পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল - বাংলা সাহিত্যের অজানা রহস্যের সন্ধান


বই - পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল

লেখক – প্রীতম বসু

পৃষ্ঠাসংখ্যা – ২৩২

প্রকাশকাল – এপ্রিল ২০১৫

প্রচ্ছদশিল্পী –  দেবাশীষ রায়

 

লেখক প্রীতম বসু বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন – 

 ১২০০ হইতে ১৪৫০ অব্দের মধ্যে বাঙ্গালা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন তো নাই-ই, বাঙ্গালা ভাষারও কোনো হদিশ পাওয়া যায় না।”  ডঃ সুকুমার সেন (বাঙালা সাহিত্যের ইতিহাস)

কেমন ছিল সে যুগের বাংলা ভাষা, বাংলা লিপি?

চয়নবিলের তলা থেকে আবিস্কৃত হল পাথরে খোদাই করে ১৪০০ সালের কথ্য বাংলা ভাষায় ও লিপিতে লেখা পঞ্চাননমঙ্গল কাব্য। কিন্তু সেখানে কেন পঞ্চানন ঠাকুরের পুজার মন্ত্রে আমাদের পূর্বপুরুষরা লুকিয়ে রেখেছিল অজস্র আধুনিক অঙ্কের সূত্র?

শ বছর আগেকার বাঙালীর অজস্র অজানা পারদর্শিতার আলেখ্য দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠবে, কিন্তু এক অশুভ বৈদেশিক শক্তি পঞ্চাননমঙ্গল ধ্বংস করার জন্য কেন উন্মত্তপ্রায়? বক্তিয়ার খিলজি নালন্দা ধ্বংস করে তিন মাস ধরে মহামূল্যবান পুঁথি পুড়িয়ে আমাদের অতীত মুছে দিয়েছিল। তবে কি পঞ্চাননমঙ্গলের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাবে প্রাচীন বাঙালীর বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনের শেষ দলিল ? " 


তাহলে সে যুগের ভাষা কেমন ছিল?কি ভাষায় কথা বলতেন বঙ্গবাসী?বাংলা ভাষার প্রকৃত রূপ কি প্রকারের ছিল?লেখাপড়া করতেন কিকরে বাংলার মানুষ?সে যুগ কি তবে ছিল বাংলা সাহিত্যের অন্ধকারময় যুগ?বাংলা সাহিত্যের সেই তথাকথিত অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের গূঢ় রহস্যের উদঘাটন নিয়েই একটি চাঞ্চল্যকর রোমাঞ্চকর কল্পভিত্তিক উপন্যাস লিখেছেন লেখক প্রীতম বসুঅসাধারণ মেধা এবং অপরিসীম পরিশ্রম ও গবেষণা দিয়ে লেখক রচনা করেছেন এক অন্যস্বাদের মঙ্গলকাব্য। 

পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য

বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে মঙ্গলকাব্য পৃথক স্থান অধিকার করে রয়েছে।যেমন মনসামঙ্গল,চণ্ডীমঙ্গল,অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি। এদেরই মত পঞ্চাননমঙ্গলও এক কাব্য গ্রন্থ।

বইয়ের এক স্থানে উল্লেখিত আছে - 

প্রাচীন বাংলায় কাব্যে কবিরা অনেক সময় অতিরঞ্জন করত। কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গলে আছে চাঁদ সওদাগরের নৌকার একটা মাস্তুল নাকি এত উঁচু ছিল যে তার ওপরে উঠলে নাকি বাংলা থেকে রাবণের লঙ্কা দেখা যেত। বিজয়গুপ্ত চাঁদ সওদাগরের নৌবহর বর্ণনা করছেন-_

তার পিছু বাওয়াইল ডিঙা নামে উদয়তারা

অনেক নায় ঝড় বৃষ্টি অনেক নায় খরা।।

তারমানে তার নৌবহরের এক দিকের নৌকোয় যখন বৃষ্টি হত, তখন অন্য নৌকোয় খরা। এইরকমই আরও বহু উদাহরণ আমরা এই বইয়ে পাই। যেমন -- 

প্রাচীন বাংলায় অনেক কাব্যে দু'রকম অর্থ হত-_” বদন বলল। 'সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতের প্রতিটি শ্লোকের দুরকম মানে ছিল। আর পঞ্চাননমঙ্গল হল দরকম অর্থের রাজা। 

শিবের মন্ত্রের আড়ালে অঙ্ক__” ধাড়া বলল। 

বাংলা সাহিত্যের রহস্যময়তাই এইখানে। কাব্যের বহু শব্দ স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে থাকে। সম্ভবত বাংলা কাব্য সাহিত্যের মাধুর্যই এই রহস্যময়তাকে বাড়িয়ে তোলে। লেখক বাংলা কাব্যের এই রহস্যকেই  কাহিনীর প্রেক্ষাপট বানিয়ে এক অতীব সুন্দর কাল্পনিক গাথা রচনা করেছেন।


কাহিনী সারসংক্ষেপঃ


পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল বইটির কাহিনি আবর্তিত হয় চৌদ্দশ সালের হারিয়ে যাওয়া বেগবতী নদীর পার্শ্ববর্তী বল্লালগ্রামকে ঘিরে—যা আবার কালের পরিক্রমায় পঞ্চমুণ্ড থেকে পাঁচমুড়ো নাম নিয়েছে।পঞ্চানন ঠাকুর অর্থাৎ পাঁচমাথা যুক্ত শিবের এক মূর্তির স্থাপিত এক মন্দির ও তাকে ঘিরে রচিত ঘটনাবলীর উপর সমগ্র কাহিনী আধারিত। পাঁচমুড়ো গ্রামের বহু পুরোনো চয়নবিলের তলা থেকে একদিন আবিষ্কৃত হলো পাথরে খোদাইকৃত ১৪০০ সালের কথ্য ভাষায় ও লিপিতে লেখা পঞ্চাননমঙ্গলকাব্যসেই কাব্যে পঞ্চানন ঠাকুরের পূজার মন্ত্রে আমাদের পূর্বপুরুষরা লুকিয়ে রেখেছিলেন অজস্র আধুনিক অঙ্কের সূত্র।
কিছুদিন আগের ভূমিকম্পে চয়নবিলের নিচে থাকা চোরাগুহার মুখ ফেটে যাওয়ায় গুহা থেকে অনেক শিলালিপি এবং পাথরের খণ্ডাংশ বেরিয়ে আসতে দেখেন পাঁচমুড়োরই জমিদার সদানন্দ ভট্টাচার্য। ইংরেজ আমলে তার বাবার রমরমা পুঁথিব্যবস্যার দরুণ সদানন্দ নিজেও একজন দক্ষ পুঁথি বিশারদ। বাবার কাছেই তিনি এবং তার সৎভাই চিদানন্দ, পুঁথি যাচাইয়ের সকল দীক্ষা নেন। 

কিন্তু একসময় বুড়ো সদানন্দকে ধোঁকা দিয়ে চিদানন্দ বেশ কিছু প্রাচীন পুঁথি আর মূল্যবান নিদর্শন নিয়ে কলকাতা পারি দেয়। সদানন্দ যেতে পারেন না, তিনি থেকে যান এই পাঁচমুড়োর জমিদার বাড়িতে, পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে। আর তাই ব্যবস্যার এমন মন্দায় চয়নবিলের তলা থেকে অকস্মাৎ শিলালিপি ভেসে ওঠায় সদানন্দ যেন লক্ষ্মী হাতে পেলেন! লোকমুখে চলে আসা পঞ্চাননমঙ্গলকাব্যের মিথ আর শিলালিপিতে থাকা বাংলা ভাষার নমুনা দেখে, এর মূল্য বুঝে উঠতে বিচক্ষণ সদানন্দের একমুহূর্তও দেরি হলো না। বাংলাসাহিত্যের এই দুর্মূল্য নিদর্শন বিদেশের মাটিতে সর্বোত্তম উপায়ে সংরক্ষণের ইচ্ছা কিংবা নিজের পকেটের পোয়াবারো দেখার লোভ, যে কারণেই হোক না কেন, সদানন্দ খবর দিলেন লন্ডনে নিজের মিউজিয়াম থাকা  ডঃ ধাড়াকে। সদানন্দ ডঃ ধাড়ার সাথে এসব নিয়েই কথা বলছিলেন এমন মুহূর্তে সেখানে এসে হাজির কালাচাঁদ পণ্ডিত ওরফে কালাচাঁদ চোর। চোর বলতে ঠিক সিঁদ কেটে ঢোকা চোর নয়, কালাচাঁদের কাজ জালপুঁথি বিক্রি এবং আসল পুঁথির হাতবদল। একাজে যে সে খুব পারদর্শী, এমনটাও নয়। এই যেমন শেষবার যখন সে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে লালশালুতে জড়ানো ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের একটা পুঁথি বগলদাবা করে নিয়ে তিরের বেগে পালাতে গেল, অমনি সদ্য সাবান-পানিতে মোছা সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে শেষতক এক বেলা হাসপাতালে এবং তারপরের তিনমাস জেলে কাটাতে হলো। তবে এবেলায় তার চৌর্য-ইন্দ্রিয়ের জোরেই কালাচাঁদ বুঝে ফেললো সদানন্দ এবং ডঃ ধাড়া যা নিয়ে আলাপ করছেন তার বাজারমূল্য নেহায়েতই কম হবে না! আর তাই সুযোগ বুঝে সদ্য তুলে আনা শিলালিপিটা থেকে উদ্ধারকৃত বাংলা ভাষার সম্ভাব্য সেই পঞ্চাননমঙ্গলকাব্যের চরণদুটো অন্তঃকরণে চটপট তুলে নিয়ে সোজা চলে এলো হরু ঠাকুর আর তার ভাগনে-বদনের বাড়িতে। সেযুগের ম্যানুয়াল পুঁথি-ফটোকপিয়ার এবং বর্তমানে সেসব নকলে সিদ্ধহস্ত হরু ঠাকুর তার এযাবতকালের অভিজ্ঞতা দিয়ে তৎক্ষণাৎ চরণদুটির ছন্দ উদ্ধার করে ফেললেন। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিলো যখন অঙ্কে পারদর্শী এবং সদ্যপাশকৃত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বদন সেই চরণদুটো থেকে আবিষ্কার করে ফেললো ছন্দের সাথে অঙ্কের এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ! শব্দের অভাবনীয় কারুকার্যে লুকিয়ে আছে হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত অঙ্কের নানান সূত্র। ছন্দ আর অঙ্ক যেন তাতে পাখির ডানার দুটোদিকএকপাশে অঙ্ক তো আরেকপাশে ছন্দ নিয়ে সেই পাখি যেন সাহিত্যের অন্ধকার আকাশে আলোর সন্ধানে উড়ে চলেছে!
প্রায় ছয়শত বছর পূর্বে বাঙালির অফুরন্ত অজানা আবিষ্কারে কাহিনী লুকানো কাব্য, যার ধংস করার জন্য উন্মুক্ত বিদেশী শক্তি।বখতিয়ার খিলজি নালন্দা ধ্বংস করে তিন মাস ধরে মহামূল্যবান পুঁথি পুড়িয়ে আমাদের অতীত মুছে দিয়েছিল।এইবার এই পুঁথির সন্ধান পাওয়া কিছু বিদেশী শক্তিও সেই পথের অনুসারী হয়ে ধ্বংস করতে চায় প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন আবিষ্কারের  গৌরবান্বিত অধ্যায়কে। যাতে তাঁদের নিজেদের আবিস্কারের ইতিহাস লঘু না হয়ে যায়।বিস্ময় জাগে যখন জানতে পারি অ্যালগোরিদম, অ্যালজেব্রা, ত্রিকোণমিতি সব নাকি বাঙালির আবিষ্কার। কাব্যে কাব্যে জটিল ছন্দে লুকিয়ে আছে তার প্রমাণ পঞ্চাননমঙ্গলে।কিন্তু সম্পূর্ণ পঞ্চাননমঙ্গল খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, বা শেষ অবধি তার পরিনতি কি হবে তা জানতে বইটা পড়তে হবে।পরতে পরতে রহস্য উন্মোচন, রোমাঞ্চকর ঘটনার সমাহার, পুঁথির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ সমস্ত আবিষ্কার – এই বইকে অনন্যসাধারন করে তুলেছে। 

এই বইয়ে লেখক বাংলা লিপির ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সুন্দর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। 



 সেই যুগের শ্লোক কেমন হত?বানান কেমন হত?  

 'শূর উচাইয়া রাতে ধাএ গজমতি

খঙ্গে কাড়ে রাএ উমত বেগবতী

বলরাম ভানুমতী সহ দেব সাথে

বোলকলা ভাগএ এহি টাদহীন রাতো।'

 মিষ্ট ভাষাসহ কাব্য আকারে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে এক উজ্জ্বল স্থান দখল করে থাকবে। 

আমি এই প্রথম প্রীতম বসুর লেখা কোনও বই পড়লাম। কেন একজন মানুষ যা হোক কিছু লিখে দিলেই তাঁকেই লেখক বলা যায় না তার প্রমাণ এই বইটি। এই বই লিখতে যে পরিমাণ গবেষণা লেখক করেছেন তা এক কথায় বিস্ময় জাগায়। অসাধারণ কাহিনী, অসাধারণ লেখনী।মুগ্ধকর।

কলমে  - পা র মি তা  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন