চা-কে আমাদের দেশের "জাতীয় পানীয়" বলা যেতেই পারে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা চায়ের জুড়ি মেলা ভার। বেগুনী বা আলুর চপের সঙ্গে, মুড়ির সঙ্গে অথবা নিদেনপক্ষে বিস্কুটের সঙ্গে, এককাপ ধূমায়মান চা পেলে মনটা সতেজ হয়ে ওঠে, মেজাজ হয়ে ওঠে ফুরফুরে। সন্ধ্যেবেলায় চা পান করতে করতে ব্যালকনি গার্ডেনে বসে শুনছেন নিজের প্রিয় গান অথবা পড়ছেন পছন্দের একখানি বই, সারাদিনের ক্লান্তি দূরীকরণের জন্য এর চেয়ে উত্তম উপায় আর কী আছে!
চায়ের রকমফের প্রচুর — কালো চা, দুধ চা, এলাচ চা, লেবু চা, আদা চা, মশলা চা, সবুজ চা বা গ্রীন টি, ও আরও অনেক। কখনও কী ভেবে দেখেছেন চায়ের ইতিহাসের ব্যাপারে? কীভাবে শুরু হলো চায়ের ব্যবহার? সেই প্রসঙ্গেই বলবো আজ। সঙ্গে থাকবে চায়ের একখানি বিশেষ রেসিপি — কাশ্মীরি চা।
চায়ের উৎপত্তি হয়েছিল চীনদেশে। এই প্রসঙ্গে রয়েছে একাধিক লোককাহিনী। কারুর মতে, একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তাঁর চীন সফরে আকস্মিকভাবেই চা তৈরি করে ফেলেছিলেন। কিছু বুনো পাতা গরম জলের মধ্যে ভিজিয়ে রাখায় সেটির স্বাদ তাঁর বেশ ভালো লেগেছিলো। সন্ন্যাসীর থেকে শুনে অন্যান্যরাও অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করায় তাদেরও সেই স্বাদ পছন্দ হয়। শুরু হয়ে যায় চায়ের ব্যবহার।
তবে যে কাহিনীটি সর্বাধিক প্রচলিত সেটি চীনের এক সম্রাটের। খ্রীষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালের কথা। চীনা সম্রাট শেন নাং ভৃত্য পরিবেষ্টিত হয়ে জঙ্গলে গেছেন আনন্দ ভ্রমণে। সম্রাট বিশ্রাম নিচ্ছেন, ভৃত্যরা তাঁর জন্য খাদ্য প্রস্তুতে ব্যস্ত। একটি পাত্রে জল গরম করা হচ্ছিল তাঁর ব্যবহারের জন্য। নিকটস্থ একটি গাছ থেকে হাওয়ায় উড়ে কিছু পাতা এসে পড়লো ওই ফুটন্ত জলে। জলের রং তৎক্ষণাৎ বাদামি রূপ ধারণ করে। ভৃত্যরা দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি সেই জল ফেলে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু বাঁধা দেন স্বয়ং সম্রাট।
গরম জলে পাতা পড়ে জলের রংয়ের এহেন পরিবর্তন দেখে তিনি সেই জলটি চেখে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অন্যান্যরা তাঁকে বিনীতভাবে অনুরোধ জানান এটি না করার জন্য। বুনো পাতা, জলটি পান করে যদি সম্রাট অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু সম্রাট কোনো কথাই কানে নিলেন না। উষ্ণ বাদামি জলটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি সেটির কিছুটা পান করেই ফেললেন।
সকলে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে সম্রাটের শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটলো কিনা। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে তাঁর মুখে ফুটে উঠলো হাসি। জানালেন, এটি পান করে তিনি বেশ চনমনে বোধ করছেন। এই ঘটনার পর থেকে চা পানের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো গোটা চীনে, সেখান থেকে ক্রমে সমগ্র বিশ্বে।
পরবর্তীকালে চীনা পন্ডিতগণ কর্তৃক চায়ের ঔষধী গুণাবলী স্বীকৃতি পেলো চিকিৎসামহলে। চায়ের স্বাদ নিয়ে চীনারা শুরু করে দিলো নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা। কখনও চায়ের সাথে আদা মিশিয়ে, কখনও নানারকম মশলা এবং কমলালেবুর রস মিশিয়ে চা-কে আরও সুস্বাদু করার চেষ্টা করতে থাকে তারা। অবশেষে ১৬০০ শতকে চায়ের স্বাদ পৌঁছোয় পশ্চিমাদের কাছে।
একটা সময় পর ব্রিটিশদের কাছে চীন বাণিজ্যিকভাবে চায়ের রপ্তানি শুরু করে। ব্রিটিশরা ছিল চায়ের বড়ো ক্রেতা। কিন্তু বিনিময় মূল্যটা ছিল সোনা ও রুপোয়, সেই কারণে খরচ পড়ে যেত প্রচুর।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে চায়ের প্রবেশ ঘটে ভারতবর্ষে। আমাদের দেশ তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। ব্রিটিশরা ভেবেছিল, চীন থেকে চারা এনে চা বাগান করা হবে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের আবহাওয়ার এবং চীনের আবহাওয়ার পার্থক্য। চারা নিয়ে এলেও সেগুলিকে প্রতিকূল আবহাওয়ায় বাঁচানো যায়নি। অনেক গবেষণার পর এক শংকর প্রজাতির চা তৈরি করা হয় যা ১৮৫১ সালে আসামে ‘আসাম ব্র্যান্ড টি’ নামে ব্রিটিশ শাসকদের রাজকীয় অনুমোদন পায়। সিলেটে ১৮৫৬ সালে দেশীয় চা গাছ উদ্ভাবনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে চা বাগান।
তাহলে জেনে গেলেন আমাদের সকলের প্রিয় চা কীভাবে প্রবেশ করেছিলো আমাদের দেশে। এবার জানা যাক বিশ্বের কিছু অভিনব চায়ের সম্পর্কে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সারা পৃথিবীতে প্রায় দেড় হাজার রকমের চা রয়েছে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের রামধনু চা, অর্থাৎ এক কাপেই পেয়ে যাবেন সাত রঙের চা।
অন্যতম অভিনব চায়ের মধ্যে রয়েছে বেগুনি রঙের চা। দেখলে মনে হবে একেবারে অর্কিড ফুলের গাঢ় বেগুনি রঙে ভরে গেছে চায়ের লিকার। এমন রঙে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়! আর এটি তেমনই মূল্যবান। এমন চা পেতে গেলে খরচ পড়বে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। বেগুনি রঙের এই চায়ের উৎপত্তিস্থল কানাডা। সেখানে একে পার্পল টি নামেই অভিহিত করা হয়। জানা গেছে, ১ কেজি পার্পল টি তৈরিতে ১ হাজারটি চা পাতার প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু তাহলে কি এই অবাক চা পান করতে সেই সুদূর কানাডায় পারি দিতে হবে! একেবারেই নয়। সুখবরটি হলো, ২০১৫ সালে ভারতের ‘টি রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ গবেষণায় দেখা গেছে আসাম এই মূল্যবান চা উৎপাদনের উপযুক্ত স্থান। আর সেই কারণে আমাদের দেশেও পার্পল টি উৎপন্ন করা হচ্ছে।
শুধু কী বেগুনি রঙের চা! আরেকটি আশ্চর্যজনক চা হলো নীল চা। প্রস্তুত করা হয় নীল অপরাজিতা ফুল, ক্লিটোরিয়া টারনেটি থেকে। কষা স্বাদ ও নীল রঙের জন্য অনেকেই এই চা পছন্দ করেন না। কিন্তু এই চায়ের উপকারিতা প্রচুর। অন্যান্য চায়ের তুলনায় অপরাজিতা চায়ের ভেষজ গুণ অনেক বেশি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, ঠান্ডাজনিত সমস্যা দূর করা, মানসিক চাপ হ্রাস, ক্লান্তি দূরীকরণ, হজমে সাহায্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই চা দারুণ কার্যকর।
এছাড়াও রয়েছে আরো কয়েক প্রকার অভিনব চা :
১) গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি হয় গোলাপ চা। গোলাপ ফুলের পাপড়ি জলের মধ্যে ফুটিয়ে তার সঙ্গে সামান্য পরিমাণে সাধারণ চায়ের লিকার যোগ করে এটি বানানো হয়ে থাকে।
২) সজনে পাতা দিয়ে প্রস্তুত হয় সজনে চা। রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ও ওজন নিয়ন্ত্রণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩) হলুদ চায়ে রয়েছে টারমারিক অর্থাৎ হলুদ। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য এতে যোগ করা হয় আদা বাটা, লেবুর রস, মধু ও গোলমরিচ।
৪) সাদা চা প্রস্তুত করা হয় ক্যামেলিয়া সাইনেসিস গাছের অনুদ্ঘটিত কুঁড়ির উপরের রুপোলি-সাদা আঁশ থেকে।
৫) ক্যামেলিয়া সাইনেসিস গাছের পাতা থেকেই অন্য পদ্ধতি অনুসরণ করে বানানো হয় ওলোং টি। এটির উৎপত্তিস্থল চীন। ওলোং শব্দের অর্থ কালো ড্রাগন।
৬) বলুমিং টি হলো আরেকপ্রকার চা, একে ফুটন্ত ফুলের চাও বলা হয়ে থাকে। এই চা এমনভাবে বানানো হয় যাতে তৈরির সময় এর মধ্যে রাখা ফুটন্ত ফুলের কুঁড়ি ফুটে যায়।
৭) মাখন চায়ের কথা তো না বললেই নয়। মাখন চা অর্থাৎ বাটার টি, তিব্বতি ভাষায় পো চা। জনশ্রুতি অনুসারে, একজন চীনা রাজকন্যা তিব্বতের একজন রাজার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন যা পরে চীন এবং তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্যপথ স্থাপনে সহায়তা করেছিল। এই বাণিজ্যিক পথগুলি চীন থেকে তিব্বতে চা নিয়ে আসে। এর সঙ্গে তিব্বতিরা নিজেদের পদ্ধতি অনুসরণ করে যোগ করে মাখন। পূর্বে চমরীগাইয়ের দুধ থেকে প্রস্তুত মাখন এতে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে গরুর দুধের মাখন দিয়েও বানানো হয়ে থাকে।
৮) হিবিসকাস টি তৈরি করা হয় হিবিসকাস পেটালস অর্থাৎ জবা ফুলের পাপড়ি দিয়ে। একইভাবে শিউলি পাতার চা, পাট পাতার চা, অর্জুন চা (অর্জুন গাছের বাকল দিয়ে প্রস্তুত), ক্যামোমিল চা (ক্যামোমিল ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে প্রস্তুত) পাওয়া যায়।
লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সাদা, বেগুনি, এমনকি সাতরঙা চায়ের কথা উল্লেখ করা হলো। এবার বলা যাক গোলাপী চায়ের সম্পর্কে কিছু কথা। গোলাপী চা অর্থাৎ কাশ্মীরি চা। সঙ্গে থাকলো এরই দুর্দান্ত রেসিপি।
তাহলে জেনে গেলেন আমাদের সকলের প্রিয় চা কীভাবে প্রবেশ করেছিলো আমাদের দেশে। এবার জেনে নিন চায়ের একখানি দুর্দান্ত রেসিপি — কাশ্মীরি চা।
কাশ্মীরি চা বা গোলাপী চা :
চায়ের মধ্যে কাশ্মীরি চা বেশ খানিকটা ব্যতিক্রমী। বানানোর পদ্ধতিও তাই পৃথক এবং তুলনামূলকভাবে সময়সাপেক্ষ। রন্ধনপ্রণালী বলার আগে এই চায়ের বিষয়ে কিছু তথ্য বলা যাক।
কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী চা বিভিন্ন নামে পরিচিত— নুন চা/ গোলাপি চা/ শির চা বা মুঘল চা। কথিত আছে তুর্কিস্তানের ইয়ারকন্দ থেকে কাশ্মীরে এই চায়ের প্রচলন হয়। কাশ্মীরের প্রথম সুলতান সাদরুদ্দিন শাহ তুর্কিস্তানের বুলবুল শাহের থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তাই ধারণা করা হয় তিনিই এই চায়ের প্রবর্তক। এটি "কাহওয়া" নামে সর্বাধিক পরিচিত। বানানোর পর প্রায় একমাস অবধি এটি সংরক্ষন করে পান করা যায়।এই চায়ের বিশেষত্ব হল এটি গোলাপি রঙের হয়, নোনতা হয়, প্রচুর বাদাম পেস্তা প্রভৃতি শুকনো ফল মেশানো থাকে।
কাশ্মীরি কাহওয়া গ্রীন টি পাতা :
মূলত গ্রীন টি-এর (ক্যামেলিয়া সিনেসিস গোত্রের) পাতাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে ব্যবহার করা হয়। কাশ্মীরিরা সাধারণত এটি অবসর সময়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পান করে থাকেন। একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তারা এই চা প্রস্তুত করে।এতে ব্যবহৃত চা শুধুমাত্র কাশ্মীরেই পাওয়া যায়। চা পাতা, দুধ, লবণ, পেস্তা, বাদাম, এলাচ এবং দারচিনি এক সাথে মিশিয়ে 'সামোভার' নামক একটি বিশেষ পাত্রে চা-টি রান্না করা হয়।
এই সামোভারের মধ্যেই আছে আসল জাদু যা চায়ের স্বাদকে অসাধারণ করে দেয়। চা তৈরির পাত্র সামোভার একমাত্র কাশ্মীরেই পাওয়া যায়। গোলাপি রঙের আভা ফুটিয়ে তোলার জন্য এতে একটু খানি বেকিং সোডাও মেশানো হয়। তারপর এর মধ্যে জল মিশিয়ে কাঠ কয়লার আগুনে জ্বাল দেয়া। গোলাপী চা যত গরম হয় খেতে তত স্বাদ হয়। অন্যান্য চায়ের সাথে এর মূল পার্থক্য হল এটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর।
উপকরণঃ
- জল — ১ লিটার,
- নুন — ১ চামচ
- গ্রিন টি — ২ টেবিল চামচ,
- এলাচ — ৩ টি,
- দারচিনি — ২ টি
- লবঙ্গ — ৪ টি
- স্টার অ্যানিস — ১ টি,
- বেকিং সোডা — ১ টেবিল চামচ,
- বরফ — কয়েক টুকরা,
- দুধ — ১ কাপ,
- চিনি — ১ টেবিল চামচ (ইচ্ছুক),
- মালাই — ১ টেবিল চামচ,
- পেস্তা বাদাম কুচি — ১ টেবিল চামচ।
- শুকনো লাল গোলাপের পাপড়ি — ২ চামচ
প্রণালীঃ
- পাত্রে জল ফোটাতে হবে। এবার এতে গ্রিন টি, নুন, এলাচ,লবঙ্গ, দারচিনি, স্টার অ্যানিস, গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ভালো করে ফোটাতে হবে।
- ১০ থেকে ১২ মিনিট ফুটিয়ে বেকিং সোডা দিয়ে নাড়তে হবে। যাতে এর মধ্যে ফেনার সৃষ্টি হয়।জল ফুটে ১/৪ ভাগ হয়ে যায়।
- ফেনা তৈরি হলে কিছু বরফ দিয়ে আবার কিছুক্ষণ জ্বাল দিতে হবে। ফুটিয়ে জল অর্ধেক করে ফেলতে হবে।
- আবার এর মধ্যে বেশ কিছু বরফ কুচি মিশিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নিতে হবে।
- চায়ের রং গাঢ় লাল-বাদামী হলে ছেঁকে নামাতে হবে।এই কাহওয়া চা ২ কাপ দিয়ে ৬-৮ কাপ গোলাপি চা প্রস্তুত করতে পারা যাবে।
- দুধে মালাই মিশিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নিতে হবে।
- কাপে দুধ চিনি মিশিয়ে (যদিও এই চায়ে চিনি ব্যবহার করা হয় না) চায়ের লিকার ঢেলে দিয়ে মেশালেই চায়ের রং গোলাপী হয়ে যাবে।
- এবার পেস্তাবাদাম দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে কাশ্মিরী গোলাপী চা।
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
চিত্র সৌজন্যঃ অন্তরজাল, গুগল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন