হ্যারিকেনের আলোর কাছে উইপোকাগুলো কেমন যেন উড়ে আসে আর পুড়ে মরে, ভ্রমর অনেকক্ষণ ধরে তাই লক্ষ্য করছিল।
আজ দু'দিন হল পাড়ায় লোডশেডিং। কী একটা বড়ো ধরণের কাজের জন্য কারেন্টটা অফ রয়েছে। পাড়ার সকলে বলছে, কালই হয়তো এই দুর্ভোগ শেষ হবে। কিন্তু হ্যারিকেনের এই আলোতে উইপোকা মরার দৃশ্যের থেকেও আরও বেশি আকর্ষণীয় ব্যাপার আরেকটা, সেটা হল ভ্রমরের রূপ। যৌবনের প্রথম ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে চারপাশের পরিবেশ থেকে ভ্রমর সহজেই সেটা উপলব্ধি করেছিল।
হ্যারিকেনের আলোটা যেন পোকাগুলোর চেয়েও বেশি কাছে পেতে চায় ভ্রমরকে। সারা শরীরের অনাবৃত অংশগুলোকে যেন চুম্বনের লালিমায় আর স্পর্শের মোহময়তায় জড়িয়ে ধরতে চায়। ভ্রমর পোকাগুলোকে দেখে আর মনে মনে হাসে।
ভ্রমরের ছোট্টো ঘরের আসবাবগুলো সবই যেন ভ্রমরের রূপের সাথে বেমানান। শ্রীর অভাবে সবই যেন মুখ ঢাকে আর বলে, “না না ভ্রমর, এদিকে এসো না, আমরা অস্পৃশ্য।” ভ্রমর হ্যারিকেনটা নিয়ে খাটের উপর এসে বসলো আর তৎক্ষণাৎ ক্যাঁচ করে আপত্তি শোনা গেল। ভ্রমরের পশ্চাদ্দেশের স্পর্শ পেয়ে নরম তোষক আর গদিটাও যেন বলে ওঠে, “আহা যেন ব্যাথা না লাগে এই নরম শরীরে।” আসবাবগুলোও যেন সবাই আপত্তি করে বলে, “আহা মরি মরি, তুমি শুভ্র, পবিত্র; আমরা কুৎসিত, অশুচি। পায়ে পড়ি।”
তারপর হঠাৎ নিজের অজান্তেই হ্যারিকেনের কাঁচে হাতটা লেগে যায় ভ্রমরের, একটা জলভরা ফোসকা উঠে আসে শরীরের সেই স্থানে। ভ্রমরের কিছুক্ষণ জ্বালা করে, কিন্তু হ্যারিকেনের কাঁচটা বুঝি ভয় পায় ভ্রমরের হাতে গরম তাপ দিয়ে ফোসকা ফেলার জন্য। আর হ্যারিকেনের সলতেটা তাকে সান্তনা দিয়ে বলে, “আহা ভেবো না বন্ধু, ও সেরে যাবে, তাছাড়া চাঁদের গায়েও তো কলঙ্ক থাকে।” কিন্তু ভ্রমরের মনে কিসের যেন একটা চাপা কষ্ট।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ভ্রমর। আজ দু'বছর হয়ে গেল তার জাতের একটা ছেলের সাথেই তার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু ভ্রমরের এমন জীবনে তার রূপ যেন ব্যর্থ। সে জানে স্বামীর মনে সে কামনার আগুন জ্বালিয়েছে, কিন্তু তাতেও বা কী, এই দু'বছরে তাকে কতটাই বা পাশে পেয়েছে আর আলিঙ্গনে থেকেছে! তাই সব কিছুই ব্যর্থ। এই রূপও, এই রঙও। সব কিছুই তাই মিথ্যা। সে মনে মনে বলে, “কালোমুখি, পেত্নি হলেও নাহয় মনকে বোঝাতাম যে স্বামীর আমায় মনে ধরেনি তাই এমন দুর্গতি। কিন্তু হায় ভগবান! এ কী তুমি আমার কপালে লিখলে! এমন কাঁচা সোনার মত রঙ আর একটা নিখুঁত নিটোল শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবই কী তাহলে বিফল?”
এতসব ভাবতে ভাবতে ভ্রমর রাতের খাওয়ার জন্য ভাত রাঁধতে রান্নাঘরের গ্যাসটা জ্বেলে দেখলো সিলিন্ডারে গ্যাস নেই, শেষ হয়ে গেছে। তাই নোংরা পুরনো ষ্টোভটাই বার করে নিল। তারপর সেটা মুছে পরিস্কার করে নিয়ে চাল ধুয়ে ভাতটা বসানোর জন্য ষ্টোভটাতে পাম্প দিতে থাকলো। তারপর পাম্প হয়ে গেলে পরে একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে আগুন জ্বেলে ষ্টোভটার দিকে দিতেই হঠাৎ এক ভীষণ শব্দ হয়ে উঠলো ও ঘরটা যেন দিবালোকের আলোর মত ফর্সা হয়ে গেল।
প্রায় বছর দেড়েক হয়ে গেছে ভ্রমর এখন শহরের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। মধ্যবিত্ত বাড়ির চেহারাটা অনেকটাই বদলেছে। নতুন বাড়িতে অনেক দামী দামী আসবাব এসেছে কিন্তু আজও সব ভ্রমরের রূপের সাথে বেমানান।
ভ্রমরের ফ্ল্যাটবাড়ির
দিকটায় বিশেষ কেউ আসে না, হয়তো তার অসামান্য রূপের
জন্য। এখানে তাই একটু নিরিবিলি বোধ হয়। সে চুপ করে একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন পড়ছিল
হঠাৎ বাইরের দরজার ডোরবেলটার আওয়াজ। ভ্রমর এগিয়ে গিয়ে দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
দরজার ওপার থেকে জবাব আসে, “আমি মিসেস চ্যাটার্জী। মিসেস মৈত্র আপনার সাথে একটা জরুরি কথা ছিল। একটু দরজাটা খুললে ভাল হয়।”
ভ্রমর দরজাটা খুলে বিনয়ের সুরে হেসে বললো, “ও আপনি, আসুন আসুন। গত দু'দিন যে এদিকে আসেননি, কী ব্যাপার বলুন তো?”
মিসেস চ্যাটার্জী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তারপর দু'জনে সোফায় এসে বসলেন। চিন্তিত স্বরে তিনি বললেন, “সেটাই তো বলতে এলাম ভাই।”
“কী?”
“গতকাল আমার ভাই এসেছিল। ওই যে গতমাসে যে একবার এসেছিল, সে।”
“ও সৌগতদা।”
“হ্যাঁ, ওর তো কিছুদিন আগে অফিসের কাজে গোয়া যেতে হয়েছিল আর সেখানে গিয়ে সৌগত হঠাৎ দেখতে পেলো মিঃ মৈত্রকে আর সাথে একজন স্ত্রীলোকও ছিল। তারা দু'জনে একটা হানিমুন রিসর্টে উঠেছিল। সৌগত জানালো উনি বোধ হয় মিঃ মৈত্রের দ্বিতীয় স্ত্রী।”
কথাটা শোনামাত্র ভ্রমরের চোখের আলোটা দপ করে নিভে গেল। সে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বললো, “তাতে কী হয়েছে?”
“তাতে আবার কী হবে মিসেস মৈত্র! আপনি কি কিছুই বুঝতে পারছেন না যে আপনি কত বড়ো বিপদে পড়েছেন!”
ভ্রমর একটা শান্ত হাসি হেসে বললো, “কীসের বিপদ মিসেস চ্যাটার্জী? কালো ভ্রমরের থেকে তো রঙিন প্রজাপতিই বেশ ভালো।”
ঘটনার দিন দশেক পরে ভ্রমরের স্বামী দীপক মৈত্র তার দ্বিতীয় স্ত্রী নীরা মৈত্রকে নিয়ে কলকাতায় এলেন। দিন সাতেক থাকার পর একদিন দীপক ভ্রমরকে বললো, “ভ্রমর বলছিলাম কী, আমরা কালই মুম্বই ব্যাক করব।”
“ও তাই!”
দীপক একটু ইতস্তত করে বললো, “আসলে নীরার ছুটিটা শেষ হয়ে এসেছে। তাই কালকের ফ্লাইটেই ব্যাক করতে হবে।”
ভ্রমর এক অদ্ভুত শান্তির হাসি এসে বললো, “বেশ তো।”
এই সাড়ে তিন বছরের বিবাহিত জীবনে ভ্রমর অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে, তাই ভ্রমর আজ শান্ত। একটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, একটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের বউ কী আর চেয়েছিল। দীপক একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে একটা সাধারণ চাকরি করতো, তাতে আসল কাজের চেয়ে ওভারটাইমই ছিল বেশি। কিন্তু ভ্রমরকে সে কোনোদিনও চাকরী করতে দেয়নি, ভ্রমর বি.এস.সি. পাশ জেনেও। ভ্রমরের সারাদিনটা যে কীভাবে একটা শ্বশুড়, শ্বাশুড়ি, দেওর, ননদ-হীন একটা শূন্য পরিবারে কাটতো তা হয়ত দীপক কোনোদিন টেরও পায়নি অথবা টের পেয়েও কিছু করেনি। অথচ ভ্রমর স্বামীকে সারাজীবন ভালবেসেছে, তার পাশে থেকেছে প্রত্যেক পদে পদে। তাই ভ্রমর আজ শান্তির হাসি হাসলো।
কিন্তু প্রায় বছর দেড়েক আগে যেন সব ওলটপালট হয়ে গেল। একটা দুর্ঘটনা আর ঝলসানো তাপ, তারপর সব চিন্তার অবসান। এর মাস দুয়েক পরে ভ্রমর হাসপাতাল থেকে ফিরলো। এর মধ্যে দীপক একটা নতুন কোম্পানিতে একটা ভাল চাকরী জুটিয়েছে। তারপর আট মাসে দু-দুটো বড়ো প্রমোশন আর এরপরই বদলি, তারপরই এই নতুন ফ্ল্যাটে আসা। তারপর থেকে দীপক ক'দিনের ছুটি নিয়ে কখনও একমাসে, আবার কখনও দু-মাসে একবারের জন্য এসে ভ্রমরের সাথে দেখা করে যায়।
দীপক আর নীরা পরের দিন সকাল সকাল রেডি হয়ে নেয় এয়ারপোর্টে যাবে বলে। সেখানে ন’টায় ওদের ফ্লাইট। বেড়োনোর সময় দীপক ভ্রমরকে বললো, “ভালো ভাবে থেকো।”
ভ্রমর আবার সেই শান্তির হাসি হেসে বললো, “ঠিক আছে, আমি ভালো থাকবো, তোমরা ভালোমতো যেও আর পৌঁছে আমায় ফোন করে জানিও।”
ফ্ল্যাটের নীচেই তাদের
জন্য ট্যাক্সি তৈরী ছিল। ট্যাক্সিতে উঠে দরজাটা বন্ধ করতে যাওয়ার সময় দীপক দেখলো, তার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে ভ্রমর হাসি হাসি
মুখে তাদের দিকেই চেয়ে আছে। সেই চাউনিতে কী যেন একটা মিশে আছে। তাই দীপক শিউরে
উঠলো, হয়ত নিজের অজান্তেই। আর
ভাবল, এ যে সেই ভ্রমর নয় যাকে সে
প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে বিয়ে করে এনেছিলো; এ
যে সেই ভ্রমর নয় যাকে সে একসময় ভালবেসেছিলো। এ যে বীভৎস, ভয়ানক, কুৎসিত
এক স্ত্রীলোক যার হাসি যেন হাসি নয়, এক
ভয়ানক সাপের ফনা। সে ভ্রমর নয়,
সে
যে কুরূপিনী কালো ভ্রমর।
কলমে - প্রীতিকনা
বিশ্বাস
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন