বই –
মাংস-লতার কৃষ্ণকলি
লেখক – সৈকত
মুখোপাধ্যায়
প্রকাশনী –
দীপ প্রকাশন
প্রকাশকাল –
২০২২
প্রচ্ছদ –
সৌম্যদীপ প্রধান
পৃষ্ঠা -
১৭৫
মুদ্রিত
মূল্য – ₹২৫০
যৌনতা ও মৃত্যু, প্রাণীজীবনের দুটি অমোঘ সত্যের মধ্যকার সম্পর্ক অতি প্রাচীন, বলতে গেলে সভ্যতার একেবারে আদি থেকে বর্তমান | প্রকৃতির খামখেয়ালকে অনুধাবন করতে দেবতাদের অবতারণা এবং তাঁদের সন্তুষ্ট রাখতে বলিপ্রথার প্রচলন থেকেই এই সম্পর্কের সূত্রপাত বলা যায় কারণ মনে করা হত যে বলিদানের মাধ্যমেই এই ধরা হয়ে ওঠে উর্বরা ও ফলপ্রসূ | মরণের মধ্যেই থাকে জননের বীজ |
এত সব ভণিতা এখানে করার কারণ “মাংস-লতার কৃষ্ণকলি”তে মৃত্যু এবং যৌনতার থিমের উপরেই (কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুর সিম্বলিজ়ম হিসেবে যৌনতার থিমের উপরে)বইটির গল্পগুলি রচিত হয়েছে | মোট সাতটি গল্পের এই সংকলনে শেষ বড়গল্পের নামেই বইটির নাম এবং গল্পটিকে বইটির “শো-স্টপার” বললে হয়তো খুব ভুল বলা হবে না | যৌনতা ও মৃত্যুর অবিচ্ছেদ্য যে সম্পর্ক মানবমনে আদিকালেই প্রোথিত হয়েছে তাকে এই গল্পের মতো করে আর অন্য কোনটাতেই পাঠক উপলব্ধি করবেন না |
“উল্কাপাতের মাঠ” বইটির প্রথম গল্প, যেখানে জন্ম, মৃত্যু, যৌনতা সবকিছুই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে | ঈডিপাস কমপ্লেক্স তথা যৌন ঈর্ষার মতো ডার্ক ফ্যান্টাসির উপাদানে গল্পটা বেশ জমজমাটি হয়ে ওঠার আশা জাগিয়েছিল কিন্তু শেষ অবধি জমল না | বরং সবই যেন তালগোল পাকিয়েই শেষ হয়ে গেল, অথচ তালগোল পাকানটা যে চমক বা ধাক্কা পাঠককে দেওয়ার জন্য, সেই চমকটাই পাওয়া গেল না |
“ফেরিওলা”তে আবার মৃত্যু আছে কিন্তু যৌনতার জায়গা নিয়েছে শেকড়ের টান | একটা মানুষ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত, অথচ তবু মরছে না | কিন্তু কোন এক অলীক কারণে পাড়ায় এক ফেরিওলার আগমন হলেই সেই মানুষের মধ্যেও চঞ্চলতা দেখা দেয়, ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে তাঁর মুখ | কেন? ফেরিওলাকে এত ভয়ের কারণ কী? সৌভাগ্যের বিষয়, প্রথম গল্পের মতো এখানে ক্লাইম্যাক্স হতাশ করেনি |
তৃতীয় গল্প “ব্যাং কাটার ক্লাস”এ আবার ফিরে এসেছে যৌনতা ও মৃত্যুর থিম তবে এবারে গল্প মোড় নিয়েছে “বডি হরর”এর দিকে | ব্যাঙের মতো নিরীহ একটা প্রাণীকে যে এরকম বীভৎসরূপ দেওয়া যায় সেটা সাধারণ পাঠকের কল্পনায় আসবে কিনা আমি সন্দিহান | তবে গল্পের অন্য মূল চরিত্র কেয়ার সাইকোপ্যাথিক মনস্তত্ত্বও যে পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই |
“ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন” গল্পটিকে হয়তো এর মাঝে বেমানান মনে হতে পারে কিন্তু এই গল্পের শেষের চমকটা ভয়ংকর রকমের অস্বস্তিকর | মানবমনের অন্ধকার যে শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক মনেই বাসা বাঁধে না, তা যে একটা বাচ্চার মনকেও আক্রান্ত করতে পারে, “ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন” তারই স্বাক্ষরস্বরূপ | তবে এই গল্পেও জন্ম, মৃত্যু, যৌনতার প্রেক্ষাপটেই ঘটেছে যা কিছু ঘটার |
“বেদিয়াটোলার বিদেহী”কে হয়তো এই বইয়ের সবথেকে সাদামাটা গল্প বলা যেতে পারে | যৌন আকর্ষণ ও মৃত্যু এই গল্পের বিষয় হলেও এটা ডার্ক ফ্যান্টাসি নয়, বরং ডার্ক রিয়্যালিটি বলাই বেশি মানানসই | লছমি ও শান্তার মতো মেয়েদের সাথে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনা যে বাস্তবে সবসময়ই ঘটে তা বলার অপেক্ষা রাখে না | এই গল্পে হরর কম, দুঃখ বেশি | প্রকৃতির আশীর্বাদ চরম অভিশাপে পরিণত হওয়ার দুঃখের কাহিনী |
“ওরা জোকারের শিকার”এ লেখক আবার পাঠককে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন যৌনতা, লালসা, মৃত্যুর দুনিয়ায় |আচ্ছা বলুন তো, মৃত্যু ও যৌনতার মেলবন্ধনকে কোন হরর ঘরানায় সবথেকে প্রকটভাবে পাওয়া যায়? ঠিক ধরেছেন! ভ্যামপায়ার হরর, যার পথিকৃৎ হল ব্রাম স্টোকারের “ড্রাকুলা” | সুতরাং, যৌনতা আর মৃত্যুর গন্ধ যেখানে সেখানে রক্তের গন্ধ থাকবে না তা কি হতে পারে? “ওরা জোকারের শিকার”এও এই সুত্র ধরে আবির্ভাব ঘটেছে রক্তওপিপাসু এক “জোকার”এর, যে বয়ঃসন্ধিতে সদ্য পা-দেওয়া ছেলে-মেয়েদের হাতে তুলে দেয় এক অদ্ভুত গান শোনার যন্ত্র, কিন্তু সেই যন্ত্র থেকে গানের বদলে বেরিয়ে আসে কামুক এক কন্ঠস্বর | আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই কন্ঠস্বর শুনতে হয় অবিকল সেই মানুষটির গলার মতো যাকে ঘিরে তাঁদের অবচেতন মনে লুকিয়ে রয়েছে কামবাসনা | কিন্তু তাঁরা জানে না তাঁদের এই ভেজা স্বপ্নপূরণের মূল্য কত ভয়ংকর হতে পারে |
এবারে অবশেষে আসি “মাংস-লতার কৃষ্ণকলি”র অর্থাৎ বইয়ের অন্তিম গল্পের প্রসঙ্গে | এটি মূলত কল্পবিজ্ঞান তথা বায়ো-হররের মিশেল | এর আগে লেখকের “পতঙ্গ সঙ্গম” উপন্যাসে বায়ো-হররে তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয় আগেই পেয়েছি; এবারেও তিনি হতাশ করেননি | তবে এইবারে সাথে-সাথে তিনি পাঠককে নিয়ে গিয়েছেন এমন এক ভবিষ্যতে যেখানে মানুষের জীবন আর পৃথিবীতে আবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে | কিন্তু এই ভবিষ্যত কোন ইউটোপিয়া নয়, বরং এক নৈরাশ্যময় ডিসটোপিয়ার যেখানে এক নির্বান্ধব এবং আপাতদৃষ্টিতে নিষ্প্রাণ গ্রহে পারদের খনিতে মজুরের কাজ করতে বাধ্য হয় হতভাগ্য কিছু মানুষজন; সামান্য ছুটি মেলে না পৃথিবীতে যাওয়ার, এমনকি মেলে না নারীসঙ্গ পর্যন্ত কারণ গ্রহের পরিবেশ তাঁদের বসবাসের অনুকূল নয় | মার্কারিড নামের এই নরকসম গ্রহে হঠাৎই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ চার-চারটি মানুষ | সেই রহস্যের কিনারা করতে মার্কারিডে পাঠানো হয়েছে ইনভেস্টিগেটর সোমক লাহিড়ীকে | কিন্তু বিষয়টার যত গভীরে ঢুকছে সোমক ততই তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে এটা কোন খনি-মজুরদের চক্রান্ত নয়, বরং তার চেয়ে অনেক ভয়ংকর কোন বিভীষিকার ইঙ্গিত | যে বিভীষিকা পাতালের অন্ধকার থেকে ওঠে আসে প্রতি সৌরমার রাত্রে (সৌরমা মার্কারিডের এক বিশেষ দিন, যেদিন মার্কারিডের আকাশের দুটো সূর্যই এক সরলরেখায় অবস্থান করে)| কিন্তু কেমন এই বিভীষিকার প্রকৃতি? সে কি এই গ্রহের কোন আদিম বাসিন্দা? কিন্তু তাই বা কী করে হয়? এই গ্রহের সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদকে তো পৃথিবীর মানুষ কবেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে! কিন্তু সত্যিই কি তাদের আর কোন চিহ্নই নেই? নাকি এতদিন পরে মার্কারিডের অন্ধকারময় অতীতের কালো অভিশাপ মাটি ফুঁড়ে উঠে আসতে চলেছে মানুষের কৃতকর্মের ফল হয়ে? জানতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে “মাংস-লতার কৃষ্ণকলি” |
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন