্রী শক্তিদ্বয়ের সম্বন্ধ সংক্রান্ত দার্শনিক তত্ত্ব যাই থাকুক, মূর্তিকল্পনায় তাঁদের দেখা যায় মধ্যস্থ বিষ্ণুমূর্তির পাশ্ববর্তিনী অতিগৌণ ও ক্ষুদ্রাকৃতি দুই পরিচারিকা রূপে। দর্শনশাস্ত্রের প্রসঙ্গেও দেখা যায় যে পঞ্চভূতের সর্বনিম্নে অবস্থিতা পৃথিবী। সাংখ্যের ২৫ তত্ত্ব হোক কিংবা শৈবদর্শনের ৩৬ তত্ত্ব, পৃথিবীর স্থান সবার‌ নিচে।


 প্রাচীন ধর্মে পৃথিবী দেবীকে কেন্দ্র করে যে মাতৃ উপাসনার ধারা সৃষ্টি হয়, তা পুরাণ এবং তন্ত্রে ব্যাপকতা লাভ করে আকার নেয় শাক্ত ধর্মের, যেখানে দেবীই মূল উপাস্যা। কিন্তু পৌরাণিক ও তান্ত্রিক শাক্তধর্মে আদ্যাশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠিতা দেবীদের মধ্যে পৃথিবী নেই। যদিও মাঝে মাঝে বিশ্বময়ী দেবীর ব্যাপ্তি বোঝাতে তাঁকে 'মহীস্বরূপেণ যতঃ স্থিতাসি' বলা হয়েছে, কিন্তু স্বতন্ত্র ভাবে পৃথিবী কোথাও পরাশক্তির পদ লাভ করেন নি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখণ্ডে মূলপ্রকৃতির পঞ্চ প্রধান স্বরূপ দুর্গা, রাধিকা, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও সাবিত্রী। তারপর আসেন প্রকৃতির অংশ রূপা গঙ্গা, তুলসী, ষষ্ঠী, মনসা, মঙ্গলচণ্ডী, কালী এবং বসুন্ধরা। তারপর আসেন কলা দেবীগণ। মূলপ্রকৃতি, পঞ্চপ্রকৃতি, অংশ এবং কলাদের এই বিভাজনে পৃথিবী তৃতীয় শ্রেণীর দেবীদের অন্যতমা। তন্ত্রেও তিনি কোনও মহাবিদ্যা নন।


 আদিমাতৃকা পৃথিবী পরবর্তী কালে সর্বত্রই যেভাবে গৌণীকৃতা হয়েছেন, সেখানে অম্বুবাচী এমন এক সময় যখন দেবী ধরিত্রী প্রকাশিতা হন তাঁর পূর্ণ মহিমায়। পৃথিবীর সঙ্গে শাক্তধর্মের প্রধান উপাস্যা মহাদেবী মহাবিদ্যাগণের যোগ  বছরের এই একটি সময়ে স্পষ্ট হয়। পৃথিবীর ঋতুকালে স্বয়ং বিশ্বময়ী মহাশক্তি রজস্বলা হন। এই সময় তিনি বিষ্ণুপরিচারিকা ভূদেবী, বরাহদন্ত কর্তৃক উদ্ধৃতা অবলা কিংবা তত্ত্বক্রমের সর্বনিম্নস্থ তত্ত্ব নন। স্বয়ং পরাৎপরা পরমাশক্তিই তখন বসুন্ধরাস্বরূপিণী। কালী, দুর্গা, তারা, ত্রিপুরা যেই হোন না কেন, সবাই তখন ঋতুমতী ধরিত্রী। আদিম ধর্মের মাতৃউপাসনা ও তন্ত্রোক্ত মহাবিদ্যাদের এই সংযোগটি তৈরি হয় কামরূপবাসিনী কামাখ্যাকে কেন্দ্র করে। কামরূপ সেই বিশেষ শক্তিপীঠসকলের অন্যতম যা ক্যাননীয় তন্ত্রের মধ্যে সমীকৃত হয়েও নিজের আদিম উপাসনা ধারা অক্ষুণ্ন রেখেছে। পুরাণের মহাদেবী ভাবনা কিংবা তন্ত্রের মহাবিদ্যা উপাসনা যে প্রাকবৈদিক মাতৃ উপাসনারই বিবর্তিত রূপ, তা এখানেই ধরা পড়ে। অম্বুবাচী আমাদের মাতৃকা উপাসক তন্ত্রধর্মের উদযাপন। এই উৎসবে নিহিত আছে আমাদের জলবায়ুর চলন, বর্ষাঋতুর আগমন, কৃষিকাজের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, পৃথিবী মায়ের রজস্বলা হওয়ার চিরন্তন জৈব প্রক্রিয়া এবং সর্বোপরি আমাদের তন্ত্রাশ্রয়ী সভ্যতার জয়যাত্রা।



তথ্যসূত্রঃ-

১.         পূজা পার্বণের উৎসকথা – পল্লব সেনগুপ্ত

২.         মাতৃকাশক্তি ও বাঙালির ভাবজগতে নারী প্রাধান্যের বলিষ্ঠ উপাদান – রণদীপম বসু

৩.         অম্বুবাচী বা চাষীর ছুটি – শ্রীচিন্তাহরণ চক্রবর্তী

৪.         পুরাণকোষ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী...



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন