ননীবালা দেবী - প্রথম মহিলা রাজবন্দী


" আমাকে বাগবাজারে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের স্ত্রী সারদা মায়ের কাছে রেখে দিন তাহলে খাবো। " - ননীবালা দেবী 

দেশ স্বাধীন করার জন‍্য বহু মানুষ আত্মবলিদান দিয়েছেন। শুধুমাত্র পুরুষই যে এগিয়ে এসেছিলেন তা নয় এই ব‍্যাপারে নারীও পিছিয়ে ছিলেন না। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা সেইসব মহিয়সী নারীদের সম্পর্কে তেমন জানিই না, অনেক জনের শুধুমাত্র নামটুকুই শুনেছি। আজ আমরা এমনই একজন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা মহিয়সী নারী ননীবালা দেবী সম্পর্কে জানব। 

পরাধীনতার জ্বালা যে কী তখন মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলো। ধনী-দরিদ্র,নারী-পুরুষ সকলেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতা পাওয়ার জন‍্য লড়াই করেছিলেন, তাঁরা মনে করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে সবাই নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে, স্বাধীন ভাবে চলতে পারবে! কিন্তু কোথায় কী? বতর্মানের বেশিরভাগ  রাজনীতিবিদদের দেখে মনে হয় - এরা তখন থাকলে দেশ আজও পরাধীন থাকত! দুঃখের বিষয়, যেসব ব‍্যক্তিদের জন‍্য আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীনতা লাভের পর বেশিরভাগ জনের খবর কেউ রাখে নি। উনারাও নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কখন যে ইহলোক ছেড়েছেন তা এখনও অজানা। ননীবালা দেবীও শেষ জীবনে অনেক বঞ্চনা ভোগ করেছিলেন, পেয়েছিলেন অনেক লাঞ্ছনা!








জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

 

নিবাস - হাওড়া জেলার বালিতে। তিনি ঐখানেই জন্মগ্রহণ করেন। 

জন্ম সাল - ১৮৮৮। 

পিতার নাম - সূর্যকান্ত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। 

মাতার নাম - গিরিবালা দেবী। 

ভাইপো - বিপ্লবী অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। 

বিবাহ - ১৮৯৯ সালে, তখন বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। 

বাল‍্য বিধবা হন - ১৯০৪ সালে, সেইসময় বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। 

বিবাহের পরের জীবনঃ

সামাজিক রীতিনীতি মেনে মাত্র এগারো বছর বয়সে বিবাহ হয় ননীবালা দেবীর। কিন্তু সেই সংসার আর করা হয় না। দাম্পত্য জীবন বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে তাঁর ঠাঁই হল না, তাই বাধ্য হয়ে পিতৃগৃহে আশ্রিত হলেন। অবশ‍্য সেখানেও বেশিদিন থাকা হল না।  

ননীবালা দেবীর পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। কিন্তু তাঁর বাপের বাড়ির লোকেরা চায় নি ননীবালা দেবী পড়াশোনা করুক। তাও নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যান। শেষ পযর্ন্ত সামাজিক ও পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হয়ে বাপের বাড়ি ছাড়েন। সেখান থেকে স্থান হল 'আহিড়াদহ রামকৃষ্ণ মিশনে'

বিপ্লবী কার্যকলাপ :

১৬০০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের একদল বণিক রানী এলিজাবেথের কাছে এক আর্জি নিয়ে হাজির হন। তারা রাণীর কাছে পূর্ব এশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসা করার জন্য সম্মতি ও রাজ সনদ প্রদানের জন্য অনুরোধ করে। ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ভারতে এলেও পরবর্তীকালে এই দেশেরই শাসক হয়ে বসে। তারা প্রায় দুইশত বছর এ ভারতবর্ষকে নির্মমভাবে শাসন-শোষণ করে। চারিদিকে চলছে তখন ব্রিটিশদের প্রচন্ড আক্রমণ, নির্মম অত্যাচার। দিনে দিনে ভারতীয় নাগরিকদের ওপর অত্যাচারের সীমা চরমে পৌঁছে ছিল। ফাঁসি দেওয়া, দ্বীপান্তর, মলদ্বারে রুল ঢোকানো,কমোড থেকে মলমূত্র এনে মাথায় ঢেলে দেওয়া, চোখের মনিতে ছুঁচ ফোটানো, গরম লোহা হাতের তালু ও পায়ের চেটোতে চেপে ধরা, কয়েক দিন উপোস করিয়ে পিছনে হাতকড়া পরিয়ে সেই অবস্থায় ঠা ঠা রোদে বন্দিকে দাঁড় করিয়ে রেখে লাথি ও রুলের মার, প্রকাশ্যে গুলি করা,হাতুড়ির ঘা মেরে দাঁত ভেঙে দেওয়া, নাক মুখ ফাটিয়ে দেওয়া, সাঁড়াশি দিয়ে হাত পায়ের নখ উপড়ে নেওয়া - এসব ছিল ব্রিটিশদের কাছে জলভাত। এমনভাবে দেশের সন্তানদের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে ব্রিটিশরা। নারীদের ক্ষেত্রে অত্যাচারের মাত্রা ছিল অন্যরকম। বহু বন্দী নারীকে দিয়ে জোর করে তাদের কাম চরিতার্থ করত। দিনের পর দিন ক্রমাগত ধর্ষণ করত। চলত মানসিক অত্যাচার।  এমন নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন বহু মানুষ। 

সে সময় চারিদিকে চলছে অরাজকতা, ব্রিটিশদের চরম অত্যাচার। ননীবালাদেবী চোখের সামনে এমন নির্মম অত্যাচার দেখে গোপনে নাম লেখালেন বিপ্লবী দলে। ননীবালা দেবী তাঁর ভাইপো বিপ্লবী অমরেন্দ্র চ‍্যাটার্জির কাছে বিপ্লবী আন্দোলন ও 'যুগান্তর দল'-এর কার্য সম্পর্কে সর্বপ্রথম অবহিত হন। তিনিই ছিলেন ননীবালা দেবীর বিপ্লব গুরু। তাঁর কাছেই বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা নিলেন। বিপ্লবের দীক্ষা মন্ত্র মাথায় নিয়ে দেশকে ভালোবেসে বিপ্লবীদের হয়ে তিনি নানান ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিতে শুরু করেন। শুধু তাই নয় দক্ষতার সাথে সেই কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টাও করতেন। কিন্তু তাঁর আচার ব্যবহারে এতটুকুও বোঝবার উপায় ছিল না যে তিনি একজন বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্যা! বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য তিনি ছিলেন 'মাধ‍্যম' । বহু অস্ত্রশস্ত্র নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতেন এবং সেইসব গোপনে বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। বাঘাযতীন ও রাসবিহারী বসুর মতো বাঘা বিপ্লবীদের মিলিত চেষ্টায় বিপ্লবী কার্যকলাপ এগিয়ে যেতে থাকে। ইতিমধ‍্যে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। এদিকে ১০ ই সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে বালেশ্বরের যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘাযতীন শহীদ হন। বাংলার মুক্তি সূর্যের আশা যেন অচিরেই অস্তমিত হতে লাগলো। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার বৈপ্লবিক কর্মসূচিতে অভাবনীয় ক্ষতি পূরণ হয়ে গেল। তবে তাঁর সাথীরা শহীদ বাঘা যতীনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য সেই গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন।


প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান ছিল ব্রিটিশদের বিপক্ষে। ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশ রাজ চলছিল, সেই হিসাবে বলা যায় ভারতবর্ষ জার্মানের শত্রু। কিন্তু ভারতবর্ষের অন্দরে তখন জোরকদমে বিপ্লবী সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষের বিপ্লবীরা জার্মানিতে গিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন‍্য গোপনে প্রস্তুত হচ্ছিল।

১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত-জার্মান যোগাযোগ এবং তারপর বিভিন্ন ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ কলকাতার 'শ্রমজীবী সমবায়' নামে এক প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি করতে যায়। তল্লাশির সময় এই প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় বিপ্লবী অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী পলাতক হন, কিন্তু সঙ্গী রামচন্দ্র মজুমদার গ্রেফতার হন। বৈপ্লবিক শিক্ষা গুরু অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী ও তার কয়েকজন সহকর্মীকে প্রায় দুই মাস হুগলির রিষড়াতে আশ্রয় দিয়ে রাখলেন ননীবালা দেবী। 

রামচন্দ্র মজুমদার গ্রেফতারের সময় “মাউজার” পিস্তল কোথায় রেখে গেছেন সে কথা দলকে জানিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু সে সময় পিস্তলটা খুব জরুরি ছিল। কিন্তু কিভাবে এর সন্ধান জানা যাবে, তা নিয়ে চলল বিপ্লবীদের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমাধানের পথ বেরিয়ে এলো। আলিপুর জেলে ঢুকে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে পিস্তলের কথা জানতে চললেন বাংলার অসীম সাহসী এক বাল‍্য-বিধবা নারী ননীবালা দেবী, সালটা ছিল ১৯১৫। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করার মত দুঃসাহস নারীদের ছিল না। কিন্তু বাল‍্য-বিধবা ননীবালা দেবী সমাজের নিয়মের গণ্ডি ভেঙে, সধবার সাজে মাথায় সিঁদুর পরে, এক গলা ঘোমটা দিয়ে রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে প্রেসিডেন্সি জেলে বিপ্লবী রামচন্দ্রের সাথে দেখা করে পুলিশের চোখ এড়িয়ে পিস্তলের খোঁজ নিয়ে এলেন। ১৯১৫ - ১৬ সাল নাগাদ এক বাল‍্য-বিধবা মহিলার ক্ষেত্রে এমনভাবে সিঁদুর পরাটা ছিল মৃত্যুর সমান। তিনি জানতেন যদি ধরা পড়েন, সমাজ তাকে মেনে নেবে না। কারণ তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার সাথে বর্তমান সমাজের ছিল বিস্তর ফারাক। সে ভয়কে তিনি আমল দেননি শুধুমাত্র দেশের কথা ভেবে।  তিনি সেইকাজটিও করেছিলেন শুধুমাত্র দেশের স্বার্থে। তবে এই ঘটনা বেশিদিন চেপে রইল না। একদিন সমস্ত ঘটনা সামনে এলো। পুলিশ অনেক পরে জানতে পারল যে ননীবালা দেবী রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী নন। কিন্তু এটা জানতে পারেননি যে তিনি রিষড়াতে বিপ্লবীদের  আশ্রয় দিয়েছিলেন। 

পুলিশের নজর এড়াতে ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চন্দননগরে পুনরায় বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেইখানে অন‍্য এখটি সমস্যা দেখা দিল, বাড়ি ভাড়া মহিলা না থাকলে পাওয়া যেত না। উদ্ধার কর্ত্রী হিসাবে আবার দৃশ‍্যপটে হাজির হলেন ননীবালা দেবী!

শুধু তাই নয় বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী সাথে করে এনেছিলেন তার বড় পিসিকে। এই বড় পিসি ও ননীবালা দেবী দুটো আলাদা আলাদা বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিলেন পলাতক বিপ্লবীদের। গোপনে সেই বাড়ি দুটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন পলাতক বিপ্লবী নেতা যদু গোপাল মুখার্জি,অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী,অতুল ঘোষ,ভোলা চ্যাটার্জী,নলিনীকান্ত কর বিনয় ভূষণ দত্ত ও বিজয় চক্রবর্তীরা। এঁদের প্রত্যেকের মাথার দাম হাজার টাকা করে ঘোষণা হয়েছিল। বিপ্লবীরা সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকতেন, আর রাতে নিশাচরের মত বেরিয়ে পড়তেন। পুলিশ এসে পড়লে সেই লুকিয়ে থাকা বিপ্লবীরা নিমেষেই গায়েব হয়ে যেতেন। 


এইভাবেই চলছিল, বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি বাড়িতে পুলিশের তল্লাশি ও বিপ্লবীদের নিমেষে পালায়ন পর্ব! কিন্তু এরপর সবার মনে হল, ননীবালা দেবীকে চন্দননগরে রাখা নিরাপদ হবে না। কারণ, সেই মুহূর্তে পুলিশ তৎপর হয়ে উঠেছিল ননীবালা দেবী কে গ্রেফতার করার জন্য। ননীবালা দেবীর বাবা সূর্যকান্ত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়কে পুলিশ বালি থানাতে নিয়ে গিয়ে ১০ টা থেকে ৫ টা অব্দি বসিয়ে রেখে জেরা করত, ননীবালা দেবী কোথায় আছেন সেই খবর জানতে। 

পেশোয়াতে পলায়নঃ

এদিক-ওদিক পালিয়ে পালিয়ে চলতে থাকলো ননীবালা দেবীর জীবন। এরপর তাঁর জীবনে এল টুইস্ট। ননীবালাদেবীর এক বাল্যবন্ধুর দাদা প্রবোধ মিত্র কাজের জন্য যাচ্ছিলেন পেশোয়ার। সেই বাল্য বন্ধু দাদাকে অনেক অনুনয় করে রাজি করালেন বিপ্লবী ননীবালাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। পলাতক ননীবালা দেবী প্রবোধ মিত্রর সঙ্গে পেশোয়া তে চলে গেলেন। এক বিধবার জীবনে এটা ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযান। কারণ যে সময় নারীরা ঘোমটা টেনে শুধুমাত্র সংসারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, তা না করে এক বাঙালি বিধবা অচেনা এক পুরুষের সাথে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে চলে গেলেন লুকিয়ে থাকতে! তবে,তিনি বেশিদিন এভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারলেন না। প্রায় ১৬ - ১৭ দিন পরে পুলিশ সন্ধান পেয়ে গেল তাঁর। এরপর পুলিশ যখন ননীবালা দেবীকে গ্রেপ্তার করতে গেছে পেশোয়ার, তখন তিনি অসুস্থ। দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কলেরাতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। পুলিশ প্রথমে তার বাড়ি ঘিরে রাখে,পরদিন পুলিশি হেফাজতে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকদিন পেশোয়াতে রাখার পর একটু সুস্থ হলে তাঁকে নিয়ে আসা হয় কাশির জেলে। এরপর ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে।

 

বন্দী জীবনঃ


জেরা পর্ব

সেইসময় কাশির ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন জিতেন ব‍্যানার্জী। কাশিতে নিয়ে আসার কয়েক দিন পর শুরু হল জেরা পর্ব! সুপারিনটেনডেন্ট জেলগেটের অফিসে এনে তাঁকে জেরা করতেন। কিন্তু ননীবালা দেবী কিছুতেই মুখ খুলতেন না। সব অস্বীকার করতেন, বলতেন তিনি কাউকে চেনেন না কিছুই জানেন না। এরপর শুরু হতো  জিতেন ব্যানার্জীর অসভ্য ভাষায় গালিগালাজ। ননীবালা দেবী চুপচাপ সব সহ‍্য করতেন। এতদিনে পুলিশ সুপারেনটেনডেন্ট বুঝতে পেরে গেছে এই মহিলা অতি সহজেই দমবার পাত্রী নয়। 

লঙ্কা বাটা দিয়ে অত‍্যাচার 

একদিন দুইজন জমাদারনী ননীবালা দেবীকে একটা আলাদা সেলে নিয়ে গেল,তারপর দুজনে মিলে তাঁকে জোর করে ধরে মাটিতে ফেলে শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে দু বাটি লঙ্কা বাটা যৌনাঙ্গে প্রবেশ করিয়েছিল। সেই অসহনীয় জ্বালা তিনি সহ‍্য করতে পারেন নি। অতিরিক্ত ঝাল খেলে আমাদের কেমন কষ্ট হয় সেটা সবাই জানি, আর উনার যে কী অবস্থা হয়েছিলো তা সহজেই অনুমেয়। তিনি চিল চিৎকার করতে লাগলেন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারতে লাগলেন। নির্মম অত‍্যাচারের পর তাঁকে আবার নিয়ে আসা হতো জেলগেটের অফিসে জিতেন ব্যানার্জীর কাছে। শুরু হতো আবার জেরা করা। এমন অকথ্য অত্যাচার,শরীরের ভেতর লঙ্কার জ্বালা, তবুও তার মুখ থেকে একটা কথাও জানতে পারল না সরকার পক্ষ! 

কাশির পানিশমেন্ট সেল 

কাশির জেলে মাটির নিচে একটা খুবই ছোট্ট শাস্তি কুঠুরি ছিল ( Punishment cell )। তাতে দরজা ছিল একটাই, আলো-বাতাস প্রবেশ করার জন্য সামান্য ঘুলঘুলিও ছিল না। সুপারিনটেনডেন্ট জিতেন ব্যানার্জীর নির্দেশে তিন দিন প্রায় আধঘন্টা সময় ধরে ননীবালা দেবীকে আলো-বাতাসহীন ওই অন্ধকার কুঠুরিতে ছেড়ে তালা বন্ধ করে আটকে রাখত। যা ছিল জীবন্ত অবস্থায় কবর দেওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করার সমান। এত কিছু করেও ননীবালা দেবীর মুখ খোলাতে পারল না সরকার পক্ষ! এইভাবেই অত‍্যাচার চলতে লাগল। এরপর অত‍্যাচারের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, আধ ঘন্টার পরিবর্তে ৪৫ মিনিট ধরে কুঠুরিতে বন্ধ করে রাখা হতে লাগল,শুরু হলো নির্মম মানসিক অত্যাচার, স্নায়ু শক্তিকে চূর্ণ করে দেওয়ার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। ননীবালা দেবীর শরীর আর সেই অসহনীয় অত‍্যাচার সহ‍্য করতে পারল না। একদিন তালা খুলে দেখা গেল ননীবালা দেবী মাটিতে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে আছেন। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে পুলিশ ননীবালা দেবীকে কাশি থেকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে এলেন।

প্রথম মহিলা রাজবন্দী হিসাবে এলেন প্রেসিডেন্সি জেলে

১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশনের (Regulation) ধারা প্রয়োগ হলো তাঁর বিরুদ্ধে। প্রথম মহিলা রাজবন্দী হিসাবে তিনি এলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। প্রেসিডেন্সিতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলেন,জেল কর্তৃপক্ষ এমনকি জেলার ম্যাজিস্ট্রেটও তাঁকে অনুরোধ করে খাওয়াতে পারলেন না। ননীবালা দেবী বললেন, বাইরে গেলে খাবেন। সেইমতো প্রতিদিন সকাল ন’টায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হতো গোয়েন্দা অফিসে। সেখানে আই.বি পুলিশের স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট গোল্ডি তাঁকে জেরা করত।

জেরা করার ধরন 

–আপনাকে এখানেই থাকতে হবে তাই বলুন কি করলে খাবেন?

–যা চাইবো তাই করবেন?

–করব।

–আমাকে বাগবাজারে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের স্ত্রী সারদা মায়ের কাছে রেখে দিন তাহলে খাবো।

গোল্ডি শয়তানি হাসি লুকিয়ে বলে,'আপনি দরখাস্ত লিখে দিন।'


ননীবালা দেবী তৎক্ষণাৎ একটা দরখাস্ত লিখে দিলেন। আইবি পুলিশের স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট গোল্ডি সেই দরখাস্ত পত্র টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে কাগজের টুকরিতে ফেলে দিল। সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ আহত বাঘিনীর মতো লাফিয়ে ওঠেন ননীবালা দেবী, সজোরে এক চড় বসিয়ে দিলেন গোল্ডির মুখে! বললেন, ছিঁড়ে ফেলবে তো আমায় দরখাস্ত লিখতে বলেছিলেন কেন? আমাদের দেশের মানুষের কোন মান সম্মান থাকতে নেই? দ্বিতীয় চড় মারার আগেই অন্য সিআইডি-র সদস‍্যরা তাঁকে ধরে ফেলে। সত‍্যিই ভাবতে অবাক লাগে প্রায় ২০০ বছর আগের এক বাল্য বিধবা নারীর সাহস দেখে! ধন‍্য তাঁর দেশভক্তি! এখনকার সমাজে এইরকম নারী বিরল! 

দুকড়িবালা দেবীর সাথে পরিচয় 

জেলে থাকাকালীন একদিন সিউড়ির দুকড়িবালা দেবীর ( যিনি 'মাসিমা' নামে পরিচিত ছিলেন।) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ননীবালা দেবী জানতে পারলেন, সিউড়িতে দুকড়িবালা দেবীর বাড়িতে সাতটা 'মাউজার পিস্তল' পাওয়া গিয়েছিল। সেই অপরাধে দুকড়িবালা দেবীর দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা হয়েছে। তাঁকে রাখা হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদিদের সঙ্গে অর্থাৎ, চোর ডাকাতের সাথে একই সেলে থাকার ব‍্যবস্থা করা হয়েছিল। সেইসময় নিয়ম ছিলো, রাজবন্দী হলে আলাদা সেলে রাখা হবে। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী জেল কর্তৃপক্ষ সেইসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মন মতো রাজবন্দীদের উপর অত‍্যাচার করত। তাঁদের প্রতিদিন প্রায় আধ মণ ডাল ভাঙতে দেওয়া হতো। ননীবালা দেবী দেখলেন, এইভাবে চললে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না, উপরন্তু কষ্টের পরিমাণ বাড়বে। তাই ঠিক করলেন, অনশন করবেন। অনশনের ১৯-২০ দিন চলছে, আবার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব অনুরোধ করতে এলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন আপনাকে তো এইখানেই থাকতে হবে। কি করলে খাবেন বলুন?

ননীবালা দেবী জবাব দেন

–আমার ইচ্ছা মত হবে?

–হ্যাঁ হবে।

–তাহলে আমার রান্না করবার জন্য একজন ব্রাহ্মণকন্যা চাই, দুজন ঝি চাই।

ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করলেন, ব্রাহ্মণ কন্যা কেউ আছেন এখানে?

ননীবালা দেবী বললেন, আছেন দুকড়িবালা দেবী।

–আচ্ছা তাই হবে।

ননীবালা দেবীর কথা মতো জেলে এলো সমস্ত নতুন বাসন-হাঁড়িকুড়ি। ২১ দিন পর ভাত খেলেন সেই অসামান্যা দৃঢ়চেতা রাজবন্দী ননীবালা দেবী। সেই সাথে দুকড়িবালা দেবীকেও পরিশ্রমের হাত থেকে মুক্তি দিলেন। 

শেষ জীবনঃ

বন্দী জীবন থেকে মুক্তি 

অবশেষে এলো মুক্তি! সালটি ছিল ১৯১৯। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। কিন্তু সেখানে তাঁর ঠাঁই হল না। 

 ঠাঁই নাই !  ঠাঁই নাই !

 প্রথমত ছিল পুলিশের ভয়, দ্বিতীয়ত ছিল সামাজের চোখ রাঙানি। তৎকালীন সমাজে বিধবাদের উপর অনেক রকম নিয়ম কানুন চাপানো ছিল। আর ননীবালা দেবী ছিলেন বাল‍্য-বিধবা। এক বাল‍‍্য-বিধবার শাঁখা-সিঁদুর পরে পরপুরুষের স্ত্রীর সাজে জেলে যাওয়া, এরপর পরপুরুষের সাথে পেশোয়াতে যাওয়া ও একঘরে থাকা - এইসব তখনকার সমাজ মেনে নিতে পারে নি। শুধু সমাজ নয়, তাঁকে গ্রহন করেনি নিজের বাড়ির আত্মীয় পরিজনরাও। 

একাকী বসবাস 

অন্যদিকে,তাঁর পরিচিত বিপ্লবী সংগঠনের সদস‍্য ও চেনাজানা প্রায় সবাই ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এমত অবস্থায় উত্তর কলকাতার এক বস্তিতে তাকে আশ্রয় নিতে হয়। আবার কারও মতে কোন পূর্ব পরিচিতের অনুগ্রহে একটি কুঁড়ে ভাড়া করেছিলেন হুগলিতে। সুতো কেটে,রান্নার কাজ করে কোনমতে আধপেটা খেয়ে দিন কেটেছিল এক নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের। সমাজ এবং নিজের আত্মীয় স্বজনদের উপরে রাগে দুঃখে অপমানে তিনি সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, নিজেকে একপ্রকার লুকিয়ে রাখলেন। পরবর্তীকালে কোন দেশ নেতাদের কাছে গেলেন না। যে মহিলা নিজের জীবনের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে দেশের কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন, তিনি কোথায় গেলেন সে ব্যাপারে কেউ কোনো খোঁজখবর রাখল না।

চিরবিদায় ( ১৯৬৭ ) 

" সব তর্ক হোক শেষ ,

সব রাগ সব দ্বেষ ,

সকল বালাই ।

বলো শান্তি , বলো শান্তি ,

দেহ-সাথে সব ক্লান্তি

পুড়ে হোক ছাই । "

                               - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( 'মৃত‍্যুর পরে'  )

 দেশ স্বাধীন হওয়ার কুড়ি বছর পরে ১৯৬৭ সালের মে মাসে তিনি মারা যান। যে দেশের জন্য তিনি এমন নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছিলেন, স্বাধীনতার ৭৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও তিনি বঞ্চিত রয়ে গেলেন। বেঁচে থাকাকালীনও এমন দেশপ্রেমিকের খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন টুকুও কেউ মনে করল না! ইতিহাস তো দূরের কথা, তাঁর পারিপার্শ্বিক পরিবেশও তাঁকে মনে রাখেনি। 

   আরও কিছু তথ‍্য 

এক তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, কোন এক বিপ্লবী সাথীর চেষ্টায়, অন‍্য মতে জেলের খাতায়  নাম থাকার জন‍্য সরকারের কাছ থেকে বেঁচে থাকা অবস্থায় পঞ্চাশের দশকে ৫০ টাকা পেনশন পেয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে, যদিও পেনশন পাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবে স্বদেশীদের নিয়ে তৈরি একটি বাংলা সিনেমায় (সিনেমার নাম ৪২) তাকে নিয়ে কিছু দৃশ্য ছিল, পাওনা বলতে শুধু এই টুকুই! 

বিধবাদের সধবা সাজতে নেই, দেশের স্বার্থে সধবা সেজেছিলেন! ছোট্ট কুঠুরি শাস্তি সেলে শ্বাস নিতে না পেরে বহুবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন! নির্মম অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেও কোথাও তিনি সম্মানের সাথে জায়গা পেলেন না! স্বাধীন ভারতের বুকে এক নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমিককে অনাহারে কাটাতে হয়েছিল বহুদিন। যে দেশের মানুষ স্বাধীনতাপ্রেমীদের সম্মান দিতে শিখেনি, স্বাধীনতাপ্রেমীদের দুঃখ কষ্ট উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেনি, সেই দেশের স্বাধীনতা উপহাস হয়ে যায়! ভাবতেই কষ্ট হয়! 

আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে এমন বহু নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমীদেরকে ইতিহাসের পাতা থেকে বঞ্চিত করেছেন, যা খুবই দুঃখজনক।  

যখন দেখি কিছু মানুষ আমাদের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে, জাতীয় সংগীতকে উপহাস করে, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকদের অকথ‍্য ভাষায় গালাগাল দেয় তখনই ননীবালা দেবীদের মতো বিপ্লবীদের কথা মনে পরে! এত কষ্ট করলেন কাদের জন‍্য? সমাজের কথা ভেবে চুপ করেই তো থাকতে পারতেন! 'আদার ব‍্যাপারী, জাহাজের খবর' রাখার কী দরকার ছিল? কিন্তু উনি তা করেন নি। দেশের কথা ভেবেছিলেন! আমরা তাঁকে আমাদের লেখার মাধ্যমে হৃদয় থেকে সন্মান জানালাম। 


1/ দুকড়িবালা দেবী (২১ জুলাই, ১৮৮৭ ― ২৮ এপ্রিল, ১৯৭০) ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নারী বিপ্লবী। পরাধীন ভারতের তিনিই প্রথম সশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্ত নারী ছিলেন। 


কলমে - সোমা লাই 



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন