অলোক ছোটবেলা থেকেই একটু খ্যাপাটে। ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি, একই পাড়ায় থাকতাম। তাই ভালই পরিচিত ছিলাম ওর খামখেয়ালিপনার সঙ্গে। সেটা যে এখন এই পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা জানলাম মাস দুয়েক আগে!
স্কুলজীবনের পরে আমরা সিমলে পাড়া থেকে
বাগুইআটিতে ফ্ল্যাট কিনে চলে আসি। তারপর থেকে ওর সঙ্গে যোগাযোগটা কমতে থাকে। শেষ
বছর দশেক কোন যোগাযোগই ছিল না। ফেসবুকে এক কমন বন্ধুর মাধ্যমে আবার যোগসূত্র
স্থাপিত হল। লিংকড ইনে ওর প্রোফাইল চেক করতে গিয়ে দেখলাম বিরাট ব্যাপার! এম.টেক., এম.বি.এ. -এইসব করে বড়বড় আইটি কর্পোরেটের চাকরি
করেছে বেশ কয়েক বছর। শেষের চাকরিটা দেখলাম, একটা বহুজাতিক সংস্থার এশিয়া-প্যাসিফিক হেড। কিন্তু গত বছর পাঁচেক থেকে
দেখাচ্ছে সেলফ এমপ্লয়েড। নিজেই কি কোন আইটি কোম্পানি খুলেছে? জানতে খুব ইচ্ছে হল।
লিংকড ইনে মেসেজ করে নম্বর জোগাড় করলাম, তারপরে ফোন লাগালাম। যা জানতে পারলাম, তাতে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! ওই সাড়ে তিন কোটির
সিটিসি ছেড়ে ও নাকি হিমাচলের কোন এক দুর্গম জায়গায় হোম-স্টে চালাচ্ছে! অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করলাম, “বলিস কী! ওতে তোর
চলে? ফ্যামিলি কিছু বলে না?” হাসির আওয়াজ ভেসে এল,
“বাবা-মা তো কবেই মারা গেছে! বিয়ে-থাও করিনি। তাই বলবে আর
কে!” বললাম, “তা বলে এত জায়গা থাকতে
অত দূরে গেলি কেন?” বলল, “একবার ঘুরে যা তালানায়, বুঝবি। সামনের মাসে তো পুজোর ছুটি, ঘুরে যা এখানে। তোর কোন খরচা নেই, সব আমার।”
বেরিয়েই পড়লাম। ঔৎসুক্যটা চাপতে পারছিলাম না।
এমন কী সে জায়গা, যার জন্যে সাড়ে
তিন কোটির প্যাকেজও অনায়াসে ছেড়ে আসা যায়! ট্রেন, বাস, গাড়ি এবং তিন
কিলোমিটার প্রাণান্তকর ট্রেক করে অবশেষে বিকেলের মুখে পৌঁছলাম হিমাচল প্রদেশের
আটহাজার সাতশো ফুট উচ্চতার এক গ্রামে। গ্রামে ঢোকার পাঁচশো মিটার আগেই নজরে এল
‘অলোক ভিলা’। হাঁফানো একটু কম হলে যখন চারপাশে নজর দিলাম,
সব কষ্ট অদৃশ্য হয়ে গেল। চারপাশে ঘন বনে ঢাকা পাহাড়, এক পাশে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলের পাহাড়ী নদী।
হাত-ছোঁয়া দূরত্বে ঘন নীল আকাশচুম্বী বরফচুড়ো। নদীর ঢেউয়ের শব্দে সঙ্গী হয়েছে
অজস্র পাখির ডাক আর ঝিঁঝিঁর আওয়াজ। এক স্বপ্নের জগৎ! কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম।
এবার চারপাশটা নজর করে দেখলাম। ছোট পাঁচিল-ঘেরা
বিশাল জমিতে একটা বাংলো ধাঁচের দোতলা বাড়ি -কাঠ আর পাথরে তৈরি। একে ‘কাঠকুনি’
শৈলীর স্থাপত্য বলে। এরকম বাড়িঘর আগেও দেখেছি হিমাচলে। পরিবেশ-বান্ধব এই বাড়িগুলো
ভূমিকম্পেও বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ছোট্ট পাঁচিলটার গা ঘেঁষে উঠে গেছে জঙ্গলে
ঢাকা পাহাড়ের ঢাল। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেও নানান গাছগাছালি। সামনে ঘাসে ঢাকা বড়
উঠোন। তার একদিকে একটা প্লাস্টিকের লাল টেবিল আর গোটা চারেক চেয়ার।
“এসে গেছিস?”, প্রশ্নটায় ঘোর কাটল। ভাগ্যিস অলোকের এই
মধ্যবয়স্ক চেহারাটা ফেসবুক আর লিংকডইনে দেখেছিলাম! নইলে চিনতে সত্যিই অসুবিধে হতো।
আলিঙ্গন পর্ব চুকতেই অলোক কাকে যেন ডাকল। এক মধ্যবয়স্কা স্থানীয় মহিলা এসে
দাঁড়ালেন, সঙ্গে একটা বছর চারেকের
ছেলে। মহিলার পরণে স্থানীয় পশমে বোনা পাট্টু। ছেলেটি অবশ্য পরে আছে সোয়েটার আর
জিন্স। অলোক পরিচয় করালো, মহিলার
নাম পুষ্পা আর ওঁর ছেলের নাম অজয়। উনিই আমার জিনিসপত্র নিয়ে দোতলার ঘরে রাখতে
গেলেন। অলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, “এ
কি ম্যানেজার?” অলোক অল্প হেসে বলল, “ওই রকমই ধরে নে। এর কিছু গল্প আছে, পরে বলব। তুই তো লিখিস-টিখিস, প্লট পেয়ে যাবি।”
একটু ধাতস্থ হয়ে দুজনায় বিস্কুট-কফি নিয়ে বসলাম
ওই চেয়ার টেবিলে। একথা-ওকথার পর জিজ্ঞাসা করলাম, “পুষ্পার ব্যাপারে কী বলবি বলছিলি?” অলোক বলল, “প্রথমেই বলি, এই তালানা গ্রামটার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।
এখানকার লোক বেশ রক্ষণশীল। কোনো এক সময় রাজা পুরুর সৈন্যদলের কাছে তাড়া খেয়ে
আলেকজান্ডারের কিছু গ্রিক সৈন্য নাকি এখানে এসে আত্মগোপন করে এবং এখানেই থেকে যায়।
এরা নিজেদের তাদেরই বংশধর বলে মনে করে। এরা অন্য জায়গার লোকদের ছোঁয় না, এমনকি অন্যান্য পাহাড়িদেরও! তুই কিছু কিনতে
গেলে টাকা টেবিলে রাখবি আর দোকানদার তা উঠিয়ে নিয়ে মাল টেবিলের ওপর রাখবে, তোকে তা টেবিল থেকে তুলে নিতে হবে। নো
ছোঁয়াছুয়ি। বাইরের লোকেদের স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে কথা বলাও এরা বিশেষ ভাল চোখে
দেখে না। ওদের মন্দিরে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। ওরা চায় না, ওদের স্থানীয় ভাষা অন্য কেউ শিখুক বা বলুক।
বাইরের লোকের এ গ্রামে রাত কাটানোও নিষিদ্ধ। এইজন্যেই তো আমাকেও হোম-স্টেটা
গ্রামের বাইরেই বানাতে হল।”
কফিতে চুমুক দিতে দিতে অলোক যা বলল তা ওর
জবানিতেই দিলাম -
“লাস্ট জবটায় আমার ওপর
প্রেসার খুব বেশি ছিল। পোস্টিং ছিল সিঙ্গাপুরে। কিন্তু বছরে বেশ কয়েক মাস ভারতেই
কাটাতাম। ভারতে থাকার সময় দিন কয়েকের ছুটি নিতাম আর লোকালয় থেকে দূরে কোথাও কয়েক
দিন কাটিয়ে স্ট্রেস রিলিজ করে আসতাম। এইভাবেই প্রথম বার আসি এই দুর্গম গ্রামে। এত
ভালো লাগে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর শান্তির পরিবেশ,
যে বলার নয়! আমার তো আর তিনকুলে কেউ নেই, তাই ওই জমানো টাকাতেই বাকি জীবনটা কোনোরকমে চলে
যাবে। চাকরি ছেড়ে এখানে এসে পার্মানেন্টলি ঘাঁটি গাড়লাম। দেখেই বুঝছিস, ভুল করিনি।”
“এই বাড়িটা আমিই বানাই।
কিছু দিনের মধ্যেই স্থানীয় অনেকের সঙ্গেই বেশ চেনাজানা হয়ে গেল। এরা এমনিতে মানুষ
বেশ ভাল। তবে রক্ষণশীলতার ব্যাপারে বেশ আপোষহীন। এখানে বিচারের জন্যে এরা পুলিশ বা
প্রশাসনের কাছে যায় না। এখানে গ্রামের মুরুব্বিরাই বিচার করে শাস্তি দিয়ে দেয়।
মুরুব্বিদের সবাই খুব মানে এবং ওদের কথার নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। আমি এদের বাচ্চাদের
বিনাপয়সায় পড়াতাম আর জ্বরজারী-পেটখারাপে ওষুধপত্তর দিতাম। সেই সুবাদে অল্পদিনেই
আমি এদের বেশ আপনজন হয়ে উঠলাম। তাও আমি ওদের বিধিনিষেধ মেনেই চলতাম, শুধু একদিন অন্যথা করে ফেলেছিলাম।”
“তালানায় দুটো চলনসই
মুদির দোকান আছে। তার মধ্যে একটার মালিক হলো অকনিল চাঁদ। ওর দোকান থেকেই আমি সব
মালপত্র কিনতাম, তাই বেশ আলাপ হয়ে
গিয়েছিল। দোকানের পেছনেই থাকার ঘর। তাতে থাকত ওর পরিবার - স্ত্রী পুষ্পা আর
দু’বছরের ছেলে অজয়। অকনিল মানুষটা বেশ সাদাসিধে এবং আলাপি,
ফলে ঘনিষ্ঠতা হতে দেরি হল না। অকনিল শহরে মাল আনতে গেলে
পুষ্পা দোকানে বসতো। আমাকে বেশ সম্মান করতো। একদিন শেষবিকেলে এখানে এরকমই বসে চা
খাচ্ছি, হঠাৎ পুষ্পা এসে হাজির।
উদভ্রান্ত অবস্থা! বলল, ছেলের নাকি
খুব অসুখ। এদিকে অকনিল কি একটা কাজে শহরে গেছে। ফিরবে কাল সকালে। আমি যদি একবারটি
যাই তাদের বাড়ি।”
“ওষুধের ব্যাগটা পিঠে ফেলে রওনা হলাম ওর সঙ্গে। গিয়ে দেখি, বাড়িতে ওদের প্রতিবেশী, হরিলাল আর তার বউ বসে আছে। ছেলের নাকি আগের দিন থেকেই পেট খারাপ চলছে। স্থানীয় ওঝা-কাম-বৈদ্য রামলাল এসে মন্ত্রতন্ত্র পড়ে জড়িবুটি দিয়ে গেছে। কিন্তু কাজ বিশেষ হয়নি। আজ অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছে, এখন ধূম জ্বর, জ্ঞান প্রায় নেই। বুঝলাম, সিভিয়ার ইনফেকশন। দেরি করে ফেলেছে। কেসটা খারাপ দিকে টার্ন নিয়ে নিয়েছে। ব্যাগ থেকে জ্বরের ওষুধ আর এন্টিবায়োটিক বার করে পুষ্পার হাতে দিয়ে তখনই খাইয়ে দিতে বললাম। মাথায় জলপটি দিতে বললাম। বললাম শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে, যদিও ভাল করেই জানি, এত দেরিতে এখান থেকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কালই নিয়ে যাওয়া যাবে।”
“জলপটি বেশ কিছুক্ষণ
চলার পর জ্বর যেন সামান্য কম লাগতে লাগল। হরিলাল আর তার বউ কিছুক্ষণ আগেই চলে
গেছে। বললাম, ‘আমি এবার যাই।’
পুষ্পাকে তখনও খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বলল, ‘জ্বরটা আরেকটু কমলে যদি যান!’ না বলতে পারলাম না। এদিকে অন্ধকার জঙ্গলের
রাস্তায় একা ফিরতে হবে ভেবে ভয়ও করছিল। কদিন আগেই এখানে চিতাবাঘ দেখা গেছে। প্রায়
ঘন্টা খানেক পরে জ্বর আরো কমল। এবার বেরোনোর তোড়জোড় করলাম। পুষ্পাই হরিলালকে বলল
আমায় এগিয়ে দিয়ে আসতে। ঘন অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটতে
লাগলাম। হরিলাল আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে চলল। বলল, ‘খুব ভাল করলেন সাহেব। পুষ্পা বেচারি তো একদম ঘাবড়ে গিয়েছিল! আপনি গিয়ে
ওষুধ না দিলে যে কি হতো!’ আমিও বললাম, ‘আরে না না, আমি আর এমন কী
করেছি! বরং তোমরা তো ওকে কত সাহায্য করেছো।’ হরিলাল বলল,
‘ওটুকু তো করতেই হবে সাহেব, পড়শীর একটা দায়িত্ব আছে, না!’
বাড়ির কাছে এসে বললাম, ‘ধন্যবাদ
হরিলাল! এবার আমি চলে যেতে পারবো। কাল তোমরা অজয়কে শহরের হাসপাতালে দেখিয়ে নিয়ে
এসো। কোনো সাহায্য লাগলে বোলো।’ সেও নমস্কার করে ফেরার পথ ধরল।”
“পরের দিন বিকেলে অকনিল
এসে দেখা করে জানিয়ে গেল অজয় এখন অনেকটা ভাল। সে তার কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুললো না।
এর কয়েক দিন পরে একদিন সকালের দিকে জনা তিনেক গ্রামবাসী এসে বললে, ‘জ্যেষ্ঠাঙ্গ’ বসছে অকনিল আর পুষ্পার ব্যাপারে।
তারা আমায় ডেকেছে সেখানে। এদের এখানে নিজস্ব দ্বিস্তরীয় শাসনব্যবস্থা আছে –
‘কনিষ্ঠাঙ্গ’ আর ‘জ্যেষ্ঠাঙ্গ’। এরাই বিচার করে, শাস্তি দেয়। এদের মানতেই হবে। তাই যেতেই হলো। জানতে পারলাম, অকনিলদের বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগ - তারা আমার মতো
বাইরের লোককে সন্ধের পরেও গাঁয়ের মধ্যে রেখেছিলো এবং পুষ্পা আমার মতো বহিরাগতর হাত
ছুঁয়ে ওষুধ নিয়েছিল। এই ঘটনার সাক্ষী হরিলাল স্বয়ং গ্রামের মোড়লদের একথা জানিয়েছে।
এখানে বিচারের একটা পদ্ধতি হচ্ছে - বাদী আর বিবাদী পক্ষের একটা করে ভেড়া এনে তাদের
সামনের পায়ে কেটে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। তারপরে যার ভেড়া আগে অসুস্থ হয়ে পড়বে বা
মরে যাবে, সে পরাজিত ঘোষিত হবে।
শুনলাম, সেই বিচারে অকনিলের ভেড়া
মরে গেছে এবং হরিলালের ভেড়ার বিশেষ কিছু হয়নি। তবু আমার সাক্ষ্য নেওয়া হল। সেদিনের
পরিস্থিতি বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! মোড়লদের রায়ে আমার কোনো দোষ তেমন পাওয়া গেল না, কিন্তু পুষ্পার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য বলেই
বিবেচিত হলো। বিধান এল, পুষ্পাকে
গ্রাম ছাড়তে হবে তিনদিনের মধ্যে। অকনিল আর পুষ্পা অনেক কাকুতি মিনতি করল। কিন্তু
মোড়লরা তাদের বিচারে অনড় রইলেন। বৃদ্ধ গ্রামপ্রধান মেওয়ারাম পাথরের মত কঠিন স্বরে
বললেন, ‘এত বড় বেআইনি এবং গর্হিত
কাজ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়...কোনো ভাবেই নয়।’ সব্বাই সম্মতি দিল।”
“বিচার শেষ হলে একগাদা
রাগ-দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। একটা অসহায় মহিলার ওপর, একটা নিরপরাধ পরিবারের ওপর এ কী জুলুম! কিন্তু কিচ্ছু করার নেই, এখানে জ্যেষ্ঠাঙ্গের বিচারই শেষ কথা! দুপুরের
দিকে অকনিল আর পুষ্পা এল অজয়কে নিয়ে। তখন আসল ব্যাপারটা জানতে পারলাম। দোকান ছাড়াও
অকনিলের কয়েক কাঠা জমি আছে। বেশ ভাল জমি। হরিলালের অনেকদিনের নজর ওই জমির ওপর।
কিনতেও চেয়েছিল, কিন্তু অকনিল
দেয়নি। এখন পুষ্পাকে নিয়ে অকনিলকে গ্রাম ছাড়তে হবে। সেই সুযোগে জমিটা তার হস্তগত
হবে। অকনিল অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে চলে গেল। মনটা খুব ভারী হয়ে গেল! বিকেলের দিকে
হঠাৎ দেখি মেওয়ারাম এসে হাজির। চা খেতে খেতে বললাম, ‘এ কী বিচার করলেন! পরিবারটার সব্বোনাশ হয়ে গেল!’ মেওয়ারাম বলল, ‘জানি সাহেব। সবই বুঝছি। আমিও তো ওদের বয়সটা
পেরিয়ে এসেছি! কিন্তু আইন তো আইনই সাহেব! এই বয়সে এসে বেআইনি কাজ তো করতে পারি না!
একটা কথা বলবো, শুনবেন?’ বললাম, ’নিঃসকোচে বলুন।’ মেওয়ারাম বলল, ‘দেখুন, আমার বিচারে আমি
বলেছি, পুষ্পাকে গ্রাম ছাড়তে হবে, অকনিলকে নয়। সুতরাং অকনিল গ্রামে থাকতেই পারে, দোকান-চাষবাস করতেই পারে।’ বললাম, ‘তাহলে আপনি বলতে চান,
পুষ্পা একা ওই ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে গাঁ-পরিবার ছেড়ে চলে যাবে?’ বিড়ি ধরিয়ে মেওয়ারাম বলল, ‘সাহেব, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? আপনার
এই হোম-স্টের একটা ঘর কি অকনিলদের ভাড়া দিতে পারবেন?’ মেওয়ারামের চোখে এক করুণ আর্তি। এই মানুষটাই কয়েক ঘন্টা আগে কী নিষ্ঠুর
ভাবে বিচারের রায় শোনাচ্ছিল! রাজী হয়ে গেলাম। তারপর থেকে ওরা এখানেই থাকে।”
অলোকের কথা শেষ হয়ে গেছে। দুজনেই চুপচাপ বসে
আছি। প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে। ঠাণ্ডাটা বেশ বেড়ে গেছে। তখনই দেখলাম একটি স্থানীয় লোক
একটা থলে হাতে ঢুকছে। অজয় ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। অলোক বলল, ‘অকনিল দোকান থেকে এসে গেল।’ খানিক বাদে লোকটা
এসে আমাদের নমস্কার করল। তারপরে অলোককে বলল, ‘সাহেব সর্দিজ্বর আর মাথাধরার ওষুধ দেবেন! নিয়ে আবার গ্রামে ফিরতে হবে।
হরিলালের শরীরটা খুব খারাপ। কাল সকালে শহরে নিয়ে যাব। রাতে কিছু হয়ে গেলে কী হবে!
ভাবছি, রাতটা ওদের ওখানেই কাটিয়ে
দেব। পড়শির তো একটা দায়িত্ব থাকে, না!’
কথাগুলো শুনে চমকে উঠলাম।
খানিক পরেই অন্ধকার জঙ্গলের রাস্তায় একটা মানুষের
অবয়ব ধীরে ধীরে আবছায়ার মতো গ্রামের দিকে মিলিয়ে যেতে দেখলাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন