নিজের বাড়ির অন্দরমহল সাজিয়ে রাখতে আমরা প্রত্যেকেই চাই। নিজেদের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন আসবাব ও শৌখিন জিনিস দিয়ে সাজিয়ে ঘরের শোভা বাড়ানোর চেষ্টা সবাই করে থাকেন।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের রুচি, চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে চলেছে। পারস্যের সুন্দর কার্পেট, ফ্রেমবন্দী বা শিল্পীর আঁকা কোনো ছবি,ছোট – বড় বিভিন্ন ঘর সাজানোর জিনিস দিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করাই যায়। কিন্তু এই সবের মধ্যে যদি থাকে এক টুকরো সবুজের ছোঁয়া, তাহলে বাড়ির সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এসব কিছুই বাড়িতে এক নান্দনিকতার ছোঁয়া দেয়।
ঘরে লাগানো আভ্যন্তরীণ গাছের ( indoor plant) ব্যবহার যে ঘরে সতেজতা বয়ে নিয়ে আসে। আভ্যন্তরীণ গাছের সবুজ সতেজতা
ইট কাঠ সিমেন্টের ঘরে এনে দেয় নির্মলতার
ছোঁয়া; যা বাড়ির বাসিন্দাদের মনকেও সাহায্য করে প্রশান্তির পরশ পেতে। এসব ছাড়াও
কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে, যার কারণে ঘরে গাছ লাগানো জরুরী হয়ে পড়ে। যেমন-
গাছ ঘরের বাড়তি খালি জায়গাটুকুকে ভরাট করে নতুনত্ব নিয়ে আসতে পারে। যদি ঘরের কোণায়
খালি জায়গা থাকে, তবে সেখানে একটি গাছ রাখলে এবং এর সঙ্গী রূপে একটি বেহালা কিংবা তানপুরার মতো কোনো বাদ্যযন্ত্র সাজাতে পারলে, তা ঘরে
এক পৃথক রুচির পরিচয় দেয়। আর
এর মধ্যে দিয়েই সেই খালি জায়গাটিও পেয়ে যায় নতুনত্বের ছোঁয়া।
গুরুত্বপূর্ণ বিয়য় হচ্ছে, ঘরে রাখা
চারাগাছ ঘরের বায়ু সংশোধনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নাসার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘরের চারাগাছ
বায়ুর ৮৭ শতাংশ দূষণ রোধ করতে সক্ষম। গৃহবাসীদের জন্য উপযোগী এবং নির্মল বায়ুর যোগান
দিতে পারে ঘরে রাখা এই চারাগাছগুলো। শহুরে বহুতলের ব্যস্ত জীবনে, এই সব চারাগাছ সবুজের সঙ্গে আমাদের
একমাত্র যোগাযোগ হয়ে দাঁড়ায়৷এছাড়া শীতের মরশুমে উজ্জ্বল রঙের চারাগাছ শুধু ঘরের শোভাই বাড়ায় না, ঘরের অতিরিক্ত আর্দ্রতা শুষে নিয়ে ঘরকে রাখে উষ্ণ৷
ঘরের বিভিন্ন জায়গায় গাছ রাখা
যায়। এমনকি রান্নাঘর ও স্নানঘরেও গাছ রেখে পরিবেশকে সুন্দর ও নির্মল রাখা যায়।
ঘরের রাখার উপযুক্ত গাছসমূহঃ
অ্যাসপ্যারাগাস ফার্ন- বসবার
ঘরের জানালার ধারে এক কোণে বা ব্যালকনিতে,সাধারণ
টব বা ঝোলানো টবে সাজিয়ে রাখা যায় এই বিশেষ ফার্ন গাছ৷ দিনের আলো যাতে পায় তার খেয়াল রাখতে
হবে৷ পিটমস মাটি এই গাছের জন্য উপযুক্ত কারণ এই মাটি জল ধরে রাখতে সাহায্য করে৷ খেয়াল
রাখতে হবে এই গাছের মাটি যাতে কোন ভাবেই শুকিয়ে না যায়৷ স্নানঘরেও এই গাছ রাখা যায়৷
অ্যালোভেরা - অ্যালোভেরা গাছের চারা প্রায় সব জায়গাতেই সহজে পাওয়া যায়। অ্যাালোভেরার ঔষধি গুণ সর্বজনবিদিত।অন্দরমহলের সজ্জায় খুব সহজেই এই গাছ ব্যবহার করা যায়। পর্যাপ্ত আলো এবং বাতাস আছে এমন জায়গায় চারাগাছটি রেখে দিলে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া অনায়াসেই বেড়ে উঠতে পারে এই গাছ।
মানি প্ল্যান্ট - ঘরের সৌন্দর্যচর্চায় সবুজ লতানো গাছ হিসাবে সহজলভ্য মানিপ্ল্যান্টের ব্যবহার সর্বাধিক হয়। এই গাছের পরিচর্যায় বিশেষ পারদর্শী হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা পর্যাপ্ত আর্দ্রতা, সূর্যের অতিরিক্ত তাপ থেকে দূরে রাখা এবং সপ্তাহে ৩/৪ দিন অল্প জল দিলেই সহজে বেড়ে উঠতে পারে এই গাছ।শুধু টবে মাটিতেই নয়, বোতলে বা কাচের গ্লাসে সুদৃশ্য গ্লাসে শুধুমাত্র জলের মধ্যে এই গাছ বৃদ্ধি পায় অতি সহজেই।
পিস লিলি – ঘরে প্রতিপালন করা যায়, এমন চারাগাছ হিসেবে পিস লিলি একটি আদর্শ গাছ। পিস লিলি ঘরের তাপমাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে বেড়ে উঠতে পারে। এই গাছ ঘরে এনে দিতে পারে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। এছাড়া গাছটির বেশ উপকারিতাও আছে। অ্যাসিটোন এবং বেনজিনের মতো পদার্থ দূর করে ঘরের বায়ুকে নির্মল রাখতে সাহায্য করে এই গাছটি।অল্প পরিচর্চাতেই এই গাছে সুন্দর ফুল ফুটে ঘর স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়।
স্নেক প্ল্যান্ট - কর্মব্যস্তময় জীবনে যদি গাছের যত্ন নেওয়ার মতো বাড়তি সময় না থকে, তবে সেক্ষেত্রে স্নেক প্ল্যান্ট একটি অত্যন্ত উপযোগী গাছ। এ গাছটির পরিচর্যার জন্য বাড়তি যত্নের দরকার পড়ে না। সপ্তাহে দু’বার জল এবং হালকা আলোর ব্যবস্থা থাকলেই বেড়ে উঠতে পারে এই গাছ। যেকোনো ধরনের গৃহসজ্জাতেই স্নেক প্ল্যান্ট মানিয়ে নেয় এবং ঘরকে দেয় এক নান্দনিক সৌন্দর্য।ছোট বড় বিভিন্ন আকারের ও আকৃতির পাত্রে এই গাছ লাগানো যায়।
ব্যাম্বু পাম – অন্দরসজ্জায় ব্যবহৃত গাছ হিসেবে ব্যাম্বু পাম গাছের ব্যবহার বহুল্মাত্রায় দেখা যায়। এই গাছের বেড়ে ওঠার জন্য দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ জল এবং ছায়া। সাধারণত স্বল্প তাপমাত্রায় এই গাছটি সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে। ঘরের কোণা, ব্যালকনি বা জানলার ধার, এই গাছের জন্য বিশেষ উপযোগী। এই গাছের জন্য অবশ্য বড় আকৃতির টব একান্ত প্রয়োজন।
স্পাইডার প্ল্যান্ট - স্পাইডার প্ল্যান্টের চ্যাপ্টা ও বেশ খানিকটা লম্বা পাতা এবং সবুজরঙা পাতার মাঝে সাদা রঙের মিশেল অন্দরসজ্জায় এক অন্য মাত্রা যোগ করে। সহজেই গাছটি বেড়ে উঠতে সক্ষম, তাই ঘরের জন্য এই স্পাইডার প্ল্যান্ট বেশ উপযোগী। ঘরকে ছিমছামভাবে সাজাতে কিংবা আভিজাত্যের ছোঁয়া দিতে এই গাছের জুড়ি নেই।ছোট / বড় যে কোনো আকার- আকৃতির পাত্র, ঝোলানো বা এমনি টবে এই গাছ লাগানো যায়। কিছুদিন পর পর গাছের নীচের দিকের পুরনো ও হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা কেটে পরিষ্কার করে দিতে হয়।
ফার্ন গাছ – বিভিন্ন ধরণের ফার্ন গাছও অন্দরসজ্জায় ব্যবহৃত হয়। তীব্র সূর্যালোক থেকে দূরে ঘরের ঠাণ্ডা ও অন্ধকারময় জায়গায় এই গাছ রাখার উপযুক্ত স্থান। প্রতিদিন জল দিলেও অতিরিক্ত জল এই গাছের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে যায়। গাছের পাতা শুকিয়ে গেলে তা অবশ্যই কেটে পরিষ্কার করতে হবে। নাহলে অন্য পাতাও নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দুই-তিন বছর পরপর গাছের মাটি বদল করা প্রয়োজন।
জারবেরা গাছ – এই গাছের বীজ থেকে এই গাছ ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। সঠিক পরিচর্চা করা হলে বেশ কয়েক বছর এই গাছ বেঁচে থাকে। এই গাছের জন্য দরকার পর্যাপ্ত পরিমানে সূর্যালোক। তাই ঘরের যে স্থানে পর্যাপ্ত রোদ আসে সেই জায়গায় এই গাছ রাখা জরুরী। গাছে নিয়মিত জল দেওয়া একান্তই দরকার। গাছের গোড়া যাতে কোনোমতেই শুকিয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।এই গাছে লাল, গোলাপি, হলুদ, কমলা প্রভৃতি বিভিন্ন রঙের ফুল ফোটায় ঘরের শোভা বহুগুন বৃদ্ধি পায়। এই গাছ দিনের বেলা ব্যতিরেকে রাত্রীবেলাতেও অক্সিজেন ত্যাগ করে থাকে। তাই শয়নকক্ষেও এই গাছ রাখা যেতে পারে।
স্ট্রিং অফ পার্লস - ঝুলন্ত গাছের তালিকায় এক নম্বরে থাকবে এই গাছ। ছোট ছোট মুক্তোর মতো দেখতে পাতার জন্য এই গাছের নাম স্ট্রিং অফ পার্লস।সপ্তাহে দু-তিন দিন বিরতিতে জল দিলেই দিব্যি বাড়বে এই গাছ। যে কোনও জানলার কাছে ঝোলানো টবে এই গাছ লাগাতে হবে।নিয়মিত জল স্প্রে করে দিলে গাছের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়ে আরও সুন্দর দেখতে লাগে। এই গাছে সহজেই পিঁপড়ে জাতীয় পোকার আক্রমন হয়, তাই নজর রাখা দরকার। প্রয়োজনে ওষুধ দিতে হবে।
ফিডল লিফ ফিগ ট্রি – শালপাতার মত বড় আকৃতির পাতা বিশিষ্ট এই গাছ জানলার ধারে বা ব্যালকনিতে রাখার উপযুক্ত। বসার ঘরে সোফার পাশে রাখা এই গাছ ঘরে এক অন্য মাত্রার আভিজাত্য যোগ করে। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন এই গাছ কড়া সূর্যালোকে রেখে ঘরে নিয়ে আসা যায়। নিয়মিত জল ও আলো পেলেই অত্যন্ত সহজে এই গাছ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সুইট হার্ট প্ল্যান্ট – এই গাছের আকৃতির জন্য এই গাছের এই নামকরণ সুইট হার্ট প্ল্যান্ট রাখা হয়েছে। পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও নিয়মিত জল পেলেই এই গাছ সুন্দরভাবে বৃদ্ধি পায়। ছোট-বড় যে কোনো আকার-আকৃতির টবে জানলার ওপর এই গাছ পালন করা যায়।
এয়ার প্ল্যান্ট - অনায়াসে মাটি ছাড়াই হাওয়ায় বেড়ে ওঠে এই বাহারি গাছগুলি। প্রতিদিন শুধুমাত্র জল স্প্রে করতে হবে গাছের পাতায়। বসার ঘরে ঝোলানোর জন্য এই গাছগুলি আদর্শ।গাছে সুন্দর রঙিন ফুল ফুটে ঘরের শোভা বাড়িয়ে তোলে।
পুদিনা গাছ - অতিপরিচিত পুদিনা গাছও অন্দরসজ্জার অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। গ্লাসে জলে বা ছোট টবে অল্প মাটিতে এই গাছ পালন করা যায়। নিয়মিত পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও জল পেলেই সুন্দরভাবে এই গাছ বেড়ে ওঠে। এই গাছ শুধুমাত্র ঘরের শোভাই বৃদ্ধি করেনা,এর তীব্র মিষ্টি গন্ধ ঘরের বাতাসও তরতাজা রাখতে সাহায্য করে।
পাথরকুচি – পাথরকুচি বা জেড প্ল্যান্ট বিভিন্ন আকার আকৃতির ও প্রজাতির হয়ে থাকে।
কিছু পাথরকুচি গাছে সুন্দর ফুলও ফোটে। এই গাছের জন্য অল্প সূর্যালোক ও সপ্তাহে ২/৩
দিন জলই যথেষ্ট।তাই ঘরের যে কোনও কোণে বা ছোট টেবিলে এই গাছ রাখা যায়। বিশেষ পরিচর্চা
ছাড়াই এই গাছ বহুবছর বেঁচে থাকে। রান্নাঘর বা স্নানঘরেও এই গাছ রাখা যায়।
প্রেয়ার প্ল্যান্ট – সন্ধ্যার অন্ধকারে গাছের পাতা নত হয়ে প্রার্থনার ভঙ্গী বিশিষ্ট হয়ে যাওয়ায় এই গাছের এই নামকরণ করা হয়েছে। সুন্দর কারুকার্য করা পাতা বিশিষ্ট এই গাছ বিভিন্ন প্রজাতির হয়। খুব সহজেই প্রাপ্ত এই গাছের দরকার সামান্য আলো ও নিয়মিত জল। গাছের গোড়া শুকনো রাখা যায় না। এই গাছের পাতা প্রজাতি বিশেষে বিভিন্ন রঙের হয়। কিছু প্রজাতির গাছে ফুল ফুটে গৃহশোভা বহুগুণে বৃদ্ধি করে।
ZZ প্ল্যান্ট – গাঢ় সবুজ বর্ণের বড় আকারের পাতা বিশিষ্ট এই গাছের কাণ্ড সোজা ও নমনীয় হয়। বেশী তাপ সহ্য করতে না পারা এই গাছ ঘরের অন্ধকার জায়গায় রাখতে হয়। সপ্তাহে একদিন জল দিলেই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে বায়ু চলাচলের জন্য গাছে গোড়ার মাটি খুঁড়ে আলগা করে দিলে গাছ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে।
ইংলিশ আইভি – গৃহসজ্জায় গাছের কথা বলতে গেলে ইংলিশ আইভির কথা না বললে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। অসম্ভব সুন্দর সাদা ও সবুজের মিশ্রণে তৈরি ও সুন্দর আকৃতির পাতা বিশিষ্ট এই গাছ সাধারণত ঝোলানো পাত্রে রাখা হয়। লতানো এই গাছ পাত্রকে ঘিরে ধরে নিচের দিকে ঝুলে পড়ে ঘরের শোভা বাড়িয়ে তোলে।অল্প জল ও মাঝারি তাপমাত্রার আলোতে এই গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সূর্যালোকের অভাবে ঘরের উজ্জ্বল ফ্লুরোসেন্ট আলো থেকেও এই গাছ প্রয়োজনীয় তাপ সংগ্রহ করে নেয়। বড় গাছের গোড়াতেও এই গাছ লাগানো যায়।
বাহারি টব, বাতিল করা বিভিন্ন
পাত্রের মধ্যে অল্প মাটি দিয়ে এই সমস্ত গাছ অনায়াসেই ঘরে লাগিয়ে ঘরের শোভা বৃদ্ধি করা
যায়। সবুজের ছোঁয়ায় ঘর সতেজ,সুন্দর ও মনোরম হয়ে ওঠে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন