আমি যখন ছোট ছিলাম, দেখতাম আমার সিনিয়র দাদা দিদিরা র্যাগিং করছে। আমার খুব খারাপ লাগত। আমি লেলু মার্কা ছিলাম বলে বেশি সমস্যা হত। তাদের উপর খুব রাগ হত। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম, আমি সিনিয়র হলে কোনোদিন ঐরকম করব না। আমি খুশি যে আমি কথা রেখেছি। বরং অনেক সময় আমার সহপাঠীদের খারাপ আচরণের প্রতিবাদ করেছি।
আমি একটা নিয়ম মেনে চলি, যে আমার উপর অত্যাচার করবে, যদি প্রতিশোধ নেওয়ার হয় তবে তার উপরই প্রতিশোধ নেব ( অসহ্য অত্যাচারের প্রতিরোধ করা দরকার। তবে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হয়। আমি এই ব্যাপারে শ্রীকৃষ্ণের নীতি মানি। শিশুপাল বধ মনে রাখি।) কিন্তু কোনো দিনই সেই আগের ঘটনা মনে করে নির্দোষ ব্যক্তির উপর রাগ দেখাব না। এতে বহু লাভ হয়েছে।
এত কথা বললাম, কারণ বতর্মান সমাজের অবস্থা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। ছেলে বলছে, ' সব মেয়ে খারাপ '। মেয়ে বলছে, ' সব ছেলে খারাপ। ' এইসব কথা কম বয়সে হলেও ঠিক আছে। কিন্তু বয়সে বড়রাই ঐরকম করছে, তো আর ছোটরা কী শিখবে?
একটি মেয়ে বা ছেলে ধোঁকা দেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস ভেঙে যায়। এরপর অনেকেই আগের রাগের প্রতিশোধ তুলতে একটি নির্দোষ মানুষকে ( ছেলে ও মেয়ে উভয় ক্ষেত্রেই ) বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে। আমার মনে হয় এইসময় একটু ব্রহ্মচর্চ পালন করে নেওয়া ভালো। এতে সামাজিক অবক্ষয় অনেক কম হবে। আপনি তো সেই নির্দোষ মানুষটিকে অত্যাচার করে পৈশাচিক আনন্দে মাতবেন, কিন্তু একবার ভেবে দেখেছেন তার মনে কী অবস্থা হবে? সেও বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হল। এরপর সে হয় জীবনে আর অন্য কারোকে বিশ্বাস করতে পারবে না, আর না হয় আর একটি বিশ্বাসঘতকের জন্ম হবে। এইভাবেই চক্রাকারে চলতে থাকবে। কেউ সুখী হবে না। অশান্তি বাড়বে।
যদি কোনো ছেলে বা মেয়েকে দেখে আবার মনে স্বপ্ন দেখার আশা জাগে তবে আবার নিজেকে মেলে দিন তার কাছে, তবেই সুখী হবেন। তা না হলে, মেয়েরা ছেলেদের ' টাকার মেশিন ' ভাবে বা ছেলেরা মেয়েদের 'কাজের মাসী' ভাবে - এইসব আরোপ চলতেই থাকবে। কোনো সমস্যার সমাধান বের হবে না।
মেয়েদের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে
সবার আগে নিজেকে চিনতে হবে। আপনি কেমন, আর কেমন মানুষের সাথে সুখী হবেন সেটা নির্বাচন করা জরুরী। ঘরের লোক বলল বলে করে নিলাম, দিয়ে মরলাম। অথবা সিনেমা দেখে আবেগে গদগদ হয়ে বিয়ে করে নিয়ে পরে আফসোস করলাম। সেটা করা চলবে না। তারপর বলবেন, সব শিক্ষার দোষ ! মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করার দোষ ! ( আসলেই 'শিক্ষা' অর্থ বোঝেন তো?)
বৈদিক যুগের - অপলা, ঘোষা, লোপামুদ্রা, গার্গি, মৈত্রী প্রভৃতি দের সম্পর্কে শুনেছেন? ওরা কিন্তু বেশ মেধাবী মহিলা ছিলেন। ছেলেদের সাথে সমান ভাবে তর্ক করার ক্ষমতা ছিল তাঁদের। আবার অনেকেই বিদ্যাচর্চার সাথে সাথে ভালো করে সংসারও করেছেন।
তারপর, কাদম্বীনী গাঙ্গুলি, দুর্গা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতিরাও সংসার আর কাজ দুইদিক সামলেছেন। পতিদেবগুলিও তেমন ছিলেন।
তাহলে আজ সব দোষ পড়াশোনার কী করে হয়ে গেল? ভেবে দেখুন। তারপর উত্তর দিন। একজন প্রকৃত শিক্ষিতা মাতা কিন্তু সুসন্তান তৈরি করে। আর পিতাকে দেখেও সন্তান অনেক কিছু শেখে। দায়িত্ব দুইজনেরই সমান।
মিথ্যা ধর্ষণ সম্পর্কে
বাকি রইল ছেলেদের উপর মেয়েদের মিথ্যা ধর্ষণ কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনা ! যাদের একটুও বিবেক বোধ কিছু নেই, বেশি ফালতু বকে, সেইসব উড়নচন্ডী মেয়েরাই ছেলেদের মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে দেয়। এর উলটো দিকটাও আছে। এখনও অনেক মেয়ে আছে যারা আজও বহুরকমভাবে ত্যাগ করে যাচ্ছে। সবার মঙ্গল কামনা করছে।
এখনকার বেশিরভাগ মেয়েই ভার্জিন নয়, ছেলেরা ভার্জিন!
এইরকম একটা কথা আজকাল খুব বেশিই শোনা যায়। তাতে তিনি পুঁথিগত বিদ্যাতে প্রচুর শিক্ষিত হলেও অভিযোগ করেন!
জনগণের কাছে প্রশ্ন - হে আমাদের মহান জনগণ, ছেলে আর মেয়ের জনসংখ্যার অনুপাত দেখেছেন? একটি মেয়ের পিছনে কতগুলো ছেলে হবে?
মেয়েটি তো নিজে নিজেই নিজের ভার্জিনিটি নষ্ট করে না, সেইজন্য ছেলে চায় ! তবে? এরপর বলবেন ছেলেদের দোষ নেই সব দোষ মেয়েদের ! তা বাছা ছেলেটির না দোষ লাগার জন্য কাকে দোষীর সঙ্গী করবে? সেই মেয়েটিকেই তো? তাহলে ছেলের মেয়েদের উপর জোর করা অনুচিত, তাই না? তবেই ওরা সতী থাকবে ! আবার উপমহাদেশের মেয়েরা বেশি ন্যাকা! ওরা বিয়ের পর সব হবে বলে ! - এইসব বলে দোষ দেওয়া চলবে না ! তবেই সে সতী থাকবে ! অনেকেই আবার পরীক্ষা করে সত্যিই মেয়েটি আদৌ নিজেকে সংযমে রাখতে পারে কী না ! যদি সত্যিই দেখে তবে পায়ে পড়ে দেয়। আর অন্য মেয়েদের নিন্দা করে ! তখন সাবধান হওয়া উচিত। যে ছেলে অন্য মেয়েদের নামে অযথা কুৎসা রটিয়ে বেড়ায় সে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিশাল ভাগ্য
এতদূর পযর্ন্ত পড়ে অনেকেই রে রে করতে আসবেন। বলবেন, মেয়েদের কী একটুও দোষ নেই না কী? এত সতী ওরা? ওরাও তো জোর করে ছেলেটিকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে? একদম ঠিক! আলবাত পারে! কিন্তু বেশিরভাগ ছেলেরাই এটিকে সৌভাগ্য মনে করে। ছেলেটি যদি বন্ধুদের নিজের কষ্টের কথা বলতেও যায় তখন তার বন্ধুরাই ছেলেটির খিল্লি ওড়ায় এবং নিজেদের অভাগা মনে করে।
এইভাবেই আবারও শুরু হয় কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি! অশান্তি! ঘটে যায় দুর্ঘটনা!
তখনকার সমাজ ও এখনকার সমাজ
তখনকার সমাজ অনেকটাই আলাদা ছিল। তখনকার ব্যবস্থা আলাদা ছিল। তখন কাঠ, কয়লা, গুল, ঘুঁটেতে রান্না হত। এখন সেটা হয় না। বাইরে এত দোকান ছিল না। মেয়েরা বাড়িতেই অনেক কিছু তৈরি করে সময় ব্যয় করত। রান্না করার পর ফাঁকা সময় অনেক কিছু করত। বাড়িতে মুড়ি ভাজা, চাল শুকানো, নাড়া, গুছিয়ে রাখা। পরের দিনের জন্য সবজি ঠিক করে রাখা। সবার বাড়িতে তো আর ফ্রিজ থাকে নি। তারপর ঘি করা, মাখন তুলে রাখা। রাতে আলোর ব্যবস্থা করা। বাড়ির গৃহপালিত জন্তুগুলির যত্ন নেওয়া। অনেক কিছু।
কিন্তু এখন সেইসব নেই। কেউ যদি বলে আদিম যুগের মতো গুহাতে থাকতে হবে, তা পারবেন কী? ঠিক তেমনি সময়ের সাথে সাথে অনেক কাজ কমেছে। মানুষ অন্য দিকে সময় ব্যয় করছে। অন্য অনেক কাজের সৃষ্টি হয়েছে। একটি মেয়ে যদি পড়াশোনা, অন্যসব সৃজনশীল কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তবে ক্ষতি কী? একটা বয়স পযর্ন্ত অর্জন করতে হয়। বাকি বয়সটাতে সেই সব অর্জন ফিরিয়ে দিতে হয়।
ভারতের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা দেড় প্যাঁচা হয়ে গেছে। শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। এইরকম করলে খুব শিঘ্রই সমাজের মধ্যে বড় ফাটল ধরবে। যেটা আমাদের জন্য সুখের হবে না।
ছেলেমেয়ে উভয়ের সমাজে প্রয়োজন আছে। সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে।সমস্যার উপর গুরুত্ব কম দিয়ে সমাধানের উপর গুরুত্ব দিলে সবার মঙ্গল। স্বামীজী বলেছেন,"প্রেম সব সময়ে আনন্দেরই বিকাশমাত্র;....."। যেখানে স্বার্থপরতা থাকবে সেখানে দুঃখ থাকবে। তাই স্বার্থপরতা দূর করে সবাই আনন্দে থাকুন!
কলমে - সোমা লাই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন