দিন বদল - অহনা বসু

 

রোজের সকালের থেকে আজকের সকালটা বেশ খানিকটা আলাদা। রোজ মন্দারদের সকাল শুরু হয় শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে হাসিমুখ হালকা কথা বিনিময় দিয়ে।মন্দার, ওর স্ত্রী নীপা, মন্দারের বাবা আর মা এই চারজনের ছোট পরিবার।সকালটা সবার সাথে একটু সময় কাটিয়ে মন্দার কাজে বের হয়। আজ সেই নিয়মিত সময় কাটানো সকালে পরিচিত দৃশ্য বদল হয়েছে মন্দারের একমাত্র পিসির আগমনে। সকালেই তিনি মন্দারদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন।রোজকার শান্ত পরিবেশ তাঁর গলার আওয়াজে এবং কান্নার শব্দে সচকিত হয়ে উঠেছে।  

সামনের চেয়ারে বসে পিসি আঁচলে চোখের জল মুছছিলেন।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অনেক কিছু বলে যাচ্ছিলেন।মন্দার নিঃশব্দে পিসির দিকে তাকিয়ে ছিল। কথা কতটা শুনছিল তা মুখের ভাবের প্রকাশ পাচ্ছিল না। কিন্তু সে দেখছিল এককালের অর্থের গর্বে অহংকারী পিসিকে, যিনি এক সময় সব কিছুকেই অর্থের পাল্লায় তুলে মাপতেন। পিসি কান্না মেশানো ভাঙ্গা গলায় বলে যাচ্ছিলেন – “কোথা থেকে এত টাকা পাবো বল? জানিসই তো তোর পিসেমশাইয়ের অবস্থা। কিকরে মেয়েটার বিয়ে দেব ভেবে পাচ্ছিনা। আপন বলতে তো আমার তোরা ছাড়া আর কেউ নেই।তাই তোদের কাছেই এলাম সাহায্যের জন্য।“সাথে ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন পাত্রপক্ষের দাবী-দাওয়ার।

মন্দারের স্ত্রী মা, পিসির পাশে বসে সান্তনা দেওয়ার সুরে বলছিলেন – “ভেবোনা ঠাকুরঝি। সবাই মিলে একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা যাবে।“ বলতে বলতে মন্দারের দিকে তাকাচ্ছিল এই আশা করে যে মন্দার হয়ত কিছু আশার কথা শোনাবে।

মন্দার শুনছিল, দেখছিল কিন্তু হারিয়ে গেছিল বহু বছর আগের এক বিশেষ দিনে। মন্দারের  বাবার থেকে কয়েক বছরের বড় পিসির বিয়ে হয়েছিল ধনী কাপড় ব্যবসায়ী পরিবারে। সুন্দরী পিসিকে দেখে ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র আদরের দুলাল পিসেমশাইয়ের এত পচ্ছন্দ হয়ে গেছিল, যে ছেলের ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদ্য স্কুল উত্তীর্ণ মেয়েটিকে প্রায় একবস্ত্রেই বাড়ির বউরূপে বরণ করেছিলেন ব্যবসায়ী পরিবারটি।কোনোদিনও দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হওয়ার জন্য কোনো অসম্মান পেতে হয়নি পিসিকে। সবাই সমাদরে যোগ্য সম্মান দিয়ে তাঁকে বধূর আসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু পিসি নিজেকে ধনী পরিবারের বধূ প্রমাণ করার চেষ্টায় নিজের বাবা – মা – ভাই এদের যেন হেয় করতে শুরু করলেন। কাজে, কথায়, ব্যবহারে তা প্রকাশ পেতে থাকল। ছোট থেকেই মন্দার বুঝতে শিখে গেছিল তাদের অবস্থার সাথে পিসির অবস্থার পার্থক্য।

মন্দারের বাবা সাধারণ চাকুরীজীবী।নিজের স্ত্রী,সন্তান, বাবা, মা সকলের ভরণপোষণ করার পর বিলাসিতা করার মত আর্থিক সাচ্ছল্যের যোগান দিতে পারতেন না। পিসিদের অফুরন্ত বিলাসিতাময় জীবন কাটানো দেখে মন্দাররা তাই বেশ একটু গুটিয়েই থাকত। কিন্তু কোনোদিনও নিজেদের অবস্থা নিয়ে আফসোস করতে শেখেনি, বাবা-মাও কখনো তাকে নিজেদের অবস্থার সাথে তুলনা করতে শেখাননি। নিজেদের জীবনে তারা সবাই আনন্দেই ছিল। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে পিসির অকারণ স্বার্থপরতা ও কটুকথা তাদের জীবনে ঢেউ তুলে দিত।

আজ বড় মনে পড়ছে বিশেষ একদিনের কথা।সেদিন ছিল মন্দারের পিসির বড়মেয়ে তুলিকার পাঁচ বছরের জন্মদিন।বিশাল অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন পিসেমশাই।প্রচুর লোকের নিমন্ত্রণ। এলাহী খাওয়া দাওয়া। গান – বাজনার আসর।আরও কত কিছু। অর্ধেক কিছু তো মন্দার জীবনে প্রথমবার চোখে দেখেছিল।জন্মদিন যে এতো বড় অনুষ্ঠান করে পালন করা যায় তাও সেদিনই সে প্রথমবার জেনেছিল।

সন্ধ্যাবেলার অনুষ্ঠানে বাড়ির সবার সাথে মন্দার সেজেগুজে উপস্থিত হল। এত বড় অনুষ্ঠান দেখে আনন্দে চোখ মুখ জ্বলজ্বল করছে। সারাবাড়ি ফুল ও আলো দিয়ে সাজানো। বহু লোকের ভীড়ে বারো বছরের মন্দারও ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বাবা,মা,দাদু,ঠাকুমা বহুদিন পরে দেখা হওয়া আত্মীয়দের সাথে গল্পে মশগুল। মন্দারও নিজের বয়সী একগুচ্ছ বাচ্চার সাথে খেলায় মত্ত হয়ে উঠছিল। খেলতে খেলতেই তুলিকার ডাকে একঘরে ঢুকে পড়ল। সেখানে কেক কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারাঘর বেলুন, মোমবাতি, ফুল, প্রচুর খেলনা দিয়ে সাজানো। পিসি সবকিছু গোছাতে ব্যস্ত। তুলিকা ঘুরে ঘুরে মন্দারকে সব দেখাচ্ছিল। হঠাৎ পিসির তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজে চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল - " হ্যাঁ রে মন্দার, তোর কি এই একটাই জামা? আর জামা নেই? যেখানেই যাস, যখনই দেখি ওই একটাই জামা পরিস। এত লোকজন আসবে আজ, একটা ভালো জামাও কি তোকে পরাতে পারলোনা তোর মা? কবে যে তোদের এই ভিখিরীর দশা শেষ হবে কে জানে! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায় তোদের জন্য।"


আকস্মিক আঘাতে মন্দার যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হল। দপ করে যেন একসাথে সব আলো নিভে ঘন অন্ধকারে চারিদিকে ডুবে গেল।ঘরভর্তি লোকের মাঝে লজ্জায় অপমানে মন্দার মাটির দিক থেকে মাথা তুলতে পারছিল না। একবুক কষ্ট যেন মন্দারের নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিল।সঙ্গী সাথী অন্যান্য শিশুরাও এই তীক্ষ্ণ আঘাতে স্তব্ধ। কোনরকমে টলমল পায়ে চোখের জল লুকাতে লুকাতে মাকে খুঁজতে লাগল। ভীড়ের মধ্যেও যেন সম্পুর্ন একা নিঃসহায় এক শিশু। কোনো রকমে বাবাকে খুঁজে পেয়েই বাড়ি ফেরার জন্য বায়না শুরু করেছিল সে।আনন্দের পরিবেশে ব্যস্ত বাবা বাড়ি ফিরতে চাওয়া মন্দারের অসহায়তা সেদিন বুঝতে পারেনি।পরের কয়েক ঘন্টা জন্মদিনের উৎসবে মন্দারকে কেউ খুঁজে পায়নি।মন্দারের না খেতে চাওয়া, মুখ কালো করে এককোণে বসে থাকা লক্ষ্য করে রাতে একটু তাড়াতাড়িই তাই সবাই বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়। কেউ জানতে পারেনি সেদিনের কথা। বুঝতে পারেনি আপাত নিরীহ শান্ত শিশুটি কেন হঠাৎ জেদি হয়ে উঠেছিল। এরপরে আর কোনোদিন মন্দারকে কেউ পিসির বাড়ি যেতে দেখেনি।বহু নিমন্ত্রণ বা প্রয়োজন, কোনো কিছুই মন্দারের জেদ ভাঙ্গতে পারেনি।


সময় সবথেকে বড় শিক্ষা দেয় মানুষকে।সময় বদলায়।অবস্থাও বদলায়।নিজের ভালো সময়ে সুখের সময়ে মানুষ জীবনের অতি সাধারণ জ্ঞানের কথাটাই মনে রাখতে পারেনা। যে সুখের পরেই দুঃখ আসে, হাসির পরেই বেদনা।আজও দিন বদল হয়েছে। হয়েছে পালা বদলও। সেদিনের সেই শিশু মন্দার আজ উচ্চপদস্থ কর্মচারী।জীবনে কোনো অভাব নেই। বাবা,মা ও স্ত্রীকে নিয়ে সচ্ছল জীবন। দাদু ঠাকুমা স্বর্গগত।অন্যদিকে পিসিমশাইয়ের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর।কোনোরকমে দিন কাটে তাঁদের। আজ পিসিমা এসেছেন তাঁদের ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইতে।


হঠাৎ  নীপার ছোঁয়ায় মন্দারের হুঁশ ফেরে।নীপা আলতো হাতের ছোঁয়ায় পিসিকে কিছু বলতে বলে। মন্দার নীরবতা ভাঙ্গে। বলে ওঠে - "বিয়ের যত জামা কাপড় লাগবে জানিয়ে দিও।সব কাপড়ের খরচ আমি দিয়ে দেব।"উঠে নিজের কাজে চলে যায় মন্দার।থতমত খাওয়া পিসি কান্না থামিয়ে মন্দারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মন্দার জানে পিসি সেই সন্ধ্যার কথা মনে করতে পারবেন না।কিন্তু মন্দার যে ভোলেনি সেই অপমানের যন্ত্রণা একদিনের জন্যও।আজ যেন  যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল মন্দার।
 


কলমে - অ হ না  ব সু

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন