শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক আহার

 


স্বাস্থ্যবান সন্তান সব মা – বাবাই কামনা করে থাকেন।একজন শিশুর সম্পূর্ণ সুস্থভাবে মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য প্রত্যেক বাবা- মায়ের তাই উদ্বেগের অন্ত থাকেনা। যদিও চিকিৎসকেরা বলেন জন্মের প্রথম ছয় মাসের প্রতি মাসে ৫০০ গ্রাম করে ওজন বৃদ্ধি বা ছয়মাস পরে শিশুর ওজন জন্মের সময়ের ওজনের দ্বিগুণ হলে – তা স্বাভাবিক ও সুস্থ বৃদ্ধি বলে ধরা হয়।তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের সন্তানের ওজন স্বল্পতা নিয়ে প্রতি বাবা-মায়ের অভিযোগের শেষ থাকে  না। বয়সের সাথে সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে ওজন বৃদ্ধির জন্য পরিমিত ও নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ালে শিশুর বৃদ্ধি সঠিক হয়। 

এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-এর মানদণ্ড অনুযায়ী বাচ্চাদের ওজন হ্রাস এবং ওজন বৃদ্ধির স্বাভাবিক মানগুলি হলঃ 

  • প্রসবের পরে প্রথম সপ্তাহের মধ্যে একটি নবজাতক তাদের জন্মের ওজনের প্রায় ৫% থেকে ১০% হারায়।
  • প্রসবের প্রথম তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি নবজাতক কমে যাওয়া ওজন ফিরে পেতে শুরু করে।
  • বাচ্চাদের স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি হলে জন্মের প্রথম তিন থেকে চার মাসের মধ্যে তাদের ওজন জন্মের ওজনের দ্বিগুণ হওয়া উচিত।
  • ছেলেরা প্রথম বছরের মধ্যে তাদের জন্মের ওজনের প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে নিতে পারে।
  • মেয়েরা তাদের জন্মের ওজন তিনগুণ করতে ষোল মাস পর্যন্ত সময় নিতে পারে।
  • প্রথম বছরের মধ্যেই শিশুর দৈর্ঘ্য জন্মের দেড়গুণ বাড়বে বলে আশা করা হয়।
  • আপনার বাচ্চার মাথার পরিধি তাদের প্রথম জন্মদিনের আগে বা তার কাছাকাছি প্রায় ১১ ইঞ্চি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়।

কোনো শিশু যদি এই সমস্ত মানগুলি পূরণ না করে বা যদি তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়েছে, লক্ষ্য করা যায় তাহলে শীঘ্রই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

কোনও শিশুর ওজন স্বল্পতার জন্য কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়। 

খাদ্যে অনীহাঃ কিছু শিশুর খাবার গ্রহনে অনীহা দেখা যায়। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার গ্রহনের ফলে পুষ্টির স্বল্পতা ঘটে। ওজন বৃদ্ধি হয়না।অথবা অপর্যাপ্ত মাতৃদুগ্ধও নবজাতকের বৃদ্ধি ব্যহত হওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে থাকে।   

বংশগত কারণঃ অনেক ক্ষেত্রে পরিমাণ অনুযায়ী পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহনের পরেও শিশুর ওজন বৃদ্ধি পায় না। এক্ষেত্রে বংশগত কারণ দায়ী হতে পারে। শিশুর শরীর খাদ্যের পাচনক্রিয়া জনিত অসুবিধার জন্য ওজন বৃদ্ধিতে অপারগ হয়।

শারীরিক অসুস্থতাঃ জন্মানোর সময় থেকে শিশু জটিল অসুখে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি ব্যহত হয়।

শারীরিক পরিশ্রমঃ দুরন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে ওজন স্বাভাবিক কারণেই কম বৃদ্ধি পায়। দৈনিক অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম তাদের স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

ওজন বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর খাবারের সাথে সাথে অন্য কয়েকটি বিষয়ের উপর নজর দেওয়া দরকারঃ 

  • শিশু নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম ও খেলাধুলা করছে কিনা সেদিকে নজর দিতে হবে । শারীরিক পরিশ্রম ক্ষুধার উদ্রেক করে, ফলে পর্যাপ্ত খাবার গ্রহনের ফলে ওজন বৃদ্ধি পায়।
  • শুধুমাত্র ওজন বৃদ্ধি করার জন্য খাবার পরিবেশন না করে ,সঠিক বয়সের জন্য সঠিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্যের দিকে নজর দেওয়া উচি৬ মাসের পর থেকে খাবার বেটে, মিশ্রণ তৈরি করে না খাইয়ে অল্প অল্প করে চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করানো উচিত।এতে প্রয়োজনীয় উৎসেচকের স্বাভাবিক ক্ষরণ শুরু হয়। খাবার সঠিকভাবে পাচিত হয়ে ওজন বৃদ্ধি ও অন্যান্য বিকাশে সহায়ক হয়। 
  • শিশুর পছন্দ ও অপছন্দের খাবারের তালিকা প্রস্তুত করে সে অনুযায়ী খাবার খাওয়াতে হবে।অপছন্দের প্রয়োজনীয় খাবার জোর করে না খাইয়ে ভুলিয়ে খাওয়াতে হবে। 
  • খাবারে নতুনত্ব যোগ করে খাওয়াতে রুচি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে ৩ বছর বয়েস অবধি বাইরের কোনও খাবার দেওয়া উচিত নয়।
  • তেল, মশলা, নুন ও চিনির ব্যবহার যথাসম্ভব কম করা উচিত।
  • এক বছরের পর থেকে শিশুকে নিজের হাতে খাওয়ার অভ্যাস করানো উচিত।
  • খাবার সময় বাড়ির সবাই একসাথে খেলে শিশুমনে খুশির সঞ্চার হয়।স্বইচ্ছায় খাবার গ্রহনের প্রবণতা বাড়ে। নিজে থেকে খাবার গ্রহন করলে ওজন স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ওজন বৃদ্ধিকারক ও পুষ্টিকর খাবারসমূহঃ

স্তনদুগ্ধ:



  • শিশু জন্মের পর থেকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো বাধ্যতামূলক।চিকিৎসকদের মতে প্রথম ৬মাস মাতৃদুগ্ধ ভিন্ন অন্য কোনো খাবার শিশুকে খাওয়ানো উচিত নয়। এমনকি জলও না। স্তনদুগ্ধ সহজে হজম হয়, পরিমিত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এবং স্বাস্থ্যকর যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ওজন বৃদ্ধি করে।
  • শিশু যদি হাসিখুশি থাকে,খেলাধুলা করে ও দিনে ৫-৮ বার মল মূত্র ত্যাগ করে তবে বুঝতে হবে পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাচ্ছে।
  • ৬ মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য তরল ও অর্ধতরল খাবারের অভ্যাস তৈরি করতে হবে। এতে করে তার দৈহিক গঠন বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তি পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে।

কলা:

৬মাসের পর থেকে মাতৃদুগ্ধের সাথে ফল খাওয়ানো উচিত। এক্ষেত্রে সবার আগে কলার নাম আসে। কলাতে পটাশিয়াম , ভিটামিন -সি, ভিটামিন- বি৬ এবং কার্বোহাইড্রেট থাকে প্রচুর পরিমাণে । অধিক পরিমাণে ক্যালরি থাকায় ওজন বাড়ানোর জন্য কার্যকরী।পাকা কলা চটকে খাওয়ানো যেতে পারে।

মিষ্টি আলু:



মিষ্টি আলু খুব সহজে সিদ্ধ করা যায় , শিশুর মুখরোচক খাবার , সহজপাচ্য ও অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধভিটামিন -এ, ভিটামিন- সি , ভিটামিন -বি৬ , তামা , ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি শিশুর ওজন বৃদ্ধিকারি আদর্শ উপাদানে ভরপুর।তন্তুসমৃদ্ধ মিষ্টি আলু সেদ্ধ করে বা সবজি স্যুপ তৈরি করে খাওয়ানো যেতে পারে যা শিশুরা খেতে খুব পছন্দ করে।

ডাল:

ডাল প্রোটিন , ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম , আয়রন , ফাইবার এছাড়া হরেক রকমের পুস্টি সমৃদ্ধ ওজন বর্ধক তরল খাবার হিসেবে ৬ মাস বয়সের পরই শিশুকে ডাল খাওয়ানো যেতে পারে ।৭-৯ মাস বয়সে ডালের সাথে চাল ও অল্প সবজি দিয়ে মিশ্র খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো খুবই উপকারী হয়।

ঘি ও মাখন:

৮-১০ মাস বয়সী শিশুদের জন্য শারীরিক গঠন ও বৃদ্ধির জন্য মাখন খুবই কার্যকরী খাবার ।গরম ডাল বা খিচুড়ির উপর অল্প ঘি দিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।তবে বাড়িতে বানানো ঘী দিতে পারলে বেশি উপকারী হয়। বাজারজাত ঘী অধিকাংশক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ হয়না। তাই এই ঘী শিশুকে না দেওয়াই ভালো। খুব দ্রুত ওজন ও চর্বি বৃদ্ধি করে তাই ঘী বা মাখন প্রতিদিন স্বল্প পরিমাণে খাওয়ানো উচি

ডিম:

ফ্যাট ও প্রোটিনে ভরপুর ডিম ১২ মাস পূর্ণ হওয়া শিশুদের জন্য আদর্শ খাবার। ফ্যাট , ভিটামিন, খনিজ লবন সমৃদ্ধ একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার এটি। শুরুতে শিশুকে ডিম সেদ্ধ খাওয়ানো উচিত।এক্তু বড় হলে অমলেট, পোচ বা ডিমের ঝুড়িভাজা করে খাওয়ালে তা খুব সুস্বাদু ও উপাদেয় হয়।

সব্জী


বিভিন্ন সব্জী যেমন মিষ্টিকুমড়া
,মটরশুঁটি,গাজর, আলু,ঢ্যাঁড়শ,লাউ,পটল প্রভৃতি অল্প পরিমানে সেদ্ধ করে বা ২ বছরের পর থেকে ভাজা খাওয়ানো যেতে পারে।এছাড়া বাদাম,কিসমিস,খেজুর,ডালিয়া ইত্যাদি খাবারও অল্প পরিমাণে খাওয়ানো খুবই কার্যকরী।

দইঃ


বাড়িতে বানানো দই অল্প পরিমানে ৬ মাসের পর থেকে শিশুর আহারের তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। শিশুদের স্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধির জন্য দইয়ে ফ্যাট এবং পুষ্টিকর ক্যালোরি থাকে । দই হজম শক্তিকে উন্নত করে
, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় সাহায্য করে । দইয়ে অল্প মধু মিশিয়ে শিশুকে খাওয়ালে তা স্বাস্থ্যকর হয়। এক বছরের পর থেকে দিনে এক কাপ দইয়ের ঘোল বা ফল মিশ্রিত দইয়ের স্মুদি রোজ খেতে দিলে তা খুবই উপকারী হয়।  

দুগ্ধজাত অন্যান্য খাবারঃ 

দুধের সাথে দুধ থেকে তৈরি হওয়া অন্যন্য খাবার খাওয়ানো একান্ত আবশ্যক। যেমন চিজ, পনীর, ছানা প্রভৃতি। ২ বছরের পর থেকে খাবারের তালিকায় এইসব খাবার যোগ করতে হবে। এতে শিশুর স্বাদও বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় না সম্ভব হলেও সপ্তাহে ২ – ৩ দিন এই সব খাবার খাওয়ালে শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

মাছঃ

৮ মাসের পর থেকে অল্প পরিমানে শিশুর আহারে মাছ দেওয়া যেতে পারে। মাছের প্রোটিন, ভিটামিন, ফ্যাট শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। প্রথমে জিওল মাছ যেমন শিঙি, মাগুর, বেলে, গুলে, কই, ল্যাটা, জ্যান্ত পোনা প্রভৃতি মাছ খাওয়ানো উচিত। প্রতিদিন শিশুর আহারের তালিকায় অন্তত ৫০ গ্রাম মাছ রাখা আবশ্যক। মাছ খাওয়ানোর শুরুর দিকে মাছ জলে সেদ্ধ করে ভালো করে কাঁটা বেছে খাওয়ানো উচিত। ১৮ মাসের পর থেকে ভাজা মাছ খাওয়ানো যেতে পারে।

মাংসঃ


১৮ মাসের পর থেকে শিশুর আহারে মাংস তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে লাল মাংস না দিয়ে মুরগীর মাংস দেওয়াই উচিত হয়। মাংসের প্রোটিন, ফ্যাট ও ভিটামিন একজন বাড়ন্ত শিশুর জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।মাংস খাওয়ানো শুরু করলে প্রথমে মাংসের স্যুপ দেওয়া উচিত। হজম করতে সক্ষম হলে অল্প পরিমানে মাংস সেদ্ধ করে খাওয়ানো যেতে পারে। মাংস খাওয়ানোর সাথে সাথে শিশুর আহারে এই সময় পেঁয়াজ, আদা ও রসুন ও যোগ করা উচিত।

ফলঃ


৬ মাসের পর থেকে শিশুকে প্রতিদিন একটি করে ফল খাওয়ানো দরকার। মুসাম্বি, কমলালেবু, তরমুজ, আঙুর, বেদানা প্রভৃতি ফলের রস করে প্রতিদিন অন্তত ১০০ মিলি রস শিশুকে পান করানো স্বাস্থ্যকর হয়। এছাড়া আম, কলা, পাকা পেঁপে, নাসপাতি, আপেল, সফেদা প্রভৃতি ফল সেদ্ধ করে বা ছোট ছোট টুকরো করে খাওয়ানো উচিত।

 

বি.দ্র. –

নতুন কোনও খাবার খাওয়ানোর আগে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া একান্তই দরকার।

যে কোনও খাবার খাওয়ানো শুরু করার পর যদি শিশুর কোনও রকম শারীরিক অসুবিধা হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই খাবারটি খাওয়ানো বন্ধ করে দিতে হবে। যথা শীঘ্র সম্ভব শিশুকে বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। 


কলমে - বা ণী  মি ত্র 


চিত্রসৌজন্যঃ অন্তরজাল 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন