আঁকতে আঁকতে
লেখক - ফারুক নওয়াজ
আঁকাই
আমার শখ;
আঁকতে
বসে আঁকি যদি
একটি পাহাড়, একটি নদী
শাদা
ডানায় উড়ে যাওয়া
ধবধবে
এক বক-
শেষ
হয়ে যায় আঁকা যখন
অবাক
লাগে ভারী-
তাকিয়ে
দেখি আমার মায়ের
সবুজ
রঙের শাড়ি।…
মানুষ
যা সহজে মুখে প্রকাশ করতে পারে না তা আঁকার মাধ্যমে খুব সহজেই প্রকাশ করতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রযোজ্য। ছোট-বড় সবারই আঁকার উপকারিতা আছে। অবসর যাপনের অন্যতম মাধ্যম
অঙ্কন হতে পারে, যা মনে শান্তিও আনে।শিশুমন খুব সহজেই রঙের প্রতি আকৃষ্ট হয়।তাই তারা
খেলনা ছাড়া খুব সহজেই রং পেন্সিল হাতে তুলে নেয়।আঁকআঁকির মাধ্যমে একটি শিশুর বিভিন্ন
ধরণের মানসিক বিকাশ ঘটে থাকে।যেহেতু শিশুরা কথা বা ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সঠিক
ভাবপ্রকাশে অক্ষম হয়, তাই তারা আঁকার মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করার চেষ্টা করে থাকে।আঁকার
থেকে খুব সহজেই একজন শিশুর চিন্তাভাবনা এবং অনুভুতি বুঝতে পারা যায়। প্রতিটি শিশু সাধারণত প্রতিটি উপাদান খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখে, নিজের মতো করে ভাবে আর ওর নিজস্ব ভাবনাটাকেই ফুটিয়ে তোলার
চেষ্টা করে ছবি আঁকার মাধ্যমে। রং দেখলেই ওরা আনন্দিত হয়। উপহার হিসেবে নানান
মাধ্যমের রং পেতে ও তা দিয়ে আঁকতে শিশুরা খুব ভালোবাসে। আর রংতুলির অসাধারণ গুণ
হচ্ছে, সেটির
নেশায় ডুবে একবার আনন্দের স্বাদ পেয়ে গেলে শিশুকে অনায়াসেই বর্তমানযুগের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত আসক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব।
শিশু বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন
“ সাধারণত শিশুরা দুরন্ত প্রকৃতির হয়। মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করার যে
চর্চা, সেটি মূলত ছোটবেলায় ছবি আঁকার মাধ্যমেই হয়। বড় হয়ে যে
পেশাতেই সে যাক না কেন, প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা, মনোযোগ
দেওয়া, নিজের
মতো করে বুঝে করতে পারার ক্ষমতাটাই তৈরি হয় ছবি আঁকার মাধ্যমে, যা
পরবর্তী সময়ে সে কাজে লাগায় মাত্র। তাই ছোট থেকেই ছবি আঁকতে দেওয়া উচিত সব শিশুকে।“
১২ – ১৮ মাস বয়সী শিশুরা
রং পেন্সিলের সাহায্যে হিজিবিজি আঁকাআঁকি ( scribbling) করতে ভালোবাসে। এর ফলে শিশুর
আঙুল দিয়ে জিনিসপত্র ধরার ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বুদ্ধির বিকাশেও সহায়তা করে। শিক্ষাব্রতী জ্যা জ্যাক রুশো এই কারণেই বলেন: ‘প্রত্যেক শিশুই জন্মগতভাবে শিল্পী।’
আঁকার উপকারিতাঃ
- নিজেকে মেলে ধরার আনন্দ :
স্বাধীন
ভাবে আঁকার ফলে শিশুটি নিজেকে মেলে ধরার আনন্দ খুঁজে পায়। তার আত্ম উন্মোচনের পথ
প্রশস্থ হয়।
- শিশু মনের স্বাভাবিক বিকাশ :
সঠিক ব্যক্তিত্ব
বিকাশের জন্য শরীরের সাথে মানসিক বিকাশও প্রয়োজন। আঁকা শিশুর মানসিক বিকাশে
সহায়তা করে।ফলে পরিমিতিবোধ বাড়ে,
রুচিবোধ বা নান্দনিক বোধ তৈরী হয়, সৌন্দর্যবোধ
বাড়ে।
- কল্পনা শক্তি :
আপন
মনের আনন্দে আঁকার ফলে শিশুর কল্পনা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীকালে
গল্প লেখা, কবিতা লেখা বা অন্যান্য বিমূর্ত চিন্তা করার জন্য
কল্পনাপ্রবণ মন খুব কাজে দেয়। চিন্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে সেই
সাথে আত্মশক্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
- পেশি সঞ্চালনায় সহায়তা :
আঁকার সময় হাতের পেশির সঞ্চালন করতে হয়। ফলে, পেশি চালনা সুগঠিত হয়। সুগঠিত পেশির অনেক উপকারিতা আছে।আঁকার ফলে চোখ ও মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র কার্যকর ও শক্তিশালী হয়।
- মনের ভাব প্রকাশ :
শিশু আঁকার মাধ্যমে নিজের মনের ভাব প্রকাশের চেষ্টা করে।ফলে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে, কল্পনাশক্তির প্রসার ঘটে, সময়জ্ঞান বাড়ে, নিয়মশৃঙ্খলা শেখে।James_Sully লক্ষ্য করেছেন শিশুদের আঁকার মধ্যে কোন সঙ্গতি থাকে না। ওরা নিজেদের আগ্রহের বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয় এবং সেইটিই বড়ো করে এঁকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে।
- হাত ও
চোখের সমন্বয় ( Hand - Eye coordination )
:
অনেক রকম কাজ বা খেলা আছে যার জন্য আমাদের চোখ ও হাতকে একসাথে চালনা করতে হয়। তারমধ্যে ছবি আঁকা অন্যতম। হাত ও চোখের সমন্বয়ের ফলে মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, নার্ভ শক্তিশালী হয়।
আঁকা শেখানোর বিভিন্ন পদ্ধতিঃ
- আঁকার প্রয়োজনীয় দ্রব্য – কাঠের বা মোমের রং পেন্সিল, পেন্সিল,কাগজ, আঁকার বই, রঙিন ছবি প্রভৃতি দিতে হবে।
প্রথমে পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি আঁকুক। আপনি শুধুমাত্র লক্ষ্য রাখতে হবে কী করছে। কারণ ছোট বাচ্চা পেন্সিল খেয়ে নিতে পারে বা খোঁচাখুঁচি করতে পারে। তবে ভুলেও কী আঁকতে হবে - এইসব বলে জোর করা উচিত নয়। বরং যা আঁকছে তার প্রশংসা করতে হবে। এতে শিশুটি উৎসাহ পাবে।
- কিছুদিন এইভাবে চলার পর পরবর্তী পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। শিশুর সাথে বাবা-মাকেও আঁকতে হবে। যাতে সে আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
- আঁকার সাথে সাথে লাইন,বৃত্ত,বর্গাকার, ত্রিভুজাকার – এই সমস্ত আকৃতির পরিচয়ও করানো দরকার।
- উৎসাহ দেওয়ার জন্য পরবর্তীতে সে কি আঁকবে তা জিজ্ঞাসা করা বা নির্দিষ্ট বস্তু আঁকার নির্দেশ দিতে হবে।
- তাদের আঁকাগুলি ঘরের বিভিন্ন জায়গায় এমনভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে যাতে তারা নিজেদের আঁকা দেখতে পায়। ফলে আরও উৎসাহী হয়ে নতুন আঁকতে চেষ্টা করবে।
- তাদের কল্পনা থেকে আঁকার ব্যপারে উৎসাহী করতে হবে।স্বাধীনভাবে কাজ করার আনুপ্রেরনা দিতে হবে। দেখতে হবে নতুন জিনিস শিখে ওরা কী করে! নিজের মনের আনন্দে এর সাথে ওর জুড়ে এঁকে সবাইকে দেখিয়ে আনন্দ করবে। শাসন বাদ দিয়ে তার আনন্দের সঙ্গী হতে হবে।
- এইরকম করে আরও কিছু দিন যাওয়ার পর যখন রেখা অঙ্কন করতে শিখে যাবে, তখন পেন্সিল সেড করতে শেখাতে হবে।পরবর্তী পর্যায়ে নিজেকে করতে দিতে হবে।
- এরপর রঙ করা বই দিতে হবে। রেখা আঁকার মতোই একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
- গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করে তারা অন্যদের তুলনায় চিন্তা ও মননে অনেক এগিয়ে। তাদের চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। তারা সামগ্রিক দিক নিয়ে ভাবতে পারে।
- মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুর কচি মস্তিষ্কে যত সৃজনশীল কাজ করবে, তার চিন্তা তত বেশি পরিষ্কার হবে। মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে দারুণ। তাদের মতে, শিশুকে শিশুকাল থেকেই এমন কাজগুলোতে ব্যস্ত রাখতে হবে। তাহলে তাদের মানসিক বিকাশ দ্রুত হবে এবং হয়ে উঠবে আদর্শ মানুষ।
- ভুল ত্রুটি হলে তা পৃথকভাবে না বলাই শ্রেয়। বা অন্যের সাথে আঁকার তুলনা করা একেবারেই উচিত না।
সবশেষে
বলব, ছোট্ট
শিশুটির আঁকার সাথে তুলনা করবেন না। বেশি ঠিক ভুল বলার দরকার নেই। আবার সবাই যে
আঁকাতে মহা পন্ডিত হয়ে উঠবে তেমনটা নয়। শৈশবের আনন্দকে উপভোগ করুন। তবে কেউ যদি
সত্যিই এগিয়ে যেতে চায় তবে তাকে উৎসাহ দিন। সঠিক পথের সন্ধান দিন। কে বলতে পারে
আজকের যে ছোট্ট শিশু ভবিষ্যতে সে পাবলো পিকাসোর মতো নাম করা আঁকিয়ে হল!
কলমে – সোমা লাই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন