এক যে ছিল রাজা এবং ছিল এক আশ্চর্য মন্দির!
ইতিহাস পড়তে অনেকেরই ভালো লাগে না। আমারও খুব বাজে লাগত। মনে হত, ইতিহাসে আছে তা কী? শুধুমাত্র মারকাট, গুচ্ছের সাল-তারিখ! এত বাপু মনে থাকে না! পরীক্ষার নম্বরও জ্বলজ্বল করে সেই ভালো না লাগার সুন্দর করে প্রমাণ দিয়ে চলছে!পরে সেই ধারণার পরিবর্তন হয়। পরীক্ষার জন্য পড়া ইতিহাস আর ইতিহাসে প্রেম দুটো আলাদা জিনিস। ইতিহাস পড়লে এমন অনেক ঘটনা জানা যায় যা সত্যিই রোমাঞ্চিত করে!
একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা জনের নানা মত দেখা যায়। তাদের মতামত পড়তে পড়তে মনে হয়, আচ্ছা সত্যি ঘটনা তবে কী? যদি টাইম মেশিন থাকত! এত তর্কের দরকার হত না! দেখে এসে বলে দিলেই হত! সচক্ষে প্রমাণ!
অবশ্য একদিন সেইসব ঘটে যাওয়া ঘটনারও সচক্ষে প্রমাণ ছিল। কালের নিয়মে অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিছু জিনিসের অবশিষ্ট অংশ আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বলছে, বল তো তোমরা আমরা তখন কেমন দেখতে ছিলাম? কী ছিল আমাদের গুরুত্ব?
আজ আমি যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার মধ্যে থেকে একটি ঘটনা বলব, আমাদের কাশ্মীরের কারকোটা বংশের মহারাজ সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভব্য সূর্য মন্দির!
কাশ্মীর ইতিহাস বলতে গেলে আমরা মুঘলদের সাথে জুড়ে দিই, কিন্তু তা তো নয়, কাশ্মীরে ইতিহাস আরও প্রাচীন। এখানে এক কালে সমৃদ্ধ হিন্দু সাম্রাজ্য ছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম 'কারকোটা বংশ'।
সম্রাট ললিতাদিত্য ও তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার (চিত্র সৌজন্য : উইকিপিডিয়া)
জন্ম : কাশ্মীর অঞ্চলে, কারকোটা বংশে।
পিতা : দুর্লভক - প্রতাপাদিত্য -II (Durlabhaka-Pratapaditya II )
মাতা : নরেন্দ্রপ্রভা ( Narendraprabha )
৩ ভাইদের মধ্যে ললিতাদিত্য সবচেয়ে ছোট ছিলেন।
রাজত্ব কাল : তিনি ৩৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন ( ৭২৪ থেকে ৭৬১ CE. পযর্ন্ত )।
রাজ্য বিস্তার : উত্তরে তীব্বত থেকে দক্ষিণে দ্বারকা এবং পশ্চিমে ইরান থেকে পূর্বে ওড়িশা, বাংলার খাঁড়ি পযর্ন্ত বিস্তৃত ছিল। এমনকি তিনি চীন পযর্ন্তও সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
চিত্র সৌজন্য : ইন্টারনেট
তিনি শ্রীনগর থেকে রাজধানীর অন্য জায়গায় স্থানান্তর করেন। রাজা ললিতাদিত্য সেই রাজধানী শহরের নাম রেখেছিলেন : 'পরিহাসপুর'। অর্থাৎ 'হাস্যময় শহর'। স্থানীয় লোক 'কানি শহর ' নামে জানে, অর্থাৎ 'পাথরময় শহর' ( বতর্মানে সেই স্থানে প্রচুর পাথর দেখতে পাওয়া যায় )।
রাজসভায় গুণীজনের সমাহার : কলহনের মতে, ললিতাদিত্য বিভিন্ন দেশ থেকে জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিজ রাজসভায় এনে অলংকৃত করেছিলেন, ঠিক যেমন "বাতাস পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুলের সুবাস সংগ্রহ করে"।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তুহখারা থেকে, তিনি চাঙ্কুনাকে (Caṇkuṇa) নিয়ে আসেন, যাঁর অনেক গুণ ছিল।চাঙ্কুনার স্ত্রীও খুবই দয়াবতী ছিলেন। তাঁর নাম ঈশানদেবী। তিনি একটি জল-কূপ নির্মাণ করেছিলেন যার বিশুদ্ধ জল অসুস্থদের নিরাময়ে সাহায্য করেছিল।
সৈন্যবাহিনীতে : তাঁর সৈন্যবাহিনী খুবই দক্ষ ও শক্তিশালী ছিল। তাঁর সৈন্যবাহিনীতে চীনা সৈনিকও ছিল।
কাশ্মীরের প্রতি নজর : সুন্দর ও সম্পন্ন স্থানের জন্য আজও কাশ্মীর বিখ্যাত।
সেইকালেও অনেক বহিরাগত মানুষের কাশ্মীরের উপর নজর ছিল। তাছাড়াও মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ
করতে হলে কাশ্মীর উপযুক্ত প্রবেশ পথ।
আরব ও তুর্কিদের সাথে যুদ্ধ : ললিতাদিত্যকে আরব ও তুর্কিদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
তিনি তাদের যুদ্ধে হারিয়েছিলেন। জুনাইদ বলে একজনকে লজ্জা জনক ভাবে পরাজিত
করেছিলেন। বলা হয়, তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন বাইরে থেকে কেউ কাশ্মীর দখল করতে পারে নি।
বাপ্পা রাওয়ালের সাথে বন্ধুত্ব :
অনেকে বলেন,
বাপ্পা রাওয়াল ( মেওয়ারের প্রতিষ্ঠাতা ) ও ললিতাদিত্য খুব
ভালো বন্ধু ছিলেন। তাঁরা একসাথে অনেক যুদ্ধ লড়েছিলেন এবং জিতেছিলেন। কিছু
ঐতিহাসিকদের মতে, বাপ্পা রাওয়াল রাজা ললিতাদিত্যের সামন্ত হিসাবে কাজ করতেন।
সামাজিক কাজ : মহারাজ ললিতাদিত্য একজন কুশল যোদ্ধা হওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞান, কলা ও শিল্প-স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি অনেক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বহু শহর, মন্দির, বৌদ্ধ স্তুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তিনি 'জলসেচ'-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। বিতস্তা নদীর জল সেচের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। এই জন্য তিনি জলচক্র ( water wheels ) ব্যবহার করেছিলেন। চক্রধারাকে চিহ্নিত করা হয়েছে বিজবেহারার (Bijbehara ) কাছে আধুনিক তসকদার উদর মালভূমিতে।
কলহন বলেছেন যে, ললিতাদিত্য পারিহাসপুরে সহস্র-ভক্ত উৎসব শুরু করেছিলেন। এই উৎসবের সময়, তিনি দক্ষিণা (দান) এর পাশে ১০০,০০১টি খাবারের থালা বিতরণ করেছিলেন।
১১ শতকের পারস্য লেখক আল-বিরুনি বলেছেন যে, কাশ্মীরের জনগণ চৈত্র মাসের দ্বিতীয় দিনে একটি বার্ষিক উৎসবের আয়োজন করেছিল। কাশ্মীরি জনগণ এটিকে যুদ্ধে বিজয় লাভ করার জন্য উৎযাপন করে। তারা বলে, এই দিনই তাদের অতীতের মহান রাজা মুত্তাই তুর্কিদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিল। সেই বিজয় দিনটি মনে রাখার জন্যই উৎসবের আয়োজন।
এই 'মুত্তাই'কে
"মুক্তাপীড়" অর্থাৎ 'ললিতাদিত্য' বলে চিহ্নিত করা যায়। আল-বিরুনির মতে,
কাশ্মীরিরা দাবি করেছিল যে মুত্তাই এবং সেই সাথে অন্যান্য
কাশ্মীরি রাজারা "পুরো বিশ্ব শাসন করেছিলেন"।
পরবর্তীকালে আল-বিরুনি এই দাবিগুলোকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে
দিয়েছেন। তাঁর মতে, অনেক কিছু অসঙ্গতি আছে।
'মুত্তাই' ও 'মুক্তাপীড়' একই ব্যক্তি কী না সে তর্কের বিষয়!
তবে এটা সত্যি যে ললিতাদিত্য তুর্কিদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেছিলেন।
চিরবিদায় : মহারাজ ললিতাদিত্যের শেষ পরিণতিও রহস্যে ঘেরা! তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব প্রচলিত আছে, সঠিকভাবে কেউ কিছু আজও বলতে পারে নি। তবে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, তাঁর মৃত্যু উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধ অভিযানের সময় ঘটেছিল।
একটি সংস্করণ অনুসারে তিনি "আর্যঙ্কা" নামক একটি দেশে অতিরিক্ত তুষারপাতের মাধ্যমে মারা গিয়েছিলেন, যা সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি।
আরেকটি সংস্করণে বলা হয়েছে যে, তিনি উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধ অভিযানের সময় কঠিন পার্বত্য পথের সম্মুখীন হন। সেই পথ অতিক্রম করার সময় তিনি তাঁর সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। সেই দুঃখে তিনি না কী আত্মহত্যা করেন! বলা বাহুল্য এই মত সত্যিই নয়। তাঁর জীবন সম্পর্কে জানলে মনে হবে একজন সাহসী, পরাক্রমশালী রাজা কঠিন থেকে কঠিনতম পরিস্থিতিতেও লড়াই করে মৃত্যু বরণ করবে। সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্ন হওয়ার কষ্টে ভয় পেয়ে আত্মহত্যা কিছুইতে করবে না।
কিছু সংস্করণে বলা হয়েছে যে, তিনি তার সেনাবাহিনীর সাথে উত্তরে অমরদের জগতে অবসর নিয়েছিলেন।
যাইহোক, এই সমস্ত বিবরণ থেকে উপসংহারে আসা যেতে পারে যে মহারাজ ললিতাদিত্য, ( তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার দেখে অনেকেই তাঁকে 'কাশ্মীরের আলেকজান্ডার' বলেন ) তাঁর উত্তর অঞ্চলে বিজয়ী অভিযানের সময় মারা গিয়েছিলেন।
মহারাজ ললিতাদিত্য দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর শাসন করেছিলেন। অনেক নীতি নিয়ম তৈরি করেছিলেন। সেইসব নীতি দীর্ঘকাল ধরে কাশ্মীর প্রশাসনকে প্রভাবিত করেছিল। এইভাবেই কাশ্মীরের অত্যন্ত খ্যাতিমান রাজার একটি রহস্যময় পরিণতি হয়েছিল, যা আজও মানুষকে রোমাঞ্চিত করে।
সম্রাট ললিতাদিত্যের অন্যতম শিল্প কীর্তি - মার্তন্ড সূর্য মন্দির (চিত্র সৌজন্য : উকিপিডিয়া)
৫ টি পুরাতন সূর্য মন্দিরের মধ্যে ভারতে মোট ৪ টি সূর্য মন্দির ( ১ টি বতর্মান পাকিস্তানে ) আছে। তারমধ্যে সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহৎ সূর্যমন্দির হল মার্তন্ড ( मार्तंड ) সূর্য মন্দির। বর্তমানে যেটি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে।
মন্দিরের অবস্থান : জম্মু - কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলা।
তৈরি : এটি একটি 'ক্রেবা' ভূমির উপর তৈরি করা হয়েছিল।
মন্দিরের প্রতীতি পুনরুদ্ধার, " লেটারস ফ্রম ইন্ডিয়া অ্যান্ড কাশ্মীরঃ জে.ডুগুইডের লেখা,১৮৭০-১৮৭৩ ( চিত্র সৌজন্যঃ উইকিপিডিয়া)
সম্রাট ললিতাদিত্য সূর্য দেবের উপাসক ছিলেন। পূজ্য দেবতাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার জন্য
তিনি এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।
নির্মাণ : এত বড় মন্দির নির্মাণের জন্য এত বড় বড় পাথর কী করে এল এই
নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক চলে। কেউ কেউ মনে করেন, তখন পাশ দিয়ে কোনো নদী বয়ে যেত। সেই নদী পথে নৌকার মাধ্যমে
পাথর এনে এটি তৈরি করা হয়েছিল।
গর্ভগৃহ : বলা হয় গর্ভগৃহে এমন একটি যন্ত্র ছিল যার মধ্য দিয়ে সারাদিন
সূর্যের আলো সূর্য দেবের মূর্তির উপর পড়ত।
মন্দিরের দেওয়াল : দেওয়ালে অসংখ্য মৃর্তি, চিত্র খোঁদাই করা আছে।
চিত্র সূত্র : উকিপিডিয়া
শিল্পশৈলী : কান্ধার, গুপ্ত ও চীনি শিল্প রীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়।
লোকবিশ্বাস : লোকেরা বলে এই মন্দির পৌরাণিক কালে তৈরি করা হয়েছিল। এটি
পান্ডবরা তৈরি করেছিল। পান্ডবদের ঘর। ভীম এই মন্দির তৈরির জন্য পাথর বাহুবলে এনে
তৈরি করেছিল, তারজন্যই
এই মন্দির এত বিশাল হয়েছে।
ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার কারণ : পরবর্তীকালে শাহ্ মীর কাশ্মীরে ইসলাম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। শাহ্ মীরের নাম
অনুসারে এই বংশের
নাম হয় 'শাহ্ মীর'। এই
বংশেরই একজন ক্রুড় রাজা 'সিকন্দর বুতশিকন ' (Sikandar Butshikan) এই ভব্য মন্দিরটি ধ্বংস করেছিল। সে নিজেকে
মূর্তি ভঙ্গকারী' ('idol-breaker'
) বলে পরিচয় দিত।
চিত্র সূত্র : উইকিপিডিয়া
এই মন্দির ছাড়াও আরও অন্য ধর্মের বহু মন্দির,
স্তুপধ্বংস করেছিল। অমুসলিমদের উপর নির্মম অত্যাচার
করতেন।
কিছু ঐতিহাসিকদের মতে সিকন্দর মোটেই তেমন ক্রুড় ছিল না।
মন্দির,
মূর্তি অন্য কারণে ধ্বংস হয়েছিল। তবে মনে রাখতে হবে,
'বুতশিকন' শব্দের অর্থই হল - মূর্তিভঙ্গকারী বা মূর্তি পূজার ঘোর বিরোধী। সিকন্দর নিজেই এই উপাধি গ্রহণ করেছিল।
আবার কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, সিকন্দর, প্রথমে মহারাজা ললিতাদিত্যের প্রতিষ্ঠিত মার্তন্ড সূর্য
মন্দিরটিকে ভেঙেছিল, তারপর মন্দিরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। কথিত আছে, মন্দিরের ভেতর কাঠ ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই আগুন
দুবছর পযর্ন্ত জ্বলেছিল।
ঐতিহাসিক দলিলঃ
[ I ] কলহনের লেখা 'রাজতরঙ্গিনী'।
[
II ] 'ফতেহ্ নামা সিন্ধ'।
[
III ] আলবেরুনি'র 'তারিখ-ই-হিন্দ'।
[
IV ] চীনের 'তাং'' রাজ্য' ( Tang Dynasty ) - এর সময়কার লেখা বই ' ঝিং তাং সু ' ( Xing Tanh Shu' )।
-
এইসব গ্রন্থে মহারাজা ললিতাদিত্য ও তাঁর কার্যকলাপের কথা
আছে।
কলমে - সো মা লা ই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন