উদযাপন


 


একটা শোভাযাত্রা চাই! এই মুহূর্তেই ! জব্বর একখানা বিজয় শোভাযাত্রা!

খবরটা চাক্ষুষ করা মাত্র সীমার বুকের ভিতরে খুশির তুবড়ি ফুটতে শুরু করেছে অনবরত। যেন নিউ ইয়ার্স ইভের রাতের সিডনি হারবারের আতসবাজির প্রদর্শনী।

যদিও প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সীমা। নিজের ডান হাতখানা যখন বাম হাতে এক রামচিমটি কাটল,

'উঃ'! অস্ফুটে কঁকিয়ে ওঠেন সীমা।

_'যাক বাবা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি না তবে।' স্বগতোক্তি করেন সীমা দেবী।

 

ভিতরের আনন্দের গুড়গুড়ানিটা আর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেন না তিনি। কাকে জানাবেন তিনি এই রাত দুপুরে! শহরের তুলনায় মফঃস্বলে রাত তাড়াতাড়ি নিঝুম হয়ে আসে। রাত বারোটা মানে এ বাড়ির সবাই ঘুমের অতলে। শোবার ঘরে উঁকি মেরে দেখেন সীমা, কর্তা এতক্ষণে ফুরুরুরুৎ...ফুরুরুরুৎ। নাসিকার কনসার্ট নিত্যদিনের মতো বেজে চলেছে তাঁর। কন্যাদের শোবার ঘরের পর্দা ঠেলে উঁকি দেন তিনি। নাহ্, দু'জনেই ঘুমের অতলে।

উঃ, কি জ্বালা! কার সাথে এ আনন্দ ভাগ করে নেওয়া যায় এই রাত দুপুরে!  

অগত্যা মধ্য চল্লিশের দশাশই চেহারার মহিলা সীমা সমাদ্দার একাই নেমে পরেন ময়দানে। সেলিব্রেশানে। দুই হাত শূন্যে ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি সহযোগে নেচে বেড়াতে থাকেন, থুড়ি আনন্দের আতিশয্যে উড়ে বেড়াতে থাকেন ডাইনিং টেবিলের চারপাশে স্বল্প পরিসর প্যাসেজটাতে।

দুই হাতের তর্জনী আর মধ্যমারা ভিক্ট্রি চিহ্ন তৈরি করেছে। মুখে প্রেসারকুকারের হুইসেলের মতো অনবরত চাপা কণ্ঠে 'ইয়েস...ইয়েস' রব।

বিজয় উল্লাসে মত্ত সীমা দেবী। আবছা অন্ধকার প্যাসেজটা তখন সীমা দেবীর আনন্দ উদযাপনের ভাইবসে বেদম আন্দোলিত হয়ে চলেছে।

 

তা প্রায় আধ ঘণ্টাটাক চলল তাঁর বিজয় উল্লাস। হাঁটুতে এবার যেন অল্প অল্প ব্যথা অনুভব করছেন। স্টাডি রুমের সোফাতে গা এলিয়ে দিয়ে মনে মনে ফিক করে হেসে ফেলেন সীমা দেবী। এতক্ষণ কি ছেলেমানুষের মতো কাজটাই না করছিলেন তিনি!

একটা গ্রামের স্কুলের অঙ্কের দিদিমণি সীমা সমাদ্দার। ফি বছর সেই গ্রামে শীতকালে ফুটবল টুর্নামেন্টর পর ছেলেপুলেদের দল এমন বিজয় শোভাযাত্রা বের করে। গ্রামে দু'পাড়ার দু'টো ক্লাব। একটা 'আমরা পেলের পোলা' আর অন্যটার নাম 'ইয়ং ফাইটার্স '। যে বছর যারা টুর্নামেন্ট জেতে সে বছর তারা পেল্লাই শিল্ড ঘাড়ে ব্যান্ডপার্টি সহযোগে পথে নামে। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হাত পা ছুঁড়ে তাদের সে কি নেত্য!

এই বয়সে একাই সীমা সমাদ্দার নিজের বিজয় সেলিব্রেশনে তেমন নেত্যকালী হয়ে ছিলেন একটু আগে। ভেবেই হাসি পায় তাঁর। তবে হাসির মধ্যেই মনের ফাঁকে ফোঁকরে স্মৃতির ঝাঁপি, ঝাঁটি গাছের ঝোপের মতো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সমুদ্র নীল রঙা মলাটের ডায়রিটাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে তাঁর এই মুহূর্তে।

 

পায়ে পায়ে এগিয়ে যান চৌকিটার কাছে। আসন পিঁড়ি হয়ে বসে পড়েন মেঝেতে। চৌকির নীচের আবছা অন্ধকারে ওই তো গামার কাঠের হারমোনিয়াম বাক্সটা। হাত রাখেন তার গায়ে। সাড়া দেয় আয়তাকার বাক্সটা। যেন সীমা দেবীর সান্নিধ্যের অপেক্ষায় ছিল সে কতকাল!

বাক্সের দুই পাশের হাতল ধরে আস্তে করে টেনে বাইরে বার করে আনেন সীমা।

 

ইসসসস্, কত্তো ঝুল হয়ে আছে সারা গায়ে! কতদিন পর যে বাক্সটা আলোর মুখ দেখল! ধুলো আর ঝুল মুছে তিনি খুলে ফেলেন বাক্সের ঢাকনাটা। হারমোনিয়ামের উপর রাখা নীল মলাটের ডায়রিটা তুলে নেন। দুই হাতের আদরে বুকের কাছে ধরে অনুভব করেন তাঁর মাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়া খুদে সীমাকে মা এই ডায়েরিটা দিয়েছিলেন ছড়া লেখার জন্য। প্রথম পৃষ্ঠায় এই তো সেই চারটে ব্যাঙের ছড়াটা।

পরপর পৃষ্ঠা উল্টে চলেন সীমা সমাদ্দার। মোটা ডায়েরির মাঝবরাবর এসে থমকে থেমে গেছে ছড়া কবিতার মিছিল।

প্রতিটা কবিতায় পৃষ্ঠার ডানদিকে মাথার উপর স্থান, তারিখ আর সময় লেখা তাঁর বরাবরের অভ্যাস ছিল। শেষ তারিখটা ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় বর্ষে পড়া কালীন এক হেমন্ত সন্ধ্যার।

বিয়ের দিন তিনেক আগের তারিখ সেটা।

 এরপরের সময়টা অনেকটা চাঁদনি রাত আর ঘূর্ণিঝড়ের ককটেলের মতো। ছন্দ এসেছে মাধবীবিতানের সুগন্ধ মেখে। কিন্তু সংসারের আবর্তে, ঘূর্ণিঝড়ে সে ছন্দ আর লিপিবদ্ধ করা হয়ে ওঠেনি। তারা শুষে গেছে কর্তব্যের ঝামা পাথরের চাট্টানে।

মা কিন্তু দূর থেকেই তাঁর অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে সীমা দেবীকে চালনা করে গেছেন বরাবর। উৎসাহ আর মমতার ফল্গুধারার মিকশ্চারে তাঁকে এগিয়ে চলার প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন অনবরত।

অনেকবার ভেঙ্গে পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়িয়েছেন সীমা। কোন কবি যেন বলে গেছিলেন সংসারের পথ সব সময় কুসুমাস্তীর্ণ হয় না, কাঁটা বিছানো থাকে পদে পদে।

মা বলতেন, 'জীবনকে যাপন করতে হয়। সে সুখ হোক কি দুঃখ। কারও কাছে এই যাপন কেবলমাত্র আটপৌরে দিনঃপাত। আবার কারও কাছে এই যাপন এক প্রকার উৎকৃষ্ট শিল্প। যারা জীবনমুখী শিল্পী শেষ পর্যন্ত তারাই পারে জীবনের জয়গান গাইতে।'

দুই কন্যা, স্কুলের শিক্ষকতা আর সংসারের হাজারটা কাজের মাঝে নিজের লেখালেখির কথা এক সময় বাতুলতা ঠেকেছিল সীমা দেবীর। দিন এগোলো জেট গতির বেগে।মেয়েরাও বড় হল এক সময়। বছর দুই আগে ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা খুলে দিয়েছিল বোন।তবে অনাঘ্রাত কুমারীর মতো অনেকদিন পড়েই ছিল অ্যাকাউন্টটা।


-'কি রে রুনু খবর কি?'

 প্রশ্ন করে নীল ডায়েরিটা।

রুনু হল সীমার ছোটবেলার ডাক নাম। আর ঝুনু হলো সীমার বোন।

-'ফাটাফাটি!' সীমার গলায় খুশি ঝরে ঝরে পড়ছে।

-'সে তো বুঝলুম। মুঝে ইয়াদ কিয়া। মানে ফাটাফাটি ব্যাপারই তো হবে।তা পেট ফাটবার আগে কয়ে ফেলো।

-'আমি না প্রাইজ পেয়েছি। সেকেণ্ড প্রাইজ।'

-'তা নেচে নাও চার পাক।'

উচ্ছ্বসিত সীমা বলেন,

-'এতক্ষণ তো সেটাই করছিলুম।'

-'সত্যিই? তুমি আর নাচ!'

-'কি করব নিজেকে সামলাতে পারলুম না যে।'

-'তা কিসে জুটল প্রাইজ?'

-'গল্প লেখা প্রতিযোগিতায়। সেকেণ্ড প্রাইজ। হাজার টাকার গিফ্ট ভাউচার। যা খুশি বই কেনার জন্য।'

-'তা কি গপ্প লিখলে?'

-'রম্য রচনা। বর্তমান পটভূমিতে নারীদের চরিত্র চিত্রায়ণ।'

-'ওঃ! ভাঁড়ামো!'

-'মানে! জানো! বর্তমান যুগে মানুষের জীবনে ওই একটা জিনিসের বড় অভাব। হাসি। সব গোমড়ামুখো কেরিয়ারিস্টের দল! হাসতে ভুলে গেছে যেন। আমি সেই হাসি দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাই।'

-'মেরা নাম জোকার দেখেছ তো? কি হাল হয়েছিল নায়কের!'

মনটা দমে যায় সীমা দেবীর।

বছর দুই হলো মুখবইতে কিছু কিছু ছবি পোস্ট করতে গিয়ে ছন্দ মিলিয়ে দু'চার লাইন লেখা শুরু করেছিলেন সীমা।

একদিন রাতে যখন সীমা ফেসবুক ঘাটছে, কত্তা বলেছিলেন,

-'নতুন করে আবার প্রেমে পড়লে না কি?'

চমকে উঠেছিলেন সীমা। চল্লিশে পড়েছেন বটে। মাজা রঙে এখনও তিনি আকর্ষণীয়া। ইনবক্সে প্রায়ই প্রেম নিবেদন করে তোষামুদে ভ্যাগাবণ্ড কিছু পাবলিক। যদিও সীমা পাত্তাই দেন না ওইসব অপগণ্ডদের। কত্তা কি তবে সে সবের ইঙ্গিত করল!

সীমা দেবীর কিছু বলার আগেই প্রকাশ বলেছিলেন,

-'ফেসবুকে ছবির সাথে ছন্দের জোয়ার দেখলাম কিনা। প্রেমে পড়লেই কবিতা আসে। তাই বললুম।'

 এরপর আর একদিন প্রকাশ সীমাকে বললেন,

-'তোমার ওই নদীর কবিতাটা বেশ লাগল।একটা কমেন্ট করে ফেললাম।'

 রাশভারি প্রকাশের মুখে নিজের কবিতার প্রশংসা শুনে সীমা দেবীর উৎসাহে জোয়ার এসেছিল।

 এরপর বিভিন্ন সাহিত্যের গ্রুপে নিয়মিত উঁকি দিতে থাকেন সীমা। শুরু করেন গল্প লেখা। ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন রম্য রচনায় তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিটা ফেলনা নয়।

 -'কবিতা লেখা ছেড়ে এখন তবে ভাঁড়ামো শুরু করলেন গণিতের শিক্ষিকা সীমা সমাদ্দার! গ্রেট! গ্রেট!'

 ডায়রির কথায় চমক ভাঙে সীমার।

দেখেন ঘরের আলো নিভে এলো। নিকষ অন্ধকার গ্রাস করল চারপাশ। সেই অন্ধকারে সাদা ফ্লুরোসেন্ট কালারের হাজারটা মুখোশের আড়ালে মুখেরা তাঁর চারপাশে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে অট্টহাসি দিচ্ছে। আর চিৎকার করে বলছে 

-'ভাঁড়...ভাঁড়....বিদূষক...জোকার....'

আর বাতাসে বিচ্ছিন্নভাবে ভেসে বেড়ানো সাদা গ্লাভসগুলো তর্জনী তুলে তাঁকে ইঙ্গিত করছে ।

তাঁকে ঘিরে বাঁকা হাসি মুখের মুখোশ আর তর্জনী তোলা গ্লাভসের ঘূর্ণি স্রোতে জ্ঞান হারাতে থাকেন সীমা।

পাঁচটার অ্যালার্মটা বেজে ওঠে মিঠে স্বরে। ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসেন সীমা সমাদ্দার। প্রতি দিনের সাংসারিক যুদ্ধ শুরু হবে এখনই।

পূবের জানালার ওপাশে ভোরের লাল আকাশ। জানান দিচ্ছে সূর্য ওঠার সময় হলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন সীমা। পরমুহূর্তে মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। প্রাইজের ব্যাপারটাও তাহলে স্বপ্নই।

মোবাইলের নেট অন করে ফেসবুকে উঁকি দেন সীমা। প্রিয় সাহিত্য গ্রুপের নোটিফিকেশনটা সবার উপরে জ্বলজ্বল করছে। তাঁকে ট্যাগ করে কিছু একটা পোস্ট করা হয়েছে। ঢিপঢিপে বুকে নোটিফিকেশনের হাত ধরে পৌঁছে যান পোস্টটাতে।

অধীরা বসু স্মৃতি পুরস্কার প্রতিযোগীতায় তাঁর রম্য গল্প 'বলহরি বাঁড়ুুজ্যের বলিহারি কীর্তির' জন্য দ্বিতীয় পুরস্কার পাচ্ছেন লেখিকা সীমা সমাদ্দার।


কলমে - এ ণা ক্ষী  ক য়া ল  ম ণ্ড ল 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন