অনেকবছর আগের কথা। তখন
সবজায়গাতেই বেশ গাছপালা ছিল। আম কাঁঠালের বন, জামগাছ, পেয়ারাবাগান, ডাবগাছ, তালগাছ, বেলগাছ, কুলগাছ এসবে একদম জঙ্গল হয়ে থাকতো বলা চলে।
আর ছোটদের তেমনই আনন্দ! কালবৈশাখীর পর আমবাগানে ছুট লাগানো বা কালবৈশাখী না হলেও
রোজ ভোর ভোর আম কুড়োতে যাওয়া অথবা দুপুরবেলায় পেয়ারা পাড়তে যাওয়া, যাদের পেয়ারাগাছ তাদের বকুনি খেয়ে দৌড়
লাগানো সে ছিল এক অনাবিল আনন্দ।
এরকমই এক সময়ের ঘটনা। তখন
বর্ষাকাল, এ বাড়ি ও বাড়ি তালের
বড়ার ঘ্রাণে আমোদিত। গাছপালা অনেক থাকলেও প্রত্যেক পরিবারেই অনেকজন করে সদস্য, তাই তাল কুড়োতে গিয়ে বেশ রেষারেষি হতো।
এমনই একটি পরিবারের বড়ো ছেলে "বাবু", বারো
তেরো বছর বয়স। রোজ ভোর ভোর ছুটতো বন্ধুদের সাথে তালবাগানে, বন্ধু মানে তাকে নিয়ে চারজন। সে কী আনন্দ!
ভোর হতে না হতেই তাল কুড়োতে ছোটা, তারপর
তাল নিয়ে হইহই করতে করতে বাড়ি ফেরা। বাড়ি এসেই মাকে বিরক্ত করতে থাকা "ও
মা, তালের বড়া কখন বানাবে?" তালের বড়ার নাম শুনে ছোটো ছোটো ভাই বোনগুলোর
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো খুশিতে।
কিন্তু ক'দিন যাবৎ সেই ভোর থাকতে থাকতে গিয়েও খালি
হাতেই ফিরতে হয়। তাদের চাইতেও আগে গিয়ে অন্যরা কুড়িয়ে নিয়ে চলে আসে।
সারাদিনের পড়াশোনা খেলাধূলার মধ্যেও বাবু মনমরা হয়ে থাকে। কতোদিন তালের বড়া
খাওয়া হয়নি। পাশের বাড়ি থেকে কাল সন্ধ্যেবেলাতেই কেমন সুন্দর বড়াভাজার গন্ধ
আসছিল। বোনটা বলছিল "এই দাদা, তোরা
আর তাল পাস না কেন রে?" তারও তো খেতে ইচ্ছে করে
খুব! সেই কতোদিন আগে খেয়েছিল।
বিকালে খেলতে গিয়ে
বন্ধুদের কাছে ঘোষণা করল, "শোন কাল আমরা আরো ভোর ভোর
যাবো, বুঝলি?"
পল্টু বলল, "তুই যাওয়ার সময় আমার জানলায় আস্তে করে
একটা টোকা মারিস, আমি বেরিয়ে পড়বো।
খবদ্দার জোরে আওয়াজ করবি না,
বাবা
জানতে পারলে খুব মার মারবে।"
বাকি দু'জনের একজন কোন আত্মীয়র বাড়ি ঘুরতে গেছে।
আরেকজন বলল কাল আর যাবে না, পরশু যাবে। সেইমতো বাবু
বাড়ি এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পরিকল্পনায় শুয়ে পড়ল।
কিন্তু শুয়ে পড়লেই কী আর
তক্ষুনি ঘুম আসে! তার উপর আবার এমন উত্তেজনা! চিন্তায় চিন্তায় ঘুম তো দূরের কথা, ঘুম ঘুম ভাবই আসে না। যদি ঘুমিয়ে পড়ে ঠিক
সময়ে আর উঠতে না পারে, যদি একেবারে সকাল হয়ে
যায়, ওদিকে পল্টুও না ঘুমিয়ে
অপেক্ষা করে থাকবে — এই ভেবে ভেবে শেষ অবধি আর ঘুমই হলো না। এদিকে ক'টা বাজছে বুঝতেও পারছে না। অনেকক্ষণ এভাবে
শুয়ে থাকার পর অধৈর্য্য হয়ে সে উঠেই পড়লো। যা বাজছে বাজুক, আজ নাহয় একটু বেশি আগেই চলে যাবে। এমনিতেই
টেনশনে ঘুম আসছে না, তার চাইতে তাড়াতাড়ি
গিয়ে তালগুলো কুড়িয়ে এনে ঘুমোবে। কিন্তু তার আগে আবার পল্টুর জানলায় টোকা
মারতে হবে।
সেও মনে হয় ঘুমোয়নি! টোকা
দিয়েছে কী দেয়নি, বেরিয়ে এসেছে হতদন্ত
হয়ে। বাবুর হাসি পেয়ে গেলো।
"কীরে ঘুমোসনি নাকি?"
পল্টু বলল, "ধুর, এভাবে
ঘুম হয়! কখন তুই জানলায় জোরে আওয়াজ করে বসবি আর বাবাও জানতে পেরে আমায় একহাত
নেবে।"
সেসব নাহয় ঠিক আছে, কিন্তু সময়টা তো বোঝা যাচ্ছে না!
"অ্যাই পল্টু, ক'টা বাজে রে?"
"সে কীকরে বলব! তুই টোকা দিতেই বেরিয়ে এসেছি। ঘড়ি তো
দেখিনি।"
"তা নয়,
দেখে
তো ভোর হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।"
"তাতে কী?
ভোর
না হলে কী আবার বাড়ি ফিরে যাবি?
তারপর
ভোর হলে আবার আসবি? আমি ওসব করতে পারবো না।
গেলে এখন চল, নয়তো আমি গিয়ে ঘুমিয়ে
পড়ছি।"
"আচ্ছা চল চল, ভোর
না হলেই বা কী! দেখা তো যাচ্ছে মোটামুটি।"
তালবাগানে পৌঁছে বাবু আর
পল্টু তো আনন্দে আত্মহারা! 'শয়ে 'শয়ে তাল পড়ে আছে! অমনটা তারা আজ অবধি দেখেই
নি কখনও। দু'জনেই দু'দিকে ছুটেছে তাল কুড়োতে। মুশকিলটা হলো বেশি
তাল নিয়েও যেতে পারবে না, থলে আনেনি কোনো সাথে করে।
তাও যেক'টা পারে হাতে করেই নিয়ে
যাবে। উফফ, কতোদিন পর মন খুশি করে
তালের বড়া খাওয়া যাবে!
কিন্তু কী অদ্ভুত! যেটাতেই
হাত দেয়, কই তাল তো নয়! একখাবলা
মাটি! কী হলো ব্যাপারটা! দেখতে অবিকল তালের মতো, সেইরকম
আকার, সেইরকম রং, সেইরকম মসৃণ — কিন্তু তুলতে গেলেই মাটি। এমন
শান বাঁধানো উঠোনে এতো এতো মাটির ঢেলা আসবেই বা কোথা থেকে! তাও আবার নিপুণভাবে
তালের আকারের। কী সুন্দর একটা গন্ধও আসছে। তালের, না
না ঠিক তালের নয়। মা তালের বড়া ভাজার সময় যেমন গন্ধ বেরোয়, ঠিক সেরকম। অবাক বিস্ময়ে বাবু সবে পল্টুর
দিকে ঘুরে তাকাতে গেছে, দেখে পল্টু নিজেই ছুটে
আসছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ভয় পেয়ে গেছে।
"এই বাবু,
শিগগির
চল এখান থেকে। আমার খুব ভয় করছে। চল চল, শিগগির
চল।"
ভয় তো বাবুরও করছে। আর
দাঁড়ায় ওখানে! দিয়েছে দু'জনে প্রাণপণে ছুট।
এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন
কেউই আর তাল কুড়োতে যায়নি। তারপর থেকে ভোরের আলো ফুটলে তবেই যেতো, আর চারজনে একসাথেই যেতো। যতো ভোরেই যাক না
কেন, মাটির ঢেলা কিন্তু আর কখনও
দেখতে পায়নি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন উঠোন। সেই দিনটার কথা ভাবলে আজও বাবু আর পল্টু
ধন্দে পড়ে যায় যে ওগুলো কোথা থেকে এলো তাহলে! শুধু একরাতের জন্য! কীভাবেই বা
এলো! সেসব উত্তর না পাওয়াই থেকে গেলো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন