দুর্গা ভোগের বৈচিত্র - বাণী মিত্র


        যে আমাকে দু’বেলা খেতে দেবে

সে আমার কাছে মা দুর্গা।

আজ শরৎভোরে মনে হয়

সিংহে চড়ে এসে সে আমাকে খেতে দেয়।

সিংহ বসে থাকে দোরের বাইরে––

তার কেশরের মতো আশ্বিনের রোদ্দুরের মধ্যে।

মা আমাকে শিউলি পাতার বড়া আর

মৌরলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত দেন।...”

                     - শরৎ, মণীন্দ্র গুপ্ত


দুর্গোৎসব আসন্ন। আর মাত্র ক’দিন পরেই এক বছরের প্রতীক্ষার অবসানে বঙ্গজীবনের সব থেকে বড় উৎসবের সূচনা হবে। সারাবছর শুধু পুজোর অপেক্ষাই থাকে না। তার সাথে অপেক্ষা থাকে মাতৃভোগেরও। দুর্গার্চনায় ভোগের গুরুত্ব অপরিসীম। মাতৃ ভোগের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয় হয়। পুজোর সময় ছাড়া যতই যত্ন নিয়ে ভোগ রান্না করা হোক না কেন পুজোর সময়ের স্বাদ বা গন্ধ পাওয়া যায় না।

ভোগ শব্দের অর্থ হল, ‘আনন্দ বা তৃপ্তি’। ঐতিহাসিক ব্যাখায় শরৎ ও বসন্ত দুই ঋতুতে দেবী শাকম্ভরী ও মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো ছিল বিধিবদ্ধ। ফলতঃ একে অনেকেই বাঙালির নবান্ন বা নতুন ফসলের উৎসব মনে করেন। এই কারণেই ভোগ দুর্গাপুজোয় এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। নদীমাতৃক বাংলার সুজলাসুফলা শস্যশ্যামলা প্রকৃতির কারণেই সম্ভবত দেবীর ভোগে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। দেবী দুর্গা শস্যদেবী, তাই আজও তাঁর ভোগে থাকে সমকালীন শস্য, শাকসবজি ও ফলের সম্ভার। বহু প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালির দুর্গাপুজোর বৈশিষ্ট্য হয়ে থেকেছে ভোগের বৈচিত্র্য। পুরাতন বনেদি বাড়ির ভোগ ইতিহাস বিচারে ভোগের বেশ কয়েকটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়, যথা নিরামিষ শস্যপ্রধান ভোগ, আমিষ ভোগ, শীতল, মিষ্টান্ন ও পান্তাপ্রসাদ।

দুর্গাপুজোর সূচনাকালে ধনী বনেদী পরিবারেই পুজো সীমাবদ্ধ ছিল। পারিবারিক নিয়মানুসারেই সেই সময় পুজো হত। সাথে হত পারিবারিক রীতি অনুযায়ী ভোগ নিবেদন। পরবর্তী সময়ে বারোয়ারী পুজো প্রচলন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন পুজোতেও অঞ্চলভিত্তিক বা নিজস্ব রীতিনীতি অনুসারে ভোগের প্রচলন হয়। বর্তমানকালে সেই সমস্ত রীতি ও নিয়ম বজায় রেখেই পুজোর্চনার সময় প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রেখে ভোগ নিবেদন করা হয়। সেই সমস্ত রীতি নিয়মের থেকেই পুজোর ভোগের ক্ষেত্রে বহুরকমের লৌকিক কাহিনী প্রচলিত হয়। ভোগ রান্নার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা হয়। সাধারণত, গুরুর দীক্ষাধারী সধবা ব্রাহ্মণ পুত্রসন্তানের জননী নারীই একমাত্র ভোগ রান্নার অধিকার পান। এছাড়া উপবীত ধারণ করা প্রাপ্তবয়স্ক ব্রাহ্মণ দীক্ষাধারী পুরুষও ভোগ রান্না করতে পারেন। এছাড়া বনেদী পরিবারের নিজস্ব প্রথা অনুযায়ীও রান্না করার বিধান রয়েছে।

পুজোর চারদিনই ভোগ নিবেদনের প্রথা প্রচলিত। সাবেককালে পুজোর দিনগুলোতে আশেপাশের গ্রামের জমিদারবাড়ি বা রাজবাড়িতে দুবেলা প্রজারা খাবার খেতেন। শাক্তবাড়িতে সপ্তমীর ভোগে মাছ আর নবমীর ভোগে মাংস দেওয়ার চল ছিল। পূর্ববাংলায় বোয়াল আর পশ্চিমবাংলায় রুইমাছ দেওয়ার রীতি ছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গে ষষ্টি, সপ্তমী, অষ্টমী তিনদিনই নিরামিষ খাওয়ার রীতি প্রচলিত। ভোগ আমিষ বা নিরামিষ যাই হোক না কেন, বাংলার কোথাও আমিষে পেঁয়াজ-রসুন দেওয়ার চল ছিল না। চল ছিল না ভোগে ধনেপাতা দেওয়ারও।

মা দুর্গার ভোগ 

ব্রাহ্মণবাড়িতে অন্নভোগ দেওয়ার চল ছিল, কিন্তু কায়স্থবাড়ির ভোগে লুচি দেওয়া হত। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায় ব্রাহ্মণবাড়ির ভোগে ভাত, পাঁচ তরকারি, দই, পায়েস ইত‍্যাদিনিবেদিত হত। ওপার বাংলার কায়স্থ পরিবারে অবশ‍্য অন্নভোগ দেওয়ার রীতি ছিল, তারাই যখন দেশভাগের পর এপারে এসেছেন সেই রীতি বজায় রেখেছেন। ভোগের রান্নায় নুন দেওয়ার চল ছিল না, নতুবা সেই রান্নাকে উচ্ছিষ্ট বলে গণ‍্য করা হত। এখনও পুজোর ভোগে সাধারণ নুন দেওয়া হয়না।

ঘি ভাত 

সাবেকি পুজোর ভোগের অনেক রান্নাই আজ বিলুপ্তির পথে। যেমন ‘ঘি-ভাত’। এটি কিন্তু কখনই পোলাও নয়। বর্ধমান জেলার বিখ‍্যাত গোবিন্দভোগ চালকে গাওয়া ঘিতে ভেজে ভাত রান্না করা হত। তাতে পড়ত কিশমিশ, তেজপাতা, কাজুবাদাম। এমনই আরেকটি হারিয়ে যাওয়া পদ হল আমআদা দিয়ে সোনার মুগের ডাল। অষ্টমীর সন্ধ‍্যায় লুচির সাথে বৃন্তসুদ্ধ বেগুনের ওপর ঝাল-ঝাল সাদা সরষে এবং মিষ্টি-মিষ্টি নারকোল কোরার পরত মাখানো ‘বেগুন বাসন্তী’ ছিল অপরিহার্য। এছাড়া দেওয়া হত ‘মোচার ঘন্ট’, যার উপাদেয়তার কথা মহেন্দ্রনাথ নিজেই বর্ণনা করে গেছেন।

ভোগে মোচার ঘন্টের প্রচলন এখনও কোথাও কোথাও থাকলেও অনেক পদই হারিয়ে গিয়েছে। এঁচোড়ের কোপ্তা, ডুমুরের কোপ্তা, পানিকচুর সবুজ লতি, পেঁপের ডালনা, আলু-কাঁচকলা-পটলের হলুদ ছাড়া সাদা ডালনা আর ছানার ডালনা ছাড়া পুজোর ভোগ কল্পনা করা যেত না। এরমধ্যে প্রথম দু’টির চল প্রায় বিলুপ্ত। তাজা গরুর দুধকে পাতিলেবু দিয়ে ছানা কাটিয়ে, বিশুদ্ধ ঘিয়ে গোলাকৃতি বড়া ভেজে, তার সাথে ডুমো-ডুমো আলু, গরমমশলা, আদা জিরেবাটা দিয়ে ফুটিয়ে মিষ্টি-মিষ্টি ছানার ডালনা তৈরি করা হত।

মায়ের ভোগে পিঠে পুলি
অষ্টমীর মিষ্টিতে দেওয়া হত হরেক রকম ভাজা পিঠে যেমন মুগসামালী, গুড়পিঠে, চন্দ্রপুলি প্রভৃতি। রসবড়া, লবঙ্গলতিকা, নারকোল ও তিলের নাড়ু, মুড়ি ও চিঁড়ের মোয়ার মত পরিচিত মিষ্টির সাথে সাথেই থাকত আগা-তোলা মন্ডা বা দুর্গামন্ডা প্রভৃতি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। কাঠের বারকোশের উপর সাজানো এই মন্ডার ওজন হত প্রায় দেড় মণ।

ভোগের নিরামিষ মাংস 

নবমীতে পাঁঠাবলির চল ছিল। সেই বলির মাংসকে পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া শুধুমাত্র লঙ্কা-আদা-জিরে বাটা দিয়ে নিরামিষ মতে রাঁধা মাংসের পদটি নিরামিষ মাংস নামে পরিচিত। গোটা বাংলাতেই শাক্তবাড়ির ভোগে এটি অপরিহার্য ছিল। বর্তমানে বলিপ্রথা লুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে নিরামিষ মাংস রান্নার চলও প্রায় লুপ্ত হয়েছে।

দশমীতে পাবনা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে পুজোবাড়িতে পান্তাভাত, জোড়া ইলিশের নিবেদনের রীতি ছিল। সাথে সামান্য আখের গুড় আর তেঁতুলের ক্বাথ দিয়ে বানানো পদ্মের নালের টক দেওয়া হয়। জোড়া ইলিশ আর পান্তা অবশ‍্য চব্বিশ পরগণা আর নদীয়ার পুরোনো সাবেকি বাড়ির পুজোতেও দেওয়া হয়। খুলনা এবং বিক্রমপুরে হয় শাপলা ফুলের নালের টক। আবার এপার বাংলার বর্ধমান বা কৃষ্ণনগরের মতো পুরনো জায়গায় পুজোতে মৌরলা মাছের টক খাওয়ার প্রথা আছে।

পশ্চিমবঙ্গের নদী-পুকুরে পাওয়া যায় এমন মাছ সহ নানারকম আমিষ ভোগ, দেবীর গুরুপাক খাবার খাওয়ার পর শীতলের ব্যবস্থা যেমন, ক্ষীর ডাব পান বা আমলকি, তারই সঙ্গে দশমীর দিন পান্তা প্রসাদ। পান্তাভাত ইলিশমাছ ভাজা কচুর লতি আর বাসি তেঁতুল/আমসির চাটনি, কখনও বা মাছের মাথার অম্বল। দশমীর এই ভোগ বিশেষ অর্থ বহন করে। প্রথমত, সামাজিকভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বামী বা শ্বশুরালয় আদরণীয় বা সম্মানীয়। তাই বাপের বাড়ি থেকে ফিরে মেয়ে বাপের বাড়ির গুণগান করবে না আবার মিথ্যাও বলবে না। তাই ফেরার দিনে মাকে এই খাবার খাওয়ানো। যা খেয়ে মা ফিরে বলবেন এই তো পান্তা আর কচুর শাক খেয়ে এলাম। এতে হরবোলা স্বামীর মানও থাকবে আর মায়ের বিনম্রতাও বজায় থাকবে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়, যাত্রাপথে যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তাই মাকে (ঘরের মেয়েকে) হালকা খাবার খাইয়ে পাঠানো হয়।

ভোগের প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই মনে পড়ে খিচুড়ি ভোগের কথা। সাধারণত অন্যান্য সব পুজোর মতই দুর্গাপুজোতে ভোগ হিসাবে খিচুড়ি ভোগ নিবেদন করা হয়। কথিত আছে মুগ ডালের খিচুড়ি ও ক্ষীর মা দুর্গার অন্যতম পছন্দের খাবার। তাই ভোগে এই দুই পদের প্রচলনই সবথেকে বেশী। খিচুড়ির সাথে সাত বা নয় প্রকারের ভাজা, তরকারি এসবও নিবেদিত হয়।

পুজোর ক’দিন রোজ খিচুড়ি তৈরি হয় বেলুড় মঠে। শংকরের ‘বাঙালির খাওয়াদাওয়া’-য় উল্লেখ রয়েছে, রোজ জাহাজ-সাইজ়ের কড়াইয়ে কয়েক কুইন্টাল খিচুড়ি তৈরি হয়।

খিচুড়ি ভোগ 

কলকাতার আদিতে গেলে, সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বড়িশার আটচালার বাড়িতে ১৬১০ সাল থেকে শুরু হওয়া দুর্গাপুজোর সপ্তমীর ভোগে থাকে খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, আলুর দম, ফুলকপির তরকারি, দু’রকম মাছ, চাটনি, পাঁপড় ইত্যাদি। আর সন্ধিপুজো শুরুর সময়ে শুকনো তালপাতা, নারকেল পাতার আগুনে খিচুড়ি রান্না হয় মাটির সরায়। খিচুড়ি হয়ে গেলে সেই আঁচেই ল্যাটা মাছ পোড়ানো হয়। সন্ধি পুজোয় এই খিচুড়ি ও ল্যাটা মাছ ভোগ দেওয়া হয় মাকে।

চালতাবাগানের কাছে ভট্টাচার্য বাড়ির পুজোয় হয় পোলাওয়ের মত ঝরঝরে ভুনি খিচুড়ি। গোবিন্দভোগ চাল ও মুগের ডাল দিয়ে তৈরি হয় এই খিচুড়ি।

দর্জিপাড়া মিত্রবাড়ির পুজোয় মায়ের ভোগে খিচুড়ি, চচ্চড়ি সবই নিবেদন করা হয়, না রেঁধে। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো পুজোতে কায়স্থ বাড়ির পুজো হওয়ার কারণে অন্নভোগ রেঁধে দিতে পারেন না। কিন্তু ভোগের সব উপাদান কাঁচা অবস্থায় নৈবেদ্যর মাধ্যমে মাকে দেওয়া হয়। এর সাথে সারা বছর ধরে আম, কুল, তেঁতুলের আচার, বড়ি তৈরি করেও নিবেদন করা হয়।

 কদলী পায়েসান্ন

শিবপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের ভোগের বিশেষ ব্যঞ্জন হল কদলী পায়েসান্ন। কলার বড়া ও নারকোলের সমন্বয়ে তৈরি এই পায়েস কয়েক যুগ ধরে মায়ের ভোগে নিবেদিত হয়ে আসছে।

১৯২ বছরের পুরানো ভবানীপুরের গিরিশ ভবনের দুর্গাপুজোর ভোগে ছানার কালিয়া নিবেদন করার প্রথা আজও অব্যাহত। বাড়ির কূলদেবী অষ্টধাতুর জগদ্ধাত্রীর মন্ত্রে দীক্ষিত বাড়ির কন্যা বা বধূ ভোগ রান্নার অধিকার পান।

পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী মহাষষ্ঠীর দিন সিংহ মজুমদার বংশের প্রবীণতম সদস্য দেবীপূজার সূচনা করেন। সেদিন গাজি পিরের দরগায় শিরনি দেওয়া হয়। পিরের দরগায় শিরনি দেওয়ার মাধ্যমেই দেবীর পুজো শুরু হয়। তারপর হয় দেবী দুর্গার বোধন। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে গাজিপুরের দুর্গাপুজো হয়ে উঠেছে হিন্দু-মুসলমান মিলনের এক মহোৎসব।

 ভেটকির নিরামিষ ঘণ্ট

১৮৬০-এ রামচন্দ্র চ্যাটার্জি শুরু করেন চোরবাগান চ্যাটার্জি বাড়ির পুজো। সপ্তমী থেকে নবমী তিন দিন বিভিন্ন রকম ভোগের আয়োজন করা হয় এখানে। সপ্তমীতে প্রথম পুজোয় খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, মাছ, অম্বল, পায়েস সহযোগে ভোগ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পুজোয় দেওয়া হয় অন্নভোগ। সঙ্গে পাঁচ ভাজা, পটল বা ফুলকপির কালিয়া, বাঁধাকপি, পোনা মাছের কালিয়া, আমের চাটনি, বাড়িতে তৈরি বোঁদে ও ল্যাংচা। এর সাথে নিবেদিত হয় এই বাড়ির বিশেষ পদ ‘নিরামিষ চিংড়ি-মালাইকারি’ ও ‘ভেটকি মাছের নিরামিষ ঘণ্ট।’

বালুশাহি

জোড়াসাঁকো শিবকৃষ্ণ দাঁ-বাড়িতে নারকেল ছাপ, চন্দ্রপুলি, বিভিন্ন ক্ষীরের মিষ্টি, রাবড়ি থাকে ভোগে। মা, তাঁর ছেলেমেয়ে, বাহনদের রোজ ৮টি করে আর সন্ধিপুজোয় ১৬টি করে সব রকমের মিষ্টি দেওয়া হয়। এই বাড়ির মিষ্টিভোগের অন্যতম হল ‘বালুসাহি’। প্রথামাফিক অষ্টমী ভোগে নিবেদিত হয় ‘মাখা সন্দেশ’।

পেরাকির পায়েস

জানবাজারের রাণী রাসমণির বাড়ির পুজোতে অন্নভোগ দেওয়া হয় না। ভোগে ঘিয়ে ভাজা লুচির সাথে থাকে বিভিন্ন প্রকারের ভাজা, ক্ষীর, পায়েস, খাজা, জিভে গজা প্রভৃতি মিষ্টি। তবে এই বাড়ির বিশেষ মিষ্টি হল ‘পেরাকির পায়েস’।

পকান্ন

১৭৫৭ সাল থেকে চলে আসা কলকাতার বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোতে মাকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয় না। থাকে বিপুল মিষ্টির প্রসাদ। খাস্তা কচুরি, সিঙ্গারার সাথে নিবেদিত হয় বিশেষ পদ ‘পদ্মলুচি’ ও ‘পকান্ন’।

রাজেশ্বরী

২৯০ বছরের প্রাচীন শেওড়াফুলি রাজবাড়ির দেবী সর্বমঙ্গলাকে ভোগে গুর, নারকোল, খোয়া ক্ষীর সহযোগে নির্মিত ‘রাজেশ্বরী’ নিবেদন করা হয়।


বহু বছর আগেকার কথা। শোনা যায়, গ্রামে তখন চরম অন্নাভাব। তার মধ্যেই স্বপ্নে দেখা দেন দুর্গা। নিদান দেন, থোড়ের ভোগ দিতে। দেবীর দয়ায় হাল ফেলে গ্রামেরও। সেই থেকে মন্তেশ্বরের কুসুমগ্রাম পঞ্চায়েতের সিংহালি গ্রামের ‘বুড়োমা’ অর্থাৎ দেবী দুর্গাকে পুজোয় থোড়ের ভোগ দেওয়াটাই রেওয়াজ।

কারকুনবাটির মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজোয় ভোগপ্রসাদে নিবেদন করা হয় আটার নাড়ু।
আটার নাড়ু

হুগলি জেলার কারকুনবাটির মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো প্রায় ২৫০ বছর পুরনো। প্রাচীন খড়ের চালের ঠাকুরদালান এখন পাকা হয়েছে। প্রতি বছর পুজো উপলক্ষে পরিবারের প্রায় ৭০-৮০ জন মানুষ গ্রামে একত্রিত হোন। এই পরিবারের পুজোর সময়ে ভোগের থালায় বাড়িতে বানানো রকমারি মণ্ডামিঠাই পরিবেশন করা হয়। তবে ভোগের থালায় সকলের নজর থাকে আটা দিয়ে তৈরি বিশেষ নাড়ুর উপরে। দেবী দুর্গার নৈবেদ্যর থালায় পরিবেশন করা হয় এই নাড়ু।

নারকোলের তক্তি 

ইতিহাসের এক চরিত্র প্রতাপাদিত্য। তিনি ছিলেন বারো ভুঁইয়ার এক জন। তাঁর এক সভাসদ ছিলেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৬০৬ সালে তিনি বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। তাঁদের বাড়ির পুজো বর্তমানে হয় উত্তর চব্বিশ পরগনার ইতিনা অঞ্চলে। এই বাড়ির পুজোর ভোগে বিশেষ চমক হল নারকেলের তক্তি। এই তক্তির আকারেও থাকে চমক। সাধারণ ফুল, পাতার ছাঁচে ফেলে ভোগের তক্তি তৈরি হয় না। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বিশেষ নকশার ছাঁচ তৈরি করেছিলেন কারিগরেরা। বন্দেমাতরম, ভারত মাতা, চরকা ইত্যাদির কাঠের ছাঁচেই তৈরি হত পুজোর তক্তি।

৩৬৩ বছরের প্রাচীন রঘুনাথগঞ্জের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পুজোতে দেবীকে মুসলিম পরিবারে তৈরি ভোগ উৎসর্গ করার পর দেবীকে দেওয়া হয় অন্যদের তৈরি ভোগ। প্রাচীন আমলে জঙ্গলে ঘেরা রঘুনাথগঞ্জে জঙ্গলের ভিতর ডাকাতদের দ্বারা পূজিত দেবীকে জমিদার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করার পরে পুজো করা হলেও দেবী তুষ্ট হন নি। তাঁর স্বপ্নাদেশে বহুরা গ্রামে বাসকারী একমাত্র মুসলিম মহিলা ‘লোকার মা’ জঙ্গল থেকে কোদার চাল কুড়িয়ে এনে নাড়ু তৈরি করে দেবীর পুজো দেন। সেই রীতি মেনে প্রতিবছর কোনও মুসলিম পরিবারের দেওয়া ভোগ প্রথমে দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। তারপর অন্যরা ভোগ দেন। কোদার চাল থেকেই এই পুজো ‘কোদা খাকি দুর্গা’ নামে পরিচিত। ডাকাতদের প্রচলিত পুজো মেনে এই পুজোতে আরতি ও পুষ্পাঞ্জলী নেই। যদিও পাঁঠাবলি আজও হয়। আজও দেবীর ভোগে অন্যতম খোদার ভোগ থাকে। প্রতিবছর বাংলাদেশ কলকাতা বা বর্ধমান থেকে কেউ-না-কেউ কোদার চাল পাঠিয়ে দেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে।

কলকাতার কাশীপুর চিৎপুর রোডে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী রায়চৌধুরী পরিবারের চিত্তেশ্বরী দেবী দুর্গাকে সপ্তমী ও নবমীর দিনে খিচুড়ি ভোগের সাথে পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া রুইমাছের পদ ভোগ হিসাবে দেওয়া হয়।

হুগলীর পালবাড়ির ৪০০ বছরের পুজোতে পটচিত্রে আঁকা দেবীর রূপ পুজো করা হয়। এই পুজোয় মায়ের ভোগে থাকে না কোনও অন্ন। পশুবলিও দেওয়া হয়নি কখনও। এমনকী ফলও ছেদন করার নিয়ম নেই এই বাড়িতে। গোটা ফল দিয়ে পুজো করা হয়।

পুরুলিয়ার কাশিপুরের পঞ্চকোট রাজ পরিবারের পঞ্চব্যঞ্জনে ভোগের পরম্পরা আজও অটুট। মহালয়ার পাঁচ দিন আগে জিতাষ্টমীর পরের দিন কৃষ্ণপক্ষের আর্দ্রা নক্ষত্র যুক্ত নবমী থেকে ভোগের পাত পড়া শুরু হয়। টানা ১৬ দিন অর্থাৎ মহানবমী পর্যন্ত চলে। গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত, কোনকা শাক, অড়হর ডাল, আলু, পটল, বেগুন, কাঁচকলা, বড়ি, কুঁদরি ভাজা, ছোলা দিয়ে পুঁই-কুমড়োর তরকারি, কুমড়ো, বেগুন, মুলো দিয়ে নটে শাকের চচ্চড়ি, মাছ ভাজা, কলজা ভাজা, বলির পাঁঠার মাংস, পায়েস, বোঁদে, রসগোল্লা, সন্দেশ প্রভৃতি ভোগে রূপে নিবেদিত হয়। পূর্বে মহালয়ার পাঁচদিন আগে যেদিন পুজো শুরু হয় সেদিন একটি বলি, তারপর কমপক্ষে চতুর্থীতে চারটি, সপ্তমীতে সাতটি, অষ্টমীতে আটটি, নবমীতে ন’টি পাঁঠা বলি হতই। বর্তমানে শুধু একদিন বলি দেওয়া হয়। মহাদশমীতে ঘট বিসর্জনের আগে মাকে দই, চিঁড়ে ভোগ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে চ্যাং মাছ পোড়া ও সিদ্ধি দেওয়ার নিয়ম আছে।

৫০০ বছরের পুরনো ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড়ের কনক দুর্গা মন্দিরে একসময় নরবলি হত। এখনও এখানে মোষ ও পাঁঠা বলি দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। দুর্গাপুজোর চারদিন বিশেষ রীতি আচার মেনে পুজো হয় ঝাড়গ্রামের কনক দুর্গা মন্দিরে। এই চারদিন দেবীকে হাঁসের ডিম, মাছ পোড়া, শাক ভাজা ও পান্তা ভাতের ভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমীর রাতে মন্দিরে পাতকুয়োর সামনে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। নবমীর অন্নভোগের আগে বলির মাংস নতুন মাটির হাড়িতে সেদ্ধ করে রাখা হয়। অষ্টমী পুজোর পর গভীর রাতে জঙ্গলের ভেতরে বলির আয়োজন করা হয়। তিথি-নক্ষত্র মেনেই বলি দেওয়া হয়। সেখানে বাইরের কারও প্রবেশাধিকার থাকে না। চিল্কিগড়ে মত্তগজ রাজবংশের গোপীনাথ সিং প্রবর্তিত এই পুজোতে নরবলির রক্তে পুজো হত কনকদূর্গার। সময়ের সঙ্গে নরবলি বন্ধ হয়ে চালু হয়েছে মোষবলির প্রথা। মহাষ্টমীতে হাঁসের ডিমের ভোগ দেওয়া হয়। নতুন মাটির হাঁড়িতে জল ও অন্যান্য সামগ্রী ভরে শালপাতা দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে উনুনে চাপিয়ে দেওয়া হয়। উনুনে তিনটি কাঠে আগুন জ্বেলে ঘরের দরজা তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পরে দরজা খুললে ভোগ তৈরি অবস্থায় পাওয়া যায়। স্থানীয়দের বিশ্বাস দেবী স্বয়ং এসে এই ভোগ রান্না করেন।

ভোগ ধারণা যেমন মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ব্যাখা করা যায়, তেমনই ভোগের প্রকার ভেদেও এই সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ছবি পরিলক্ষিত হয়। সমাজের ও সংস্কৃতির বিবর্তনে দুর্গাপুজো উমা মায়ের বাপের বাড়ি ফেরা। উমা যেন সব বাঙালির ঘরের মেয়ে। তার বৎসরান্তে একবার ফেরা পিতৃগহ তথা বাংলায় আনন্দের আবেশ এনে দেয়। দুর্গাপুজোর ভোগেও পড়ে তার ছায়া। নানারকম আমিষ নিরামিষ পদের বিবিধতা সত্ত্বেও বাঙালি ভোগে অভিনবত্ব রেখে নানান নতুন উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রমাণ রাখে। সাথে দেবীর দৃষ্টিভোগের কথা স্মরণে রেখে ভোগ নিবেদনকে দৃষ্টিনন্দনও করে তোলা হয়।







Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন