চলচ্চিত্র - মানিকবাবুর মেঘ
অভিনয়ে - চন্দন সেন, দেবেশ রায়চৌধুরী, নিমাই ঘোষ, ব্রাত্য বসু, অরুণ গুহঠাকুরতা
পরিচালনা - অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়
কয়েকদিন আগে সদ্য নির্মিত বাংলা ছবি দেখলাম।,"মানিকবাবুর
মেঘ।" প্রথম কুড়ি মিনিট দেখে মনে হচ্ছিল যে টাকাটা জলে গেল। কিন্তু, ধীরে ধীরে ছবি যত এগোতে লাগল তত মনে হতে লাগল হয়তো তা নয়। আমি নিজে সমাজের একটা অনুকূল জায়গায় বিরাজমান বলে হয়তো ছবিটা কেমন একটু
ন্যাকা, একটু বোকা প্যানপ্যানে ধরণের লাগছিল। কিম্তু, পরবর্তী সময়ে এই ছবি বাধ্য করল ভাবতে, যে মানুষ কত একা হতে পারে। কলকাতার মতো ভিড়ে ভর্তি শহরে, হাজারো চেনা ও অচেনা মানুষের মাঝেও সম্পূর্ণ একা থাকতে পারে। নিত্যদিনের কাজ,
দায়িত্ব, কর্তব্য পালনের মাঝে সে ক্লান্ত, সঙ্গীহীন। সে যে সঙ্গীহীন তা বোঝার বা
ভাবার অবকাশও হয়তো তার হয়ে ওঠে না। সাংসারিক জটিলতা, দারিদ্রতার নীচে সেই একাকীত্ব চাপা পড়ে যায়। একটা ছাপোষা চাকুরিজীবীকেও যে কেউ
ভালোবাসতে পারে, তার ভালো চাইতে পারে, তার দিকে ঘন্টার পর
ঘন্টা তাকিয়ে থাকতে পারে, তা তার কল্পনার বাইরে। যদিও তার কল্পনার জোরেই তার এই ধারনা।
ভালোবাসার সম্পর্ক বা ভালোলাগার সম্পর্ক মানুষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, কখন কার বা
কীসের প্রতি আকর্ষণের বীজ, বৃক্ষের আকার ধারণ করে তা বলা মুশকিল। সেই আকর্ষণ নিতান্তই
একাকিত্বের ফল। আচ্ছা,
মেঘ কে কি ভালোবাসা যায় ? কারণ, মেঘকে ভালোবাসা বা তার সাথে যৌনতা মানে
সমাজের সীমালঙ্ঘন করা, সমাজ তাকে পাগল বলে পরিচয় দেয়। কোন পরিস্থিতিতে, কেন, একটা
মানুষ এইরকম ভালোলাগা বা অনুভুতির শিকার হয়, সমাজ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চায় না। একটা
আমিত্বহীন জীবন কাটাতে কাটাতে যখন হঠাৎ আমি, আমার ও আমাকে এই অনুভূতিগুলোর জন্ম হয় তখন
যেন সবকিছুই বেশ অন্যরকম লাগে। বুদ্ধি, যৌক্তিকতা এসবকে তুচ্ছ মনে হয়।
চন্দন সেন
একজন বড়ো মাপের অভিনেতা, কিন্তু তাঁর অভিনয় এই ছবিতে সব মাপকাঠিই ছাড়িয়ে গেছে। বোধের একটা
পর্যায় না থাকলে যেন উপলব্ধি করা যাবে না এই মহাকাব্যিক ছবি। এ যেন এক জীবন্ত
জীবনানন্দ। অদ্ভুত এক অনুভূতি এই ছবি। এই ছবির বিস্তৃতি বহুদূর, যা মনের মধ্যে রয়ে
যাবে চিরস্থায়ী হয়ে। সমাজের এক অনবলোকিত বাস্তবকে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক ও পরিচালক
অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রথম ছবির মাধ্যমে। যা দেখতে বা মেনে নিতে তথাকথিত সংস্কৃতিবান ও প্রগতিশীল
সমাজের অসুবিধে হবে। শারীরিক চাহিদা, মানসিক চাহিদা, ভালোবাসা, কল্পনা, যৌনতা ও
সাহচর্য্যর মতো অসীম ও অমেয় বিষয়গুলিকে একটা ছকে ফেলে দিয়ে সমাজ বিচার করে। এই
বিচার অতিক্রম করেছেন মানিকবাবু তাঁর মেঘের হাত ধরে।
চলচ্চিত্রগ্রহণ অনবদ্য এই
ছবিতে। অনুপ সিংকে কুর্নিশ তাঁর এই অসামান্য কাজের জন্য।চলচ্চিত্রের শুভজিৎ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনা যোগ্য সঙ্গত করেছে।
এই ছবি ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর এস্তোনিয়ায়, ২০২২ সালের ৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৩ আগস্ট যুক্তরাজ্যে, ২৩ আগস্ট হংকং সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে মুক্তি পায়। ২০২৪ সালের ১২ই জুলাই ভারতের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য চন্দন সেন রাশিয়ায় প্যাসিফিক মেরিডিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন