চিকের আড়াল থেকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে এক নেপথ্যচারিণীঃ বেগম হজরত মহল - সোমা লাই


'গভীর- গভীরতর তবুও জীবন-
নিজেদের দীনাত্মা ব্যক্তির মত মনে ক’রে ওরা
সকলের জন্যে সময়ের
সুন্দর, সীমিত আলো সঞ্চারিত ক’রে দিতে গিয়ে
প্রাণ দিয়েছিল ।
জীবনধারণে, তবু জীবনের আরো বর্ণনীয়
ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে আরো সুস্থ- আরো প্রিয়তর
ধারণায় ইতিহাস:- ইঙ্গিতের আরো স্পষ্টতায়;
তবে তা' উজ্জ্বল হ’লে জীবন তবুও
নিরালোক হয়ে রবে কত দিন?
কত দিন হতে পারে!'
- জীবনানন্দ দাশ ( বহু মৃত বিপ্লবী স্মরণে )



স্বাধীনতা হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। মানুষ স্বাধীনচেতা। ইতিহাস সাক্ষী আছে যখনই মানুষের স্বাধীনতা হরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে তখনই জীবন বাজি থেকে তীব্র প্রতিবাদ করেছে। আমরা আজ এমনই একজন স্বাধীনচেতা মহিয়সীর কথা জানব।

জন্ম সাল : আনুমানিক ১৮২০ সাল
জন্ম স্থান : ফৈজাবাদে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এক দাস পরিবারে জন্ম হয় তাঁর।
পিতা : মীর গুলাম হুসেন।
পারিবারিক নাম : মোহাম্মদি খানম।
স্বামী : ওয়াজেদ আলি শাহ ( অওধের পঞ্চম বাদশাহ )।
পুত্র : রমজান আলি বাহাদুর ওরফে ব্রিজিস কদর সিপাহী বিদ্রোহের সময় লখনৌ-এর নবাব হয়েছিলেন।

হজরত মহলের শৈশব সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায় না। অনেকটা ধোঁয়াশায় ভরা। আর্থিক অনটনের কারণেই কৈশোরে তাঁর পিতা তাঁকে নর্তকী হিসাবে অওধের রাজপরিবারে বিক্রি করে দিয়েছিলেন । অচিরেই অওধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের নজরে পড়েন। অন্দরমহলে তখন তিনি ‘মাহাক পরি’ বা সৌন্দর্যের পরি। ওয়াজিদ আলি শাহের আত্মজীবনীমূলক কবিতা ও চিত্র সঙ্কলন ‘ইশক-নামা’ থেকে জানা যায়, এই ‘কালো মেয়ে’র প্রতি নবাবের বেশ দুর্বলতা ছিল। হজরত মহলের রূপের প্রশংসাও আছে সেখানে! পরবর্তীকালে 'মাহাক পরি' হয়ে উঠলেন নবাবের 'বেগম'।

বেগম হজরত মহল ছিলেন অওধের বাদশা ওয়াজিদ আলি শাহ-র ত্রয়োদশ পত্নী, ইফতিকার-উন-নিসা বেগম হজরত মহল সাহিবা। লখনউর কায়জারবাগের নাগিনা-ওয়ালি বারাহদারিতে তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।

উত্তর ভারতের অওধ সামরিক শক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে তখনও নিজস্বতা হারায়নি। লখনউ ছিল এই রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ সিংহাসনে বসলে অওধও এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছয়। বিশেষত শিল্প ও কলাবিদ্যার চর্চা রাজ্যে বিস্তার লাভ করে। অবশ্য এই সুসময় দীর্ঘ দিন স্থায়ী হয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্বত্ববিলোপ নীতির মাধ্যমে উত্তরাধিকারীহীন রাজাদের হাত থেকে রাজ্যের শাসনভার কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। লর্ড ডালহৌসির নেতৃত্বে ঝাঁসি, উদয়পুর এবং অওধ-সহ প্রায় একুশটি রাজন্যবর্গ-শাসিত রাজ্য দখল করে নেয় কোম্পানি। ব্রিটিশদের দেওয়া সন্ধির শর্ত পছন্দ হয়নি অওধের নবাবের। শর্ত মানতে অস্বীকার করায় ওয়াজিদ আলি শাহ নির্বাসিত হন কলকাতায়। তাঁর স্বপ্নের শহর লখনৌ ছেড়ে গেলেন, পিছনে পড়ে রইলেন অসংখ্য গুণমুগ্ধ প্রজা। নবাবের নির্বাসন যাত্রায় বেগম হজরত মহল সঙ্গী হননি, তিনি লখনউয়েই থেকে গেলেন। শোনা যায়, কলকাতা যাওয়ার আগেই নবাবের সঙ্গে বেগমের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল।

হৃত গৌরব ফিরে পেতে ১৮৫৭ সালের জুন মাসে বেগম হজরত মহল চোদ্দো বছরের শিশুপুত্র বিরজিস কদরকে রাজমুকুট পরিয়ে অওধের নতুন নবাব ঘোষণা করেন।  চিনহাট যুদ্ধের 'বীর' বরকত আহমেদ পাথরওয়ালি-বারাদারিতে ব্রিজিস কদরের মাথায় রাজমুকুট পরিয়েছিলেন। সারা শহরে উড়তে লাগল সবুজ আর গেরুয়া পতাকা। যেহেতু ব্রিজিস কদর নাবালক ছিলেন তাই প্রত‍্যক্ষভাবে রাজ‍্য শাসন করতে পারছিলেন না, তার পরিবর্তে রাজপ্রতিনিধি হলেন মা বেগম হজরত মহল। রাজমাতা হজরত মহল অওধ শাসন করতে লাগলেন।

হজরত মহলকে সাহায্য করার জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছিল। শরাফ-উদ-দৌলা হলেন নায়েব অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। ওয়াজিদ আলি শাহ-র বিশ্বস্ত রাজা বালকৃষ্ণ হলেন অর্থমন্ত্রী। সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হল রাজা জয়লাল সিংহকে। বিদ্রোহী সৈন্যদের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উমরাও সিংহ, রঘুনাথ সিংহ, রাজমুণ্ড তেওয়ারি ও ঘামাণ্ডি সিংহকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখার প্রধান করা হল। রাজা ব্রিজিস কদর মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরকে তাঁর সম্রাট বলে মেনে নিলেন। তীরন্দাজ গুরু বখশ, নবাব আলি খানদের নিয়ে পরিকল্পনায় বসলেন তিন মূর্তি—রাজা জয়লাল সিংহ, মৌলবি আহমদুল্লাহ শাহ ও মাম্মু খান।

বেশ কিছু কাল অতিবাহিত হওয়ার পর হজরত মহল এবং তাঁর সঙ্গীদের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল। রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ তখন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়মে বন্দি। সেইসময় লখনৌ শহরের তিন দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজ অবস্থান করছিল। তিন বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাম্পবেল, জেনারেল ফ্রাঙ্কস ও আউট্রাম। দক্ষিণ দিক দিয়ে ঢুকল জঙ্গবাহাদুর থাপার গোর্খা বাহিনী। নগরী জুড়ে চলছিল যুদ্ধের সাজো সাজো রব। কোম্পানির সৈন্যসংখ্যা ৫৭ হাজার, বিদ্রোহীরা সংখ্যায় ৩৬ হাজার। বেগমের সাথে যোগ দিয়েছিলেন ইংরেজদের ত্রাস বিপ্লবী আহমদুল্লাহ। নানাসাহেবের সঙ্গেও বেগম হাত মেলান।

৩০ জুন ১৮৫৭, লখনউ শহরের অদূরে যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনী বেগম হজরত মহলের সৈন্যদলের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ছিল। লখনৌ ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত, এই ঘোষণা করা হয়। বেগমের অপরিসীম বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের দৃষ্টান্ত তৎকালীন ইউরোপীয়দের নজর এড়ায়নি। উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেল তাঁর বিখ্যাত ‘মাই ইন্ডিয়ান মিউটিনি ডায়েরি’-তে লিখেছেন, ‘‘অভূতপূর্ব শক্তি ও সক্ষমতা প্রদর্শন করেন বেগম। তিনি তাঁর ছেলের রাজ্য রক্ষার স্বার্থকে সর্বজনীন কর্তব্য হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। আমাদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি।’’ বেগমের স্বাধীনচেতা মানসিকতা দিল্লির দরবারের শেষ মুঘল সম্রাটের সম্ভ্রম ও স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল।

প্রাথমিক সাফল্যের পর, বেগম তাঁর পুত্রের নামে একের পর এক ঘোষণা জারি করেছিলেন। ইংরেজদের এই মাটিতে আর ঘাঁটি গাড়তে না দেওয়ার শপথ নিয়েছিলেন। ইংরেজদের নানা ছল-চাতুরি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেমন করে একের পর এক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে, মানুষকে শোষণ করছে, তার অজস্র উদাহরণ তুলে ধরেন সকলের সামনে। সতর্ক করেন, ইংরেজ মরিয়া হয়ে ধর্মীয় আচার-আচরণের উপরেও আঘাত করতে পারে।

১৮৫৭ সালের শেষ দিকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। তালুকদাররা অর্থাভাবে নিজের নিজের এলাকায় চলে গিয়েছিল। যে জায়গাগুলোয় বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, ইংরেজরা সেগুলো দখল করে নিয়েছিল। বিদ্রোহী সেনাদের মনোবল ভেঙে ফেলতে অকথ্য অত্যাচার শুরু করেছিল কোম্পানি। লখনউয়ের কাছে আলমবাগ প্যালেসে জেমস উট্রাম-এর নেতৃত্বে ইংরেজদের একটা ছোট দল ঘাঁটি তৈরি করেছিল। বহু বার আক্রমণ চালিয়েও সেই ঘাঁটি ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়নি। অন্য দিকে সিপাহি বিদ্রোহকে দমন করতে লর্ড ক্যানিং কৌশলী চাল চালতে শুরু করেন। ওইদিকে কলিন ক্যাম্পবেল উন্নত সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অওধ আক্রমণ করেছিল। এমন অবস্থায় বিদ্রোহীদের কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল। বেগম হাতির পিঠে চেপে সামনে থেকে লড়াই চালিয়ে যান। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। বেগম কোঠির ভয়াবহ যুদ্ধের তিন চার দিন পর হজরত মহল ও তাঁর পুত্র রাজা ব্রিজিস কদর কায়জারবাগ ত‍্যাগ করেছিলেন। তাঁরা প্রথমে গিয়েছিলেন উজির শরাফ-উদ-দৌলার বাড়ি। সেখানে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন হুসাইনাবাদের দৌলতখানায়। ঐদিকে পুরো লখনৌ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কবজায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু তখনও বেগম ও তাঁর পুত্র যে অধরা! সেইজন‍্য ব্রিটিশরা তাঁদের হন‍্যে খুঁজে বেড়াচ্ছিল । অবশেষে হুলিয়া জারি করা হয়েছিল, বেগম ও তাঁর পুত্র যদি আত্মসমর্পণ করেন তবে তাঁদের সঙ্গে সম্মানজনক সন্ধি স্থাপন করা হবে। ঠিক তার পরদিনই বড় ইমামবাড়ার মুসাফিরখানা বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল ফিরিঙ্গিরা। হজরত আব্বাসের দরগা থেকে ফেরার সময় উজির শরাফ-উদ-দৌলাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। রাজা জয়লালকে হত্যা করা হয়েছিল। হাজার হাজার বিদ্রোহীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল কোম্পানির ব্রিটিশ ফৌজ।

শেষ পযর্ন্ত বেগম হজরত মহল যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। বাধ‍্য হয়েছিলেন দেশ ছাড়তে। চাইলেই তিনি কোম্পানির শর্ত মেনে নিয়ে নবাবের মতো পেনশনভোগী হয়ে ভবিষ্যৎ জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। পরাধীন ভাবে জীবন কাটাতে চান নি বলেই, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পুত্রের সাথে নেপালে পাড়ি দেন, সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর, আর ছিলেন মাম্মু জান - দুর্দিনের বন্ধু ও আপনজন। সেখানে তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিলেন নেপালের রাজা জঙ্গবাহাদুর রাণা। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই জঙ্গবাহাদুর রাণা হজরত মহলের বাহিনীকে দমন করার জন‍্য ইংরেজদের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। তা সত্ত্বেও রাণা শরণার্থী হিসাবে আগত হজরত মহলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বেগমের বাকি জীবনটা সেইখানেই কাটে। সেইখানে তিনি পুত্র ব্রিজিসের বিবাহ দেন, পাত্রী ছিলেন মাহতাব আরা মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরের নাতনি!

মৃত্যু এত অতি বড় সত‍্য ঘটনা যা আমরা বার বার অস্বীকার করি। কিন্তু কালের নিয়মে সকলকে ইহলোক ত‍্যাগ করতে হয়। বেগমও তার ব‍্যাতিক্রম ছিলেন না। ৭ ই এপ্রিল ১৮৭৯ সালে তিনি গত হন। বেগমের নিজের হাতে গড়া জামে মসজিদ চত্বরেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীকালে ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় প্রয়াত হলে হজরত মহল ও ওয়াজিদ আলির পুত্র ব্রিজিস কদর কলকাতায় আসেন।

বেগমের সমাধি 

১৯৮৪ সালের ১০ই মে ভারত সরকার তাঁর সম্মানে ডাকটিকিট প্রকাশ করে


আরও কিছু তথ‍্যঃ

◆ স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে পরিবারের সদস্যদের দাবিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নির্দেশে এক অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয় এবং তাঁর স্মৃতিসৌধ খুঁজে বার করা হয় ।

◆ লখনৌ-এর একটি উদ্যানের নামকরণ করা হয়েছে বেগমের নামে।

◆ সংখ্যালঘু মেয়েদের পড়াশোনায় উৎসাহ দিতে কেন্দ্রীয় সরকার চালু করেছে বৃত্তি - ‘বেগম হজরত মহল ন্যাশনাল স্কলারশিপ’।

◆ বেগমের বংশধর তালাত ফাতিমা একজন রাজনৈতিক কর্মী, পাশাপাশি দুঃস্থ ও দরিদ্র মানুষদের জন্য বেগমের অবদান নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন।

◆ পরিবারের আর এক সদস্য মাঞ্জিলাত ফাতিমা কয়েক বছর ধরে আয়োজন করছেন আলোচনাসভার।

◆ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে মেটিয়াবুরুজ সিবতানাবাদ ইমামবাড়াতেও আলোচনা হবে বেগমের জীবনের নানা দিক নিয়ে।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন