দু'মাস অনিয়মিত ঋতুস্রাব হওয়ার পর তৃতীয় মাস
থেকে সেটি বন্ধই হয়ে গেল ঋতজার। বেশ চিন্তায় পড়ে গেল সে। দিব্যি কলেজ, পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইহই করে দিনগুলো কাটছিল। চিকিৎসকের
কাছে যেতে তিনি তলপেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন।
কয়েকমাস
আগে বিয়ে হয়েছে সৌমির। স্বামী ছোটোখাটো একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে, সৌমি একটি স্কুলের শিক্ষিকা। দু'জনের উপার্জন মিলিয়ে হেসেখেলেই সংসার চলে
যায়। পরিকল্পনা করে রেখেছে, অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা শক্তপোক্ত হওয়ার পর তারা
তাদের জীবনে সন্তানকে স্বাগত জানাবে। এদিকে হঠাৎই সৌমির ঋতুস্রাব বন্ধ, চিন্তায় পড়ে গেল সে। তাদের দাম্পত্যজীবনে
যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করেও এমন হল কেন! তাহলে কি সে এখনই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে
পড়ল!
মায়ের
সঙ্গে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে এসেছে সুতনুকা, তার ঋতুস্রাব বন্ধ। হঠাৎ করেই এমন হতে ঘাবড়ে
গেছে সে। চিকিৎসক নির্দেশ দিলেন প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়ে আনতে। সুতনুকার মা বলে
উঠলেন, "আমার
মেয়ের তো এখনও বিয়েই হয়নি ডাক্তারবাবু!" চিকিৎসক তাও বললেন টেস্টটা করিয়ে আনতে। টেস্ট
করিয়ে দেখা গেল প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ। সুতনুকার মায়ের মূর্ছা যাওয়ার
অবস্থা, সুতনুকাও দিশেহারা।
এই তিনটি ঘটনার মধ্যে কোনো না কোনোটা আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মেয়ের জীবনেই ঘটে থাকে, যার মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা নয়। অনিয়মিত ঋতুস্রাব অথবা হঠাৎ করেই ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা আজ ঘরে ঘরে। তবে বর্তমানে এই ব্যাপারে সচেতনতা আগের তুলনায় কিছুটা বেশি। ঋতুস্রাব অর্থাৎ মাসিক না হলে আমরা সাধারণত ধারণা করে নিই PCOD/PCOS এর সমস্যা হবে হয়তো।
তাহলেও
অনুমানের উপর নির্ভর করে উদাসীন থাকাটা একেবারেই অনুচিত। শরীরের ভেতরে কোনোরকম
সমস্যা দেখা দিলে শরীর আমাদের বিভিন্ন লক্ষণের মাধ্যমে সেটি জানান দেয়। এবার সেই
লক্ষণগুলিকে গুরুত্ব না দিলে আখেরে ক্ষতি কিন্তু আমাদেরই। PCOD/PCOS যেটাকে আমরা সিস্টের সমস্যা বলে থাকি, তারও চিকিৎসার প্রয়োজন, সেই সিস্টের কিন্তু প্রকারভেদ আছে। শুধু তাই
নয়, সেটি আমাদের শরীরের জন্য
কতখানি ক্ষতিকর তা নির্ভর করে তার আকারের উপরও। এছাড়াও, সবসময় যে সিস্টের কারণে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়
এমনও নয়।
এমতাবস্থায়
একমাত্র পরামর্শ হল চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। অনেকসময় শুধুমাত্র মাসিক বন্ধ হয়ে
যাওয়াই নয়, সাথেই নানারকম শারীরিক
পরিবর্তন দেখা দেয়। যেমন ওজন বৃদ্ধি পাওয়া, মুখে অবাঞ্ছিত লোম, ব্রণর প্রকোপ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে সমস্ত বিবরণ
শুনে নেওয়ার পর চিকিৎসক নির্দেশ দেন তলপেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে আনতে।
অন্তঃসত্ত্বা
হয়ে পড়লে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া একটি প্রধান লক্ষণ, উল্টোটি কিন্তু নয়। অর্থাৎ ঋতুস্রাব বন্ধ
হওয়া মানে গর্ভবতী হয়ে পড়া নয়। এবিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
PCOD/PCOS : পূর্বেই উল্লেখ
করেছি, ঋতুস্রাব বন্ধের একটি বহুল পরিচিত কারণ হল এটি।
Polycystic Ovarian Disease (PCOD) বা Polycystic Ovary Syndrome (PCOS) সাধারণত ১২ বছর
থেকে ৪৫ বছরের নারীদের ক্ষেত্রে হতে পারে। এক্ষেত্রে মেয়েদের শরীরে হরমোনের
ভারসাম্য ঠিক না থাকার কারণে যে লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায় তার মধ্যে অন্যতম হলো
অনিয়মিত মাসিক অথবা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া।
PCOS এর জন্য মাসিক বন্ধ হওয়ার কারণ হলো এটির প্রভাবে মেয়েদের শরীরে হরমোন লেভেলের তারতম্য ঘটে। যেসব মেয়েরা PCOS এর সমস্যায় ভুগছে তাদের দেহে অতিরিক্ত পুরুষ হরমোন (অ্যান্ড্রোজেন) নিঃসরণের জন্য অনিয়মিত ঋতুস্রাব দেখা দেয়। সেই কারণে ঋতুস্রাব হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া বা অনিয়মিত হতে যাওয়া PCOS এর অন্যতম প্রধান লক্ষণ হিসাবে গণ্য করা হয় থাকে। অন্যান্য লক্ষণসমূহের মধ্যে মুখে ও শরীরে অতিরিক্ত লোম, ব্রণ, তলপেট ব্যথা, গর্ভধারণে সমস্যা, ওজন হ্রাসে সমস্যা, ওভারিতে সিস্ট ইত্যাদি অন্তর্গত।
আগেই উল্লেখ করেছি PCOS এর সমস্যা ১২ বছর থেকে ৪৫ বছরের নারীদের ক্ষেত্রে হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে এই বয়সী মেয়েদের মধ্যে প্রায় ২৭ শতাংশ মেয়ের এই সমস্যা রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো প্রায় ৭০ শতাংশ মেয়ের শরীরে এই সমস্যার শনাক্তকরণই হয় না। শনাক্তকরণ না হওয়ার অর্থ চিকিৎসা না হওয়া। সন্তানধারণের সময়ই সমস্যাটা নজরে পড়ে।
PCOS এর কারণে ঋতুস্রাব বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলি।
প্রথমে
জানা যাক ঋতুস্রাব কেন হয়। মেয়েদের শরীরে ওভারি থেকে দু'রকমের হরমোন নিঃসৃত হয় — ইস্ট্রোজেন ও
প্রোজেস্টেরন, যেগুলি ঋতুস্রাবের
প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে। এই দু'টি হরমোন ছাড়াও ওভারি স্বল্প পরিমাণে পুরুষ হরমোনও নিঃসরণ
করে যার নাম অ্যান্ড্রোজেন।
প্রতিমাসে নারীদেহে ওভ্যুলেশন (ovulation) হয়। FSH (ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন) নামক একটি হরমোন ডিম্বাশয়কে উদ্দীপিত করার মাধ্যমে একটি পরিপক্ক ডিম্বাণু উৎপাদনের দিকে পরিচালিত করে। এই প্রক্রিয়ায় ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনও নিঃসৃত হয়। নারীর ডিম্বাশয়ে ডিম্বস্ফোটন হওয়ার পর সেই ডিম্ব ফ্যালোপিয়ান টিউব দিয়ে জরায়ুতে চলে আসে। যেখানে ডিম্বাণুটি ২-৩ দিন অবস্থান করে। ডিম্বাণুর সংশ্লেষ না হলে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের লেভেল নেমে যায়। ডিম্বাণুটি নিষিক্ত হতে না পেরে নষ্ট হয়ে যায় এবং জরায়ুগাত্রের অভ্যন্তরে এন্ডোমেট্রিয়াম স্তরে ভেঙ্গে পড়ে। এই নষ্ট ডিম্বাণু, সঙ্গের শ্লেষ্মা এবং এর রক্তবাহ থেকে উৎপাদিত রক্তপাত সব মিশে তৈরি করে এক তরল অবস্থা যা ৪-৫ দিন ব্যাপী নারীদেহ থেকে ক্ষরিত হয়। এই ক্ষরণকেই অভিহিত করা হয় মাসিক বা ঋতুস্রাব নামে।
এবার PCOS এর ক্ষেত্রে ওভারিতে থাকে পলি-সিস্ট অর্থাৎ একাধিক সিস্ট যেগুলি হলো ডিম্বাশয়ে উপস্থিত একপ্রকার তরলপূর্ণ থলে। ওভারিতে যে ছোট ছোট ফলিকল থাকে সেগুলি পূর্ণাঙ্গ না হলে এই সিস্ট হয়। প্রভাব পড়ে ওভ্যুলেশনে। ফলস্বরূপ ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন এবং অন্যান্য নারী হরমোনগুলির লেভেলের তারতম্য ঘটে। প্রোজেস্টেরন লেভেল স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে এবং পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেনের লেভেল স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পেলে ঋতুস্রাব বিঘ্নিত হয়।
থাইরয়েডের সমস্যা : ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে পড়লে তলপেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ছাড়াও চিকিৎসকরা রক্ত পরীক্ষা করতে দেন যার মধ্যে থাইরয়েড টেস্টও থাকে। এই থাইরয়েড হল গলাতে অবস্থিত একটি অন্তক্ষরা গ্রন্তি যেখান থেকে থাইরয়েড হরমোন ক্ষরিত হয়। এই গ্রন্থির কোন সমস্যা হলে থাইরয়েড হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে পারে। এমতাবস্থায় মাসিক দেরি বা মিস হওয়া সম্ভব। রক্ত পরীক্ষা করার পর রিপোর্টে থাইরয়েডের সমস্যার দিকটি সামনে আসতে পারে।
হ্যাঁ সম্ভব। এই ব্যাপারে একটু আলোচনা করা যাক।
হোম প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের স্ট্রিপটি শিশু-ডিটেকটর নয়। একজন মহিলার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে Human Chorionic Gonadotropin (HCG) নামক একটি হরমোন সেই মহিলার দেহে নিঃসৃত হয় যা প্রস্রাবের মাধ্যমে দেহ থেকে বের হয়। একটি নিষিক্ত ডিম্বানু যে সময় থেকে ইউটেরাইন লাইনে প্রোথিত হয় এবং প্ল্যাসেন্টা তৈরি হয়, তারপর থেকেই এইচ সি জি নিঃসরণ শুরু হয়। গর্ভধারণের ১১ দিন পর থেকে রক্তপরীক্ষায় এবং ১২ থেকে ১৪ দিন পর থেকে মূত্র পরীক্ষায় এই হরমোনের উপস্থিতি ধরা পড়ে। ৮ থেকে ১১ সপ্তাহ ধরে ৭২ ঘন্টা অন্তর, হরমোনের এই মাত্রা দ্বিগুণ হতে থাকে। তারপর থেকে এই মাত্রা স্থির হয়। এবার এই একই হরমোন অনেকরকম টিউমারের কারণেও নিঃসৃত হতে পারে। তখন প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ দেখায়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা একান্ত প্রয়োজন।
টিউমার ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি শারীরিক সমস্যায় এইচ সি জি মাত্রা বেড়ে গিয়ে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষায় ভুল ফল দেখাতে পারে। যেমন পিটুইটারি গ্ল্যান্ড ও হরমোন মাত্রার বিশৃঙ্খলা, বিশেষ করে, মেনোপজ পূর্ববর্তী বা মেনোপজ হয়ে যাওয়ার পরে। অনেকসময় কিডনি রোগ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন হলেও হোম প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের রেজাল্ট পজিটিভ আসতে পারে।
তবে অন্তঃসত্ত্বা না হয়েও প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ আসার কারণ সবক্ষেত্রেই যে টিউমার বা আরো ভয়ানক কিছু হয় তা নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেস্ট কিট এরও সমস্যা থাকে। টেস্ট কিটটি খারাপ থাকলে অথবা তার এক্সপায়রি ডেট পেরিয়ে গেলে অথবা এইচ সি জি হরমোনযুক্ত কোনো ওষুধ গ্রহণ করতে থাকলেও এমনটা হয়।
সেই কারণেই বলব ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ গর্ভবতী হয়ে পড়া নয়। তাই আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, তাঁর পরামর্শ মত চলুন। ভালো থাকুন, শুভকামনা রইল।
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
_____________________
চিত্রসৌজন্যঃ গুগল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন