বিলুপ্ত শিল্পের ইতিহাস বলে দেয় - মানদাসুন্দরীর কাঁথা



  • বই - মানদাসুন্দরীর কাঁথা 
  • লেখক - তাপস রায় 
  • প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারী ২০১৮
  • প্রকাশনী –  আনন্দ পাবলিশার্স 
  • প্রচ্ছদশিল্পী –  প্রত্যয়ভাস্বর জানা
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা - ১৮৩
  • মুদ্রিত মূল্য – ২০০/-



"যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে,
এ বি শিখে, বিবি সেজে, বিলাতি বোল কবেই কবে"
- কবি ঈশ্বর গুপ্ত

আঠারো শতকের গোড়ার কথা। বাংলায় একদিকে হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিওর মত অ্যাঙলো সাহেব এবং রাজা রামমোহন রায়ের মত দেশীয় শিক্ষিত সম্প্রদায় যখন স্ত্রীশিক্ষার সম্প্রসার ও সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলছেন, তখন অপরদিকে রাধাকান্ত দেব, ঈশ্বর গুপ্ত, রামকমল সেনের মত সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা গোঁড়া হিন্দু সনাতন ধর্মের দোহাই দিয়ে ক্রমাগত প্রবল প্রতিরোধ গড়ে চলেছেন। একই সাথে সেই সময় হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি-মুক্ত হয়ে ব্রাহ্মধর্মের প্রার্থনাকেন্দ্রিক একেশ্বরবাদের প্রবর্তনে কিশোর-যুবাদের অতি উৎসাহ ও 'জাত-ধর্ম বিসর্জন'এর ঘনঘটায় সনাতন ধর্মের গোঁড়া সম্প্রদায় প্রায় বিপর্যস্ত। শিক্ষিত যুক্তিবাদীদের কোনঠাসা করতে অবশেষে অশ্লীল বাক্যপ্রয়োগ, ছড়া রচনা কিংবা সামাজিকভাবে একঘরে করেও নিজেদের অস্তিত্ব সংকটকে কোনোমতে রক্ষা করার চেষ্টায় মত্ত সনাতন-হিন্দুধর্ম পন্থীরা। বাংলার ঠিক এইরকম এক টালমাটাল সামাজিক-ধার্মিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অর্থাৎ বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে রচিত তাপস রায় লিখিত উপন্যাস "মানদাসুন্দরীর কাঁথা"

জমিদার কন্যা কিশোরী মানদার বিয়ে হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব বিপত্নীক জমিদার কৃষ্ণমোহনের সাথে। অন্য গ্রামের জমিদার পত্নী হওয়া সত্ত্বেও মানদা সেইযুগের রীতি অনুযায়ী ঘোমটা টানা অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে ঘরকন্নার কাজে জুবুথুবু হওয়ার পরিবর্তে জমিদারী ও সামাজিক নিয়মের বেড়া লঙ্ঘন করে নিজের শর্তে জীবন কাটানোর পথ খুঁজে নিয়েছিল। নিজের স্বাধীনচেতা মনকে সংস্কারের বিবিধ বেড়াজাল মুক্ত করার জন্য যখন হাজার প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল, সেই সময়ই নিজের প্রায় সমবয়স্ক ও উদারচেতা উচ্চশিক্ষিত দেবর ধরণীমোহনের সংস্পর্শে আসে সে। দুই প্রায় সমবয়সীর মধ্যে ভাবের আদান প্রদানে মানদার  কাছে এক উন্নত জগতের আলোর দিশা উন্মুক্ত হয়। জমিদারের অন্দরমহলে সমস্ত সামাজিক রক্ত চক্ষুর আড়ালে কিশোরী বধুটি ঘটিয়ে ফেলে এক নিঃশব্দ বিপ্লব। বাড়ির সমস্ত অবহেলিত নারীদের পড়াশোনা শিখিয়ে নিজেদের পায়ের তলার জমি শক্ত করার শক্তি জোগান দেয়। এই কার্যে তার যোগ্য জুরিদার হয় তার দেবর। এবং তৎসহ বাড়ির অন্যান্য পুরুষদেরও নিঃশব্দ উৎসাহ ও নীরব সমর্থন তার চলার পথ মসৃণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় তার হাতে আসে তার দিদিমার তৈরি করা এক অসম্পূর্ণ নকশী কাঁথা। মানদার মা প্রসন্নময়ীর নির্দেশে সে এই কাঁথা সম্পূর্ণ করতে শুরু করে। এর থেকেই সে নিজের নারী বাহিনীর স্বনির্ভরতার উপায় খুঁজে পায়। কিন্তু বিধিবাম। কিছু স্বার্থান্বেষী জটিল ও কুটিল প্রবৃত্তির মানুষের চক্রান্তে তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার ভবিষ্যত। এরপর তার কি হয়? কি হয় তার নারী বাহিনীর? ধরণীমোহন তার জীবনে কি প্রভাব বিস্তার করে? এই সমস্ত ঘটনা নিয়েই ১৯৩২ সালে গুরুসদয় দত্ত রচিত এক নাটক মঞ্চস্থ হয়। সে যুগের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ জানানো হয় নাটক দেখার জন্য। অশ্রুসজল নাটকটি দেখার পরই মানদাসুন্দরীর জীবনীতে প্রভাবিত হয়ে কবি জসীম উদ্দিন রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "নকশীকাঁথার মাঠ"।

লেখক তাপস রায়ের লেখা এই প্রথম পড়লাম। সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষায় লেখা উপন্যাসের বেশ কিছু জায়গা গায়ে কাঁটা জাগিয়ে তোলে। এই উপন্যাস রচনা প্রসঙ্গে লেখক জানিয়েছেন - 

"মানদাসুন্দরীর কাঁথাটি সত্যি। এই সুজনি কাঁথাটি জোকার গুরুসদয় মিউজিয়মে আছে। যে ছবিটি প্রচ্ছদে আঁকা হুবহু তাই আছে মিউজিয়মে। কাঁথাটি লম্বায় পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি আর চওড়ায় তিন ফুট দশ ইঞ্চি। এটির কেন্দ্রে আছে পদ্ম। আর পদ্মকে ঘিরে গোল করে সূচ সুতোর লেখা 'শ্রীযুত বরদাকান্ত বসুর কন্যা আমি শ্রীমতি মানদা সুন্দরী দাস্যা মোম হস্তে প্রস্তুত পূর্বক শ্রীযুত পিতা ঠাকুর মহাশয়কে এই সজনী প্রণাম পূর্বক দিলাম।' এই সত্যিটুকু ছাড়া বাকি সবটাই ইতিহাসের কালটিকে ধরে ধরে কল্পনা।"  

কিছু কিছু লেখার পাঠপ্রতিক্রিয়া দেওয়া যায় না, শুধু অনুভবটুকুই বলার চেষ্টা করা যায়। এই লেখা অনুভব করায় গ্রাম বাংলার অন্দরমহলের নারীদের কঠিন জীবন সংগ্রামকে, অনুভব করায় পুরুষতান্ত্রিকতার কঠোর সামাজিকতার আড়ালে থাকা কতিপয় মানবতাবোধ সম্পন্ন পুরুষদের প্রকৃত হৃদয় বেদনা, উপলব্ধি করায় সামান্য সহযোগিতা নিরুপায় অসহায় নারীকে এগিয়ে চলার কতটা শক্তি ও মনোবল জোগান দিতে পারে, বুঝতে শেখায় নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য একজন মানুষ সমস্ত বিশ্বাসের শ্বাসরোধ করে অন্য একজন মানুষের চরম সর্বনাশ করতেও দ্বিধাবোধ করেনা। লেখক অত্যন্ত সুন্দরভাবে আনুষঙ্গিক সমস্ত ঘটনা প্রবাহকে মেলে ধরেছেন। শুধু খেদ রয়ে যায় উপন্যাস সমাপনে। সমাপ্তি আরেকটু বিস্তারিত হলে যেন মন ভরে যেত। জানার বড় ইচ্ছা রয়ে গেল কি হলো শেষে মানদা ও ধরণীর? গোলাপী কি সফল হল নিজের অভিসন্ধিতে? ধরণী ও এমিলিয়া কোথায় গেল? মানদার নারী বাহিনী কি অন্ধকার কাটিয়ে ঊষার আলোয় উদ্ভাসিত হল? মানদাসুন্দরী কি নিজের শিল্পকলাকে জগতের সামনে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল? সক্ষম হয়েছিল তাঁর নারীবাহিনীর মেয়েরা স্বনির্ভর হতে। গুরুসদয় দত্ত রচিত নাটক পরবর্তীকালে বাংলার হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে কিভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল? এরকম আরো বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া রইল।

 জোকা গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত মানদাসুন্দরীর কাঁথাটি

এই উপন্যাসের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ পৃথকভাবে উল্লেখের দাবিদার। মানদাসুন্দরী নির্মিত প্রকৃত কাঁথারই অঙ্কিত রূপকে প্রচ্ছদরূপে ব্যবহার করা হয়েছে। বইয়ের অভ্যন্তরস্থ অলংকরণে গল্পে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনাকে শিল্পী প্রত্যয়ভাস্বর জানা সেলাইয়ের ফোঁড়ের আকারের রেখাচিত্রর মাধ্যমে  অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা মুগ্ধ করে। সাথে সাথেই গল্পের সাথে সমানভাবে সঙ্গত করে পাঠকের কল্পনায় কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই রকম অনন্যধারার চিত্রকলা সত্যিই প্রশংসনীয়। 

বইয়ের আভ্যন্তরীণ অলংকরণ 

কলকাতার সংগ্রহশালার মানদাসুন্দরীর কাঁথা প্রসঙ্গে অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় "দেখা হয় নাই" বইতে লিখেছেন - 

'পশ্চিমবঙ্গের যে সুসন্তানের নামের সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠানটি যুক্ত তিনি স্বর্গত গুরুসদয় দত্ত, আই সি এস। সরকারী পদমর্যাদার চোখ-ধাঁধানো গাগা-চাপকানের ওপর একখানা আটপৌরে নকশী কাঁথা চাপিয়ে এমন অনাড়ম্বর সারল্যে তিনি জীবন কাটিয়ে গেছেন যে, তাঁকে আমরা ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক ও বঙ্গসংস্কৃতির গভীর অনুরাগী বলেই বেশী করে জানি। .....
গুরুসদয় মিউজিয়মে যে শ'দুয়েক নকশী-কাঁথা রক্ষিত আছে তার একটিও পুরুষের তৈরি নয়। এ সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে কিছু লিখিত প্রমাণ আছে। অন্যত্র মুদ্রিত কাঁথার ছবিটি যশোহর জেলার জঙ্গলবাধাল গ্রামের শ্রীমতী মানদাসুন্দরী দাস্যার তৈরি এক নকশী-কাঁথার। দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল এই অপরূপ শিল্পসৃষ্টিটি সম্ভবত এক পারিবারিক বা গ্রামীণ জমায়েতে তিনি তাঁর বাবাকে উপহার দেন। কাঁথাটির কলকাগুলিকে ঘিরে সেলাই-এর অক্ষরে যে কথাগুলি লেখা আছে তা হুবহু নিম্নরূপঃ 

"এই সজনী জঙ্গল-বাধাল নিবাসী শ্রীযুত বরদাকান্ত বসুর কন্যা আমি শ্রীমতি মানদাসুদরী দাস্যা মোম হস্তে প্রস্তুতপূর্বক শ্রীযুত পীতা ঠাকুর মহাশযেকে এই সজনী প্রণামপূর্বক দিলাম। সভ্যগণ মহাশযেরা যে ত্রীটি  হয় মাপ করিবেন।" 

খুব ছোট এ দু'টি বাক্যের মধ্যে 'শ্রীমতী' 'সুন্দরী', 'মম', 'পিতা', 'মহাশয়', 'ত্রুটি' প্রভৃতি অতি সাধারণ কথাগুলির ভুল বানান থেকে মনে হয়, অল্পশিক্ষিতা বা অশিক্ষিতা মানদাসুন্দরী পরিবারের পুরুষদের কাছ থেকে সম্ভবত কোন সাহায্যই নেননি। গুরুসদয় মিউজিয়মের আর একটি নকশী-কাঁথার শিল্পী হরিশ্চন্দ্রকাটিনিবাসী "শ্রীমতি শরলাবালা দেবী"। এখানেও বানানের ভ্রান্তি একই সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করে। এবকম দৃষ্টান্ত আরও আছে। ... মানদাসুন্দরী দাস্যার কাঁথাটিতে 'দাস্যা' শব্দটির ব্যবহারে বোঝা যায় তিনি ছিলেন পিতৃগৃহনিবাসিনী বিধবা কন্যা। সভ্যগণদের ত্রুটি মার্জনা করবার অনুরোধ থেকে মনে হয় এজাতীয় উপহারের অর্পণ উপলক্ষে সামাজিক বা পারিবারিক প্রীতি-সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হত। কী অনির্বচনীয় হৃদ্যতায় যে সে সমাবেশগুলি অভিষিক্ত হত তা এখন কষ্টকল্পনা।'
  
উপন্যাসে বর্ণিত মানদাসুন্দরীর কাঁথা, যে কাঁথায় মানদাসুন্দরী নিজ হস্তে খোদাই করে দিয়েছিলেন নিজ নামের সাথে নিজ গল্পগাথা। সাথেই রচিত হয়েছিল অন্যান্য রমণীকুলের নির্মিত বহু দুষ্প্রাপ্য অপূর্ব সূচীশিল্পের নিদর্শন অনন্য কাঁথাগুলিও। যেগুলি আজও প্রায় দু'শো বছর আগের দুঃসহ নারী জীবনের তথা সামাজিক জীবনের কাহিনী বর্ণনা করে চলে। তাপস রায় লিখিত বইটি একটি অবশ্য পাঠ্য ও সংগ্রহে রাখার মত উপন্যাস। যার সমাপ্তিতে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে ভেসে যায় কোনও এক সুদূর অতীতের বিরাট অট্টালিকার কোনও এক কোণের অন্ধকারাছন্ন এক ঘুপচি ঘরে। যেখানে সাদা থান পরিহিতা এক সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণা সুচের ফোড়ে রচনা করে চলেছে নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, কান্না - হাসির গাথামালা, আর এইভাবেই সে নিজের বেরঙিন জীবনে বুলিয়ে চলেছে রঙের ছোঁয়া। 

তাই তো পল্লীকবি কলমেও ফুটে ওঠে এক আর্তরব - 

“কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে

মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকসী কাঁথাটি ধরে
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ওগাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।”

 

(‘নকশী কাঁথার মাঠ’; জসীম উদদীন) 




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন