গর্ভাবস্থায় পুষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন হয়। এই সময় মায়ের সঠিক বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবারের সাথে সাথে গর্ভস্থ শিশুর পুষ্টির দিকেও খেয়াল রাখা একান্ত দরকার। গর্ভবতী নারীর পুষ্টির উপর নির্ভর করে গর্ভস্থ শিশুর পুষ্টি ও বিকাশ। তাই এই সময় দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় সঠিক পরিমানে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট থাকার পাশাপাশি যোগ করতে হয় ভিটামিন ও অন্যান্য উপযোগী খাদ্য সমূহ।একজন গর্ভবতীর স্বাভাবিক কারণেই খাবারের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশী হয়। প্রত্যেক গর্ভবতী নারীর উচিত নিজের বয়স, শারীরিক অবস্থা ও ওজন বিবেচনা করে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞর পরামর্শ অনুযায়ী খাবারের তালিকা প্রস্তুত করা এবং তা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ও পরিমাণ মত গ্রহন করা।
অনেকক্ষেত্রে
গর্ভবতী অবস্থার প্রথম কয়েকমাস সকাল বেলায় অতিরিক্ত দুর্বলতা, বমির লক্ষণ প্রকাশ পায়।কিছু
বিশেষ খাবার খেতে অনীহা জন্মায়। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে কিছু খাবার অবশ্যই পরিত্যাগ করা
উচিত। জোর করে কিছু খাওয়া এবং খাওয়ার পরে তা বমি করে দেওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক
হতে পারে।
আমেরিকান
কলেজ অফ অবেস্টেট্রিশিয়ানস্ অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্ট-এর মতে, প্রথম
তিন মাসে শিশু এবং মায়ের জন্য ফোলেট, আয়রন, ওমেগা
-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন বি ১২ এবং ক্যালসিয়াম জাতীয়
পুষ্টি প্রয়োজন।
প্রোটিনঃ প্রোটিন শরীরের গঠন ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে৷ গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রোটিনের চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি হয় ৷প্রোটিন গর্ভস্থ শিশুর শরীরের নতুন টিস্যু তৈরিতে সাহায্য করে। গর্ভবতী মাকে দৈনিক অন্তত ৬০ - ১০০ গ্রাম প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় তাই ডিম,মাছ, মাংস রাখা একান্ত জরুরী।এছাড়া নিয়ম করে প্রতিদিন একগ্লাস স্বল্প উষ্ণ গরম দুধ পান করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় trimester-এ প্রতিদিন যথাক্রমে ১, ৯ ও ৩১ গ্রাম অতিরিক্ত প্রোটিন প্রয়োজন হয়।সব ক্ষেত্রেই খাবার যেন ভালো করে রান্না করা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আধা সেদ্ধ বা আধা কাঁচা রান্না খাওয়া এই সময়ে উচিত নয়।
ক্যালসিয়াম: স্বাভাবিক অবস্থায় যতটুকু ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন, গর্ভাবস্থায় এর প্রয়োজন বেড়ে যায় প্রায় ২০০ মি.গ্রা. এর মতো। গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি, নিজের শরীরের দেখভাল এবং বুকের দুধ তৈরিতে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন।গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে শিশুর হাড় ও দাঁতের গঠনের জন্য অনেক ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়৷ যদিও গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় ক্যালসিয়ামের চাহিদা বেড়ে যায়, তবুও শেষের ৩ মাস চাহিদাটা সবচেয়েতে বেশি থাকে। WHO এর মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের দিনে ১০০০ মিলিগ্রাম এবং বিশেষ করে শেষ ৩ মাসের প্রতিদিন ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। দুধ, দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাছ, বাদাম, কমলালেবু, শুকনো ফল, সবুজ পাতাসহ শাক-সবজি, ফুলকপি ও তৈলবীজ খাবারে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম আছে৷
আয়রন: অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন মেয়েদের যথাযথ পরিমাণে আয়রন যুক্ত
খাদ্য ও আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণ করার
পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। এখানে আমরা দেখে নেবো তার কারণগুলি।অধিকাংশ মেয়ের
শরীরে এমনিতেই হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি থাকে। গর্ভাবস্থায় এই ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়ে
রক্তশূন্যতা হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। গর্ভকালীন শরীরে ক্যালরির সঙ্গে আয়রনের
চাহিদাও বৃদ্ধি পায় এবং এটি পূরণ না হলে এ সময় রক্তশূন্যতা হয়।
হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে আয়রন অনেক বেশি সহায়ক।
অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় শরীরের পরিবর্তনের পাশাপাশি গর্ভের শিশুর জন্য ভিটামিন ও
মিনারেল বেশিমাত্রায় প্রয়োজন হয় এবং এক্ষেত্রে আয়রন আবশ্যিক রূপেই দরকারি।
এইসময় আয়রনের ঘাটতি মেটাতে মায়েদের আয়রন সাপ্লিমেন্ট এবং এই জাতীয় খাবার
খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় যা মায়েদের ও শিশুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে সাধারণত দৈনিক ২৭ মিলিগ্রাম আয়রনের প্রয়োজন হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম তিন মাসের পর থেকে নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট অবশ্যই সেবন করা উচিত। সাধারণত প্রথম তিন মাসে মাসিক বন্ধ থাকার কারণে রক্তশূন্যতা ততটা প্রকট হয় না, কিন্তু পরবর্তীতে আয়রনের প্রয়োজন পড়ে।
আয়রন ট্যাবলেটের পাশাপাশি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার ও গ্রহণ করা
উচিত। কচুশাক, কাঁচকলা,
পেয়ারা, শিম, মটরশুঁটি, পালংশাক,
মটরডাল, বাঁধাকপি, মাংস ইত্যাদি। তবে আয়রনের কারণে অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্যের
সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া দরকার।
ফলিক অ্যাসিড: আয়রনের মতো ফলিক অ্যাসিডও অন্তঃস্বত্তা মেয়েদের জন্য
অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ফলিক অ্যাসিড হলো এক ধরনের ভিটামিন বি যা গর্ভস্থ শিশুর
মস্তিষ্ক ও স্নায়ুরজ্জু গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সন্তান ধারণের শুরুতেই
প্রতিদিন অন্তত ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করলে অনাগত শিশুর জন্মগত
ত্রুটির আশঙ্কা অনেকখানি হ্রাস পায়। অধিকাংশ জন্মগত ত্রুটি গর্ভধারণের প্রথম তিন
থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই দেখা দেয়। তাই গর্ভধারণের পরিকল্পনার শুরুতেই চিকিৎসকের
পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ শুরু করে দেওয়া ভালো। প্রথম তিন মাস
পর্যন্ত এটি চালিয়ে যাওয়া উচিত।
ফলিক অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাবারগুলি হলো গাঢ় সবুজ রঙের পাতাওলা
সবজি যেমন পালংশাক, মুলোশাক, সরিষাশাক,
ব্রকোলি, গাজর, মটরশুঁটি, বীজজাতীয় সবজি, পেঁপে, কমলালেবু, আঙুর, স্ট্রবেরি ইত্যাদি। তবে গর্ভকালীন সময়ে দৈনন্দিন খাদ্য থেকে
যথেষ্ট পরিমাণ ফোলেট পাওয়া নাও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক ফলিক অ্যাসিড
সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার পরামর্শ দেবেন।
ভিটামিন-A: হাড় ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহের গঠনের জন্য ভিটামিন-A প্রয়োজন৷ গর্ভস্থ শিশুর প্রতিটি
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বেড়ে ওঠা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কার্যকর থাকা,
দৃষ্টিশক্তি সঠিকভাবে কাজ করা এবং সার্বিকভাবে বেড়ে ওঠায়
‘ভিটামিন-A’ প্রয়োজন। গর্ভে থাকা শিশু যেহেতু সব
পুষ্টি মায়ের মাধ্যমেই পায়, তাই গর্ভবতী মায়ের শরীরে ভিটামিন-A র এই চাহিদা পূরণ হওয়া দরকার। WHO-এর মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৮০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-A
সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে খাবারের তালিকায় থাকা চাই
ডিম, গাজর,
আম, গাঢ় কমলা ও হলুদ রঙের ফল এবং গাঢ় সবুজ রঙের শাক-সবজি।
ভিটামিন B1, B2 ও নায়াসিন: ভিটামিন- B পরিবারভুক্ত ৬টি ভিটামিনের মধ্যে গর্ভাবস্থায় চাহিদা বেড়ে যায় ভিটামিন B1 বা থায়ামিন, B2 বা রিবোফ্লাবিন ও B3 বা নায়াসিনের। ভিটামিন- B পরিপাকতন্ত্রকে সচল রাখতে সাহায্য করে। শারীরিক ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি ত্বকের শুষ্কভাব কমিয়ে সতেজ রাখে।গর্ভাবস্থায় যেহেতু হরমোনের পরিবর্তনের কারণে পেট, কোমর, গলা-এসব জায়গার ত্বকের রং পরিবর্তন হয়, পেট স্ফিত হওয়ায় পেটের ত্বকে টান লাগে, তাই ভিটামিন- B এই সময় ত্বকের যত্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহন করে। ‘রেড মিট’, ডিম, কলা, বিনস, পালংশাক, কাঠবাদাম ও দুধে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন- B পাওয়া যায়।
ভিটামিন- Cঃ ভিটামিন- C এর সাহায্যে শরীর সহজেই শাকসবজি থেকে আয়রন শোষণ করে নিতে পারে,
রক্তশূন্যতার সম্ভাবনা কমায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বাড়ায়।এর জন্য ডাক্তার বা
পুষ্টিবিদেরা আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরপরই লেবু,
কমলা, বাতাবিলেবু বা আমলকী খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে
থাকেন।সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় পাওয়া যাচ্ছে ভ্রূণের মানসিক বৃদ্ধিতে ভিটামিন- C গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন- C ফলিক অ্যাসিডকে কার্যকর করে তোলার চালিকাশক্তি।গর্ভের শিশুর মাংসপেশি ও
হাড় গঠনের কোলাজেন প্রোটিনের প্রয়োজন। ভিটামিন-
C কোলাজেন তৈরিতেও সাহায্য করে।একজন গর্ভবতী
মায়ের দিনে ৮৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন-
C সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। ভিটামিন- C সমৃদ্ধ খাবার যেমন – আমলকী, পেয়ারা, কমলা লেবু, বাতাবি লেবু, সবুজ শাক-সবজি, টমেটো এবং আলু খেতে হবে৷ মনে রাখবেন বেশি তাপে
দীর্ঘক্ষণ রান্না করলে ভিটামিন নষ্ট
হয়ে যায়৷তাই ফল যথাসম্ভব কাঁচা এবং সব্জি অল্প তাপে পাত্র
ঢাকা দিয়ে রান্না করে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
আয়োডিনঃ গর্ভাবস্থায়
আয়োডিনের অভাব হলে গর্ভে থাকা সময় থেকে শুরু করে জন্মের ৩ মাস বয়স পর্যন্ত
শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়াও আয়োডিনের অভাবে গর্ভে থাকা শিশুর
মৃত্যুর সম্ভাবনাও থাকে। এটি থাইরয়েডকেও সুস্থ রাখে। তাই গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন
প্রায় ২০০ মিলিগ্রাম আয়োডিনযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে WHO। আয়োডিন
যুক্ত খাবারের মাঝে আছে আয়োডিনযুক্ত লবণ, সামুদ্রিক মাছ, পনির, টক দই, গরুর দুধ ইত্যাদি।
ভিটামিন- D: যদিও ভিটামিন D সরাসরি গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধিতে কোনো সাহায্য করেনা তবুও,মায়ের শরীরে
ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের সুষম
ব্যালেন্স শিশুর হাড় ও দাঁত তৈরিতে সাহায্য করে। সে কারণে গর্ভবতী অবস্থায় ডিম, দুধ, পনির, দই ও ছোট মাছ
খাওয়া বেশি পরিমাণে খুবই দরকার।
প্রত্যেক গর্ভবতী নারীর প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের মতানুযায়ী নির্দিষ্ট
পরিমানে ও নির্দিষ্ট মাত্রায় পুষ্টিকর খাদ্য ও বিভিন্ন ভিটামিন গ্রহন করা। নিজস্ব শারীরিক
অবস্থা ও প্রয়োজনের বিভিন্নতা অনুযায়ী খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা উচিত। তবেই গর্ভস্থ
শিশুর সঠিক বিকাশ সম্ভব।
_______________
কলমে -শ্বেতা মিত্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন