চিকিৎসকের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রসবপদ্ধতি – সিজারিয়ান না নরমাল

 প্রথমেই সবাইকে শুভ বিজয়ার প্রণাম, প্রীতি ও শুভেচ্ছা।


বিজয়া দশমীর সকালে বেশ করে লুচি-মিষ্টি খেয়ে-দেয়ে আমি লিখতে বসেছি। মা দুর্গা যথারীতি এসেছেন, দেখেছেন, জয় করেছেন এবং কৈলাসে ফিরে গেছেন, মা লক্ষ্মীও তার পর পাঁচ-ছয়দিন মামাবাড়িতে নাড়ু-মোয়া খেয়ে তারপর হেলেদুলে বৈকুণ্ঠে ফেরত যাবেন। এই লেখা যখন আপনার পড়বেন তখন আর দিন-দুই-তিনের মধ্যে পিলে চমকে দিয়ে আবির্ভূতা হবেন মা কালী, আর তারপর ঝটিকা সফরে এসেই বিদায় নেবেন মা জগদ্ধাত্রী। কারও কারও ক্ষেত্রে আবার মাঝে একদিন ছটি মাইয়াও এসে কিছু গান-বাজনা করে যাবেন।

তা, দেড় মাস ধরে দেবী-মায়েদের এই রমরমার মাঝে মানবী-মায়েদের জন্য কিছু লেখা কর্তব্য বলে আমি স্থির করলাম, আর আজকাল মা-মাতৃত্ব-সন্তানজন্ম নিয়ে একটিই সদা-গরম বিষয় - 'সিজার না নরমাল'!

এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে একজন ডাক্তার হিসেবে আমি কোন দলে - Caesarean Section না কি Normal Vaginal Delivery? এখন, আমি বিজ্ঞানের বিপক্ষে যাই কি করে? লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রকৃতি যে বিবর্তনের ফলে শিশুর স্বাভাবিক জন্মের ব্যবস্থা করেছেন, সেটা একেবারে পচা, এমন দাবী করার মত ধৃষ্টতা আমার নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক প্রসবের থেকে উত্তম আর কিছু হতে পারে না। তবে সেই সাথে এটাও সত্য যে কোন ক্ষেত্রে C-Section করা উত্তম, এবং কোন ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসব, তা স্থির করার যোগ্যতা এবং দায়িত্ব দুটোই কেবলমাত্র চিকিৎসকের।

কিন্তু ভারতের মত বিপুল জনসংখ্যার দরিদ্র দেশে পশ্চিমের ধনাঢ্য দেশগুলোর মত ২৪-৪৮ ঘন্টা ধরে হাসপাতালের এক-একটি শয্যা আটকে রেখে এক-এক করে প্রসব করানো কতটা সম্ভব, বিশেষ করে যেখানে জীনগত দুর্বলতা ও পারিপার্শ্বিক কারণে অনেক গর্ভবতীই রক্তাল্পতা, উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ ইত্যাদি কঠিন রোগ আনুসাঙ্গিক হিসেবে নিয়ে আসেন? আর রোগিনীর পরিজনেরা? যদি ধাত্রীবিদ বলেন ধৈর্য্য ধরতে, স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে সময় লাগাটাও স্বাভাবিকের পর্যায়ে পড়ে, তবে কি তাঁরা মানতে রাজি থাকবেন? না, তখন তাঁরা মনে করবেন যে রোগিনীর অবহেলা হচ্ছে, এবং এর থেকে অশান্তি বাঁধতে কতক্ষণ? আর শিশু অসুস্থ বা মৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হলে তো কথাই নেই!

আবার, স্বাভাবিক প্রসব অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য বিমার অন্তর্ভুক্ত থাকে না। এই সব ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিজেরাই চিকিৎসকের কাছে অনুরোধ রাখেন Caesarean Section করে দিতে। আবার, রোগিনীরা স্বাভাবিক প্রসবের দীর্ঘসূত্রিতা ও ব্যথা সহ্য করতে না চাইলে আগেভাগেই Caesarean section করার অনুরোধ করে থাকেন। এবার, বেচারা চিকিৎসক কোন দিকে যাবেন?

এই সমস্ত সমস্যার কারণ হল, আমাদের দেশে চিকিৎসক,রোগী ও পরিজনের মধ্যে এক বিরাট communication gap রয়ে যায়, এবং এই gapকে কিঞ্চিৎ হলেও কম করানোর উদ্দেশ্যেই আমার এই লেখা যার সারবস্তু হল - কেন ও কখন সিজার করা হয়?
 
আলোচনা শুরু করার আগে জানিয়ে রাখি - বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু অনাবশ্যক Caesarean Section কমাতে বদ্ধপরিকর, এবং এই কারণে প্রতিটি শিশুর জন্মের সমস্ত বৃত্তান্ত সরকারের খাতায় সযত্নে লিপিবদ্ধ করা হয়। তাই, 'অনাবশ্যক সিজার' করা কিন্তু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পক্ষে বিপজ্জনক, এবং তেমন হলে শাস্তি হওয়াও বিচিত্র নয়। তাই, একটা বিনীত অনুরোধ রইল - আপনার চিকিৎসককে বিশ্বাস করুন, কারণ কোনও নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া Caesarean Section করালে তিনি ছাড় পাবেন না কিছুতেই!


Caesarean Section
হল এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে মায়ের উদরের ত্বক ও মাংসপেশী অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ব্যবচ্ছেদ করে জরায়ু থেকে গর্ভস্থ শিশু ও গর্ভসঞ্চারের অন্যান্য ফসল (নাড়ি, গর্ভের থলি, তরল, গর্ভফুল) কে বাইরে বার করে গর্ভাবস্থার অবসান ঘটানো। স্বাভাবিক প্রসব যদি অসম্ভব হয়, বা সঙ্গতিহীন ভাবে মা বা শিশু বা উভয়ের পক্ষেই বিপজ্জনক হয়, তখনই Caesarean Section করার বিধান।

এটা বুঝতে হলে মনে করা যাক, স্বাভাবিক প্রসব একটি সমবাহু ত্রিকোণের মত,এবং এর তিনটি কোণ হল - Pressure, Passage, Passenger - অর্থাৎ স্বাভাবিক চাপ, স্বাভাবিক পথ, স্বাভাবিক শিশু। এই তিনটির মধ্যে কোনও একটির ব্যত্যয় ঘটলেই ত্রিকোণ আর সমবাহু থাকে না, তখন আর স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয় না, এবং অন্যান্য উপায় অবলম্বন করতে হয়, Caesarean Section যাদের মধ্যে অন্যতম।

প্রথমতঃ স্বাভাবিক চাপ বা 'Pressure':

অর্থাৎ জরায়ুর মাংসপেশীর স্বাভাবিক সঙ্কোচন ও তার ফলে যে বেদনাদায়ক চাপের সৃষ্টি হয় (সাধারণত যাকে 'ব্যথা ওঠা' বলে থাকি আমরা)। স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে, এই 'ব্যথা ওঠা'র সময়ে প্রসূতিকেও নিশ্বাস বন্ধ করে ব্যথার সাথে তাল মিলিয়ে নিজের পেটের উপর চাপ দিতে হয়।

স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে জরায়ুর দুই pole অর্থাৎ জরায়ু আর তার নালি (fallopian tubes) দুটির দুই সংযোগস্থলের মাংসপেশীর থেকে শুরু হয়ে গোটা জরায়ুতে এই সঙ্কোচনের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। কোনো কারণে যদি তা সঠিক সময়ে শুরু না হয়, বা হতে হতে হঠাৎ থেমে যায়, বা যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে না পারে,তখন Caesarean Section করার দরকার হয়।




জরায়ুর সঙ্কোচনের তরঙ্গ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ্যণীয়কেবলমাত্র জরায়ুর উপরিভাগ বা upper segment সক্রিয় ভাবে সঙ্কোচনে অংশগ্রহণ করে। নিচের অংশ অর্থাৎ lower segment এই ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে। এর ফলে গর্ভের নাড়ির উপর চাপ কম পড়ে, এবং শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর সঙ্কোচনের কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না।

  • যদি নির্দিষ্ট সময়ের পরেও স্বাভাবিক প্রসব বেদনা শুরু না হয় (post dated pregnancy - বিয়াল্লিশ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা গর্ভকাল) তখন প্রথমে তা ঘটানোর চেষ্টা করা হয় যোনীপথে prostaglandin জাতীয় ওষুধ দিয়ে জরায়ুমুখ খুলে ও প্রশস্ত করার চেষ্টা করে (induction of labour)তাতে কাজ না দিলে গর্ভের থলি বিদীর্ণ করা (artificial rupture of membranes), Oxytocin/Epidocin জাতীয় injection দিয়ে জরায়ুর সঙ্কোচন শুরু করা - খাতায় কলমে অনেক কিছুই করা যায়, কিন্তু এইরকম post dated শিশুদের নানারকম স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকি থাকে - বিশেষতঃ শ্বাসকষ্ট জনীত, যার থেকে মস্তিষ্কের চিরস্থায়ী ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। এ ছাড়া, এরা অনেক ক্ষেত্রেই আয়তনে বড় হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়া মায়ের পক্ষে কঠিন, বেদনাদায়ক বা অসম্ভব হতে পারে। এই রকম প্রসূতিদের নিয়ে বেশি অপেক্ষা না করাই ভালো, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে prostaglandin কাজ না দিলে সরাসরি Caesarean Section করে দেওয়া হয়।
  • যদি স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয়েও থেমে যায় বা মন্থরগতিতে অগ্রসর হয় (prolonged labour)  এবং তখনও মা ও শিশু দুইজনেই সুস্থ, অক্লান্ত ও জীবিত থাকলে গর্ভের থলি কে বিদীর্ণ করা হয় প্রথমে (artificial rupture of membranes), তারপর Epidocin বা oxytocin injection দিয়ে প্রসবের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করা হয়। সাধারণত প্রথমটি বা খুব জোর দ্বিতীয়টি করলে স্বাভাবিক প্রসব এমনিতেই হয়ে যায়। বিরল ক্ষেত্রে যদি এই দুই পদ্ধতি কাজ না করে, অথবা মাঝপথে মা ক্লান্ত হলে বা অসুস্থ বা অচৈতন্য হলে বা শিশুর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বা দুজনের কারও মৃত্যু হলে caesarean section করাই বিধেয়।
  • যদি হঠাৎ করে প্রসব প্রক্রিয়া মাঝপথে থেমে যাওয়ার পর দেখা যায় যে শিশু অনেকটা নিচে নেমে এসেছে, তাহলে অন্যান্য কিছু শর্তাবলী পূর্ণ হলে forceps বা vacuum suction cup দিয়ে স্বাভাবিক প্রসব শেষ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এটা ৩ বার অবধি চেষ্টা করা যায়, তাতেও কাজ না হলে caesarean section ছাড়া উপায় নেই।
  • গর্ভবতীর পথ দুর্ঘটনা বা অন্য যে কোন কারণে মৃত্যু হলে জরায়ুর স্বাভাবিক সঙ্কোচনও হবে না, এবং তিনি নিজের থেকে পেটের উপর চাপ দিয়ে প্রসব প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এই ক্ষেত্রে তাই Caesarean Section ছাড়া গতি নেই। 


Amniotomy বা Artifical Rupture of Membranes - কৃত্রিম উপায়ে গর্ভের থলি বিদীর্ণ করা। এর ফলে গর্ভের তরলের সাথে প্রাকৃতিক prostaglandin নির্গত হয়, যা স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।


            Forceps-এর মাধ্যমে মাঝপথে আটকে যাওয়া স্বাভাবিক প্রসব শেষ করা হচ্ছে।

 


                          Vacuum Suction Cup- এর মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসব শেষ করা।

দ্বিতীয়তঃ স্বাভাবিক পথ বা 'Passage':

 অর্থাৎ প্রসবের রাস্তার স্বাভাবিকতা। যে পথে শিশু নেমে আসছে - সেই জরায়ু, জরায়ুমুখ এবং যোনী কোনোভাবেই অবরুদ্ধ থাকা চলবে না।


●     
যদি মায়ের fibroid, cervical cancer, বা জরায়ু, জরায়ুমুখ বা যোনীর কিছু কিছু জন্মগত ত্রুটি থাকে, এবং সেই কারণে প্রসবের স্বাভাবিক পথ আটকানো থাকে, তখন সেই মুহুর্তে যাই করা হোক না কেন, তা কিছুতেই স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে না। তাই এমন ক্ষেত্রে caesarean section ছাড়া উপায় নেই।

●     
গর্ভফুলের (placenta) স্বাভাবিক অবস্থান হয় জরায়ুর উপরিভাগে, পিছন দিক ঘেঁষে। এখন ধরা যাক, যদি একাধিক গর্ভধারণের ফলে সেই অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে, তবে গর্ভফুল স্বাভাবিক অবস্থানে থাকতে পারবে না, তখন তার অবস্থান হবে জরায়ুর নিচের দিকে। এর ফলে জরায়ুমুখ অংশত বা সম্পূর্ণ আটকানো থাকতে পারে এবং শিশুর জরায়ুমুখ বেয়ে যোনীপথে পৌঁছনো অসম্ভব হয়ে যায়। ধীরে ধীরে জরায়ুমুখ যত বড় হয়, গর্ভফুলের রক্তজালিকায় টান পড়ে তা ছিড়ে গিয়ে মায়ের প্রবল রক্তপাত হতে থাকে। একে ডাক্তারি পরিভাষায় Placenta Praevia grade 3 বা 4 বলা হয়। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে caesarean section ছাড়া প্রসব অসম্ভব।


 ●      Cephalopelvic Disproportion,
অর্থাৎ শিশুর আয়তন ও মায়ের প্রসবপথের প্রশস্ততা যদি অসঙ্গত হয়, তখন অন্য কোনো অসুবিধা না থাকলেও শিশু বাইরে আসতে পারবে না। তাই এমন ক্ষেত্রেও caesarean section করতে হবে। এখানে বলে রাখা উচিত যে মায়ের প্রসবপথের প্রশস্ততা নির্ভর করে তাঁর কোমরের হাড় (pelvis) এর গঠনের উপর। মানুষের দেহে pelvis-এর গঠন নির্ভর করে নৃতাত্ত্বিক জাতিগত পার্থক্য, বয়স এবং জন্মগত গঠনের উপর। এর মধ্যে কোনো কারণে যদি মায়ের কোমরের হাড় অনুপযুক্ত হয়, তবে প্রসবের রাস্তা যথেষ্ট প্রশস্ত হবে না। আবার যদি কোনো একটি শিশু গর্ভাবস্থায় মায়ের মধুমেহ (diabetes) প্রমুখ কারণে আয়তনে অনেক বড় হয়ে যায়, তখন মায়ের প্রসবপথ যথেষ্ট প্রশস্ত হলেও শিশু কখনই বাইরে আসতে oপারবে না। তাই Cephalopelvic disproportion এর একটাই উপায় - caesarean section - অন্যথায় মা ও শিশু উভয়েরই জীবনসংশয় হবে (obstructed labour বা labour dystocia)

 ●     
যদি সময়ের আগেই প্রসব শুরু হয় (preterm labour - ছত্রিশ সপ্তাহের কম সময় ধরে চলা গর্ভকাল), তবে জরায়ুর নিচের দিক (lower segment) প্রসবের জন্য প্রস্তুত থাকে না। তখন শিশু প্রথমে স্বাভাবিক ভাবে নামতে থাকলেও পরে আটকে যায়। যাতে এইভাবে প্রসব মাঝপথে আটকে না যায়, তাই সময়ের আগে প্রসব বেদনা শুরু হলে সাধারণত Caesarean Section করা হয়।



মনুষ্যদেহের pelvis-এর রকমফের। উল্লেখ্য, প্রাপ্তবয়স্কা নারীদের প্রসবের সুবিধার্থে প্রাকৃতিক নিয়মেই Gynaecoid Pelvisই সাধারণত দেখা যায়। কিন্তু বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতির জীনগত বিন্যাসের ফারাকের কারণে নারীদের মধ্যে Gynaecoid এবং অন্যান্য pelvis-এর অনুপাতেরও তফাৎ ঘটে। যেমন, প্রসবের পক্ষে সবথেকে অসুবিধাজনক Android Pelvis ব্যাপক হারে দেখা যায় Negroid-জাতীয়া কৃষ্ণাঙ্গী নারীদের মধ্যে। এঁদের মধ্যে তাই Caesarean Section-এর হারও স্বাভাবিক ভাবেই অধিক।


Cephalopelvic Disproportion -
মায়ের কোমরের অস্থি ও শিশুর আয়তনের মধ্যে অসঙ্গতি - লক্ষ্যণীয় যে শিশুর মাথা একটি স্তরে এসে আটকে গিয়েছে।

 



 Placenta
অর্থাৎ গর্ভফুলের স্বাভাবিক অবস্থান।



                               Placenta Praevia - গর্ভফুলের অবস্থানগত ত্রুটি।
 

তৃতীয়তঃ স্বাভাবিক শিশু, বা Passenger :

শিশুর স্বাভাবিকতা প্রয়োজনীয় কেন? কারণ পূর্ণ গর্ভকালের অন্তিম পর্যায়ে শিশুর মস্তিষ্কের pituitary গ্রন্থি থেকে ACTH ক্ষরণ হয়ে তা adrenal গ্রন্থি থেকে dihydroepiandrosterone sulfate ক্ষরণ করায়, তারপর তা গর্ভফুলের মাধ্যমে রক্তস্রোতে মিশে গিয়ে শেষে মায়ের যকৃতে পৌঁছায় এবং সেখানে গিয়ে oestradiol hormone-এ পরিবর্তিত হয়। এই hormone এর মাত্রা বৃদ্ধির কারণেই জরায়ুর মাংসপেশীর সঙ্কোচন হয়ে প্রসব বেদনা শুরু হয়।


●     
শিশুর মস্তিষ্ক বা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি যদি অপরিণত হয়ে থাকে (যথাক্রমে Anencephaly বা Congenital Adrenal Hyperplasia) , বা গর্ভেই মৃত্যু হয়ে থাকে তবে এই hormone তৈরির ব্যাপারটা ঘটতে পারবে না, তাই স্বাভাবিক প্রসব ঘটবে না। তাই এ ক্ষেত্রে Caesarean Section ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

●      Malpresentations and Malpositions :
অর্থাৎ গর্ভস্থ শিশুর অবস্থানগত বৈচিত্র্য। এখনও অবধি এই প্রতিবেদনে যত কিছু ডাক্তারি আলোচনা করেছি, তার মধ্যে এই malpresentation এবং malposition এর বিষয়টি অ-ডাক্তার ব্যক্তিকে বোঝানো সবচেয়ে কঠিন। আমাদের সুবিধার্থে এইটুকু মাথায় রাখলেই চলবে যে প্রসবকালে গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক অবস্থান এইরূপ হবে : মাথা নিচে - পা উপরে (cephalic presentation), ঘাড় থাকবে হেঁট ও মাথার তালু থাকবে সর্বাগ্রে (vertex denominator with flexed attitude), এবং মা ও শিশুর শিরদাঁড়া পরস্পরের সাথে সমান্তরাল থাকতে হবে (longitudinal lie)এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটলেই সেটা গর্ভস্থ শিশুর অবস্থানগত অস্বাভাবিকতার পর্যায়ে পড়ে, এবং এই সমস্ত ক্ষেত্রেই Caesarean Section হওয়ার ঝুঁকি অনেক গুণ বেশি হলেও সব ক্ষেত্রে আবশ্যক নয়।

●      একাধিক গর্ভস্থ শিশু (multifoetal pregnancy) : দুই বা তার বেশী সংখ্যক গর্ভস্থ শিশু থাকলে অনেক সময়েই Caesarean Section ছাড়া উপায় থাকে না, কারণ বেশি সংখ্যক শিশু থাকায় সময়ের আগেই জরায়ু বড় হয়ে গিয়ে যথেষ্ট চাপ পড়তে থাকে, তাই জরায়ু ও প্রসব পথ প্রস্তুত না থাকলেও প্রসব বেদনা শুরু হয়ে যায় এবং এতগুলো শিশুর স্বাভাবিক সময় নিয়ে বাইরে আসা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া, এক বা একাধিক শিশুর অবস্থানগত অস্বাভাবিকতা থাকার সম্ভাবনাও অনেক বেশি, কাজেই Caesarean Section হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এই একাধিক শিশু বিশিষ্ট গর্ভাবস্থা নিয়ে পরে একদিন বিশদে আলোচনা করা যাবে।

 

                              প্রসবের প্রাক্কালে গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক অবস্থান।


 
সবথেকে বেশি যে অবস্থানগত বৈচিত্র্য দেখা যায় তার নামটি প্রায় সকলেই শুনেছেন - Breech শিশু। Breechদের ক্ষেত্রে কিন্তু Caesarean section সর্বদা আবশ্যক নয়।


গর্ভকাল ছত্রিশ সপ্তাহ পূর্ণ হলে
, এবং গর্ভের থলিতে যথেষ্ট পরিমাণে তরল (amniotic fluid) থাকলে বাইরে থেকে হাতের সাহায্যে পেটের উপর চাপ দিয়ে breech শিশুকে স্বাভাবিক অবস্থানে আনার চেষ্টা করা যায় - একে External Cephalic Version বলা হয়। প্রক্রিয়া শুরু করার আগে মা কে tocolytic জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয় যাতে অপ্রত্যাশিত ভাবে গর্ভথলি বিদীর্ণ হয়ে স্বাভাবিক প্রসব শুরু না হয়ে যায়।


দুইবার External Cephalic Version চেষ্টা করার পরও যদি কাজ না হয়, বা এটা করার সময়ে যদি শিশুর শ্বাসকষ্ট বা অন্যান্য সমস্যা হয়, বা মা যদি ঝুঁকি নিতে রাজি না থাকেন, তবে যথা সময়েই Vaginal Breech Delivery পদ্ধতিতেও শিশুকে স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে বাইরে আনা যায়। তবে এখানে একটা ছোট্ট 'কিন্তু' রয়েছে। এই স্বাভাবিক উপায়ে Breech শিশু প্রসবের ক্ষেত্রে গলায় নাড়ি পেঁচিয়ে যাওয়া, নাড়ির উপর চাপ পরে শিশুর দেহে রক্ত চলাচল ব্যহত হওয়া, মাঝপথে শিশুর কাঁধ আটকে যাওয়া (shoulder dystocia) ইত্যাদি কারণে জন্মের সময়ে শিশুমৃত্যুর (Stillbirth) হার কিঞ্চিৎ বেশি, হ্যাঁ, খুব নগণ্য মাত্রায় হলেও বেশি। তাই অনেক সময়েই ঝুঁকি না নিয়ে Caesarean Section করা হয় - মা, শিশু ও চিকিৎসক, সবাই 'চাপমুক্ত'!



 Transverse Lie -
গর্ভে আড়াআড়ি ভাবে অবস্থিত শিশু। এদের স্বাভাবিক অবস্থানে আনা অত্যন্ত দুরূহ কাজ, কার্যত অসম্ভব এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই এই ক্ষেত্রে Caesarean Sectionই করা হয়।

 
চতুর্থতঃ অন্যান্য কারণ, যাতে Caesarean Section ছাড়া উপায় থাকে না

●      Cord Prolapse
অর্থাৎ নাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসা। এই ক্ষেত্রে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়ে শিশুর শ্বাসকষ্টের প্রবল সম্ভাবনা থাকে।

●      Compound Limb Prolapse
অর্থাৎ হাত বা পা বাইরে বেরিয়ে আসা। এই ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসব আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় (obstructed labour) এই বিপত্তি সাধারণত ঘটে transverse lie শিশুকে জোর করে স্বাভাবিক ভাবে প্রসবের চেষ্টা করতে গিয়ে। এর পরেও যদি খুব বেশি বিলম্ব করা হয়, তবে মাতৃমৃত্যু বা শিশুমৃত্যু কোনোটাই অসম্ভব নয়, তাই অবশ্যই Caesarean Section করে দেওয়াই উচিত।

●      Vesico-Vaginal Fistula,
বা মূত্রথলি ও যোনীর মধ্যে অস্বাভাবিক নালীপথ, যার কারণে রোগিনীর যোনী থেকে মূত্র বাইরে বেরোতে থাকে। এই ক্ষেত্রে Caesarean section করতেই হবে, কারণ এটা তৈরি হয় পূর্ববর্তী কোনো প্রসবের ক্ষেত্রে cephalopelvic disproportionকে জোর করে স্বাভাবিক প্রসব করানোর চেষ্টা করতে গিয়েই। বর্তমানে যদি cephalopelvic disproportion নাও থাকে, তাও স্বাভাবিক প্রসব করালে এই fistula আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা। অতএব Caesarean Section ছাড়া গতি নেই।

●     
মায়ের ইতিপূর্বে Caesarean Section হয়ে থাকলে প্রথমে কিছুক্ষণ স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা করা যেতে পারে - এই প্রক্রিয়াকে Trial of Scar বলা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রধান ঝুঁকি হল আগের Caesarean এর যে সেলাই জরায়ুর উপর আছে, তা খুলে গিয়ে প্রচুর রক্তপাত ও মৃত্যু। খুব বেশি ঝুঁকি মনে হলে Caesarean করে দেওয়া হয়।

●     
মায়ের অসুস্থতার কারণে যদি গর্ভস্থ শিশুকে যথা সময়ের আগেই বাইরে বার করা জরুরি হয়ে পড়ে, যেমন কিছু কিছু হৃদরোগ,যকৃতের রোগ, বৃক্কের রোগ, খিঁচুনি, উচ্চ রক্তচাপের কারণে Pre Ecclampsia বা Ecclampsia, ইত্যাদি।

 ●     
শিশুর কোনো জন্মগত রোগ বা যে কোন কারণে শিশু যদি গর্ভের মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠে বা অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবে দ্রুত তাকে চিকিৎসার জন্য মাতৃগর্ভ থেকে বার করা প্রয়োজন। তখন Caesarean section করতেই হয়।

 ●     
মায়ের HIV,Herpes,Gonorrhea,Hepatitis B অথবা C - ইত্যাদি কিছু কিছু সংক্রমণ থাকলে শিশু যদি মায়ের যোনীরসের সংস্পর্শে আসে তবে সে সংক্রমণ শিশুর দেহেও ছড়িয়ে যেতে পারে। সেটা আটকাতে Caesarean section করা হয়। এই ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা একদমই করা উচিত নয়।

 

Cord Prolapse - গর্ভের নাড়ি যোনীর বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

 


 Compound Hand Prolapse -
হাত যোনীপথ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।






 
 Vesicovaginal Fistula - মূত্রনালী ও যোনীর মধ্যে অস্বাভাবিক নালীপথ।

তা, এই হল আধুনিক ধাত্রীবিদ্যায় Caesarean Section এর অনুমোদিত কারণ, যা আমি আমার সাধ্যমত ব্যখ্যা করার চেষ্টা করলাম।

'
সর্বজয়া'র এই দ্বিতীয় সংখ্যা আমার জন্য প্রথম বার কোনো পোষাকী পত্রিকায় লেখা। লেখা সম্বন্ধে আমি একেবারে আনাড়ি নই এ কথা সত্যি, কিন্তু প্রথম বার কোনো কাজ করতে গেলে সামান্যতম হলেও উদ্বেগ থেকে যায়। তবে চিন্তা করে দেখলে এই 'নরমাল বনাম সিজার' সাধারণ মানুষকে বিশেষতঃ হবু মায়েদের যত উদ্বেগে রাখে, তার কাছে আমার এই উদ্বেগ কিছুই নয়। তাই যথাসাধ্য বৈজ্ঞানিক কারণগুলো বোঝানোর চেষ্টা করলাম - সাধারণ পাঠক, এবং অতি অবশ্যই পাঠিকাদের পক্ষে সহজে বোধগম্য করে। কতটা সফল হলাম তা জানা নেই, তবে এর ফলে একজনেরও মনের ভয়-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যদি এতটুকুও কম হয়, তবে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। 

 

 কলমে - ডঃ অ দ্রি জা  ব সু


চিত্র সৌজন্যঃ গুগল, ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন