দীর্ঘ একবছর প্রতীক্ষা শেষে মা দুর্গার আগমনে আনন্দোৎসবে মাতে ছোট বড় সকলে। মহালয়ার দিন থেকে দেবীপক্ষের শুভ সূচনা। দশ হাতে অস্ত্র ধারণ করে দেবী দুর্গা নিধন করেন মহিষাসুরকে। সেই কারণে দুর্গাপুজো বাঙালিদের কাছে শুধুমাত্র দেবীর আরাধনা অথবা উৎসব উদযাপনের গণ্ডীতেই আটকে থাকে না। এর বিস্তৃতি সুদূরে এবং মনের গভীরে। দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মহিষাসুর বধ যা সকলের কাছে অশুভ শক্তির বিনাশের বার্তা বহন করে আনে। কিন্তু মুদ্রার অপর পৃষ্ঠ হিসাবে এই কাহিনী যদি সম্পূর্ণরূপে আলাদা হয়? যদি মহিষাসুর বধ আদপেই অশুভ শক্তির বিনাশ না হয়ে শোনায় কোনো এক ষড়যন্ত্রের কাহিনী? তাহলে একটা গল্প বলা যাক।
এক দেশে এক রাজা ছিল। সে রাজা মহাবীর, মহাযোদ্ধা, মহাসাহসী। তার রাজ্যের নাম চাইচম্পা। সেখানকার প্রজাদের মধ্যে সর্বদা সুখ
ও শান্তি বিরাজ করত। একদিন সেই রাজ্যে অনুপ্রবেশকারীদের আগমন ঘটে। এমন শস্যশ্যামলা
সুন্দর রাজ্য তারা হাতিয়ে নিতে চায়। কিন্তু এর একমাত্র পথ হলো যুদ্ধ। সেইমতো সেই
রাজ্য ও রাজার বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে রাজা অতীব পরাক্রমশালী। তাকে
হারানো সহজ ব্যাপার নয়। অগত্যা অনেক যুদ্ধের পর তার বীরত্বের কাছে হার মেনে
আক্রমণকারীরা চম্পট দেয়।
কাহিনী এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হয় না। তারা সামিল হয় এক গভীর
চক্রান্তে। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, রাজা এবং সেই রাজ্যের মানুষজন নারীদের অত্যন্ত সম্মান করে এবং নারীর ওপর
কোনরকম বলপ্রয়োগ বা আঘাত করে না। অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিনিধি এক সুন্দরী ও
গৌরবর্ণা নারীকে রাজার কাছে প্রেরণ করে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। সেই নারীর রূপে
মুগ্ধ হয়ে রাজা বিবাহে সম্মতি জানায় এবং নিজের অজান্তেই পাতা ফাঁদে ধরা দেয়।
বিবাহের পর নয়দিন রাজা উক্ত নারীর সঙ্গে দাম্পত্যজীবন কাটায় এবং নবম দিনে সেই
নারী রাজাকে হত্যা করে। রাজার মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্র বিপক্ষ দল রাজ্য আক্রমণ
করে এবং রাজ্যকে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।
না, এই কাহিনী কোনো পৌরাণিক কাহিনী নয়। এই কাহিনী আদিবাসী সমাজের লোককাহিনী, এই কাহিনী অনার্যদের। আদিবাসীদের বিশ্বাস, বহুকাল পূর্বে আর্যরা তাদের ভিটেমাটি গ্রাম দখল
করার জন্য এহেন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র রচনা করেছিল। সম্মুখসমরে পেরে না উঠে ছলে বলে
কৌশলে পরাজিত করেছিল তাদের রাজা হুদুড় দুর্গাকে। আদিবাসীরা মনে করে, ওই ঘটনায় নারীকেই আর্যরা অর্থাৎ হিন্দুরা দেবী
দুর্গা হিসেবে এবং রাজাকে মহিষাসুর হিসেবে অতিরঞ্জিত ভাবে বর্ণনা করেছে এবং তাদের
রাজা হুদুড় দুর্গার নামই উক্ত নারীর নাম হিসাবে ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেই কারণে
দুর্গাপূজার সময় তারা দুর্গার আরাধনা করে না, আরাধনা করে মহিষাসুরের।
দাঁসাই নাচ
ভাবলে অবাক হতে হয়, একই উৎসব এক একজনের কাছে এক একরকম বার্তা বহন করে আনে। হিন্দুদের
দুর্গাপুজো শুধুই আনন্দের। আবার সাঁওতালদের রয়েছে হুদুড় দুর্গার দাঁসাই পরব, যা তাদের কাছে শোকের। হুদুড় দুর্গার প্রতি
শোকপ্রকাশের উদ্দেশ্যে শালবনির কেন্দাশোল গ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এবং
জঙ্গলমহলের আরো বেশ কয়েকটি জেলার মানুষজন পুজোর ক'দিন হুদুড় দুর্গা বা মহিষাসুরকে স্মরণ করে। সপ্তমীর সকাল থেকে দশমী
পর্যন্ত হুদুড় দুর্গার মূর্তির সামনে চলে দাঁসাই নাচ। পূর্ব কাহিনী অনুযায়ী, রাজার মৃত্যুর খবর শুনে আর্যরা যখন রাজ্য
আক্রমণ করেছিল, রাজ্যের অনার্য
পুরুষরা তাদের ধর্মগুরুর পরামর্শ অনুসারে সরস্বতী নদীতে স্নান করে নারীর বেশ ধারণ
করে দাঁসাই নৃত্য করতে করতে রাজ্য থেকে পালিয়ে যায়। সেই প্রথা মেনে আদিবাসী
পুরুষরা পুজোর ক'দিন নারীদের বেশ
ধরে মাথার পাগড়িতে ময়ূরের পালক গুঁজে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে
নেচে, গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়।
প্রত্যেক গানের আগে এবং মাঝে মাঝে 'হায়রে', 'হায়রে' শব্দের ব্যবহার করা হয়। এই শব্দ শোকের আবহ তৈরি করে।
তবে দাঁসাই নাচকে কেন্দ্র করে অপর একটি
লোককাহিনী রয়েছে। আদিবাসী সমাজের যুবক যুবতীরা প্রতিদিনই জঙ্গলে কাঠ-পাতা সংগ্রহ
করতে যেত। এটা ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। একবার আয়নম এবং কাজল নামে দুই সাঁওতাল
যুবতী কাঠ-পাতা সংগ্রহ করার জন্য বনে যায়। সেই সময় আর্য সমাজের কয়েকজন মানুষ সেই
যুবতীদের অপহরণ করে। রাখালরা সেই দৃশ্য দেখতে পেয়ে গ্রামের মানুষদের খবর দেয়।
মহিলাদের রক্ষা করার জন্য একাই ছুটে যান আদিবাসীদের রাজা হুদুড় দুর্গা। বৃহৎ
শক্তির বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে সাঁওতাল সমাজের মানুষজনের একদিন সময় লেগে যায়। তারা
মহিলাদের পোশাক পরিধান করে লাউয়ের খোলের মধ্যে তিরের ফলা,
অস্ত্র ইত্যাদি লুকিয়ে রেখে হুদুড় দুর্গা, আয়নম এবং কাজলের সন্ধানে বেরোয়। অতিবৃষ্টি
তাদের অনুসন্ধান পর্বকে প্রলম্বিত করে। সাঁওতালি ভাষায় দাঁসাই শব্দের 'দাঁ'-এর অর্থ জল আর 'সাই' হল প্রশমিত হওয়া বা কমা। জল কমার অপেক্ষায় দেরি
হয় এবং তারা তাদের প্রিয় মানুষজনকে তৎক্ষণাৎ খুঁজে না পেয়ে 'হায়' 'হায়' শব্দ করে গান করে এবং
খুঁজতে থাকে, যেখান থেকে দাঁসাই
নাচের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করে থাকেন। তবে অধিকাংশের মতে, প্রথম কাহিনীটির গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা
অপেক্ষাকৃত অধিক।
হুদুড় দুর্গা
আদিবাসী সমাজে প্রচলিত দাঁসাই নাচের প্রধান অংশ
ভুয়াং। এটি এই নাচের মুখ্য বাদ্যযন্ত্র। দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী থেকে দশমীর মধ্যে
ভুয়াং, ধামসা, মাদল, সারিন্দা, করতাল, আড়বাঁশি, ঘণ্টা, কাঁসার থালা, কেন্দরী ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে দাঁসাই নাচ করা হয়। ভুয়াং যন্ত্র
শুকনো লম্বা লাউয়ের খোলা দিয়ে তৈরি। এই লাউয়ের খোলার সঙ্গে একটা ধনুকের মতো
কাঠামো লাগিয়ে সাঁওতাল কারিগররা তৈরি করেন। গানের সঙ্গে ওই ধনুকের ছিলায় আঙুল
দিয়ে টানলে যে আওয়াজ হয় সেটাই আরও মধুর শব্দে জোরে প্রতিধ্বনি হয়ে বেরিয়ে
আসে। তার সাথে সাথে চলে দাঁসাই নাচ। কেন্দাশোল ছাড়াও পুরুলিয়ার দু'-একটি আদিবাসী অধ্যুষিত স্থানে মহিষাসুরের পুজো
উপলক্ষ্যে বড় মেলা বসে।
ডাঙাদিঘি গ্রামের দুর্গাপূজা
তবে বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী সমস্ত
আদিবাসীদের পুজো কিন্তু একরকম নয়, বেশ
কিছু পার্থক্য রয়েছে। কুলটির আদিবাসী আশ্রমের কথাই ধরা যাক। এখানে দেবী দুর্গার
আরাধনা হয় আদিবাসী রীতিতে। এমনকি চণ্ডীপাঠও হয় এখানে, যদিও সংস্কৃতের পরিবর্তে সাঁওতালি ভাষা অলচিকিতে। এই চণ্ডীপাঠ দিয়েই শুরু সপ্তমীর পুজো। সাঁওতালি দেবদেবীর পাশাপাশি দুর্গা, গণেশ, কালী, লক্ষ্মীও পূজিতা হন
এই আশ্রমে। দুর্গাপুজোর সময় মা দুর্গার আটচালায় থাকেন বিষ্ণুর অবতার নরসিংহ।
নরসিংহের মূর্তিটি কার্তিকের পাশেই প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দিরে সারা বছর মা দুর্গা থাকেন।
পঞ্চমীর দিন পুরনো প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হয়। নবমীর দিন মন্দিরের
বাইরে চলে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। একপক্ষ দেবতা ও অন্যপক্ষ অসুর সাজে। অভিনব এই পুজো
দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান কুলটির নিয়ামতপুরে।
ঠিক একইভাবে মালদা জেলার ভাঙা দিঘি গ্রামে দেবী
পূজিতা হন আদিবাসী ভাষার মন্ত্রে। কমবেশি দু'শোটি আদিবাসী পরিবার এখানে বসবাস করে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা হবিবপুর
ব্লক। সেই ব্লকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের ভাষায় মন্ত্র পাঠ করে মা
দুর্গার। এই ভাঙা দিঘি গ্রামের মধ্যে রয়েছে ছোট্ট একটি টিনের ঘর। সেই ঘরের মধ্যে
রয়েছে মা দুর্গার বেদী। সেখানেই প্রায় ১৫০ বছর ধরে এই পুজো হয়ে আসছে। ব্রাহ্মণ
পুরোহিতের বদলে একজন প্রবীণ আদিবাসী তাঁদের নির্দিষ্ট ধর্মীয় রীতি মেনে দেবী
দুর্গাকে পুজো করেন। পুজোর চারদিন এখানে পংক্তি ভোজনের আয়োজন করে থাকেন আদিবাসী
সমাজের মানুষেরা। চারদিনই নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। নবমীতে খিচুরি ভোগ করা হয়।
দুর্গাপুজোর বিস্তৃতি সত্যিই অনেকখানি। বছরের পর
বছর, যুগের পর যুগ ধরে বহুধা
সংস্কৃতির সংমিশ্রণের এক একটি নিদর্শন ধরা পড়ে গ্রামেগঞ্জের ও শহরের পথেঘাটের
পুজোগুলোতে, যেখানে পৌরাণিক কাহিনী
ও লোককাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আর এখানেই আমাদের উৎসবের অনন্যতা, মৌলিকতা। আশা রাখি, নিজ নিজ ভক্তিতে নিজ নিজ রীতিতে উদযাপিত দিনগুলি সকলের জীবন ভরিয়ে রাখুক
সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি দিয়ে।
সমৃদ্ধ হলাম।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন