ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক -- কাদম্বিনী বসু গাঙ্গুলি

 

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী 

 

সেদিন সকালে মৃত্যু হয়েছে স্বামীর। বিকালে ডাক এলো আসন্নপ্রসবা এক নারীর বাড়ি থেকে।শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার নির্দিষ্টক্ষণ উপস্থিত। এখুনি প্রয়োজন চিকিৎসকের। সদ্য স্বামীহারা স্ত্রী দ্রুত তৈরি হয়ে নিলেন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে। বাড়িভর্তি আত্মীয় স্বজনের প্রশ্নসূচক মুখের দিকে তাকিয়ে  তিনি বললেন – যে গেছে সে তো আর ফিরবে না, যে নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসছে তাকে তো আনতে হবে!” সকলকে হতবাক করে দিয়ে চলে গেলেন প্রসব করাতে।সুস্থ সন্তান প্রসব করালেন।

 

আর একদিন এক রুগীর বাড়ি থেকে ডাক পেয়ে রুগী দেখতে গেছেন। গাড়ি থেকে তাঁকে নামতে দেখে রুগীর বাড়ির লোকেদের বক্তব্য – ও মা ! ডাক্তার কই ? ডাক্তার আনতে বললাম যে। এ তো মেয়ে!" ঠিকই তো। মেয়ে তো আর ডাক্তার হতে পারেনা। সে যুগে মেয়েরা যে বইয়ের পাতাও খুলে দেখার অধিকারিণী ছিলেন না। 

কলকাতার বনেদী  রায়চৌধুরী বাড়ির মেয়ের প্রসবকালীন জটিলতায় নাকাল দাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মৃত্যু প্রায় আসন্ন। ডাক পড়ল  দেশের একমাত্র মহিলা  ডাক্তারের। তিনি এলেন কঠোর পরিশ্রমে  সফলতার সাথে প্রসব করালেন। মা  ও কন্যা সন্তানের জীবনদান করলেন। কৃতজ্ঞ  পিতা ডাক্তারের দিকে হাতজোড়ে এগিয়ে গেলেন। বললেন - " আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দেব মা? আশীর্বাদ করুণ এই মেয়ে যেন আপনার মতোই ডাক্তার হয়।"  ডাক্তার  জলভরা চোখে  ফিজ ফিরিয়ে দিলেন । বললেন  - "ফিজ দিতে হবে না।  যা বললেন সেটাই করুণ।মেয়েটাকে শিক্ষা দিন। বিকশিত হতে দিন কুঁড়িগুলিকে।" গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।   

এই মেয়ে ও মহিলা ডাক্তারের নাম কাদম্বিনী বসু  গাঙ্গুলী। যিনি আট সন্তানের জননী হয়েও এক নতুন ইতিহাস করেছিলেন।

উনবিংশ শতাব্দীতে নারীকে গৃহকর্ম ,সন্তান ধারণ ও পালনের গণ্ডীতে আবদ্ধ রাখা সমাজে এক বিদ্রোহী নারী চরিত্র ছিলেন ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। ভারতের ও বাংলার প্রথম মহিলা স্নাতক ও মহিলা ডাক্তার। যে সময় ভারতীয় মেয়েদের বহির্জগতে কর্মক্ষেত্রে পা রাখার কথা কেউ ভাবতেই পারতেন না সেই সময় কাদম্বিনী গাঙ্গুলী কলকাতার মত গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজে শুধু যে চিকিৎসা শাস্ত্রের অধ্যয়ন করেছিলেন তাই নয় তার যথাযোগ্য প্রয়োগও করে দেখিয়েছিলেন।যে যুগে নারীরা ছিলেন চরম অবহেলার শিকার, তাঁদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগও দেওয়া হত না সেই যুগে কাদম্বিনী সমাজের রক্ত চক্ষুকে অগ্রাহ্য করে সমস্ত প্রতিরোধের অর্গল ভেঙ্গে অগ্রসর হলেন এবং সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে উঠলেন। সেই উত্তরনের কাহিনী সত্যিই অবাক করার মত।

ভাগলপুর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ব্রাহ্মসমাজের সক্রিয় কর্মী ব্রজকিশোর বসুর আদিবাড়ি বরিশালের চাঁদসিতে হলেও চাকুরীসুত্রে ভাগলপুরে থাকতেন। ১৮ জুলাই ১৮৬১ সালে বিহারের ভাগলপুরে তাঁর কন্যা কাদম্বিনী বসুর জন্ম হয়।সমাজ সংস্কারক পিতা নারী শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হয়ে প্রথমেই নিজের কন্যাকে শিক্ষিত হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করেন।ব্রজকিশোর বসু ভাগল্পুরে অভয়চরণ মল্লিকের সাথে মিলে মহিলাদের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন। ১৮৬৩ সালে সেখানে তিনি নারীমুক্তির জন্য প্রথম ভারতীয় মহিলা সংগঠন ভাগলপুর মহিলা সমিতি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

নিজকন্যাকে শিক্ষিত করে তুলতে উদ্যোগী পিতা কাদম্বিনীকে প্রথমে ইডেন মহিলা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। উচ্চশিক্ষার জন্য কাদম্বিনীকে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। বাবার সাহায্য ও উৎসাহ সঙ্গে থাকলেও কাদম্বিনীর পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহন সহজ ছিল না। কারন তৎকালীন সমাজে নারীশিক্ষাকে সুনজরে দেখা হত না। কিন্তু তেজি কাদম্বিনী সমাজের সমস্ত চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে ১৮৭৩ সালে ভর্তি হন কলকাতায় বালিগঞ্জের হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে।সেই সময় নব্যস্থাপিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্ত্রীশিক্ষায় প্রবল উৎসাহী ব্রাহ্ম সমাজনেতা ও “অবলাবান্ধব” নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক পণ্ডিত দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী। (পরবর্তী কালে স্কুলটির নাম হয় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়)। 

১৮৭৭ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় কাদম্বিনী বসু প্রথম স্থান অধিকার করেন।বেথুন বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তিনি ১৮৭৮ সালে প্রথম নারী হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেন। তার দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে বেথুন কলেজে প্রথম এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) এবং তারপর অন্যান্য স্নাতক শ্রেণী প্রবর্তিত হয়।

১৮৭৮ সালে কাদম্বিনী বসু মহিলাদের মধ্যে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পান। মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ না পেলেও সমস্ত সমালোচকের মুখ বন্ধ করে কাদম্বিনী বসু পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন।

১৮৭৯ সালে বাংলার প্রথম দুই মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমূখী বসু এফএ পাশ করলেন এবং তাঁদের যুগ্ম সাফল্যের  জন্য বেথুন কলেজে বিএ পড়ানোর প্রচলন হল। ১৮৮৩ সালের জানুয়ারিতে ইতিহাস গড়ে দু’জনে বিএ পাশ করেন। দেশের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েট। সে বার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দুই মহিলার ডিগ্রি নেওয়া দেখতে এত ভিড় হয়েছিল যে, পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। ভিড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে ট্রামলাইন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। লর্ড লিটন নিজে তাঁর প্রশংসা করেন। লেডি লিটনের নিজহাতে তাঁকে পুরস্কার ও সার্টিফিকেট প্রদান করেন। এক যুগান্তকারী ইতিহাস  রচনা হল।

কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপলক্ষ্যে লিখলেন - বেঁচে থাক, সুখে থাক চিরসুখে আর। কে বলে রে বাঙ্গালীর জীবন অসার?" 

১৮৮৩ সালে দেশের প্রথম স্নাতক কাদম্বিনীর শিক্ষা ও সৌন্দর্যের খ্যাতি সারা দেশে বহুলচর্চার বিষয় ছিল।সেই সময় দেশ বিদেশ থেকে তাঁর জন্য বিবাহের প্রস্তাব আসতে থাকে।

 

    কাদম্বিনী  গাঙ্গুলি ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি  ( ছবি সৌজন্যঃ গুগল) 

১৮৮৩ সালের ১২ই জুন ৩৯ বছর বয়স্ক বিপত্নিক ও দুই সন্তানের জনক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে ২১ বছর বয়সী কাদম্বিনী বসু বিবাহসুত্রে বাঁধা পড়েন। দ্বারকানাথ বয়সে কাদম্বিনীর থেকে ১৮ বছরের বড় ছিলেন, ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। এই ঘটনা তৎকালীন বাঙালি সমাজে প্রবল সমালোচনার ঝড় তোলে। বিশেষত ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের বিবাহ তখন প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। দ্বারকানাথের বহু আত্মীয়, এমনকি শিক্ষিত ব্রাহ্ম সমাজের এক অংশও এই বিবাহে অংশ গ্রহন করেন নি। তাঁরা দ্বারকানাথের সংসর্গ ত্যাগ করেন। দ্বারকানাথের মেয়ে বিধুমুখী ছিলেন কাদম্বিনীর সমবয়সী এবং ছেলে সতীশ ছিলেন রিকেট রুগী ও মানসিক প্রতিবন্ধী। কথিত আছে ছেলে সতীশের চিকিৎসার সমস্ত ভার কাদম্বিনী নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতে সেই যুগে ডাক্তাররা সবাই পুরুষ ছিলেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাহেব ছিলেন। পর্দানসীন মহিলা সমাজে তাঁদের অনুপ্রবেশ ছিলনা। বিনা চিকিৎসাতেই বহু মহিলার মৃত্যু হত। ছোট থেকে এই ধরনের বিভিন্ন ঘটনা কাদম্বিনীর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তাই স্নাতক পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে তিনি চিকিৎসক হতে চাইলে পিতা সোৎসাহে রাজী হয়ে যান। কিন্তু মেডিকেল কলেজের তরফ থেকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। যুক্তি দেওয়া হয় চিকিৎসা বিদ্যা মেয়েদের জন্য উপযুক্ত নয়। তাছাড়া সমস্ত পুরুষ ছাত্রদের মধ্যে একটি মাত্র মেয়ের পড়াশোনা করাও রীতিমত অসুবিধাজনক। বিশেষ করে শালীনতা বজায় রাখা কঠিন। অ্যানাটমি ক্লাসে শব ব্যবচ্ছেদও একজন মহিলার জন্য সুবিধার নয়। কিন্তু কাদম্বিনীর শেখার ইচ্ছা, পিতা ব্রজকিশোরের উৎসাহ ও স্বামী দ্বারকানাথের প্রবল জেদ ও মেডিকেল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাছে মেডিকেল কাউন্সিল পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। 

১৮৮৩ সালের ২৩শে জুন ( মতান্তরে ২৯ শে জুন) মেডিকেল কাউন্সিল কাদম্বিনীকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি প্রদান করে।সেইসময় বি এ পাশ করলেই বিনা খরচে মেডিকেল কলেজে মেডিসিন পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। কাদম্বিনী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, প্রথম ছাত্রী হিসাবে, দেশের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করলেন। যুগযুগান্তের এক রুদ্ধদ্বার খুলে দিলেন নারীদের জন্য। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন তিনি মাসে ২০ টাকা সরকারি স্কলারশিপের ও অধিকারী হলেন।

শুধু রক্ষণশীল সমাজই নয় মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সমাজও তাঁর চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের অন্যতম রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র তাঁর বিরোধিতা করেন এবং তিন বছর শিক্ষা গ্রহনের পরে ১৮৮৮ সালে মেডিসিনের পরীক্ষায় তাঁকে মাত্র ১ নম্বরের জন্য অকৃতকার্য করিয়ে দেন। কাদম্বিনী বুঝতে পেরেছিলেন , ব্রিটিশ ছোটলাটের আনুকূল্যে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারলেও রক্ষণশীল বাঙালির কূপমণ্ডূক মানসিকতার ব্যূহভেদ করে বেরোনো তাঁর পক্ষে কঠিন, হয়তো বা অসম্ভব। তবে, সেবার ব্রিটিশ অধ্যাপকরা দয়া-পরবশ হয়ে তাঁর পাঠ - নিষ্ঠার কথা মাথায় রেখে গ্রেস দিয়ে তাঁকে পাশ করানোর আর্জি জানালেন। আর্জি মঞ্জুর হয় । কাদম্বিনী পাশ করলেন।কিন্তু পাঁচ বছর কঠোর অধ্যয়নের পর শেষ পরীক্ষায় আবার রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্রের পেপারেই অকৃতকার্য হলেন।কিন্তু তাঁর অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ কোটসের উদ্যোগে, ডাক্তারির ডিগ্রি না পেলেও গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল” সার্টিফিকেট এবং প্র্যাক্টিস করার ছাড়পত্র পেলেন । সার্টিফিকেট কোর্স করিয়ে তাঁকে অবশ্য প্র্যাকটিস করার অধিকার দেওয়া হল। তিনি যোগ দিলেন ইডেন হসপিটালে।কিন্তু সেখানে তাঁকে ডাক্তারের মর্যাদা দেওয়া হল না, তাঁকে দিয়ে নিয়মিত ধাত্রীর কাজ করানো হতে লাগল।

১৮৮৮ সাল থেকেই তিনি নিজস্ব প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। ভারতের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, স্বীকৃত হলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক (প্র্যাকটিশনার) হিসেবে।এই সময়ই তিনি লেডি ডাফরিন হাসপাতালে তিনশো টাকা বেতনের চাকরিতে যোগদান করেন। 

প্রসঙ্গত কাদম্বিনী গাঙ্গুলী বিশ্বের জ্ঞানীগুণী মহলে কী বিশাল বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন, তার নিদর্শন স্বরূপ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের লেখা একটি  চিঠি এক অমূল্য দলিল। সুদূর বিদেশ থেকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেনঃ


 “Do you know or could tell me anything about Mrs Ganguly, or give me any advice? … (she) has already passed what is called the first licentiate in medicine and surgery examinations and is to go up for the final examination in March next. This young lady, Mrs. Ganguly, married! after she made up her mind to become a doctor! and has had one, if not two children since. But she was absent only thirteen days for her lying-in!! and did not miss, I believe, a single lecture!!”

 

[অনুবাদঃ “মিসেস গাঙ্গুলির ব্যাপারে কিছু জান বা আমাকে ওনার বিষয়ে কিছু জানাতে পারো?উনি নাকি ইতিমধ্যেই  ফার্স্ট লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি পাশ করে ফেলেছেন আর আগামী মার্চ মাসে ফাইনাল পরীক্ষা দেবেন। ডাক্তার হবে ঠিক করার পর এই তরুনী মিসেস গাঙ্গুলি বিবাহ করেন!এবং  তারপর অন্তত একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, যদি না দুটি জন্মে থাকে।কিন্তু  মাত্র ১৩ দিন গর্ভকালীন ছুটি নিয়েছিলেন, আর শুনছি একটাও লেকচার মিস করেননি!” (২০ ফেব্রুয়ারী, ১৮৮৮)]

কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রে পূর্ণ ডিগ্রী অর্জনের জন্য দ্বারকানাথ কাদম্বিনীকে ১৮৯২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত পাঠালেন। মাত্র এক বছরেই কাদম্বিনী এডিনবরা থেকে এল.আর.সি.পি ও এল.আর.সি.এস এবং গ্লাসগো থেকে এল.এফ.পি.এস ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন। সব বাধা জয় করে রক্ষণশীল, ঈর্ষাকাতর সমাজের মাথা নত করে হয়ে উঠলেন 'ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক' থেকে 'ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসা-শিক্ষক'

১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বাই শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম যে ছয় জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন, কাদম্বিনী ছিলেন তাদের অন্যতম একজন। পরের বছর কাদম্বিনী কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তারূপে কলকাতার কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। কাদম্বিনী গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রানসভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি এবং ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের সদস্য ছিলেন। 

বিলেত থেকে ফিরে এসে প্রথমে কিছুদিন লেডি ডাফরিন হাসপাতালে সিনিয়র ডাক্তার রূপে যোগদান করেন। অল্পদিন পরেই তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রথমে বাড়িতেই নিজস্ব প্র্যাকটিস শুরু করেন। পসার বাড়তে সময় লাগেনা। এরপরই তিনি দ্বারকানাথের উৎসাহে, নিজস্ব চেম্বার খুললেন বেনিয়াটোলা লেন ও সুকিয়া স্ট্রিটে। কাদম্বিনী ছিলেন প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্র্যাকটিস করতেন। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ বা ‘বেঙ্গলি’র মতো কাগজে নিয়মিত বিজ্ঞাপন বের হত।

হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকাতে যার বিজ্ঞাপনে লেখা হল –

 

MRS. KADAMBINI GANGULY 

B.A. G.M.C.B.Medical Practitioner.

Can be consulted at her residence, 45-5 Beniatola Lane, College Square, Calcutta,

Terms Moderate.

 

কিন্তু গোঁড়া হিন্দু সমাজ একজন নারীর এই সফলতা সহজে মেনে নেয়নি। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন ব্যাঙ্গ – বিদ্রুপ ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। একই সঙ্গে চিকিৎসক ও সফল স্ত্রী এবং দায়িত্বশীল মাতার ভূমিকা অত্যান্ত সফলভাবে পালন করলেও সনাতনপন্থী সাময়িকী “বঙ্গবাসী” তাঁকে পরোক্ষভাবে আঘাত করে।

 ১৮৯১ সালে ‘বঙ্গবাসী’ সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল তাঁর মাথা নত করে দেওয়ার জন্য একটি কার্টুন ছাপলেন, যাতে দেখানো হয়েছিল কাদম্বিনী ভেড়ারূপী তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাকে দড়ি বেঁধে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তার নীচে লেখা ছিল – “ ফিজ দিলেই রাত্রে মিলবে যুবতী ডাক্তার।" কাদম্বিনীকে স্বৈরিণী, চরিত্রহীনা বলে কদর্য ইঙ্গিত করা হল । এই অপমান কাদম্বিনী সহ্য করলেন না। ১৮৯১ সালে দ্বারকানাথ মামলা করলেন শুধু কাদম্বিনীর জন্য নয়, সমস্ত নারী সমাজের জন্য এবং জয়ী হলেন। ‘বঙ্গবাসী’র সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের একশো টাকা জরিমানা, ছ’মাসের কারাদণ্ড হল।সেই সময় এই ধরনের মামলা করা, বিশেষ করে একশক্তিশালী পুরুষ কাগজের সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো নারীর মানহানির মামলা করাটা সহজ কাজ ছিল না।দ্বারকানাথের কঠোর ব্যক্তিত্ব ও কাদম্বিনীর আত্মসন্মানবোধ এই অসাধ্য সাধন করে দেখাল।

আট সন্তানের জননী এক নারী সেই যুগে প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের চিকিৎসা করতেন। যা অত্যন্ত বিরল ঘটনা।দেশীয় ডাক্তারের অভাব, নারীদের পর্দানশীন হওয়া বঙ্গীয় নারী সমাজে কাদম্বিনী আশীর্বাদ স্বরূপ ছিলেন। 


কথিত আছে নেপালের রাজা জঙ্গ বাহাদুরের অসুস্থ মাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন বলে খুশি হয়ে রাজা প্রচুর অর্থ, দামি পাথর বসানো সোনার গহনা, মুক্তোর মালা, রুপোর বাসন, তামা-পিতল-হাতির দাঁতের জিনিস আর একটি সাদা রঙের গোলগাল জ্যান্ত টাট্টু ঘোড়া পুরস্কারে দিয়েছিলেন। সেই ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপেই তিনি কলকাতার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রোগী দেখতে ছুটতেন। রাস্তায় যাওয়ার সময়টুকু অনবরত লেস বুনে যেতেন! যে দক্ষতায় অস্ত্রোপচারে ছুরি চালাতেন, সেই দক্ষতাতেই তৈরি করতে পারতেন অপূর্ব সব লেসের নকশা।

 

কাদম্বিনীর হাতে বোনা কুরুশের লেস ( ছবি সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা) 

এই প্রসঙ্গে বিধুমুখীর মেয়ে পুণ্যলতা চক্রবর্তী তাঁর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ বইয়েই লিখেছিলেন— 

এক দিকে খুব সাহসী আর তেজস্বীনা, অন্য দিকে ভারি আমুদে মানুষ ছিলেন তিনি। যেখানে বসতেন হাসি, গল্পে একেবারে মাতিয়ে তুলতেন। সঙ্গে সঙ্গে হাতও চলত। আমরা হাঁ করে তাঁর গল্প শুনতাম আর তাঁর আঙুলগুলির খেলা দেখতাম। কী অদ্ভুত ভাবে তাড়াতাড়ি কী সুন্দর লেস বোনা হচ্ছে।’’

 নাতনি পুণ্যলতার লেখায় আরও পাওয়া যায়,

বিলেত থেকে উপাধি নিয়ে তিনি যখন দেশে ফিরলেন তখন দেশের লোক খুব আনন্দ ও গৌরব বোধ করলেন এবং আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে বাড়িতে বেশ একটি উৎসবের সাড়া পড়ে গেল। আমাদেরও আনন্দের সীমা রইল না, সুন্দর সুন্দর খেলনা, পুতুল, ছবির বই উপহার পেয়ে। ছোট বড় সকলের জন্যই দিদিমা কিছু-না-কিছু উপহার এনেছিলেন। দিদিমা বিলাত থেকে ফিরলেন, নতুন কায়দায় তাঁর ড্রইংরুম সাজানো হল। দেশ-বিদেশ থেকে আনা কত রকম সুন্দর সুন্দর জিনিস। আমরা সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে, সে সব নেড়েচেড়ে দেখতাম।" 

 

 দিদিমা কতটা শৌখিন তার বিবরণও দিয়েছেন তিনি,

"কাদম্বিনী বেশ সুন্দরী ছিলেন। তখনকার সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশানের শাড়ি, জামা, জুতো পরে সহজ স্বচ্ছন্দভাবে চলাফেরা ও বাইরের কাজকর্ম করতেন।“ পুণ্যলতা জানিয়েছেন, ” বাড়িতে একটা ঘরে ছোটরা ঢুকত না। ওটা ছিল কাদম্বিনীর পড়াশোনার ঘর। ছোটরা বলত ‘কঙ্কালের ঘর’। তার দেওয়ালে মানুষের আস্ত কঙ্কাল ঝুলত। আলমারিতে মোটা মোটা বই, তাকের উপরে সারি সারি শিশিবোতল আর কী সব যন্ত্রপাতি।" 

কাদম্বিনী-দ্বারকানাথ ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে পনেরো বছরের দাম্পত্য জীবন কাটান।ব্রাহ্মসমাজের রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে শান্তাদেবী লিখেছিলেন

‘‘তিনি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবাদিতে আমাদের বাড়িতে আসতেন। ...কাদম্বিনী ভাল ডাক্তার ছিলেন এবং খুব কড়া কড়া কথা বলতেন, অপ্রিয় সত্য বলতে ভয় পেতেন না। নিজের ছেলেমেয়েদেরও বাদ দিতেন না।’’

কাদম্বিনীর সৎ-মেয়ে বিধুমুখীর সাথে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বিবাহ হয়েছিল। সেই সুত্রে বিধুমুখী ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের জেঠিমা। লীলা মজুমদার তাঁর ‘পাকদণ্ডী’ গ্রন্থে লিখেছেন-

তাঁর জীবনটাই একটা আশ্চর্যের বিষয় । আমি যে সময়ের কথা বলছি তাঁর অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বয়সে জ্যাঠাইমার চাইতে সামান্য বড় ছিলেন, দেখে মনে হত অনেক কম। মস্ত দশশই চেহারা, ফুটফুট করত গায়ের রঙ, থান পরে এবং এত বয়সেও রূপ চাপা পড়ত না, তবে কেমন একটা কড়া ধরনের ভাব। আমরা দূর থেকে দেখতাম।" 

 

সাবলম্বী, স্বাধীনচেতা কাদম্বিনী সবসময় বলতেন তিনি কারো কাছে এমনকি নিজ পুত্রেরও গলগ্রহ হয়ে থাকতে চান না। কর্মাবস্থায় সজ্ঞানে তাই মৃত্যু কামনা করতেন। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে শরীর আর তাঁর সঙ্গ দিচ্ছিল না। ১৯২৩ সালের ৩ অক্টোবর ৬২ বছর বয়স্কা কাদম্বিনী সকালে কাঁথাতে নক্সা তুলে রোগীর বাড়ি গিয়ে জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন। বাড়ি ফিরে পরিতৃপ্ত কাদম্বিনী পুত্রবধূ সরলাকে বলেছিলেন, 

বউমা, লোকে বলতে শুরু করেছে, ডাক্তার গাঙ্গুলী নাকি বুড়ো হয়ে গেছেন, তাঁর হাত আর আগের মত চলে না। আজ যে অপারেশন করে এলাম, সে্টা দেখলে তারা আর এ কথা বলতে সাহস করবে না ।” 

 পুত্রবধূর সাথে কথা বলার কিছুক্ষণ পরই স্নান করতে গিয়ে কঠিন সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বাংলার নারী জগতে ইতিহাস রচনাকারী ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলির। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর হাত ব্যাগে পাওয়া যায় তাঁর শেষ রোজগার পঞ্চাশ টাকা। ইতিহাস সৃষ্টিকারী চিকিৎসকের সম্মানে সেই টাকা খরচ করা হয়েছিল তাঁর শেষকৃত্যে। ১৪ই অক্টোবর ১৯২৩, তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মসমাজে উপাসনা করেছিলেন শ্রদ্ধেয় হেরম্বচন্দ্র মৈত্র মহাশয়। কাদম্বিনী তর্পণ খুব ভালোবাসতেন, সেদিন প্রভাতচন্দ্র তর্পণ ও জীবনী পাঠ করেছিলেন।

 

                                                        _______________________________________


 কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


 তথ্য ঋণ : 

অনন্যা কাদম্বিনী--সুবীরকুমার চট্টোপাধ্যায়। 

পাকদণ্ডী – লীলা মজুমদার

ছেলেবেলার দিনগুলি – পুন্যলতা চক্রবর্তী ।

আনন্দবাজার পত্রিকা

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন