বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্য ও তার ঘরোয়া সমাধান



এই বিষয়টি নিয়ে সব বাবা মায়েরাই কম বেশি চিন্তিত থাকেন। বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্য ও তার কারণে পটি করতে যাওয়ার সময়ে বাচ্চাদের দুর্ভোগ, বাবা মায়েদের কাছে খুবই কষ্টকর। স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চাদের যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা কম, তার সাথেই পেটের পেশীর জোর কম হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্যে অনেক বেশি কষ্ট হয় তাদের। আর এই কারণে অনেক বাচ্চার কাছে পটির সময়টা অত্যন্ত আতঙ্কের, সেইজন্য তারা পটি করতে আপত্তি জানায়। ফলস্বরূপ, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বৃদ্ধি পায়, সেই শিশুকে পেট ব্যথা অথবা পেটের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। শুধু তাই নয়, এতে ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিতে পারে এবং পরিপাক প্রক্রিয়ারও ব্যাঘাত ঘটে। সেই কারণে শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যের ঘরোয়া কিছু সমাধানের কথা এখানে আলোচনা করা হলো। তার আগে জেনে নেওয়া যাক বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্ভাব্য কারণগুলি।

ছোটো থেকে বড়ো হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, সেগুলি নিম্নে বিবৃত করা হলো।

 ১) ছয়মাস বয়সের কম শিশুরা মাতৃদুগ্ধের উপর নির্ভরশীল, তাই তাদের মধ্যে এই সমস্যা সেভাবে দেখা যায় না। যেসব শিশু ফর্মুলা মিল্ক খায় তাদের মাঝেমধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

২) ছয়মাসের পর শিশুরা ধীরে ধীরে সেমি-সলিড ও সলিড খাদ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। এরকম সময়ে শিশুর খাদ্যতালিকায় ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার না থাকলে এবং তরল খাদ্য বা পানীয়র পরিমাণ পর্যাপ্ত না হলে এই সমস্যা দেখা দেয়।

৩) শিশুরা দেড়-দু'বছরের হলে স্বাভাবিক খাবারে, যার বেশিরভাগটাই কঠিন খাদ্য, অভ্যস্ত হতে শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তখন থেকেই শুরু হয় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা। তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা এই সমস্যায় বেশি ভুক্তভোগী হয়।

৪) আগে ৩০ শতাংশ বাচ্চা কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্মুখীন হতো। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, রিফাইন্ড ফুড বা পরিশোধিত খাবার বেশি খাওয়ানোর জন্য এই সমস্যা বেড়েই চলেছে।

৫) বাচ্চা ছোটো হোক বা বড়ো, ফাইবারসমৃদ্ধ খাদ্য কম খেলে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান না করলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। তার কারণ, বাচ্চাদের শরীরে জলের ঘাটতি হলে বা ডিহাইড্রেশন হলে মল শুকনো ও শক্ত হয়ে যায়। এছাড়াও আছে প্যাকেটজাত দুধ যার জন্য অনেক বাচ্চাই এই সমস্যায় জেরবার হয়।

৬) কোষ্ঠকাঠিন্যের আরেকটি কারণ হলো, এই সমস্যার জন্য একবার পটি করতে কষ্ট হলে বাচ্চারা অনেক সময় পরে পটি পেলেও মলদ্বারে যন্ত্রণা হওয়ার ভয়ে চেপে দেয়, পটি করতে চায় না। এইভাবে তারা যত মল নির্গত হওয়া চাপতে থাকে ততই কোষ্ঠকাঠিন্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।

৭) কিছু কিছু খাদ্যের প্রভাবে বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন—

Ø  প্যাকেটজাত দুধ

Ø  ফর্মুলা খাদ্য 

Ø  স্টীমড গাজর 

Ø  ভাত 

Ø  কাঁচকলা 

Ø  কন্দজাতীয় খাদ্য (রাঙা আলু বাদে) 

Ø  সাদা পাউরুটি 

Ø  চিজ



এই সম্পর্কে আজ সংক্ষেপে কিছু সাহায্যকারী খাবারের নাম বিবৃত করলাম যা শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

রাঙা আলু :

সাধারণত কন্দজাতীয় খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়ায়, যেমন ধরুন আলু, মুলো ইত্যাদি। এগুলির কারণে স্বল্প হলেও কোষ্ঠর সমস্যা হতে পারে। কিন্তু রাঙা আলুর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টোটা ঘটে। রাঙা আলুর মধ্যে বিপুল পরিমাণে থাকে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেট।

খেজুর ও প্রুন :

ফাইবার ও মাল্টিভিটামিনে খেজুর পরিপূর্ণ। কিন্তু বাচ্চাকে খেজুর দেবেন কীভাবে? পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ। রাতের বেলায় খেজুর ভিজিয়ে রাখুন, সকালে সেই ভেজা খেজুর বাচ্চাকে দিন। এটি পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। প্রুন কিছুটা খেজুরের মতোই, তবে আমাদের দেশে সেভাবে সহজলভ্য নয়। বিদেশে বাবামায়েরা বাচ্চাদের প্রুন খাওয়ান আর সেক্ষেত্রে খেজুরের মতোই একইরকম কাজ হয়। এদেশে যেহেতু প্রুনের তুলনায় খেজুর সহজলভ্য, তাই আপনার বাচ্চার খাদ্যতালিকায় খেজুর অন্তর্ভুক্ত করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা অনেকটাই কমবে বলে আশা করা যায়।

নাশপাতি :

কোষ্ঠকাঠিন্যে সাহায্যকারী আরেকটি ফল নাশপাতি। এর মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা বাচ্চাদের পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।

ব্রোকলি:

এটি প্রোটিন এবং ফাইবারের একটি সমৃদ্ধ উৎস। ছোট ছোট ফুল হিসাবে কেটে নিয়ে সামান্য নুন যোগ করে স্টীমড বা বেকড হিসাবে দেওয়া যায়। বাচ্চারা নিজে নিজে খেতে খুবই পছন্দ করে।

মটরশুঁটি :

ফাইবারে পরিপূর্ণ। বাচ্চা একটু বড়ো হলে কাঁচাও দিতে পারেন তাকে। ছোটো শিশুর ক্ষেত্রে মটরশুঁটি সেদ্ধ করে তাকে খেতে দিন। তার জন্য তৈরি ডাল বা খিচুড়িতেও এটি যোগ করতে পারেন।

পেঁপে :

এটি ফাইবারের একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং সেই কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে খুবই কার্যকর। ছয়মাসের বেশি বয়সী বাচ্চাদের খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন পেঁপে সেদ্ধ বা পেঁপের মন্ড। বাচ্চা আরেকটু বড়ো হলে তার খাদ্যাভ্যাসে রাখতে পারেন পেঁপে দিয়ে তৈরী ঝোল বা ডাল বা স্ট্যু।

বিনস :

অত্যন্ত উপকারী একটি সবজি হলো বিনস। এর মধ্যে থাকে দু'ধরণের ফাইবার — জলে দ্রাব্য বা ওয়াটার সলিউবল ফাইবার এবং জলে অদ্রাব্য বা ওয়াটার ইনসলিউবল ফাইবার। এই দু'টোই শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য খুব উপকারি। 

অ্যাপ্রিকট:

আপনার শিশুর জন্য অত্যন্ত উপকারী ফল এটি, বিশেষ করে কোষ্ঠকাঠিন্যের ক্ষেত্রে অধিক উপযোগী। ফলটি দোকানে বাজারে সেভাবে সহজলভ্য নাও হয়ে পারে। তবে বড় কোনো বাজারে বা সুপারমার্কেটে এই ফল কিনতে পাওয়া যাবে। শুধুমাত্র কোষ্ঠ পরিষ্কার করাই নয়, ফলটি বেশ সুস্বাদু হওয়ায় শিশুরা সহজেই পছন্দ করে ফেলবে এটি। কাঁচা বা রস হিসাবে এটি দেওয়া যেতে পারে অথবা দোকান থেকে শুকনো অ্যাপ্রিকট কিনে এনে সারারাত জলে ভিজিয়ে শিশুকে দেওয়া যেতে পারে।

হোল গ্রেইন ব্রেড বা গোটা শস্যের রুটি :

পাউরুটি হোক বা রুটি, গোটা শস্যের হলে তা থেকে বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। প্রাতরাশে বাচ্চাকে পাউরুটি দিয়ে চাইলে তাকে অবশ্যই দিন হোল গ্রেইন ব্রেড।

ওটস :

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য, ফাইবারসমৃদ্ধ ও সহজপাচ্য। সকালে অথবা সন্ধ্যাবেলার জলখাবারে বাচ্চাকে খাওয়াতেই পারেন। ওটস বানাতে পারেন বিভিন্নভাবে। যেমন দুধ দিয়ে, সঙ্গে রাখলেন কাজু বা কাঠবাদাম, কিশমিশ অথবা ওটস পরিজ বানানোর পর এতে যোগ করলেন আপেল বা কলার টুকরো। এছাড়াও বানানো যায় ওটসের খিচুড়ি, বিভিন্ন সবজি ও মশলা সহযোগে।


শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় প্রসঙ্গে কিছু কথা :

১) বাচ্চা ফর্মুলা মিল্ক বা প্যাকেটজাত খাবার খেলে সেটি বানানোর সময় পাউডার এবং জলের পরিমাণ যেন সঠিক অনুপাতে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। উদ্দেশ্য হলো, বাচ্চার শরীরে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল যায় সেদিকে খেয়াল রাখা।

২) আপনার বাচ্চার বয়স ছয়মাসের বেশি হলে আপনার শিশুর ডায়েটে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল অন্তর্ভুক্ত করুন। জল ছাড়াও স্যুপ, ফলের রস, দুধ এরকমই কিছু উপায়ে।

৩) বাচ্চাকে বেশি করে ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানোর দিকে নজর দিন। উপরে উল্লিখিত ফল ও সবজি ছাড়াও তাকে দিতে পারেন যেকোনো শাক, পটল, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, শিম, লাউ, কুমড়ো, পেয়ারা, কালো জাম, কলা, বেল, ইত্যাদি। ডালের মধ্যে মুগ, মটর ও ছোলার ডালে যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার রয়েছে।

৪) বাজার চলতি হেলথ ড্রিঙ্ক যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। বাচ্চার বয়স দু'বছরের বেশি হলে, সে মাতৃদুগ্ধ না খেলে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগলে তার খাদ্যতালিকায় দুধের পরিমাণ কমিয়ে দিন।

৫) বড়োদের মতো বাচ্চাদেরও শারীরিক সক্রিয়তার প্রয়োজন আছে। এটি মসৃণ মলত্যাগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চা একদম ছোট হলে তার হাত পা নাড়িয়ে খেলা করান অথবা পা দিয়ে সাইকেল চালানোর মতো করে একটু ব্যায়াম করিয়ে দিন। বাচ্চা হামাগুড়ি দেওয়ার পর্যায়ে থাকলে তাকে ঘরের মধ্যেই চারপাশে ঘুরতে উৎসাহিত করুন। হাঁটতে শিখে গেলে তো আর কথাই নেই! খেলাধূলা, দৌড়াদৌড়ি লেগেই থাকবে।

৬) প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে পটি করার জন্য বাচ্চাকে উৎসাহিত করুন। এতে ধীরে ধীরে বাচ্চার মধ্যে ঠিকমতো পটি করার অভ্যেস তৈরি হয়ে যাবে।

৭) কোনও ওষুধ খাওয়ার জন্য বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখুন। সেরকমটা হলে আপনার বাচ্চার চিকিৎসকের সঙ্গে অবশ্যই পরামর্শ করুন।

বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হলে এতে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। প্রথম থেকে নজরে রাখতে হবে সে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছে কিনা, পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান করছে কিনা, যথেষ্ট পরিমাণে অ্যাক্টিভিটি হচ্ছে কিনা। আর প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।


কলমে - ত মা লি কা  ঘো ষা ল  ব্যা না র্জী

 


 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন