নটী শব্দটা কানে আসলেই আলোর গতিবেগের মতো 'বিনোদিনী' নামটা মাথায় আসে, 'নটী বিনোদিনী।' কিন্তু, কে এই বিনোদিনী? কেন আসে তাঁর নামটা মাথায়? কেন তাঁর নামের আগে নটী শব্দটি উপসর্গরূপে স্থাপন করা হয়েছে? বিনোদিনীর পুরো নাম 'বিনোদিনী দাসী।' ঊনবিংশ শতকের বাংলা মঞ্চের একজন অভিনেত্রী। তার ১২ বছরের স্বল্প অভিনয় জীবনের মধ্যেই তিনি মঞ্চাভিনয়ে বিপুল সাফল্য অর্জন করেন। এতোটাই সাফল্য যে, স্বয়ং, শ্রী রামকৃষ্ণদেব বিনোদিনী দাসীর 'চৈতন্যলীলা' নাটকটি দেখতে যান ও তাঁকে আশীর্বাদ করেন আর তার ঠিক দুবছর পরই তিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করেন। তারপর দীর্ঘদিন জীবিত থাকলেও কখনও অভিনয়ে ফিরে আসেননি। ফলে বাংলা থিয়েটার বঞ্চিত হয় এক অসামান্য অভিনেত্রীর প্রতিভা এবং অভিনয় থেকে। কিন্তু, কেন এই ত্যাগ? বৃত্তির শীর্ষে থেকে, এতো খ্যাতি ও টাকা অর্জনের পরেও? থিয়েটারকে পাগলের মতো ভালোবেসেও?
তিনি বারবণিতার পরিবেশ থেকে একেবারে ছোট বয়েসে বাংলা মঞ্চে অভিনেত্রী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম অভিনয় শুরু হয় ১২ বছর বয়সে মাত্র মাসিক দশ টাকা বেতনে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে 'শত্রুসংহার' নাটকে দ্রৌপদীর সখীর ছোট্ট ভূমিকার হাত ধরে। বৃত্তির আরও শীর্ষে পৌঁছোন তাঁর গুরু 'গিরীশ ঘোষ' (নাট্যকার) এর হাত ধরে। আমাদের বিনোদিনী দাসীর জীবনে থিয়েটার ছাড়াও আরও একটি ভালোবাসা ছিল, যাঁর নাম 'কুমার বাহাদুর'। বিয়ে করার প্রতিশ্রুতিও দেয় সে তার নির্মল বেণিকে। কিন্তু, শেষরক্ষা হয়না, সামাজিক চাপ ও পারিবারিক চাপের দোহাই দিয়ে সে অন্য এক নারীকে বিয়ে করে। ছেড়ে দেয় তার বেণির হাত, তাকে কয়েকদিনের রক্ষিতা করে। তিনি ছিলেন এক ধনী জমিদার, তাই তার সামাজিক মান বজায় রাখতেই নাকি তার বাবার এই সিদ্ধান্ত। নটীর সাথে প্রেম করা যায়!! যায় না সংসার করা!! যায় না নিজের স্ত্রী হিসেবে সামাজিক মর্যাদা দেওয়া। হায় রে সমাজ!!! এই তীব্র লাঞ্ছনা, প্রতারণা বুকে চেপেও বিনোদিনী চালিয়ে যান অভিনয়, তাঁর ভালোবাসার থিয়েটার, কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, থিয়েটার কখনো তাঁকে প্রতারণা, লাঞ্ছনা দেবে না। দুঃখের বিষয় এই বিশ্বাসকে আশ্রয় করে বিনোদিনী বেশিদিন অতিবাহিত করতে পারেননি।
১৮৮৩ সালের দিকে গিরিশ ঘোষ স্টার থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন। কারণ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক ছিলেন একজন অবাঙ্গালী ব্যবসায়ী প্রতাপচাঁদ জহুরী, যিনি থিয়েটারকে ব্যবসা হিসেবেই দেখতেন। তাই তার অধীনে কাজ করা গিরিশ ঘোষ এবং বিনোদিনী কারও পক্ষেই সহজ ছিল না। থিয়েটার গড়ে তোলার জন্য যে রকম টাকা পয়সা দরকার ছিলো, তা গিরিশ ঘোষের ছিল না। একজন ২০-২১ বছরের ব্যবসায়ী গুরমুখ রায় অর্থ সাহায্য প্রদান করেন। থিয়েটারের চেয়ে তার বিনোদিনীর প্রতিই বেশি আকর্ষণ ছিল। তিনি ছিলেন বিনোদিনীর জন্য পাগল। শর্ত রাখেন, টাকা তিনি দেবেন, কিন্তু, তার বিনিময়ে সে চায় বিনোদিনীকে। মনে আপত্তি নিয়ে সে তাঁর আপন থিয়েটারের কর্মী ও তাঁর শ্রদ্ধ্যেয় মাস্টারমশাইকে প্রশ্ন করে যে এ কি করে সম্ভব? কিন্তু, সে জানত না যে অর্থ, খ্যাতি ও নিজেদের স্বার্থের জন্য বিনোদিনীই তাদের একমাত্র হাতিযার। থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে গুরমুখ রায়ের রক্ষিতা পর্যন্ত হতে বাধ্য করে। খানিকটা মগজধোলাই ও বিনোদিনীর থিয়েটারের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠে 'স্টার থিয়েটার।'
যদিও বিনোদিনীকে বলা হয়, রীতিমতো তাকে গুরমুখ রায় কথা দেন যে সেই থিয়েটার হবে বিনোদিনীর নামে, "বি থিয়েটার।" সেই খুশিতে সে রক্ষিতা হওয়ার গরলও পান করেন। এই পাষাণের দুনিয়াতে ছেলেমানুষ বিনোদিনী বড্ড বেশিই বোধহয় আবদার করে ফেলেছিল বা আশা করে ফেলেছিল। থিয়েটার তৈরী হয়, তবে নাম রাখা হয় 'স্টার থিয়েটার।' যুক্তি দেওয়া হয়, মানুষ এক নটীর নামে নাম রাখা থিয়েটারে নাটক দেখতে আসবে না। কি অদ্ভুত এই সমাজ, এই ভদ্র সমাজ, যা নিতান্তই তথাকথিত, যে কিনা নটীর নাটক দেখতে আসবে কিম্তু, তার নামে থিয়েটার হল হলে তাতে নাটক দেখতে আসবে না। এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আসলে নারীর সাফল্য হজম করতে অক্ষম। নারীর নামে নামকরণ ও তাতে পুরুষকর্মী কাজ করবে!! সেটিতে বিরক্ত। কথা দিয়েও কথা না রেখে বিনোদিনীকে চরম আঘাত দেয় তারাই, যাদের বিনোদিনী নিজের মনে করতো। মহাভারতের যুগ থেকেই প্রমাণিত যে নারীকে সর্বদাই বস্তুরূপে কল্পনা করা হয় ও সেই কল্পনাকে বাস্তবায়ন করা হয় রীতিমতো ,এমনকি ভোগের বস্তুরপেও। তাকে সহজেই বাজি রাখা যায়। ঠিক যেমন বিনোদিনীকে ব্যবহার করল তারই তথাকথিত কাছের লোকেরা শুধু মাত্র একটা থিয়েটারের লোভে, পুঁজিবাদের লোভে। একসময় যার সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখছিল বিনোদিনী তার তলোয়ারের আঘাতও যেন তার জীবনের প্রাপ্য।
বিনোদিনী অপেরা একটি সঙ্গীত-ভিত্তিক নাটক যা অবন্তী চক্রবর্তী রচিত এবং পরিচালিত। সহ-লেখক হিসেবে শিবাশিস বন্দোপাধ্যায়। রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায় একজন ড্রামাটর্গের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
বিনোদিনীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী, কুমার বাহাদুর- পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, গুরমুখ রায়-সুজন মুখোপাধ্যায়। এছাড়াও আছেন অভিজিৎ গুহ, প্রকাশ ভট্টাচার্য, বিশ্বজিৎ দাস, তথাগত চৌধুরী, ইন্দুদীপা সাহার মতো অভিনেতারা। সঞ্চয়ন ঘোষের সেট পরিকল্পনা অবশ্যই দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত। মাঝখানে রস্ট্রাম রেখে কিছু রঙিন মোটা দড়ির ব্যবহার নারীদের পায়ে শুধু নয়, জীবনটাকে বেঁধে রাখার ইঙ্গিত দেয়। বিনোদিনীর জীবনের এই বিষাদঘন মর্মস্পর্শী কাহিনি আমরা অনেকেই জানলাম। তবে অবন্তী চক্রবর্তী ও শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘বিনোদিনী অপেরা’ কোনও জীবনী নয়, তাতে তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা, চরিত্র আর নাট্যমুহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে। কিছুটা কোলাজের কায়দায় অবন্তী তাঁর নির্দেশনায় একধরনের জ্যামিতিক প্যাটার্নে কোরিওগ্রাফি করেছেন অনেকগুলি দৃশ্য।
সুদীপ্তা চক্রবর্তীর নজিরবিহীন অভিনয় নাটকটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।থিয়েটারটি গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল বসু, গুরমুখ রায়, কুমার বাহাদুর, রঙ্গবাবু এবং তৎকালীন বাংলা থিয়েটারের আধিক্যের ঐতিহাসিক উপস্থিতি সহ একটি সমন্বিত কাস্টকে মূর্ত করে।‘আঙ্গিক’ এর এক অসাধারণ প্রযোজনা এই বিনোদিনী অপেরা। যদিও কোরিওগ্রাফী নিয়ে আরেকটু ভাবা যেত, এছাড়া সবই অনবদ্য। থিয়েটার সমসাময়িক সময়ের পিতৃতান্ত্রিক শ্রেণিবিন্যাসকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করে গানের আখ্যান এবং ব্যাখ্যামূলক পরিবেশনার মাধ্যমে। মজার বিষয় হল, যথেষ্ট, পিতৃতন্ত্রের উপস্থিতি সময়ের সাথে খুব বেশি মিশে যায়নি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন