ঘরের মানুষটাও সেই রকম। ঘরকুনো, খালি খাবার শখ। অলকার হাড় মাস কালি হয়ে গেলো গো
এই হেঁসেল ঠেলতে ঠেলতে। ছেলেও ডানা শক্তপোক্ত হতেই ভোঁ ভা। একদম পগার পার। তার
টিকিরও নাগাল পাওয়া মুস্কিল। অথচ কতো আশা সেধেছিল মনের গহীন কোণে। বাপ না হোক, স্বামী না হোক; অন্তত আত্মজে কিছুটা বুঝবে। কি না করেছেন তিনি ছেলের জন্য। রান্না করতে
করতে অঙ্ক শেখানো থেকে, ভোর রাত
থেকে উঠে জলখাবার, আর দুপুরের
টিফিন। একা হাতে সব কিছুঃ বাজার, রেশন, কেরোসিন, আর ঘরের সব হাবিজাবি, সঙ্গে
আরো ছিল উপরি পাওনা আত্মীয়-কুটুম্বদের নানাবিধ বছরভর যত সব বায়নাক্কা। পরীক্ষার
সময় বাস না পেলে, ছুটে-ছুটেই স্কুলে
পৌঁছে যাওয়া, টিফিনের খাবার
খাওয়ানোর জন্য। ছেলেটা আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে থাকলে, ডাক্তারদের কোনো হেল দোল বা সাড়াশব্দ না পেয়ে
সোজা হাজির হয়েছেন মেডিকেল ডিরেক্টরের অফিসে। আর্তনাদ করে উঠেছেন এই বলে যে যদি
আপনার সন্তান হত, এই ভাবে ফেলে রেখে
দিতে পারতেন? ঐ উন্মাদনায় কাজ
হয়েছিল। ছেলেটা সুস্থ ভাবে ঘরে ফিরে এসেছিল।
এ জীবনে সবই দেখলেন। যৌথ, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি রকমের সংসারই। সবই মন্দ-ভালর মিশেল। যে
যেভাবে নেবে। অনেকে রঙ মেখে সং সেজে আনন্দ দেখায়। ভেতরে হয়ত বিষাদের নীল গরল।
বাইরে কেউ নারকেলের মত রূঢ়, হয়তো
ভেতরে বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রস্রবণ।
বাবামশাই চাকরিজীবী ও পুরানপন্থী ছিলেন। অলকা
পড়াশোনায় তুখোড় হলেও, উচ্চবিদ্যায়
মেয়েকে তিনি মোটেই পাঠাতে ইচ্ছুক ছিলেন না। প্রথমত, ঐ যুগে উচ্চবিদ্যায় গুটিকতক মহিলাই উৎসাহী হতেন, অধিকাংশই পিতৃ-নিয়োজিত পাত্রে সত্ত্বর মনোনিবেশ করতেন। বাবামশায়ের দূষিত
পরিবেশের আশঙ্কা অমূলক প্রতিপন্ন করার জন্য শেষে শিক্ষকদের মুচলেকা লিখে দিতে হয়।
আর পড়া শেষ হতে না হতেই ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষিকার চাকরি। জীবনে একটা ছন্দ আসার মৃদুমন্দ সমীরণ। কিন্তু বিধি যে বাম! এবার
বাবামশাইয়ের গলগ্রহ কন্যাদায় উদ্ধারের পালা। দুশ্চিন্তায় কাল কাটাতে কাটাতে, তিনি অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একটি
চাকরিজীবী পাত্রের সন্ধান পেতেই, বাবামশাই
পাকা কথা দিয়ে দিলেন; অলকার মতের
তোয়াক্কা না করেই। ভেবেই দেখলেন না যে মেয়ে কিভাবে এক ক্ষুদ্র পরিবার হতে বৃহদাকার
যৌথ পরিবারে খাপ খাইয়ে নেবে। আর চাকরি? শান্ত মায়ের কাছ থেকে সমর্থনের কোন প্রত্যাশা ছিল না। সেই তাঁর প্রথম মেয়ে
হয়ে মানিয়ে চলার প্রথম পাঠ। সেই পাঠ মোটেই সহজ ছিল না, বরং সাতিশয় কঠিন।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি, প্রতিটি শৃঙ্খল ঝঞ্ঝারে অনুভূত হয়েছেন ভারতবর্ষে বা বঙ্গদেশে প্রমীলারূপে
অবতরণের মহা মহত্ত্ব, বিশেষত
মধ্যবিত্ত অবতারের। অথচ নিজেকে মানিয়ে নেবার কোন প্রচেষ্টাই তিনি বাকি রাখেননি।
তিনি সবার যোগ্য ও জনপ্রিয় হবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছেন,
শুধু একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পূর্ণ জীবনের জন্য। নিজেকে
বারংবার ভেঙ্গেছেন, বারবার অন্যের
ছাঁচে নিজেকে ঢেলেছেন, কিন্তু সংসার
দেবতা প্রসন্ন হননি। সংসার দেবতা কখনও প্রসন্ন হন না, সেটা তাঁর ধাতে নেই। এই সারসত্য তাঁর বোধগম্য হতে হতে, মাথাময় রূপালী ঝিলিক আজ শুভ্রতায় পর্যবসিত
হয়েছে।
যৌথ পরিবারে কোন গণতন্ত্রের বালাই নেই। ক্ষমতা
সমস্ত শাসক শ্রেণীর কুক্ষিগত। তুমি সেই দলের তাঁবেদার হলে,
তোমার ভাগে কুটো কাটা জুটতে থাকে। তুমি “হ্যাঁ তে হ্যাঁ” না
মেলালে, তুমি প্রতিক্রিয়াশীল। তুমি
এই মহৎ শাসনের প্রতিস্পর্ধী হলে, তোমার
স্থান কেন্দ্র হতে বহুদূরে, আস্তাকুঁড়ের
কাছাকাছি। মুখ খোলার অধিকার তোমার নেই। আর দৈবাৎ মুখ খুলে ফেললে, শাসকের বজ্রনির্ঘোষ তোমায় অবদমিত রাখতে পিছপা
হবে না।
অলকার শাসিতের জীবনকাল কোনরকমে অতিবাহিত হচ্ছিল।
স্বামী মানুষটির কোন হেলদোল নেই। অফিস আর আড্ডায় তাঁর দিব্যি সময় কাটে। ঘরের সঙ্গে
তাঁর সম্পর্ক শুধু জৈবিক-খাদ্য গ্রহণ আর নিদ্রার। এদিকে বাবামশাই হয়ত মনঃকষ্টেই
কালান্তক রোগে বিগত হলেন। আর তিনিও তো চাকরি ছেড়ে আসার পর সুবৃহৎ যৌথ পরিবারের
সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করেছেন। শৈশবের বৃন্দাবনমুখো আর তিনি হননি।
বাবামশাই শেষ সময়ে হাজির হয়েছিলেন, করজোড়ে
সংসারের কাছে থেকে আত্মজার কিছু সময়ের আর্জি জানিয়েছিলেন। কিভাবে যেন সেই
প্রার্থনা অনুমোদিত হয়। রাশভারী বাবামশাই মুখ ফুটে কিছু না বলে উঠলেও, কন্যা আর পৌত্রের সান্নিধ্যে শেষ কটা দিন গহিন
মনের কোণের বিষাদ ভুলতে চেয়েছিলেন। তা সে আর কতদিন?
স্বামীঠাকুরের সরকারি কর্মস্থল মফঃস্বল হতে
রেলপথে ঘন্টাখানেক। তিনি ঘরের খাবার খেয়ে স্টেশনমুখো হতেন। আর সন্ধ্যায় ফিরে আর এক
প্রস্থ গলাধঃকরণ করে তাস পিটতে বেড়িয়ে পড়তেন। ওনার সরকারি কোয়ার্টার প্রাপ্য ছিল।
অলকা কোন এক আবেগ ঘন দুর্বল মুহূর্তে তা নিয়ে আব্দারও করে বসেছিলেন। কিন্তু ছি-ছি
করে তা তৎক্ষণাৎ স্তব্ধীকৃত হয়। সেই প্রথম ঘর ভাঙানি বিশেষণে বিভূষিত হওয়া।
তারপর জীবন চলছিল নিজের নিয়মে। অলকা প্রতিনিয়ত
সাংসারিক যূপকাষ্ঠে আত্মার বলি চড়াচ্ছিলেন। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘরাশির প্রথম গর্জন পাত
হল, যখন আপনার উপরের অবহেলা, বিতৃষ্ণার ভাগ আত্মজের উপর বর্ষিত হতে থাকল।
অলকা সেটা কিছুতেই হতে দিতেন পারেননা। পড়াশোনার অব্যবস্থা তো একেবারেই নয়।
পতিদেবতার ততদিনে কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ ঘটেছে।
পত্নীর অসহায়তায় কখনও উদ্বিগ্ন না হলেও বা স্বেচ্ছায় উদাসীন থাকলেও, অপত্য স্নেহ বোধে চিত্ত অতিমাত্রায় চঞ্চল হয়ে
উঠেছে। সন্তানের লেখাপড়ার বিষয়ে এখন পত্নীর উবাচগুলিকে আর অসহনীয় বোধ হচ্ছে না।
বাড়ির অন্যদের কথাবার্তাও এখন কিছুটা গাত্রদাহের অবকাশ রাখছে। তিনি নিজে অন্য শহরে
পড়তে গিয়েছিলেন, এখানে পড়ার পরিবেশ
না পেয়ে। নাড়িকাটার যন্ত্রনা যে ভীষণ। তাই সব সত্ত্বেও, গায়ে কিছু না মেখেও চালিয়ে নিচ্ছিলেন। ভাই-বোন-দাদা-দিদি-মা-বাবা ও
অন্যান্য আত্মীয়স্বজন সহ বৃহৎ যৌথ পরিবারের সংকীর্ণ এক কোণে পড়ে থেকে। কলহ করা বা
বাড়ীর কাউকে মন্দবাক্য বলা তাঁর কাছে অশিষ্টাচারের নামমাত্র। তবে সন্তানকে
প্রয়োজনীয় শিক্ষার পরিবেশ না দিলে যে কুলাঙ্গার তৈরীতে দেরি হবে না, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। তথাপি কথায় কথায়
অন্তরঙ্গ বন্ধুসম দাদা যখন তাঁকে আলাদা হতে নিদান দিলেন, তিনি বিস্ময়সূচক ভাবই শুধু প্রকাশ করেননি, কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
স্মৃতিচারণ করেন তিনিঃ এ যেন ভাগ্য নির্দিষ্ট।
সামান্য তল্পিতল্পা সহ এক রাত্রে মাটাডোর ভ্যানে চড়ে শিল্প শহরে। স্বেচ্ছায় তিনি
যে ছেড়ে আসতে চাননি। সবকিছু সত্ত্বেও, পৃথক হবার উৎসাহ বা আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। তিনি যে ছিলেন যৌথের
অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর অদ্ভুত ব্যাপার, অলকা নিজের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিলেন। শত বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়েও, সীমাবদ্ধ আয়েও কোনদিন অসতর্কতা বশতঃ সামান্য
ভুলও হতে দেন নি। কক্ষনো আয়ব্যয় না মেলানো মানুষ, বিরক্ত না হয়ে পাই-পয়সার হিসেব মিলিয়ে সংসারের ঘানি ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন।
শুধু একটাই অক্ষরে অক্ষরে সন্তুষ্টির বিষয় ছিল
যে পুত্রের পড়াশোনায় স্বল্প আসক্তি বা ঝোঁক। এই একটি বিষয়ই তাঁকে বর্ণনাতীত
শান্তির প্রবল মায়াবী হাওয়ায় ভাসিয়ে দিত। পুত্রের কাছে মনের গহিন কোনের নিজস্ব
ব্যথাগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ছিল। সমাধান না করতে পারার বা দুঃখকে অতিক্রম করা ইচ্ছা, অবশ্য লোক সম্মুখে ক্রমশঃ প্রকাশ পাচ্ছিল। এ
স্মৃতিচারণ তো নির্ঘাত ছিলই। মুহূর্তের উত্তেজনায় পুত্রও বেপরোয়া বিচ্ছিন্নতার
ভাষা মুখে এনে ফেলেছিল। অনুগত বোকা ছেলে জানেনা যে ঐ ভাষায় এখানে কথা হয় না। এখানে
মানিয়ে চলাই যে জীবন-যাপনের ছাড়পত্র। সেই পুত্র আজ স্বাবলম্বী হয়েছে। মুখে-মুখে
তীব্র তর্ক করে। এটা বলা যেতেই পারে যে কৃতজ্ঞতাবোধ একটু কম, আর অহঙ্কার বেশ খানিক। ঘর-পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ
দেখলে যে ভয় পায়। তর্জনকারী বা ষণ্ডা সব সময়ই কাপুরুষ।
অলকা যে বিনা মেঘে বজ্রপাত চান না। ভয়ে থাকেন, কুঁকড়ে থাকেন। লেপমোড়া শীতেও ঠাণ্ডা হাড়ের মাঝে
হিমের বাস বসায়।
অবশেষে এক পাঠশালা তিনি খুলেছেন। আশেপাশের কলোনি
থেকে মেয়ে-ঝিয়েরা আসে। কখন সখনও কাঠকুড়ুনী, বাসনওয়ালি, মাছওয়ালি, সবজিওয়ালি, কুড়াওয়ালি ইত্যাদিরা। সবারই তাড়া থাকেঃ সংসার ঠেলার আর সংসারের মুখে অন্ন
গুঁজে দেবার। তিনি তাড়ার কারণগুলো খুবই বোঝেন। আর হাসিমুখে পড়াতে থাকেন। পড়াশোনাটা
ভীষণ জরুরি। সবাই তোমাকে দমিয়ে রাখতে চাইবে। তোমার ক্রমশঃ দমবন্ধ হয়ে আসবে। তখন এই
পড়াশোনাই তোমায় ঠিকঠাক জানালার দোরগোড়ার সামনে নিয়ে আসবে। একটু আলো বাতাস বা
সাঁঝের মিটমিটে তারাই তো প্রাণের ধুকপুকানি জিইয়ে রাখবে।
বেশ ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন