“ আজ এত দেরী হল যে? কোথায় চড়ে বেড়াচ্ছিলি শুনি?”-দরজা খুলে দাঁড়িয়েই অসিত বিশ্রীভাবে চেঁচিয়ে উঠল।
“কোথায়
আবার বেড়াব? স্মিতা বৌদির বাড়িতে কাজ ছিল। আজ লোকজন এসেছিল।বেশি রান্না করতে হল।বাসও
পেলাম দেরিতে।তাই দেরী হল।”
শম্পা
পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ক্ষীণ স্বরে বলল।সারাদিনে সাত বাড়ির হাড়ভাঙ্গা খাটুনির
ক্লান্তি তার কথা বলার শক্তিও নিঃশেষ করে দেয়।
“তাই
দেরী হল নাকি কোথাও ফুর্তি করা হচ্ছিল? বলি বাড়িতে রান্না করবে কে? খাবো না আমরা?”
কর্কশ স্বরে অসিত চিৎকার করে ওঠে।
শম্পা
তাকিয়ে দেখে, মদে চুর ক্ষয়াটে চেহারার অসিত নিজের পায়ে সোজাভাবে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটা
পর্যন্ত নেই। অথচ গলায় কি জোর। মনে মনে ভাবে এত গলায় জোর আসে কোত্থেকে কে জানে! বিরক্তি
চাপতে না পেরে বলে ফেলে – “নিজে তো সারাদিন ঘরে বসেই থাকো, খাবারটুকু করতে পারো তো?
আর কত করব আমি?”
“কি?
আবার মুখে মুখে চোপা? আমি রান্না করব?” টলতে টলতে এগিয়ে এসে আচমকা সজোরে মুঠো পাকানো
হাত নেমে আসে শম্পার নাক বরাবর। আঘাতের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে মাটিতে। চিৎকারের আওয়াজে
ঘরের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এসেছে বছর চারেকের মেয়েটা। মাকে পড়ে যেতে দেখে ভয়ে কেঁদে ফেলে।
দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে মাকে।
“মাকে
মেরো না বাবা। মার লাগবে।“
চারিদিক
অন্ধকার লাগা চোখে অতিকষ্টে শম্পা মেয়েকে ধরে উঠে বসার চেষ্টা করে। ঠোঁটে তখন রক্তের
লবণাক্ত স্বাদ। নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে নামছে। চোখ শুকনো।
বছর
তিন আগে অসিতের কারখানা থেকে ছাঁটাই হয়েছিল। প্রথম কয়েকমাস কাজের জন্য চেষ্টা করত।
বাড়িতে তখন এক বছরের শিশু সমেত শম্পা। যেদিন মেয়ের মুখে ভাতটুকুও তুলে দিতে না পেরে
পাশের বাড়ির নমিতার কাছে হাত পাতল, সেদিন নমিতাই বুদ্ধি দিল রান্নার কাজ নেওয়ার। নমিতার
চেনাশোনা থেকেই শম্পার লোকের বাড়ির রাঁধুনি জীবনের সূত্রপাত। কয়েক বাড়িতে বেশী টাকার
জন্য অন্যান্য কাজও করে। শম্পার রোজগার শুরু হতেই অসিতের মদের সাথে সাথে বিনা খাটুনিতে
আরামের নেশাও লেগে গেল। সেই চলছে। সাথে রোজকার মারধোর, গালিগালাজ।মাঝে মাঝে শম্পার
নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা জাগে। এত কষ্ট আর যেন সহ্য হয়না। কিন্তু মেয়ের দিকে তাকালে
থেমে যায়।
নমিতা
মাঝে মাঝে বলে - “কেন পড়ে আছিস এখানে? নিজে খেটে খাস যখন মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে পারিস
তো।তোরই খাবে তোরই পরবে, আবার তোকেই ধরে ধরে মারবে। এ কি কথা?”
শম্পাকে
বোঝাতে পারেনা, কোথাও যাওয়ার নেই ওর। মা-বাবা ছোটবেলাতেই মারা গেছে। মামার কাছে কোনো
রকমে মানুষ। চার ক্লাসের বিদ্যা নিয়ে বেশী কিছু করতে পারা যায়না। মামা-মামী দায়মুক্ত
হবার জন্য আঠেরো না পেরোতেই বিয়ে দিয়ে দিল। সেই থেকে চলছে কষ্টের জীবন।ছ’বছরের বিয়ের
জীবনের প্রতিটি দিন এক অসহনীয় যন্ত্রণার কথা। কিন্তু কাকে বলবে? কে শুনবে? তবু তো মাথার
ওপর একটা ছাদ আছে। স্বামী আছে বলে একটা সুরক্ষা আছে। কেউ নোংরা নজরে তাকায় না। একা
হয়ে গেলেই তো শিয়াল- শকুনে ছিঁড়ে খাবে। মেয়েদের একা বেঁচে থাকাটা এখনও অত সহজ নয়।
মাত্র
কয়েকমাস আগে কাজে ঢোকা রায়বাড়ির স্মিতা বৌদিকে বলত কষ্টের কথা।বৌদি সান্তনাও দিত অনেক।ভরসাও
যোগাত। কিন্তু গতমাসে হঠাৎ বৌদির গালেও কালশিটের দাগ দেখার পর থেকে নিজের কষ্টের কথা
বলা বন্ধ করে দিয়েছে। বৌদিও নিজে থেকে কিছু জানতে চায় না। শম্পা দেখেছে ইদানিং বৌদিও
সারাক্ষন কি একটা চিন্তা, কি একটা ভয় , কি যেন একটা কষ্টে ডুবে থাকে।শম্পা ভেবে পায়না
বৌদি তো পড়াশোনা জানা বড় ঘরের মেয়ে তাহলেও কেন চুপ থাকে!
পরেরদিন
মারের যন্ত্রণা সমেত জ্বর গায়ে কাজে বেরোতে হয় শম্পাকে।সবাই দেখে মারের দাগ, কেউ আহা
করে, কেউ শম্পার বরকে দুটো অভিসম্পাত করে দায়িত্ব শেষ করে।কিন্তু কেউ বলেনা কাজ করতে
হবে না। যেন এটা নিত্যদিনের
ব্যপার। তাই বলে কাজে ফাঁকি দেওয়া চলবে না।
বিকালে
স্মিতা বৌদির বাড়ি গিয়ে আর ধকল সহ্য করতে না পেরে মাথা ঘুরে বসে পড়ে।বৌদি তাড়াতাড়ি
এগিয়ে এসে ধরে না ফেললে শম্পা হয়ত পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেত। শম্পার মুখের দিকে তাকিয়ে বৌদি
চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করল “একি হয়েছে তোর? কি অবস্থা করেছে রে!অসিত কি মানুষ নয় নাকি?ছি
ছি! এইভাবে কেউ মারে! তুই সহ্য করিস কি করে শম্পা?”
শম্পা
মাথা তুলে অতি কষ্টে ক্ষীণ হেসে কোনমতে বলল – “তুমিও তো সহ্য করো বৌদি।তুমি তো বুঝবে
কেন, কিজন্য সহ্য করি আমি।“
স্মিতার
হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে শম্পা ধীরে ধীরে বলে,” বৌদি আমরা মেয়েরা বোধহয় সবাই এক জায়গায়
সমান। সে তোমাদের ঘরের মেয়েই বলো আর আমাদের বাড়ির মেয়েই বলো।সবাই মেনে নিতেই বাধ্য।নাহলে
তুমি কেন আমার মত অবস্থা সহ্য করো?আমাদের দুজনেরই জীবন পাশাপাশি সমান্তরালে চলে। মাঝে
শুধু অবস্থার ফারাক।তুমি বড় ঘরের বউ। আমি গরীবের।আর কিছুই পার্থক্য নেই। ”
স্মিতা
নিশ্চুপ থেকে শম্পার কাছ থেকে উঠে ঘরে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে আসে। হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,
“ আজ বাড়ি যা। কাজ করতে হবেনা। দু’দিন বিশ্রাম নে। কাজে যাস না।একটু ডাক্তার দেখিয়ে
নিস।“
শম্পা
চোখের জল মুছে উঠে পড়ে। মুখ ঘুরিয়ে দেখে বৌদি অন্যঘরে বিছানায় মুখ ঢেকে শুয়ে আছে। কান্নার
দমকে ফুলে ওঠা শরীর জানান দিচ্ছে অব্যক্ত যন্ত্রণার।
দু’দিনের
বদলে চারদিন শম্পা কাজে যেতে পারল না। জ্বরের ঘোরেও ঘরে অসিতের নেশা জড়ানো খিস্তি খেউর
শুনে শুনে শম্পার চোয়ালও যেন শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। নিজেকে আর যেন মানুষ মনে হয়না আজকাল।
রক্ত মাংসের মানুষ হলে এত অপমান এত অত্যাচারের পরেও কি এখানে থাকতে পারত? নিজেকেই প্রশ্ন
করে সে। মনে মনে নিজেকে মানুষ করার ইচ্ছার জাল বুনতে চায় সে।
চারদিন
পর স্মিতা বৌদির বাড়ি কাজে গিয়ে দরজায় বড় একটা তালা ঝুলতে দেখে অবাক হয়ে যায়।কি করবে
বুঝতে না পেরে পাশের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করে। পাশের বাড়ির মাসীমার থেকে জানতে পারে স্মিতা
বৌদি দু’দিন হল নিজের মায়ের কাছে চলে গেছেন। যাওয়ার আগে মাসীমাকে বলে গেছে শম্পাকে
দেখা করতে যেতে।
শম্পা
ঠিকানা বুঝে নিয়ে স্মিতা বৌদির মায়ের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। বেশী দূর নয়। বাসে করে
গেলে কুড়ি মিনিটের রাস্তা।এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে বাসে ওঠে শম্পা। কেন জানি মনে কু ডাক দিতে থাকে।কেন জানি মনে হয়
খুব খারাপ কিছু হয়েছে। খুঁজে খুঁজে ঠিক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দরজার কড়াতে আওয়াজ তোলে
শম্পা।
দরজা
খোলেন শান্ত নিরীহ চেহারার এক বৃদ্ধ। দেখে নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায় শম্পার। হাঁ
করে তাকিয়ে থাকে, বলতে ভুলে যায় কেন এসেছে। বৃদ্ধই কথা বলেন,” তুমি শম্পা বোধহয়, তাই
না?”
শম্পা
নিজের নাম উচ্চারণে হুঁশ ফিরে পায়। বলে,” হ্যাঁ। স্মিতা বৌদি দেখা করতে বলেছিলেন।“
বৃদ্ধ ভেতরে ডাকেন, “ এসো এসো।বোসো। আমি স্মিতাকে
ডেকে দিচ্ছি।“
একটু
পড়েই স্মিতা বৌদি এসে পড়ে। হাসিমুখের স্মিতা বৌদিকে দেখে শম্পার মনে তবু একটু ভরসা
আসে। বৌদি একগ্লাস ঠাণ্ডা সরবত নিয়ে এসে সামনে রাখে। বলে,” তোর সাথে খুব দরকার বুঝলি।
তাই এখানে আসতে বলেছিলাম।“
শম্পা
চুপ করে অপেক্ষা করে পরের কথা শোনার। অজানা ভয়ে বুক দুরদুর করে ওঠে। বৌদি ওর মুখের
দিকে তাকিয়ে কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন হয়ত। তাই শম্পার হাতটা চেপে ধরে বলেন,” দূর পাগলি।
ভয়ের কি আছে। এখন আর ভয় নেই রে। সেদিন তুই চলে যাওয়ার পর আমি অনেক ভেবেছি জানিস। দু’দিন
লাগাতার শুধুই ভেবেছি তোর বলা কথাগুলো। সত্যিই তো কেন সহ্য করছি এসব। কেন নিজেকে বাঁচানোর
চেষ্টা করিনা আমি। কেন এত অসহায়তা আমাদের? কোথায় বাঁধা আসে?”
“ভেবে
কি বুঝলে বৌদি? আমরা একা বাঁচতে পারিনা? এই সমাজে আমাদের একার বাঁচার সাহস নেই? তাই
না?”
“নারে
শম্পা। ভেবে দেখলাম আমরা নিজেদের ছাড়া অন্য সবাইকে নিয়ে বড় বেশী ভাবি। নিজেদের জীবনের
থেকে ঠুনকো মান সম্মানের কথা ভাবি। কিছু করার আগেই ভয় পাই এই ভেবে যে, ‘কি জানি পারব
তো?’ । কখনও ভাবি না যে চেষ্টা করলে কিছু না কিছু একটা রাস্তা ঠিক পেয়েই যাব। হয়ত একটু
কঠিন হবে সে রাস্তা, কিন্তু তাতে সম্মান থাকবে, শান্তি থাকবে।“
“তাহলে
কি করবে তুমি বৌদি?”
“আমি
নয় শম্পা। আমরা। তুই, আমি আর আমাদের মত আরও অনেক মেয়েরা। আমি ভেবে রেখেছি। সেই ভেবেই
আমি আমার বাবা মা ও বাড়ির সবার সাথে কথাও বলেছি।আমার বাড়ির লোকেরাও আমার পাশে থাকবেন।
অসুবিধা যা আসবে সবাই মিলেমিশে কাটিয়ে যাব।“
“কি
করবে ঠিক করেছ বৌদি?” শুকনো মুখে প্রশ্ন করে শম্পা।
“আর
মার খাবো নারে। তোকেও খেতে
দেব
না। আমি ঠিক একটা চাকরি পেয়ে যাব। তারসাথে একটা খাবারের একটা ব্যবসাও শুরু করব। তুই
মেয়েকে নিয়ে চলে আয় এখানে। এখানেই থাকবি আমার কাছে।এখন অনেক কাজ করতে হবে আমাদের। প্রথম
কয়েকমাস একটু অসুবিধা হবে হয়ত। কিন্তু আমরা ঠিক পারব দেখিস।কিরে পারবি তো পরিশ্রম করতে?”
হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে স্মিতা।
পরম
আগ্রহে শম্পা স্মিতার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে। বলে ক’দিন ধরে আমিও এটাই ভাবছিলাম বৌদি। শুধু
সাহস পাচ্ছিলাম না লড়াইটা শুরু করার।তুমি বাঁচালে বৌদি। বাঁচতে চাই বৌদি। মেয়েটাকে
একটা ভালো জীবন দিতে চাই। একটু শান্তি। একটু সম্মান পেতে চাই শুধু। তুমি যত কাজ বলবে
করব বৌদি। শুধু একটি মানুষের মত বাঁচতে চাই।“
স্মিতা
শম্পার হাতে অল্প চাপ দিয়ে ভরসা জোগায়, “ যা বাড়ি গিয়ে মেয়ে আর দরকারি সব জিনিস নিয়ে
চলে আয়।কাল থেকে আমাদের লড়াই শুরু।থানা পুলিশ কোর্ট থেকে শুরু করে নিজেদের ভবিষ্যৎ
- সব নিয়ে আমাদের এখন অনেক কাজ। অনেক বড় লড়াই, যেটা কোনোমতেই হারা চলবে না আমাদের।
মানুষের মতই বাঁচবো এবার আমরা।“
বিকাল
ফুরিয়ে সূর্য অস্তাচলে তখন।স্মিতাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শম্পা রাস্তায় তখন । পড়ন্ত রোদের
লালচে আভা তাঁর মুখে চোখে নতুন রং লাগিয়ে দেয়। মনের মধ্যে অনেক স্বপ্ন অনেক ইচ্ছা বুদবুদ
হয়ে উঠতে থাকে। নিজেকে মানুষ মনে হতে থাকে।মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছায়
মগ্ন শম্পা তাড়াতাড়ি নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়। ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন