সামনেই কালীপুজো। মোমবাতি, প্রদীপ, টুনিবাল্ব, রকমারি বাজি সব নিয়ে আলোয় আলোয় সেজে উঠবে চতুর্দিক। তার সাথেই চলবে পেটপুজো। সেই উপলক্ষ্যেই আজ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবো বাঙালির অতি পছন্দের মুচমুচে মুখরোচক খাবার সিঙ্গাড়ার দু'খানি রেসিপি।
এই প্রসঙ্গে সিঙ্গাড়া নিয়ে একটু গল্প হয়ে যাক। বাংলায় সিঙ্গাড়ার প্রচলনের নেপথ্যে রয়েছে এক জমজমাট কাহিনী। কী সেই কাহিনী? আসুন জেনে নিই।
এই কাহিনীকে একপ্রকারের রাজকাহিনী হিসাবে অভিহিত করা যেতেই পারে। হালুইকর লুচি বানিয়ে রাজসভায় পাঠাচ্ছেন, কিন্তু রাজামশাই সে লুচি হাতে নিয়েই দেখেন একেবারে জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। অতএব লুচি ফেরত পাঠাও। এদিকে রাজামশাইয়ের লুচি অপছন্দ হওয়ায় রাজবাড়ির হালুইকর অনুমতি চাইলেন রাজসভায় মিষ্টান্ন পাঠাতে, এটি চেখে যদি তিনি সন্তুষ্ট হন। কিন্তু মুশকিলটা হলো, রাজামশাই মধুমেহে আক্রান্ত। মিষ্টান্নের কথা শুনে তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন এবং হালুইকরকে শূলে চড়ানোর হুকুম দিলেন। অনেক মিনতি করে নিজের প্রাণ রক্ষা করলেন হালুইকর, কিন্তু এক শর্তে। রাজা আদেশ দিয়েছেন, হালুইকরকে তিনরাত্রের মধ্যে দেশত্যাগ করতে হবে।
দ্বিতীয় রাত্রে হালুইকরের স্ত্রী ঠিক করে দেশত্যাগের আগে একবার দেখা করবে রাজামশাইয়ের সাথে। সেইমতো তৃতীয় দিন সকালবেলায় রাজদরবারে এসে প্রণাম জানায় স্বয়ং রাজামশাইকে। রাজসভায় আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে রাজাকে জানায়, সে নাকি এমনভাবে লুচি তরকারি বানাতে পারে যা মহারাজ আধঘন্টা পর খেলেও গরম পাবেন। এজাতীয় লুচি এবং তরকারি নাকি কিছুক্ষণ বাদে খাওয়াই দস্তুর।
সন্দিহান রাজা কৌতূহলী হয়ে হালুইকরের স্ত্রীকে পাঠালেন পাকশালে। জানিয়ে দিলেন, যখন রাজসভা থেকে খবর যাবে তৎক্ষণাৎ পাকশাল থেকে খাবার পৌঁছনো চাই। হালুইকরের স্ত্রী মৃদু হেসে মহারাজকে জানালো, খাদ্যদ্রব্য রাজসভায় সেই মুহূর্তেই পৌঁছবে, কিন্তু তিনি অনুগ্রহ করে যেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খান। অন্যথায় মহামান্য রাজামশাইয়ের জিহ্বা পুড়ে যেতে পারে। বিস্মিত মহারাজের সামনে দিয়ে হাস্যমুখে হালুইকরের স্ত্রী চলে গেল পাকশালে।
রাজপাচক আলুর তরকারি তৈরি করে পাকশালে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন, হুকুম এলেই লুচি ভাজতে হবে। ময়দার তাল মাখা রয়েছে হাতের সামনে। হালুইকরের স্ত্রী বসলো সেই ময়দার তাল নিয়ে। লেচি কেটে লুচি বেলে কাঁচা ময়দার ভেতর লুচির জন্য তৈরি সাধারণ তরকারি ভরে দিয়ে সমভুজাকৃতি ত্রিভুজের গড়ন বানিয়ে আড়ষ্ঠ রাজপাচকের সামনে খোশগল্প ধরলো।
রাজাজ্ঞা আসতেই তরকারির পুরভর্তি দশটি ত্রিভুজাকৃতির লুচির ময়দা ফুটন্ত ঘি ভর্তি কড়ায় ফেলে দিয়ে ভেজে নেওয়ার পর সোনালী রঙের ত্রিভুজগুলি তুলে নিয়ে স্বর্ণথালায় সাজিয়ে হালুইকরের স্ত্রী নিজেই চললো রাজসভায়। মহারাজ এরূপ অদ্ভুত দর্শন খাদ্যবস্তু দেখে স্তম্ভিত। তখন হালুইকরের স্ত্রী অত্যন্ত বিনীতভাবে জানালো খাদ্যদ্রব্যটির নাম সমভুজা। মহারাজ যেন সম্পূর্ণ বস্তুটি মুখে না ঢুকিয়ে একটি কামড় দিয়ে দেখেন সেটি ঠাণ্ডা না গরম এবং অনুগ্রহ করে যেন স্বাদটি জানান।
না, মহারাজ স্বাদ জানাননি। তিনি তিনছড়া মুক্তোর মালা খুলে হালুইকরের স্ত্রীয়ের হাতে দিয়েছিলেন। সাথেই রাজবাড়ির হালুইকরের দণ্ডাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিলেন।
এই রাজামশাই কে জানেন? মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার রাজ-হালুইকর, কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠপুত্র গিরীধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী আবিষ্কার করেছিলেন সিঙ্গাড়া।
সিঙ্গাড়ার জন্য ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে। নাম ভুলে গেছে তাঁর প্রধান হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী বেহারার। ধরিত্রী দেবী সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ খাদ্যদ্রব্যের, যেটির সমাদর বাঙালির ঘরে ঘরে।
এবার আসি সিঙ্গাড়ার সেই সুস্বাদু রেসিপি দু'টিতে — ফুলকপির সিঙ্গাড়া ও পনিরের সিঙ্গাড়া।
ফুলকপির সিঙ্গাড়াঃ
উপকরণঃ
- ২৫০ গ্রাম ময়দা
- ১ চা চামচ নুন
- ১/২ চা চামচ চিনি
- ময়ানের জন্য তেল
- পরিমাণ মত জল
- পরিমাণ মত তেল (সিঙ্গাড়া ভাজার জন্য)
পুরের উপকরনঃ
- ১ কাপ ফুলকপি কুচি
- ২ টি মাঝারি আকারের আলু কুচি
- ২৫ গ্ৰাম বাদাম
- ১ টেবিল চামচ আদা বাটা
- ৩-৪ টি কাঁচালঙ্কা বাটা
- ১ চা চামচ লঙ্কাগুঁড়ো
- ১/২ চা চামচ হলুদগুঁড়ো
- ১ চা চামচ জিরেগুঁড়ো
- ১ চা চামচ ধনেগুঁড়ো
- ১ চা চামচ গরম মশলা গুঁড়ো
- ১/২ চা চামচ চিনি
- ৪ টেবিল চামচ তেল
- ১/২ চা চামচ পাঁচফোড়ন
- ১/৪ চা চামচ জোয়ান
- ১ চা চামচ বিটনুন
- স্বাদমতো নুন
পদ্ধতিঃ
- আলু ও ফুলকপি ছোটো ছোটো করে কেটে নিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন। কড়াইতে ২ টেবিল চামচ তেল দিন এবং বাদাম আর ফুলকপিগুলো ভেজে তুলে রাখুন। এরপর বাকি ২ টেবিল চামচ তেল দিয়ে ওর মধ্যে পাঁচফোড়ন দিন। তারপর আলুগুলো যোগ করে লালচে করে ভাজতে থাকুন। আলু আর ফুলকপি ভাজার সময় সামান্য নুন ও হলুদ দিয়ে দিলে সবজি তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়ে যায় এবং সুন্দর রং আসে।
- আলু ভাজা ভাজা হওয়ার পর আদা বাটা ও কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে দিন আর অল্প জল দিয়ে কষাতে থাকুন। এবার এক এক করে ফুলকপি ভাজা, বাদাম ভাজা, লঙ্কাগুঁড়ো, হলুদগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, ধনেগুঁড়ো ও নুন দিয়ে ভালো করে কষিয়ে অল্প জল ঢেলে পাঁচমিনিট ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে রান্না করুন। আলু সম্পূর্ণভাবে সেদ্ধ হয়ে গেলে বেশ কিছু আলু একটু ঘেঁটে দিন। সবশেষে বিটনুন, জোয়ান আর গরম মশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে পুরটা শুকনো শুকনো করে নামিয়ে নিন। পুর ঠান্ডা হওয়ার পর সিঙ্গাড়াতে ভরবেন।
- এবার ময়দার মধ্যে তেল, নুন, চিনি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে অল্প অল্প করে জল দিয়ে একটু শক্ত করে মেখে নিন আর ১৫-২০ মিনিট ঢাকা দিয়ে রাখুন। এরপর ময়দাটা একটু ঠেসে নিয়ে বড়ো সাইজের লেচি কেটে লম্বা করে বেলে নিয়ে মাঝখানে ছুরি দিয়ে কেটে নিন। একটা টুকরো নিয়ে অল্প জল দিয়ে দুই ধার মুড়ে খিলির মত বানিয়ে নিন। তারপর ওর ভেতর ফুলকপির পুরটা ভরে দিন। ময়দার ধারগুলোতে জল লাগিয়ে দু'দিক থেকে চেপে দিন যেমন করে পুলি বানায়। এরপর ওই দু'দিক থেকে জোড়া অংশটা নিয়ে আরেকটা ভাঁজ দিয়ে দিন। জোড়া লাগানোর আগে অবশ্যই জল বুলিয়ে নেবেন আর জোড়া অংশগুলো ভালো করে একটু চেপে দেবেন, নাহলে ভাজার সময় খুলে গিয়ে পুর বেরিয়ে আসতে পারে।
- সবগুলো সিঙ্গাড়া বানানো হয়ে গেলে কড়াইতে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল গরম করে হাল্কা আঁচে বেশ সময় নিয়ে সিঙ্গাড়াগুলো ভাজতে থাকুন।প্রত্যেকটা ব্যাচ ভাজতে ২০মিনিট মত সময় দিলে ভালো হয়। আঁচ জোরে করে ভাজলে বাইরেটা পুড়ে যাবে, ভেতরটা কাঁচা রয়ে যাবে। সেই কারণে হাল্কা আঁচে ধৈর্য্য ধরে সময় নিয়ে ভাজাই শ্রেয়। সব সিঙ্গাড়া ভাজা হয়ে গেলে চায়ের সঙ্গে পরিবেশন করুন। কালীপুজোর সন্ধ্যেটা জমে যাবে।
পনিরের সিঙ্গাড়াঃ
উপকরণঃ
- ৫০০ গ্রাম পনির
- আধ কাপ আলুসেদ্ধ
- সামান্য আদাবাটা
- ১/২ চা চামচ হলুদগুঁড়ো
- ১ চা চামচ জিরেগুঁড়ো
- ১ চা চামচ গরম মশলা গুঁড়ো
- পরিমাণমতো বাদাম
- স্বাদ অনুযায়ী নুন ও চিনি
- ফোড়নের জন্য কালোজিরে
- ৫০০ গ্রাম ময়দা
- সামান্য খাবার সোডা
- ১৫০ গ্রাম তেল
পদ্ধতিঃ
- পনিরগুলো হাত দিয়ে ভেঙে নিয়ে আলুসেদ্ধর সঙ্গে ভালোভাবে মাখুন। কড়াইতে তেল গরম হলে কালোজিরে ফোড়ন দিন। বাদাম দিয়ে ভালো করে ভেজে নিয়ে পনির ও আলুর মিশ্রণটা যোগ করুন। আদাবাটা, গুঁড়ো মশলা, নুন ও চিনি দিয়ে নাড়ানাড়ি করে শুকনো শুকনো নামান। সিঙ্গাড়া র পুর তৈরি।
- এবার ময়দার মধ্যে তেল, নুন, চিনি ও খাবার সোডা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে অল্প অল্প করে জল দিয়ে একটু শক্ত করে মেখে নিন আর ১৫-২০ মিনিট ঢাকা দিয়ে রাখুন। এরপর ময়দাটা একটু ঠেসে নিয়ে লেচি তৈরি করুন। লেচিকে সিঙ্গাড়ার আকার দেওয়ার পদ্ধতি পূর্বেই বিবৃত করা হয়েছে, তাই আর বিশদে গেলাম না। উপরের উল্লিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করে সিঙ্গাড়ার মধ্যে পুর দিয়ে হাল্কা আঁচে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে ভেজে তুলুন। টম্যাটো কেচাপ অথবা তেঁতুলের চাটনি সহযোগে পরিবেশন করুন। উৎসবের আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যাবে।
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন