আমার ক্লিনিকে যখন কোন মহিলা বা মেয়ে ত্বকের সমস্যা নিয়ে আসেন, তখন আমার প্রথম প্রশ্ন হয় " আপনি ত্বকের ভালো করে যত্ন নেন?" অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তর হয়, "হ্যাঁ, মানে ওই আর কি, ঠিক জানিনা।" এই পত্রিকার পাঠিকাদের প্রশ্ন করলেও সাধারণভাবে উত্তর একই আসবে বলে আমার ধারণা। অতএব আসুন জেনে নিই ত্বক পরিচর্যার ধাপগুলি, ও তাতে কি প্রসাধনী (product) ব্যবহার করা উচিত।
অনেকেই হয়ত জানবেন, বা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, ত্বক পরিচর্যার
তিনটি ধাপ – ক্লিন্সিং, টোনিং ও ময়শ্চারাইজিং (cleansing, toning ও moisturising) । টিভিতে, ইন্টারনেটে বা কাগজে
বহুবছর ধরে বিজ্ঞাপনে এইগুলিই দেখিয়ে আসছে, এবং এর প্রোডাক্ট গুলি সম্পর্কেও অনেকের
ধারণা আছে। তবে ডাক্তারদের মতে এখন এই নিয়মের কিছু পরিবর্তন হয়েছে।
আগে দেখা যাক ত্বকের যত্ন
নেওয়া বলতে কি বোঝায়:
১। ত্বককে আবহাওয়া ও রোদ থেকে হওয়া ক্ষতি থেকে বাঁচানো
এবং ক্ষতি হলে তাকে নিবারণ করা।
২।ত্বকের উপরে যে ময়লা বা residues নিয়মিত জমা হচ্ছে তাকে
পরিষ্কার করা।
৩। ত্বকের উপরের lipid স্তর ও আর্দ্রতা ( hydration) বজায়
রাখা যাতে ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
প্রত্যেকটির জন্য আলাদা দ্রব্য সামগ্রী রয়েছে, যা কিছু নির্দিষ্ট
নিয়মে ব্যবহার করা প্রয়োজন।
এক নম্বর, অর্থাৎ বহির্জগতের ক্ষতি থেকে ত্বককে বাঁচাতে আমাদের প্রধান অস্ত্র হল সানস্ক্রিন (sunscreen)। রোদ থেকে বাঁচতে সানস্ক্রিনের সঙ্গে ছাতা, স্কার্ফ ইত্যাদিও ব্যবহার করা দরকার।
সানস্ক্রিন দুই ধরণের হতে পারে - physical ও chemical।
Physical sunscreen ত্বকের উপর একটি আবরণ তৈরি করে সূর্যরশ্মিকে ভিতরে ঢুকতে বাধা দেয়।
Chemical sunscreen সূর্যের ক্ষতিকর UV রশ্মি শুষে নিয়ে ত্বককে বাঁচায়। একটি আদর্শ
সানস্ক্রিনে এই দুটি উপাদানই থাকা উচিত।
আমাদের প্রধান সুরক্ষা প্রয়োজন UVA ও UVB রশ্মি থেকে। অতিবেগুনী(UV) রশ্মি আমাদের ত্বকের বয়স বাড়িয়ে দেয়, বলিরেখা এনে দেয়,গাঢ়বর্ণের ত্বক (pigmentation) এনে দেয়, এমনকি খুব বেশি পরিমাণে হলে ত্বকে ক্যান্সার পর্যন্ত ঘটাতে পারে। সানস্ক্রিনের UVA protection মাপার পরিকাঠি হল PA rating। দেখবেন ভাল সানস্ক্রিনে PA+++/PA++++ rating দেওয়া থাকে, যার মানে High/Extremely high UVA protection। UVB protection-এর পরিমাপ হল SPF বা Sun Protection Factor rating- এর মাধ্যমে আপনি তুলনা করতে পারেন আপনার ত্বক সানস্ক্রিন না লাগলে কত গুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হত। SPF ৩০-৫০ সানস্ক্রিন সাধারণতঃ ৯৫-৯৯% UVB রশ্মিকে আটকাতে পারে। অতএব দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য আপনি PA +++/++++ ও SPF ৩০-৫০ রেটিং সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন।
সানস্ক্রিন ব্যবহারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে বাইরে না বেরোলেও সানস্ক্রিন লাগানো উচিত। ঘরে যেটুকু সূর্যালোক ঢোকে এবং আমাদের চারপাশে ফোন/টিভি/ল্যাপটপ থেকে যে নীল আলো বেরোয়, তাতেও ত্বকের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। যেহেতু UV চোখে দেখা যায়না, তাই কতখানি রোদ লাগছে তার ভিত্তিতে সানস্ক্রিন লাগানো ঠিক নয় (মেঘলা দিনেও রোদ ঝলমলে দিনের মতো একই পরিমাণ UV রশ্মি আমাদের ত্বকে ঢোকে)।
এছাড়াও, যেহেতু সানস্ক্রিনের প্রভাব তিন ঘন্টার মধ্যে শেষ
হয়ে যায়, তাই এটি তিন ঘণ্টা পরপর লাগানোর দরকার যতক্ষণ UV exposure হচ্ছে। সানস্ক্রিনের
উপর মেকআপ করা যেতে পারে।
এক নম্বরের এই কাজটি সবাই না করলেও, দুই নম্বর, অর্থাৎ নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার করা কাজটি মোটামুটি সবাই মন দিয়ে করেন। মুখের ত্বক পরিষ্কার করতে সাধারণতঃ মহিলারা ব্যবহার করেন বিভিন্ন কোম্পানির ফেসওয়াশ (facewash)। কি ফেসওয়াশ ব্যবহার করব তাই নিয়ে আমার কাছে নিয়মিত অসংখ্য প্রশ্ন আসে, কারণ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সবাই দেখেন ও বিশ্বাস করেন যে ফেসওয়াশ ব্যবহার করে মুখ শুধু পরিষ্কার নয়, ফর্সা, উজ্জ্বল, দাগহীন এবং ব্রণমুক্তও করা যায়। কিন্তু এই ধারণার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সঠিক নয়। কোনো দ্রব্যসামগ্রী আমাদের ত্বকে কাজ করতে হলে তাকে বেশ কিছুক্ষণ ত্বকের সংস্পর্শে থাকতে হবে যাতে তা ত্বককোষের ভিতরে শোষিত হতে পারে। কিন্তু ফেসওয়াশ আমাদের মুখে লেগে থাকে খুব বেশি হলে ৩০ সেকেন্ড, তাই এই সময়ে তার পরিষ্কার করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ খুবই কম। মুখে কোনো ওষুধ বা cosmeceutical লাগালে তার কার্যকারিতা বাড়াতে বা কমাতে কিছু বিশেষ উপাদান ফেসওয়াশে ব্যবহার করা হয় - যেমন ব্রণ বা তৈলাক্ত ত্বকের জন্য salicylic acid, বা রোদে পুড়ে যাওয়া (tan) কমাতে glycolic acid, কিন্তু শুধু ফেসওয়াশ দিয়ে ত্বকের আমূল পরিবর্তন সম্ভব না।
ফেসওয়াশের ব্যাপারে আরেকটি কথা জানা প্রয়োজন, যে সাধারণ সাবানের বদলে ফেসওয়াশ কেন ব্যবহার করবেন। সাবান আমাদের ত্বকের pH পাল্টে দেয়, এবং ত্বকের আর্দ্রতা (hydration) ও lipid আস্তরণেরও ক্ষতি করতে পারে - তুলনায় ফেসওয়াশ অনেক নরম জিনিস যা আমাদের ত্বকের pH ঠিক রাখে এবং পরিষ্কার করার সময় ত্বকও সুরক্ষিত রাখে।
ফেসওয়াশ দিনে দুবার করা উচিত, এবং মুখ ধোয়ার পর রগড়ে মোছা ঠিক নয়, তাতে ত্বকের hydration ও lipid স্তরের ক্ষতি হতে পারে। সঠিক পদ্ধতি হল হালকা করে নরম তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে মোছা, যাকে বলে dabbing।
মেকআপ তোলার জন্য ফেসওয়াশের আগে Michellar water বা
alcohol free wipes ব্যবহার করা উচিত। একে বলে double cleansing।
অনেকেই ভাবছেন ফেসওয়াশের পর টোনার (toner) লাগানো জরুরী, কিন্তু তা পুরোপুরি ঠিক নয়। আগে যখন সাবান ক্ষারযুক্ত (alkaline) হত, তখন pH পার্থক্যের জন্য ধোয়ার পর মুখে কিছু অবশিষ্ট লেগে থাকত, যা দূর করতে টোনারের প্রয়োজন হতো। কিন্তু আধুনিক ফেসওয়াশ ত্বকের pH বজায় রাখে, তাই এতে টোনারের কাজটাও হয়ে যায়, আলাদা করে না লাগালেও চলে।
এবার আসি তিন নম্বরে। ত্বকের lipid স্তর ও আর্দ্রতা ঠিক রাখতে যে জিনিসটার প্রয়োজন হয়, তা হল ময়শ্চারাইজার (moisturiser)। তৈলাক্ত ত্বকের উপর অনেকে ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করেন না, ভাবেন আরো তেলতেলে হয়ে যাবে - কিন্তু ময়শ্চারাইজার না লাগালে ত্বক থেকে তেলের সাথে জলও বেরিয়ে যায়। ময়শ্চারাইজ করার সঠিক সময় হলো মুখ ধোয়ার পর, হালকা ভিজে অবস্থায় (damp face)। অবশ্যই যাদের শুষ্ক ত্বক, বিশেষতঃ শীতকালে, তাদের একটু ভারী ময়শ্চারাইজার নিয়মিত ব্যবহার করা প্রয়োজন (দিনে ২-৩ বার, প্রয়োজন হলে আরো বেশি)। কিন্তু তৈলাক্ত ত্বকেও dehydration আটকাতে খুব হালকা সিরামের (serum) মত ময়শ্চারাইজার দেওয়া দরকার - দিনে একবার হলেও।
- সকালে চান করার সময় ফেসওয়াশ ।
- হালকা ভিজে ত্বকে ময়শ্চারাইজার ।
- ৫-১০ মিনিট বাদে সানস্ক্রিন, তা প্রতি তিন ঘন্টায় আবার লাগাতে হবে যতক্ষণ রোদ বা UV রশ্মি লাগছে। এর উপর পছন্দমত হালকা মেকআপ করতে পারেন।
- সন্ধে বা রাতে এসে Michellar water ও তারপর ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে মেকআপ তোলা।
- হালকা ময়শ্চারাইজ করা।
- রাতে শোয়ার আগে পছন্দমত night cream লাগাতে পারেন।
যত কম বয়স থেকে এই রুটিন মেনে চলা যায়, তত বেশিদিন ত্বক
উজ্জ্বল, সজীব, বলিরেখাহীন থাকে। ১৬-৬০ বছর বয়সের সবাই এই নিয়ম মেনে চলতে পারেন,
তবে বয়স ও ত্বকের ধরণ অনুযায়ী দ্রব্য সামগ্রী (product) আপনার ত্বক বিশেষজ্ঞের (skin
doctor)- এর থেকে পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করুন।
নিয়মিত ত্বক পরিচর্যার আরেকটি অঙ্গ হল active products,
অর্থাৎ ভিটামিন C, retinol ইত্যাদি দেওয়া product, যা অনেকেই night cream হিসেবে ব্যবহার
করেন। আপনারা যদি আগ্রহী থাকেন, তবে আরেকদিন সেই আলোচনায় বসা যাবে।
কলমে - ডঃ দে ব ত্রী দ ত্ত ( ত্বক বিশেষজ্ঞ)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন