প্রথমবার গর্ভধারণের সময় থেকে প্রসবকাল এবং তার পরবর্তী সময়ে নতুন মায়েদের মনে নানাবিধ প্রশ্ন তৈরী হতে থাকে। প্রাথমিকভাবে তা থাকে তার সন্তানকে কেন্দ্র করে এবং দ্বিতীয়ত তার নানান শারীরিক পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে। গর্ভাবস্থা এবং প্রসবপরবর্তী সময়ে হরমোনের ওঠানামা একজন নারীর শরীরে নানারকম প্রভাব ফেলে। এর ফলস্বরূপ স্বাভাবিক সময়ের বদলে ঋতুস্রাব শুরু হতে পারে একটি নির্দিষ্ট সময় পর, যে সময়টি আবার এক একজনের ক্ষেত্রে হতে পারে আলাদা আলাদা।
প্রথমেই একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা জেনে রাখা জরুরী। প্রসবের ঠিক পরেই নতুন মায়েদের যোনিগত যে রক্তপাত হয় তা কিন্তু চিরাচরিত মাসিক বা পিরিয়ড নয়। এর নাম লোচিয়া। গর্ভাবস্থাকালে জরায়ুর লাইনিং মোটা হয়, তবেই সে সন্তানকে ধরে রাখতে পারে। প্রসব হয়ে যাওয়ার পর জরায়ুর দেওয়াল থেকে এই অতিরিক্ত লাইনিং খসে পড়তে থাকে যা রক্তের সাথে যোনি দিয়ে শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসে। এই জন্য লোচিয়ার মধ্যে সাধারণ ঋতুস্রাবের তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণ রক্তের সঙ্গে অনেক ক্লটও বেরোয় এবং রং গাঢ় হয়। যত দিন যেতে থাকে, রক্তপাতের পরিমাণ কমতে থাকে এবং রং হালকা হয়ে যায়। ঘন লাল বা কালচে লাল ধীরে ধীরে গোলাপি এবং শেষ পর্যায়ে সাদাটে ও স্বচ্ছ বর্ণ ধারণ করে। এসময় তলপেটে ঋতুস্রাবের মতোই ব্যথা হতে পারে, কারণ জরায়ুর সংকোচন শুরু হয়ে যায়। শরীরের ওপর ভিত্তি করে এই লোচিয়া ২৪-৩৬ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। অর্থাৎ যোনিগত রক্তপাত হলেও লোচিয়া ও সাধারণ মাসিক সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রসবের পর স্বাভাবিক মাসিক শুরু হওয়ার জন্য ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের গড় সময়কাল স্বাভাবিক। শিশু একেবারেই ব্রেস্টমিল্ক না খেলে তার মায়ের ঋতুচক্র শীঘ্রই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিংয়ের ক্ষেত্রে সময়টা বদলে যায়। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে যতদিন শিশুকে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিড করানো হলো ততদিন মায়ের মাসিকই হল না। তবে বাচ্চা ব্রেস্টমিল্ক ও অন্য খাবার মিলিয়ে মিশিয়ে খেলে প্রসবের পরে মোটামুটি কয়েকমাস পরেই ঋতুস্রাব শুরু হয়ে যায়। এর একটি কারণ রয়েছে। ব্রেস্টমিল্ক তৈরি করার প্রোল্যাকটিন নামক হরমোনটি জননে জড়িত হরমোন বা রিপ্রোডাট্কিভ হরমোনগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলস্বরূপ নতুন মায়ের শরীরে পুনরায় ওভ্যুলেশন বা ডিম্বস্ফোটন শুরু হয় না। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঋতুস্রাব শুরু হয় না।
যোনিপথে সন্তান প্রসব করা হলে প্রসবোত্তর ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে একজন নতুন মায়ের প্রথম মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সি-সেকশনের ক্ষেত্রে এটি কিছু বেশি সময় অর্থাৎ ১০ থেকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে যে কোনও সময় হতে পারে। এসময়ে মাসিক সাধারণ মাসিকের তুলনায় খানিকটা অন্যরকম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সন্তান জন্মদানের পর বেশ কয়েকমাস ধরে এটি অনিয়মিত হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। শরীর তার নতুন হরমোনের মাত্রার সাথে সামঞ্জস্য তৈরি করতে কিছুটা সময় নেয়। প্রসবের পরে সময়মত মাসিকচক্র ফিরে আসার ঘটনাটি এক একজন মেয়ের ক্ষেত্রে এক একরকম হতে পারে। প্রসবোত্তর রক্তপাত সাধারণত স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সময় স্থায়ী হয় এবং এটি ভারী বা হালকা হয়।
প্রসব পরবর্তী ঋতুস্রাব অন্যান্য সময় হওয়া ঋতুস্রাবের ক্ষেত্রে খানিকটা আলাদা হতে পারে। পূর্বে হওয়া ঋতুস্রাবের তুলনায় বেশি ব্যথা, তলপেটে টান, অনিয়মিত রক্তপাত,
প্রত্যেক মাসে নির্দিষ্ট দিনের পরিবর্তে অন্য দিনে
হওয়া এসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে পেটে ব্যথা বা বেশি
রক্তপাত নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ধীরে ধীরে এই ব্যথা কম হতে থাকে এবং পরবর্তী
কয়েক মাসের মধ্যেই আবার আগের মতো মাসিক হতে শুরু করে। অনেকসময় দেখা যায়, গর্ভবতী হওয়ার আগে যেসব
মেয়েদের এন্ডমেটরিওসিসের মতো সমস্যা ছিল, প্রসবের পর তাদের রক্তপাতের পরিমাণ কমে যায়। শারীরিক
কোনও সমস্যা বা পিটুইটারি গ্রন্থি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মাসিকে প্রভাব পড়ে। সেক্ষেত্রে
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া একান্ত জরুরী।
প্রসবের পর প্রথম মাসিক বুকের দুধ সরবরাহকে প্রভাবিত করতে পারে। ঋতুস্রাবের সময় আমাদের শরীর রক্ত এবং টিস্যু ধারণকারী জরায়ুর আস্তরণটি ফেলে দেয়। এই প্রক্রিয়াটি হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয় যা দুধের উৎপাদন হ্রাস করতে পারে এবং এর ফলে শিশুর আচরণে কিছুটা পরিবর্তন হলেও হতে পারে। এর কারণ ব্রেস্টমিল্কের পরিমাণ একটু কমে গেলে বা ব্রেস্টমিল্ক গঠনগতভাবে ও স্বাদগতভাবে কিছুটা বদলে গেলে শিশু দুধের পরিমাণ হ্রাস হওয়া এবং স্বাদবদলটা বুঝে ফেলে এবং কিছুদিন একটু অদ্ভুত আচরণ করে। এই যেমন খেতে চাইল না কিংবা বেশি বা কম খেলো। তবে সব শিশু এই স্বাদবদলের ব্যাপারটা বুঝতে পারে না, আর যারা পারে তারা দু’দিন পরেই আবার নিজের খাওয়ার ছন্দে ফিরে আসে।
পরিশেষে কয়েকটি কথা মনে রাখা দরকার। প্রসব পরবর্তী মাসিকের ক্ষেত্রে যদি দু'ঘন্টা ধরে এমন ব্লিডিং হয় যে ঘণ্টাখানেক পরপর একটার বেশি প্যাড বদলাতে হচ্ছে, সঙ্গে অসহ্য ব্যথা এবং খুব জ্বর, গল্ফ বলের চেয়েও আকারে বড় ক্লট বার হয়ে আসছে –এগুলির মধ্যে যেকোনো একটি লক্ষণ দেখলেও দেরি না করে সত্বর চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। নতুন মাকে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র সন্তানের খেয়াল রাখলেই চলবে না। নিজে সুস্থ থাকলে তবেই সে সন্তানের খেয়াল রাখার জন্য সক্ষম হতে পারবে। শরীরের যেকোনো কিছুর ছন্দপতন লক্ষ্য করলে নির্দ্বিধায় চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করতে হবে। নিজে সতর্ক থেকে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলে একজন নতুন মা নিজেকে এবং তার সন্তানকে রাখতে পারবে সুস্থ ও সুরক্ষিত।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন