"অলপ্পেয়ে হতচ্ছাড়া! ফের এদিকে দেখলে গায়ে গরম ফ্যান ঢেলে দেবো.."
রবিবারের সকাল, তবে সকাল না বলে বেলা বলাই ভালো। টিউশন পড়ে ফেরার সময় রাস্তার ধারে অটোর জন্য অপেক্ষা করছিল অঙ্কনা। তীক্ষ্ণস্বরের আওয়াজে চমকে দেখে বাসস্ট্যান্ডের পাশের ভাতের হোটেলের বউটা একটা ভিখারীকে গালমন্দ করছে। ভিখারীটা তাও যায় না। কাতরকন্ঠে বলে চলেছে, "দু'দিন কিছু খাইনি গো!"
বউটা ঝাঁজিয়ে ওঠে, "আ মোলো যা! তুই খাসনি তো আমি কী করবো! দূর হ' এক্ষুনি!"
অঙ্কনার খুব খারাপ লাগে। একটু ভাতই তো চেয়েছে। এরকম কতো ভাত নষ্ট হয় ওদের হোটেলে। একটু নাহয় দিতোই লোকটাকে। সে তো দিলো না, উপরন্তু কেমন দূর দূর করছে!
বাড়ি ফিরে দুপুরে খেতে বসে নিজের থালার দিকে তাকিয়ে সেই ভিখারীটার কথা মনে পড়ে যায়। দু'টো ভাতের জন্য লোকের মুখঝামটা খাচ্ছে, আর সে কতোদিন "আর খেতে পারছি না" বলে পাতে খাবার ফেলে রেখে উঠে যায়। কতোদিন ভাতের পরিমাণ একটু বেশি হলেই মায়ের সঙ্গে ঝামেলা করে।
"মা, একটা প্লেট দিয়ে যাও তো। কিছুটা ভাত উঠিয়ে রাখি। দরকার লাগলে পরে নিয়ে নেবো।"
অঙ্কনার হাঁক শুনে তার মা রান্নাঘরে গজগজ করতে শুরু করে দেন, "এই এক হয়েছে আজকালকার ফ্যাশন। ঘরের খাবার খেলে ওজন বাড়বে, আর ওই পিৎজা বার্গার খেলে বাড়বে না!"
অঙ্কনার বাবা অবিনাশবাবু বলেন, "না, এটা কিন্তু অনু ঠিকই করছে। কম খাক বেশি খাক, থালায় পরিমাণমতো খাবার নিক। দরকার লাগলে আবার নেবে। বেশি বেশি নিয়ে নষ্ট করা মোটেও ভালো ব্যাপার নয়।"
তারপর খেতে খেতে বলেন, "তা আজ হঠাৎ হলো কী! এতোদিন তো এরকম তৎপরতা
দেখিনি।"
অঙ্কনা উত্তেজিত হয়ে ওঠে, "জানো বাপি, আজ না স্যারের বাড়ি থেকে ফেরার সময় বাসস্ট্যান্ডের কাছে দেখি একটা ভিখারী। সে একটা ভাতের হোটেলে একটু খাবার চেয়েছে বলে হোটেলের বউটা তাকে কী যাচ্ছেতাই করলো! কতোবার করে ভাত চাইলো লোকটা, কিন্তু বউটা কিছুতেই দিলো না। যা ঝগড়ুটে কী বলবো!"
"তুমি তখন কী করলে?" অবিনাশবাবু জানতে চান।
"মানে?"
"হোটেলের বউটা নাহয় খেতে দিলো না, কিন্তু তুমি কী করলে? তুমি কী সেই লোকটিকে খাবার দিয়ে সাহায্য করেছো?"
অঙ্কনা চুপ করে থাকে।
অবিনাশবাবু বুঝিয়ে বলেন, "দেখ মা, অন্যলোকের উপর আমাদের কোনো হাত নেই। সেই বউটি খেতে দেয়নি, তার ব্যাপার। কিন্তু নিজেদের উপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ আছে। সে দেয়নি বলে আমিও দেবো না, এটাই তো ভুল।"
অঙ্কনা মনে মনে ভাবে পরেরদিন পড়তে গিয়ে লোকটাকে দেখতে পেলে সে ঠিক কিছু খাবার কিনে দেবে তাকে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সেইদিনের পর থেকে রাস্তার ধারে তাকে আর দেখতে পায় না অঙ্কনা। কেজানে হোটেলের বউটা লোকটার গায়ে সত্যি সত্যি গরম ফ্যান ঢেলে দিলো কিনা! যা সাংঘাতিক মহিলা!
----------------------------
মাসখানেক কেটে গিয়েছে।
সামনে পুজো, তারপর স্যার আবার
পরিবারসমেত কোথায় একটা ঘুরতে যাবেন। বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকবে টিউশন। সেইজন্য
স্যার এখন সকালে পড়ানোর সঙ্গে ক'দিন যাবৎ বিকালেও পড়িয়ে
দিচ্ছেন। এরকমই একদিন কলেজ ফেরতা টিউশন পড়ার পর কতগুলো নোটস জেরক্স করে বেরোতে
বেরোতে অঙ্কনার বেশ রাত হয়ে যায়। নেহাত এই নোটসগুলো এতো দরকারি ছিল, তাই অতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জেরক্স করিয়ে
আনলো সে।
বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে অঙ্কনা যথারীতি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ায়, অটো ধরতে হবে তাকে। চারপাশটা তাকিয়ে দেখে নেয়, লোকজন নেই তেমন। কে বলবে সকালেই এই রাস্তা গমগম করে, আর এখন কেমন ফাঁকা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অধৈর্য্য হয়ে পড়ে সে। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে আজ, এদিকে অটোগুলোও আসছে ভর্তি হয়ে। উফ্, আরও দেরী হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎই অঙ্কনার চোখে পড়ে পাশে বাইক নিয়ে তিন-চারটে ছেলে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে আর মাঝেমধ্যে তার দিকে তাকাচ্ছে। অজানা আশঙ্কায় অঙ্কনার খুব ভয় লাগতে শুরু করে। রাস্তাঘাট শুনশান, দরকার পড়লে যে কারুর সাহায্য নেবে সে উপায়ও নেই।
"অ মেয়ে! ওখানে কী করছো! এদিকে এসে দাঁড়াও।"
খ্যানখ্যানে স্বরে চমকে ওঠে অঙ্কনা, দেখে ভাতের হোটেলের সেই মহিলা। হাত নেড়ে তাকে ডাকছে। অঙ্কনাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে।
মহিলা বলে, "দেখো বাছা, দিনকাল মোটেও ভালো নয়। ওভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে তুমি এবার থেকে আমার হোটেলের পাশ থেকেই অটো ধোরো।"
অঙ্কনা ঘাড় নেড়ে সম্মতি
জানায়।
অটোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে মহিলার সঙ্গে অনেক কথা হয় তার। জানতে পারে, মহিলার নাম শিবানী। স্বামী অনেকদিন আগে মারা গেছে। তিন ছেলেমেয়ে, স্কুলে পড়ে। হোটেল, সংসারের কাজ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা সবকিছু সে-ই এখন সামলায়। বড়ো ছেলেটা ক্লাস ইলেভেনে উঠেছে, মাকে বলেছে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা হয়ে গেলে সেও হোটেলে বসবে। কিন্তু শিবানী রাজি নয়। সে চায় তার ছেলেমেয়েরা অনেকদূর পড়াশোনা করুক। তারপর সম্ভব হলে তারা তাদের এই ভাতের হোটেলটাকে আরও বড়ো করবে। তখন আর এটা শুধু ভাতের হোটেল থাকবে না, বড়ো একখানা রেস্টুরেন্ট হবে। অঙ্কনা চুপ করে শুনে যায় শিবানীর স্বপ্নগুলো।
"দিদি, বাসন ধোওয়া হয়ে গেছে.."
"হ্যাঁ, আসছি।" বলে শিবানী। তারপর অঙ্কনার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে, "এ হলো দীনু। রাস্তার ধারে ভিক্ষে করছিল, তাই কাজে রেখে দিলাম। গতর আছে, ভিক্ষে কেন করবে! খেটে খাক, দু'পয়সা উপায়ও করতে পারবে। মাথা উঁচু করে বাঁচুক।"
আরে তাইতো! এ তো সেদিনের সেই ভিখারীটা! অবাক হয় অঙ্কনা। অটো পেয়ে যেতে শিবানীর কাছ থেকে বিদায় নেয় সে। অটোয় যেতে যেতে সারা রাস্তা সে শিবানীর কথাই ভেবে চলে। সত্যি, তাকে কেমন ভুলই না বুঝেছিল!
দুর্গাপুজো এসে যায়, চারপাশে খুশির কলরব। মহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি দিতে গিয়ে মা দুর্গার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অঙ্কনা। মনে পড়ে যায় শিবানীর কথা। উপলব্ধি করে জগৎ সংসারের সব নারীর মধ্যেই মা শক্তিরূপিনী হয়ে প্রচ্ছন্ন রয়েছেন।
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন