আসাম
মূলত দুই নদের অববাহিকা অঞ্চলে বিভক্ত। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক। দুই নদের অববাহিকা
অঞ্চলের ভাষা,
সংস্কৃতি
এমনকি ভৌগোলিক অবস্থানেও বিস্তর ফারাক। ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা,
মণিপুর,
মেঘালয়
ছাড়াও বাংলাদেশ দিয়ে ঘেরা বরাকে আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে সড়কপথে সরাসরি
যাওয়ার রাস্তা নেই। অসমিয়া নয়, এখানে সবাই
কথা বলেন বাংলায়। খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতিও বাঙালিদের মতোই।
বরাক উপত্যকা
অসমে
অসমিয়া আর বাঙালির তিক্ত মধুর সম্পর্ক শতাব্দী প্রাচীন। যদিও এর কারণ আরও গভীর।
কিছুটা হয়ত প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বৃটিশ ভারতে ১৮২৬ থেকে ১৮৭৪ সাল
পর্যন্ত অসম বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময় রেভিনিউ কমিশনার জেনকিনস অসমে
বাংলা ভাষার প্রচলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রসেনজিৎ চৌধুরী, শিবনাথ
বর্মনের মতো মননশীল প্রগতিবাদী লেখকরা এই যুক্তির বিরোধিতা করেন। লক্ষীনাথ
বেজবরুয়াও “জোনাকি পত্রিকা”য় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। শুধু তাই
নয়, খৃস্টান পাদ্রীরাও আসমিয়া ভাষাকেই চেয়েছিলেন। হয়ত তখনও বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান
আর হিন্দুরা খ্রিস্টধর্মকে সে ভাবে গ্রহন করে উঠতে পারেনি কিংবা অসমিয়ারা কিছুটা
কাজে পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। এর ফলস্বরুপ ১৮৭২ সালে অসমের স্কুল থেকে বাংলা ভাষা
সরিয়ে অসমীয়া ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
ভাষার
মাধ্যমে ভারতীয়দের মনে বিষ ছড়াবার আরেকটা পরিকল্পনা ততদিনে ব্রিটিশরা ভেবে
নিয়েছিলেন। ১৮৬৬-তে প্রশাসনিক সুবিধা
ও সুবিচারের জন্য তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা স্যার স্টাফোর্ড
নর্থকোট, স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড, স্যার হেনরি কটন, অ্যান্ড্রু ফ্রেজার হয়ে অবশেষে লর্ড কার্জনের মধ্যে
দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর কার্যকর হয়।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের প্রস্তাবে পালিত হয়
রাখিবন্ধন উৎসব। ১৯০৫-এর ৭ আগস্ট টাউন হলের ঐতিহাসিক সমাবেশে সেদিন জনসমুদ্রে
নেমেছিল জোয়ার। ২৬ আগস্ট ১৯০৫, ধর্মীয় প্রভেদ ভুলে হিন্দু মুসলমান ঢাকার প্রতিবাদী সমাবেশে সকলেই
এগিয়ে এসেছিলেন।
পথে পথে সবার মুখে শোনা গিয়েছিল-
"মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!
কী
যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
গেয়ে
গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা ।।"
তবে
অসমের বরাক উপত্যকায় এই আন্দোলন সুখকর হয়নি। বাঙালীরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও
যেন প্রবাসী হয়ে ছিল। ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ভাষা বিচ্ছেদ' প্রবন্ধে
লিখেছিলেন, সাযুজ্য
বশত অসমিয়া ও ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার সাথে একদিন মিশে যাবে। কিন্তু সেখানেও
লক্ষীনাথ
বেজবরুয়া এই কথার বিরোধিতা করেন। অবশ্য অসমিয়াদের হীনমন্যতাই এর কারণ ছিল। 'ভারতের
স্বাধীনতা সংগ্রামত অসমর অবদান' গ্রন্থে লক্ষীনাথ তামুলী লেখেন,
"বাঙালি
বিদ্বেষে ভাষার স্বাতন্ত্র্য হারানোর আশঙ্কার চেয়ে বেশি ছিল আর্থিক নিরাপত্তার
প্রতিশ্রুতিতে ধ্বস নামার চিন্তা।"
অসমিয়া
জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা হল 'অসম ছাত্র সাহিত্য সম্মেলনী'।
জাতি জনগোষ্ঠীর বিভেদ আর সংঘাতে অসমের বাংলা ভাষী মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে
তুললো। দেশভাগের পর বাংলাদেশ থেকে অনেক বাঙালি আসায় সংকট আরও ঘনীভূত হল। ধীরে ধীরে
বাঙালিরা নিজের ভূমিতেই উদ্বাস্তু রূপে পরিগণিত হলো। এর প্রভাবে আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির
বাঙালি এলাকায় অসমিয়াদের অত্যাচার বেড়েই চলল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গৌহাটি শহরেই শুরু হয়
বাঙালিদের উপর আক্রমণ, সঙ্গে চলে হুমকি এবং নির্যাতন।
১৯৫০
সালে অসমে গড়ে ওঠে "বাঙালি খেদাও" অভিযান। এভাবেই ইতিহাসের সুরমা উপত্যকা ধীরে ধীরে মৃত্যুর
উপত্যকায় পরিণত হয়। তার ঠিক দশ বছর পরে
রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ১৯৬০-এর ২১-২২ এপ্রিল অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভায়
অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য সে প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ে এবং সরকারি ভাবে কার্যকর করার
জন্য মন্ত্রিসভাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভাষা
আন্দোলনের প্রতিবাদী সুর তখন অসমের প্রত্যেক বাঙালীর রক্তে ছড়িয়ে গেছে। দেশের
স্বাধীনতার পর ভাষার স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। তবে এবার বিদেশী নয়, নিজের
দেশেরই বিমাতৃক মনোভাবাসম্পন্ন কিছু রাজনৈতিক নেতা সামিল হন।
২০ মে ১৯৬১, কার্ফু ভঙ্গ করে শিলচরে মিছিল
ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ রঞ্জিত বরপুজারি
পূর্ব পাকিস্থানের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের ছায়া অসমেও ঘনিয়ে আসে। ভাষা আন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্ত গণজাগরণ ঘটে। ১৯৬১-র ৫ই ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জের গণ সমাবেশে সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, আব্দুর রহমান চৌধুরী, নলিনীকান্ত দাস এবং বিভুভূষণ চৌধুরির নেতৃত্বে জেলা ওয়ারি ‘গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। আইনের বিরুদ্ধে এই গণসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বরা শহর ও গ্রামে জনসচেতন ও জনসংযোগ গড়ে তুলতে থাকে।
অবশেষে
আসে ১৯ মে। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধে সরকারের বাহিনী ট্রেন
চালাতে ব্যর্থ হন। ১৯ মে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
পুলিশ এদের অনেককেই গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। বিভিন্ন দফায় লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাসের ব্যবহার করা
হয়।
বেলা
তখন ২টো বেজে ৩৫। রেলস্টেশনে কর্তব্যরত বি এস এফ এর সদস্যরা হঠাৎ গেরিলার ভঙ্গিতে
গুলিবর্ষণ আরম্ভ করল। স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় জালিয়ানওয়ালাবাগ। গুলিবিদ্ধ হয়ে
তৎক্ষনাৎ শহীদ হন ৯ জন। পরদিন স্টেশনের পুকুর থেকে সত্যেন্দনাথ দেবের বুলেটবিক্ষত
দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেন্দ্র সূত্রধর। মোট ভাষা শহিদদের
সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ জন। গুলিতে আহত হয়েছিলেন অনেকে। তাদের মধ্যে
অন্তত ৩০ জনকে শিলচর সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসার
পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই ৩০ জন কর্মীর মধ্যে কেউ কেউ তাদের জীবনের বাকি অংশ
ব্যথা এবং বুলেটের আঘাতের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে ছিলেন।
বাংলাভাষা
সংগ্রামের একমাত্র নারী শহিদ কমলা ভট্টাচার্য মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েই ভাষা আন্দোলনে
ঝাঁপিয়ে পড়েন। ষোল বছর বয়সে তিনি শহিদ হন। পিতৃহীন কমলা ছিলেন অবিবাহিতা, থাকতেন ভাই
রামরমণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিলচর শহরে। তাদের পরিবার ১৯৫০ সালে সিলেট ছেড়ে কাছাড়ে
আশ্রয় নেন।
তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে কমলা ছিলেন তৃতীয়। সেদিন একটা কিশোরীকে
গুলি করতেও কাপুরুষদের হাত কাঁপেনি।
মাত্র
উনিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বুকে গুলি পেতে নিয়েছিলেন শচীন্দ্র
পাল। তাদের পূর্বনিবাস ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার নবিগঞ্জের সন্দনপুর গ্রামে।
ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে শচীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। কাছাড় হাইস্কুল থেকে
মেট্রিক পরীক্ষা দেন। ১৭ বছরের ক্ষুদিরাম তো তবুও ফাঁসির দড়িতে
ঝোলার আগে পর্যন্ত বিদেশীদের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। সে সুযোগও স্বাধীন
সরকারের কর্মচারীরা দিতে রাজি হয় নি।
সেদিনের
ভাষা শহিদ ময়মনসিংহ
জেলার খিলদা গ্রামের ৩৭ বছর বয়সী কানাইলাল নিয়োগী ছেড়ে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রী দুই
ছেলে ও দুই মেয়েকে। তখন
তার মা শান্তিকণা নিয়োগীর বয়স ৭০ বছর। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী আগেই প্রয়াত।
মা, স্ত্রী ও সন্তানদের মুখ চেয়ে বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন-
"মৃত্যুতো জীবনের সাথী। কেন রব ভয়ে,
যেতে হবে শুধু সংসারে বিদায় জানিয়ে।
বিদায় এ ক্ষণিকের বাস, আঁখিজল রেখ ধরে,
রব বসে সেথা তোমাদের সবার তরে।"
কুমুদ রঞ্জন দাস, সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। বুলেটের আঘাতের সময় মুখ থেকে যে প্রাণভেদী আর্তনাদ উঠেছিল, সেটাও কিন্তু মাতৃভাষায়। হয়ত শেষ জীবনীশক্তি দিয়ে প্রিয়াকে বলে গিয়েছিল, ভেঙে পোড় না। এরা আমার নশ্বর শরীরটাকে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু আমার ভালবাসাকে নয়। এ ভালবাসা আমার মায়ের ভাষার মতই পবিত্র।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের সময় শিলচরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন পিতা যোগেন্দ্র দেবনাথ। ২১ বছরের তরতাজা ব্যবসায়ী তরণী দেবনাথের মনে অনেক স্বপ্ন ছিল। জীবনকে ভালকরে দেখার আগেই চলে যেতে হল। বুলেটবিদ্ধ নিথর শরীরটা হয়ত পড়ে ছিল। কিন্তু স্বাধীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাকে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, স্বাধীনতা আমরা এনেছিলাম। তোমরা তো তার অর্থই বুঝতে পারনি। তাই স্বাধীনতাকে হত্যা করে তোমরা আবার পরাধীন হলে। রবির আলোকে তাই আমি চললাম-
“কোটি কোটি ছোটো ছোটো মরণেরে লয়ে
বসুন্ধরা
ছুটিছে আকাশে,
হাসে
খেলে মৃত্যু চারি পাশে।
এ
ধরণী মরণের পথ,
এ
জগৎ মৃত্যুর জগৎ।"
বাস্তহারা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পিতৃহীন হীতেশ বিশ্বাস মাত্র বারো বছর বয়সে ত্রিপুরার খোয়াই শহরের উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দা হন। মা, ছোট ভাই ও এক বোনের সংসার ছিল তাদের। শিলচর শহরে ভগ্নিপতির বাসায় অবস্থানকালে শুধুমাত্র নিজের মাতৃভাষার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছিলেন।
পিতৃহীন
চন্ডীচরণ সূত্রধর ১৯৫০ সালে হবিগঞ্জের জাকেরপুর গ্রাম থেকে মামার সঙ্গে উদ্বাস্তু
হয়ে আশ্রয় নেন শিলচরে। পড়াশোনা এম.ই. পর্যন্ত। জীবিকা হিসেবে পৈতৃক বৃত্তি
কাঠমিস্ত্রির কাজেই নিয়োজিত করেন নিজেকে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভাষার জন্য আত্মদান
করেন।
চির সংগ্রামী সুনীল সরকারকে একটা বুলেটের
আঘাত থামাতে পারে নি। ইংরেজদের ফাঁসির দড়ি কি হাজার শহিদদের দাবিয়ে রাখতে
পেরেছিল? পারেনি। ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তাই প্রত্যেকটা ভাষার যোদ্ধার মৃত্যু
সরকারী বুলেট দিয়ে থামান যাবে না। ভাষা সংগ্রামের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে উনি
চিরকাল বেঁচে থাকবেন কবিগুরুর ভাষায়।
"যতটুকু বর্তমান, তারেই কি বল’ প্রাণ?
সে
তো শুধু পলক, নিমেষ।
অতীতের মৃত ভার পৃষ্ঠেতে রয়েছে তার,
না
জানি কোথায় তার শেষ।"
করিমগঞ্জের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিতা সঞ্জীবচন্দ্র পুরকায়স্থ ডিব্রুগড়ে ব্যবসা করতেন। অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে ‘বাঙ্গাল খেদা’ অভিযানের শিকার হয়ে সপরিবারে স্বগ্রামে চলে আসেন। ভাষা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়ে মাতৃভাষার ঋণ শোধ করেন সুকোমল। হায় রে স্বাধীন ভারত।
শৈশবে বাস্তুহারা হয়ে পিতামাতার সঙ্গে
হবিগঞ্জের নবিগঞ্জের বহরমপুর গ্রাম থেকে শিলচর যান বীরেন্দ্র সূত্রধর।
জীবিকার অন্বেষণে বর্তমান মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে গিয়ে কাঠমিস্ত্রির পেশা
অবলম্বন করেন।
বিয়ে করেন ত্রিপুরার ধর্মনগরে। পরে কাছাড় জেলায় অবস্থিত মণিপুর চা বাগানের
কাছে ঘর ভাড়া নেন।।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রী ও এক বছর বয়সী কন্যাকে রেখে
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে শহিদ হন। শিলচর রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর
হাসপাতালে ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর শান্ত মুখটা দেখে তাঁর
সদ্যবিধবা স্ত্রী কি সিঁথির সিঁদুর মুছতে পেরেছিলেন? অব্যক্ত কান্নায় হয়ত বলে
উঠেছিলেন রবি
ঠাকুরের কিছু
কথা নিজের মাতৃভাষায়।
"মরণেরে জীবনের প্রিয়
নিজ
হাতে করিয়াছ প্রিয়া।
খুলিয়া দিয়াছ দ্বারখানি,
যবনিকা লইয়াছ টানি,
জন্মমরণের মাঝখানে
নিস্তব্ধ
রয়েছ দাঁড়াইয়া।
তুমি মোর জীবন মরণ
বাঁধিয়াছ
দুটি বাহু দিয়া।"
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করেন সত্যেন্দ্র দেবনাথ। উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় নূতন রাজনগর কলোনিতে তিন বোন ও মাকে নিয়ে আশ্রয় নেন পিতৃহীন প্রাইমারি পাশ সত্যেন্দ্র। মা ও বোনকে সেখানে রেখে জীবিকার অন্বেষণে শিলচরে গিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। তার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় ২০ মে শিলচর রেল স্টেশনের পুকুর থেকে। মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ কি শুনেছিল সেদিনের পুলিশ, নাকি হত্যালীলার আনন্দে বেহুঁশ হয়েছিল। সেই সন্ধ্যায় তাঁর বোনেরা ভাইয়ের নিঃস্পন্দ শরীরটাকে দেখে অসহায় ভাবে কেঁদে উঠেছিল।
"সেদিন রবি ছিল ম্লান, ধুসর হয়েছিল গোধুলির আসমান
পারেনি রক্তিম হতে আর, দেখেছিল
তাদের যেতে পরপার।
সেদিল জলধর ছিল নির্জল, দামিনীতে
ছিল না কোন বল
আসমানে কেঁদেছিল তারা, তমসায়
লুকিয়ে জলধারা।"
ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে তৈরি মূর্তি, উধারবন্দ
মৃত্যু এখানেই থেমে থাকেনি। ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট শহীদ হন বিজন চক্রবর্তী। এরপর ১৯৮৬ সালে আরও দুই ব্যক্তি শহীদ হন। এনারা হলেন জগন্ময় দেব এবং দিব্যেন্দু দাস।
অসংখ্য
বিপ্লবীদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ওই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসাবে
বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে কতৃপক্ষ বাধ্য হয়।
১১ জন ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর
দেওয়া নির্দেশের উপর ভিত্তি করে গৃহীত সংশোধনী আইনে কাছাড় জেলায় বাংলাভাষা
ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। এভাবেই আসাম রাজ্যে ভাষা আন্দোলনের
চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধানসভায় স্বীকৃতি পায়।
তথ্যসুত্রঃ
bangla,thedailystar.net
bangla,thedailystar.net
https://www.sylhettoday24.news
https://bn.wikipedia.org
https://m.somewhereinblog.net
https://www.groundxero.in
চিত্রসূত্রঃ অন্তর্জাল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন