এক অনুচ্চারিত প্রেমের কালজয়ী উপাখ্যান

 




ই - ন হন্যতে 

লেখিকা - মৈত্রেয়ী দেবী

পৃষ্ঠাসংখ্যা - ২৬৪ 

প্রকাশকাল -  ১৯৭৪ সাল

প্রচ্ছদ - সত্যজিৎ রায়


"অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো
 ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।"

শ্রীমদ্ভগবদগীতা ২য় অধ্যায়: সাংখ্যযোগ, শ্লোক: ২০

"ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥২০॥"

অনুবাদ : আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না৷ তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না। 

ন হন্যতে” মানে সংস্কৃতে “(একে) হত্যা করা হয়না‌/যায়না”। অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই, বিনাশ নেই। এটি মূলত একটি আত্নজৈবনিক উপন্যাস।মৈত্রেয়ী দেবী লিখিত ‘ন হন্যতে’ ১৯৭৬ সালে ভারতের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত বই। এই বই সম্পর্কে কিছু  বলতে গেলে ‘লা নুই বেঙ্গলী’ বইয়ের উল্লেখ করতেই হয়। ছেলেবেলার প্রেমিক মির্চা এলিয়াদের (লেখকের ভাষায় মির্চা ইউক্লিড) রোমানিয়ান ভাষায় লেখা ‘মৈত্রেয়ী’ বইয়ের (ফরাসি-লা নুই বেঙ্গলী, ১৯৫০; ইংরেজি-বেঙ্গল নাইটস, ১৯৯৩) প্রতিউত্তর হিসেবে মৈত্রেয়ী দেবী লেখেন ‘ন হন্যতে’। ‘লা নুই বেঙ্গলী’ প্রথম প্রকাশের প্রায় চার দশক পর প্রকাশিত হয় ‘ন হন্যতে’।  

বইয়ের বিষয়বস্তুর সারসংক্ষেপ

সামগ্রিক বিশ্লেষণ : 

এই বইটি পড়ে বেশিরভাগ ব‍্যক্তি লেখিকার প্রেম সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। লেখিকার চরিত্র বিশ্লেষণের চেষ্টা করবেন। কিন্তু বইটি যদি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তবে তার অন‍্য আরও অনেক সুন্দর দিক আমাদের চোখে ধরা পড়বে। এখানে তৎকালীন সমাজ ব‍্যবস্থার একটি খুব সুন্দর চিত্র উঠে এসেছে। সমাজে ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার ছিল প্রবল। আমাদের দেশ সেই সময় পরাধীন ছিল, সমাজের একটি অংশ দেশ স্বাধীন করার জন‍্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, তাতে অবশ‍্য তৎকালীন শিক্ষিত বাবু সমাজের একটা অংশ নাক কুঁচকাত, বলত এইভাবে এরা ইংরাজ তাড়াবে? গৃহের অন্দরের ব‍্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারি। তখনকার বাড়ির বউয়ের সংসারের জন‍্য নিঃস্বার্থ আত্মবলিদান সম্পর্কে জানা যায়। তখন মানুষ বিলিতি জিনিস দিয়ে ঘর সাজিয়ে নিজেকে এলিট ভাবতেন। মনে আনন্দ পেতেন। এছাড়াও আরও অনেক ছোট ছোট সূক্ষ্ম বিষয় সম্পর্কে জানতে পারা যায়।

  পিতার সম্পর্কে লেখিকার বক্তব্যঃ

লেখিকার পিতার, কন্যাকে নিয়ে খুব অহংকার ছিল। লেখিকা এই বিষয় নিয়ে মনে মনে অখুশি ছিলেন। তাঁর মতে লোকের সামনে আমার মেয়ে এই, আমার মেয়ে ওই, কি সুন্দর দেখতে, কি সুন্দর কবিতা লেখে - এইসব বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। অথচ তাঁকে অমান্য করলে চরম আঘাত দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সম্পর্ক : 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে লেখিকাদের পরিবারের ভালো যোগাযোগ ছিল। এই বইটিতে রবি ঠাকুরের বিদেশী যাদুকরকে জব্দ করার কথা জানতে পারি। কবির অসামান্য মানসিক শক্তির কথাও জানা যায়। বুজরুকিকে একদম পাত্তা দিতেন না।

মির্চার সাথে বিয়ে না হওয়ার জন‍্য দায়ী কী

এক জায়গায় লেখিকা বলেছেন, মির্চার সাথে তার বিয়ে খ্রিষ্টান বলে হয়নি তা নয়, তার জন‍্য অন‍্য আরও বিষয় দায়ী ছিল।

                     


তরুন বয়সী মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবী 

লেখিকার নিজের এবং মির্চা সম্পর্কে মতামতঃ

লেখিকা নিজেকে সততা, ন‍্যায়ের প্রতিমূর্তি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে এসে অন্যের কাছে যখন জানতে পারলেন মির্চা তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন; সেখানে তাদের শারীরিক সম্পর্কের কথা লিখেছেন, প্রতিরাতে মির্চার ঘরে তিনি যেতেন তা লিখেছেন; এইসব শুনে তাঁর পায়ের তলার জমি সরে যাচ্ছে মনে হয়েছিল। কী লজ্জা! কী লজ্জা! মির্চা এত বড় মিথ্যেটা লিখতে পারল? মির্চার দেশের অন‍্য একজন (সেরগেই সেবাস্টিন) লেখিকাকে বলেছিলেন, তাঁর ( মির্চার) খুব কষ্ট ছিল। সে যে আপনাকে বুঝতেই পারেনি তা বোঝা যায়। তাই তো তাঁর লেখাতেও ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।

  উপসংহার :

এবার কেউ যদি মনে করেন এই বই শুধুমাত্র লেখিকা আর এক বিদেশির অন্তরঙ্গতা নিয়ে লেখা, তাহলে ভুল করবেন। এখানে লেখিকার আত্মার কথন শুনতে পাওয়া যায়। যেখানে দেহগত প্রেম দেহাতীত প্রেমে রূপান্তরিত হয়েছে।সাহিত্যের মানদন্ড শুধু লেখার কারুকার্যে নয় বরং তার জীবন ঘনিষ্টতার ওপরও নির্ভর করে।  লেখকের ব্যক্তিজীবনের অনুভব যখন লেখক নিজেই লিখতে বসেন তখন নিঃসন্দেহে সেই কাজের সাহিত্য আবেদন বহুগুণ বেড়ে যায়।

বি.দ্রঃ  মির্চা এলিয়াদ মৈত্রেয়ী দেবীকে কথা দিয়েছিলেন তাঁদের দুজনের জীবনকালে ‘লা নুই বেঙ্গলী’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হবে না।  সে অনুযায়ী মৈত্রেয়ী দেবীর মৃত্যুর চার বছর পর ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস হতে প্রকাশিত হয় এর ইংরেজি অনুবাদ। পরের বছরই শিকাগো প্রেস দুটো উপন্যাসকেই ভলিউম আকারে একই মলাটে প্রকাশ করে।

                                                    ________________________________

কলমে - সোমা লাই


চিত্র সৌজন্যঃ গুগল

তথ্য ঋণঃ উইকিপিডিয়া

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন