বর্তমানের ব্যস্ততার যুগে এত ঝক্কি পুষিয়ে পিঠে বানানোর সুযোগ বেশিরভাগ মহিলাদের কাছেই নেই। কিন্তু তাতেও ভাটা পড়েনি এই উৎসব পালনে। তা সে বাজার থেকে কিনে আনা পিঠেই হোক বা চালের বদলে ময়দা দিয়ে বানানো পাটিসাপটাই হোক। সবই সমানভাবে গ্রহণীয়। তবে আজ বঙ্গদেশের কিছু হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যমণ্ডিত পিঠের রন্ধনপ্রনালী জানাবো। যাতে কালের চক্রে এই সমস্ত শিল্প হারিয়ে না যায়। যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও এই স্বাদের বিষয়ে অবহিত থাকে। কেউ সুযোগ ও সুবিধা পেলে হয়ত বা বানিয়ে ফেলতেও পারেন আমাদের ঠাকুমা-দিদিমার হাতের তৈরি অত্যন্ত সুস্বাদু ও শিল্পগুণে ভরপুর সেই সব পিঠে।আজ সেই কথা মনে রেখেই আমার এই প্রচেষ্টা।
মুগ পাকন পিঠা
উপকরণঃ
- চালের গুঁড়ো -১০০
গ্রাম।
- ময়দা - ২ ৫০ গ্রাম।
- বেকিং পাউডার - ১/৪ চা চামচ।
- মুগডাল ভাজা - ১০০ গ্রাম।
- চিনি গুঁড়ো – ৫০
গ্রাম।
- দই – ৫০ গ্রাম।
- ঘি -১০০ মিলি
চিনির রস প্রনালীঃ
প্রথমে ২ কাপ
চিনির সাথে ১ কাপ জল দিয়ে ঘন সিরা বা রস তৈরি করে নিতে হবে।
পিঠে প্রস্তুত প্রণালীঃ
- মুগডাল অল্প জল দিয়ে সিদ্ধ
করে মিহি করে বেটে নিতে হবে।
- পাত্রে আন্দাজ
মত জল বসিয়ে গরম করতে হবে। অল্প নুন
দিয়ে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে কাই করে নিতে হবে।
- তারপর কাইয়ের সাথে মুগডাল
বাটা দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে বাকি সব উপকরণ একসাথে দিয়ে ভাল করে মাখতে হবে।
- এই মণ্ডের সাথে অল্প অল্প করে ময়দা মিশিয়ে মিহি নরম মণ্ড তৈরি করতে হবে।
- আধা সেমি পুরু করে বেলে নিতে হবে। কুকি কাটার দিয়ে বা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী আকৃতি দিয়ে কেটে নিতে হবে।
- মাঝারি আঁচে ঘি গরম হলে মুচমুচে করে ভেজে তুলে নিতে হবে।
- চিনির রসে ভিজিয়ে তুলে নিতে হবে। হালকা গরম পরিবেশন করতে হবে।
চুঙ্গাপুড়া পিঠে বা চুঙ্গা পিঠে
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পিঠে হল চুঙ্গা পিঠে।চুঙ্গা পিঠে তৈরির প্রধান উপকরণ ঢলু বাঁশ ও বিন্নি
ধানের চাল। এর সাথে দুধ, চিনি ও নারকোল মিশিয়ে এই পিঠে তৈরি করা হয়।
পিঠে তৈরির উপাদান:
- ঢলু বাঁশের চুঙ্গা – পরিমাণ মত
- বিন্নি চাল – ২৫০
গ্রাম
- দুধ – ২০০ মিলি
- চিনি – ১০০ গ্রাম
- নারকেল কোরা – ২৫০ গ্রাম
- চালের গুঁড়ো – প্রয়োজন মত।
- খড় – পরিমাণ মত
- প্রথমে বাঁশকে নির্দিষ্ট মাপ দিয়ে টুকরো করে কেটে নিতে হয়।
তারপর ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।
- ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করা চাল, দুধ, চিনি, নারকোল কোরা ও পরিমাণ মত চালের গুঁড়ো মিশিয়ে মেখে মণ্ড তৈরি করতে হবে।
- বাঁশের চুঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারকেল ও চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মন্ড ঠেসে দিতে হবে।
- এভাবে চুঙ্গা ভর্তি হয়ে গেলে বাঁশের টুকরোগুলো খড়ের আগুনে পুড়তে দিতে হবে।
- পিঠে তৈরি
হয়ে গেলে চুঙ্গার ভিতর থেকে পিঠে আলাদা করে বার করে নিতে
হবে।
- পাতলা গুড় বা দুধের মালাই সহযোগে পরিবেশন করতে হবে।
খোলাজালি বা ছিটা পিঠে
উপকরণঃ
- চালের গুঁড়া– ১ কাপ
- ময়দা– ২-৩ টে চামচ
- কুসুম গরম জল– ২ কাপের মতো
- নুন– স্বাদমতো
- তেল– ব্রাশ করার জন্যে
- এছাড়া লাগবেঃ ননস্টিক প্যান ও প্লাস্টিকের বোতল।
প্রনালীঃ
- চালের গুঁড়ো, ময়দা ও
নুন
একসাথে মিশিয়ে অল্প অল্প জল দিয়ে হাতে মেখে মেখে
পাতলা মিশ্রণ তৈরি করতে হবে।
- ব্লাস্টিকের
বোতলে মুখে একটি ফুটো করে নিতে হবে।
- এইবার
এই মিশ্রণ বোতলে ভরে নিয়ে, মাঝারি আঁচে প্যান গরম করে তেল
ব্রাশ করে বোতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যানের ওপর সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।
- বেশী
ঘন যেন না হয়, সেদিকে
খেয়াল রাখতে হবে।একটি পাতলা স্তর তৈরি হবে।
- পিঠে প্যান থেকে উঠে আসতে শুরু করে খুন্তি দিয়ে ভাঁজ করে নামিয়ে নিতে হবে।
- এই পিঠে বিভিন্ন রকম তরকারি সহযোগে খাওয়া হয়।
গোলাপ পিঠে
গোলাপের
মতো দেখতে হওয়ায় এই পিঠের এমন নামকরণ। তবে এই পিঠেতে গুড় নয়, ব্যবহৃত হয় চিনির
রস।
উপকরণ:
- ময়দা – ২০০ গ্রাম,
- দুধ
– ১০০ মিলি,
- চালের
গুঁড়ো –
৫০ গ্রাম,
- চিনি –
৫০ গ্রাম,
- ঘি – ১০০মিলি,
- নুন - স্বাদ মতো,
- সাদা তেল – ১০০ মিলি
চিনির
রসের জন্য:
- চিনি
– ২০০ গ্রাম,
- এলাচ - ৩টি,
- গোলাপ জল - ২ চা চামচ।
প্রণালী:
- প্রথমে
পাত্রে গরম জলে চিনি, এলাচ, দারচিনি
দিয়ে ফুটিয়ে রস বানাতে হবে।নামিয়ে এর মধ্যে গোলাপজল মেশাতে হবে।
- ময়দায়
চালের গুঁড়ো,
নুন, চিনি
ও ঘি মিশিয়ে ভালো করে ময়ান দিতে হবে।
- ঈষদুষ্ণ
দুধ মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করতে হবে। তার থেকে টুকরো কেটে বল তৈরি করে পাতলা রুটি বেলে নিতে হবে।
- এই
রুটি থেকে সমান মাপের ছ’টি গোল টুকরো কেটে নিতে হবে।এই গোল
টুকরো একটির উপরে আর একটি রাখতে হবে।
- এই
ছ’টি স্তরের রুটি একসঙ্গে রোল করে নিয়ে, রোল
মাঝখান থেকে ছুরি দিয়ে কাটতে হবে।
- কাটার
জায়গা হাতের চাপে জুড়ে নিতে হবে।এবার গোলাপের পাপড়ির মতো
খুলে দিতে হবে।
- মাঝারি আঁচে গরম তেলে পিঠে সোনালি করে ভাজতে হবে। ভাজা পিঠে রসে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তৈরি গোলাপ পিঠে।
নকশি পিঠে
চালের আটা মোটা করে বেলে উপরে খেজুর কাঁটা দিয়ে পদ্ম, মাছ, চক্র, পাখি ফুটিয়ে তোলা হয়। এই পিঠে বহু দিন রেখে দেওয়া যায়। পরিবেশন করা হয় গুড়ের সঙ্গে। আগে নববধূর সঙ্গে এই পিঠে তত্ত্ব হিসেবে পাঠানো হত শ্বশুরবাড়িতে। নাম দেওয়া হত কাজললতা, শঙ্খলতা, হিজলপাতা, উড়িফুল, পদ্মদিঘি। আবার মেয়ে-জামাইকে নিয়েও নাম দেওয়া হত— কইন্যামুখী, জামাইবরণ, জামাইসুখ, সতীনমছুড়া, আরও কত কী।বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই পিঠে বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।
উপকরণঃ
- চালের
গুঁড়ো – ৩০০ গ্রাম
- নুন, চিনি
– পরিমাণ
মত
- ময়দা – ১০০ গ্রাম
- চিনির
গুঁড়ো – ২০০ গ্রাম
- খেজুরের
গুড় – ৫০
গ্রাম
- দুধ
– ১/২ লিটার
- কমলালেবু
– ১ টা
- এলাচ – ৩ টি
- তেল
– ২০০ মিলি
- গরম জল – পরিমাণ মত
- সাধারণ
তাপমাত্রার জল
– ২০০
মিলি
প্রণালীঃ
- জলে
চিনি আর গুড় মিশিয়ে রস বানিয়ে নিতে হবে।
- এবার
নুন ময়দা চালের গুঁড়ো অল্প গরম জল মিশিয়ে কিছু সময়
ঢেকে রাখতে হবে।
- গরম থাকতে থাকতে মেখে একটা মন্ড তৈরি করে ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে শুকনো না হয়ে যায়।
- এবার একটা সমান জায়গায় তেল মাখিয়ে তার উপরেই মণ্ড থেকে দু'টো গোলা নিয়ে ছোট রুটির আকারে বেলে নিয়ে কলকার মতন আকার দিয়ে তার মধ্যে নকশা ছুরি বা খেজুরের কাঁটা দিয়ে নকশা তৈরি করতে হবে।
- একইভাবে পছন্দঅনুযায়ী পাতা ফুল পাখী বানিয়ে নিতে হবে।কয়েক ঘণ্টা রেখে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।
- কড়াইতে সাদা তেল গরম হলে, প্রতিটা পিঠে আলাদাভাবে ভেজে তুলে নিতে হবে।
- এবার তৈরি করে রাখা হালকা গরম চাঁচনির মধ্যে প্রতিটা প্রতিটা নকশি পিঠে ডুবিয়ে তুলে নিতে হবে।
- ক্ষীর কমলা বানানোর জন্য দুধ গরম করে ঘন করে তাতে গুঁড়ো চিনি মিশিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে।
- এবার কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে কমলালেবুর রস বার করে নিয়ে ঠাণ্ডা দুধে মেশাতে হবে।তাহলেই তৈরি হয়ে যাবে ক্ষীর কমলা।
- এবার সাজানোর পালা। প্রথমে নকশা ছাড়া কলকার পিঠে নিয়ে তার উপরে ক্ষীর কমলা মালাই দিতে হবে।
- তার উপরে রাখতে হবে নকশি কলকা পিঠে। এইভাবে ইচ্ছানুযায়ী সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
- চাইলে শুধু রসে ডুবিয়েও খাওয়া যাবে।
টক ঝাল খেজুর পিঠে
উপকরণ:
- সুজি – ১০০ গ্রাম
- ময়দা – ৫০ গ্রাম
- দই – ৫০ গ্রাম ( জল ঝরানো)
- চিনি – ২০০ গ্রাম বা স্বাদ অনুযায়ী
- নুন - ১ চিমটে
- ঘি/তেল – ৫০ মিলি
- বেকিং পাউডার - ১/৪ চা চামচ
- গরম দুধ – ৫০ মিলি
- তেল - ডুবো তেলে ভাজার জন্য পরিমাণ মত
পদ্ধতি:
- একটি বড় পাত্রে সুজি, ময়দা, চিনি, নুন, বেকিং পাউডার ও ঘি নিয়ে ভালো করে মেশাতে হবে।
- এখন দই যোগ করে খামির তৈরি করতে হবে। খামির বেশি শুকনো হয়ে গেলে অল্প দুধ যোগ করে আবার মাখতে হবে।
- খেয়াল করতে হবে যাতে খামির বেশি শুকনো বা বেশি নরম না হয়ে যায়। খামির বল তৈরি করার মত নরম হতে হবে।প্রয়োজন না হলে দুধ ব্যবহার করার দরকার নেই।
- খামির দিয়ে ছোট ছোট বল তৈরি করে ডিমের আকৃতি দিতে হবে।
- তারপর এটি একটি ছাকনির উপর ছড়িয়ে দিয়ে আর একপ্রান্ত থেকে ভাঁজ দেয়া শুরু করতে হবে এবং অন্যপ্রান্তে না যাওয়া পর্যন্ত ভাঁজ দিতে হবে।
- এর ফলে বলের গায়ে ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত দাগ তৈরি হবে। একইভাবে সব পিঠে বানিয়ে নিতে হবে।
- একটি কড়াইতে তেল গরম হলে, এতে ৩-৪ টা পিঠে দিতে হবে এবং পিঠের সবদিকে কড়া বাদামী রং না আসা পর্যন্ত আস্তে আস্তে ভাজতে হবে।
- ভাজা হয়ে গেলে তেল থেকে তুলে একটি টিস্যু পেপারে রেখে অতিরিক্ত তেল ঝরিয়ে নিতে হবে।
- মাঝারি বা কম আঁচে ভাজতে হবে। ভাজার সময় তাড়াহুড়া করা চলবে না, অন্যথায় পিঠের ভেতরে কাঁচা থেকে যেতে পারে।
- এই পিঠে বায়ুরোধী বাক্সে করে ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তবে বাক্সবন্দী করার আগে পিঠে অবশ্যই ঠান্ডা করে নিতে হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন