ভারতের সিন্ধু সভ্যতার সময় সৃষ্টি হয়েছিল সিদ্ধা ঔষধি
বিদ্যা । পরবর্তীকালে এই বিদ্যা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর দ্রাবিড় গোষ্ঠীর
মানুষের সাথে দক্ষিণ ভারতে চলে যায় এবং এই সিদ্ধা ঔষধি বিদ্যার বিভিন্ন পুঁথিতে
হদিস মিলেছে পুট্র নোই নামক রোগের যেটির লক্ষণগুলি ক্যানসারের মতোই।
ক্যানসারের সংলগ্ন স্ফীত অংশে কাঁকড়ার
পায়ের মতো বিস্তৃত শিরা ও ধমনিকে দেখে ঔষধি বিদ্যার জনক হিপোক্রেটিস এই রোগের নাম
দিয়েছিল কারকিনোস অর্থাৎ কাঁকড়া। পরবর্তীকালে এই কারকিনোস থেকে উৎপত্তি হয়
ক্যানসার শব্দটি এবং বাংলা ভাষায় এই রোগকে বলে কর্কট রোগ।
স্তন ক্যানসার কি ?
স্তন ক্যানসার একপ্রকারের ক্যানসার যেটি একটি স্তন বা দুটি
স্তনেই একসাথে হতে পারে। আমাদের শরীর লক্ষাধিক কোষের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
এই কোষগুলো ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। পুরানো অথবা ক্ষতিগ্রস্ত কোষের
স্থানে এই নতুন কোষ দখল করে নিয়ে আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপ নির্বাহ করতে
সহায়তা করে। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে কোষের অস্বাভাবিকতার জন্য
কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এরফলে টিউমার বা আবের সৃষ্টি হয়। কিন্তু
টিউমার মানেই ক্যানসার নয়। টিউমার বিনাইন (benign) স্তরে থাকলে
সেটিকে ক্যানসার বলে গণ্য করা হয় না। কিন্তু এই টিউমার ম্যালিগন্যান্ট (
malignant) স্তরে উত্তীর্ণ হলে তাকে ক্যানসার হিসাবে চিহ্নিত করা
হয়।
স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই আব বা টিউমার প্রথমে স্তন থেকে
নিকটবর্তী লসিকা গ্রন্থিকে আক্রমণ করে এবং তারপর সেখান থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়।
ক্যানসারের এভাবে একস্থান থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়াকে মেটাস্ট্যাসাইজ
(metastasize) বলে।
স্তন
ক্যানসারের লক্ষণ:
প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যানসার ধরা পড়লে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ
করা অনেক সহজ হয়। তার জন্য স্তন ক্যানসারের নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি সম্বন্ধে অবগত থাকতে
হবে –
- স্তনের উপর কোন অস্বাভাবিক শক্ত অংশ । (এটি উপলব্ধি করার জন্য তেল বা ক্রিম জাতীয় জিনিস হাতে নিয়ে স্তনের উপর আস্তে আস্তে হাত বোলাতে হবে। )
- স্তনের আকার বা গঠনের কোন বিশেষ পরিবর্তন।
- স্তনের উপরের কোন অংশের রং পরিবর্তন হওয়া বা কোন অংশে হঠাৎ করে টোল পড়া বা খাঁজ সৃষ্টি হওয়া ।
- স্তন বৃন্তের হঠাৎ করে ভেতরে ঢুকে যাওয়া।
- স্তন বৃন্তের সন্নিকটস্থ অংশ লাল রঙের হয়ে যাওয়া।
- স্তন বৃন্ত থেকে হঠাৎ পূঁজ ও রক্ত নির্গত হওয়া।
- উক্ত লক্ষণগুলির একটিও বিদ্যমান হলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
স্তন ক্যানসারের কারণ
স্তন
ক্যানসারের কোন একটি সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। তবু বিশেষজ্ঞেরা কতগুলি কারণকে চিহ্নিত করেছেন যেগুলো স্তন
ক্যানসারের বিপদকে ত্বরান্বিত করে –
- পুরুষদের তুলনায় নারীদের স্তন ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। তাই প্রতিটি নারীর তার স্তন সম্বন্ধে অবগত থাকা আবশ্যক। স্তনে কোন অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লেই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে উচিৎ।
- বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্তন ক্যানসারের বিপদ বাড়তে থাকে। তাই এই সময়ে সর্বাধিক সচেতন থাকতে হবে।
- যদি একটি স্তন ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে থাকে , তবে দ্বিতীয় স্তনটির ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
- যদি কোন নিকট আত্মীয় (যেমন - মা , মেয়ে, বোন) স্তন ক্যানসারের দ্বারা আক্রান্ত হয় । তবে এই স্তন ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পায়। BRCA1 এবং BRAC2 জিনের প্রকরণ মূলত স্তন ক্যানসারের জন্য দায়ী এবং বংশপরম্পরায় এটি সঞ্চারিত হতে পারে।
- আদ্যঋতু বা menarche ১২ বছরের পূর্বে শুরু হলে এবং ঋতুজরা বা menopause স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বয়সে হলে স্তন ক্যানসারের ভয় থাকে।
- ঋতুজরার উপসর্গগুলো বন্ধ করার জন্য কোন প্রোজেস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন যুক্ত হরমোন থেরাপির সাহায্য নিলে এই স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
- নিয়মিত মদ্যপানও এই স্তন ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়:
- কিছু সুনির্দিষ্ট উপায় অবলম্বন করলে, এই স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা ও বিপদ কিছুটা হ্রাস করা সম্ভব । সেই উপায়গুলো হল –
- নিকট কোন আত্মীয়ের ক্যানসার বা স্তন ক্যানসার হলে, নিজের এই স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই সেক্ষেত্রে ২০-৩০ বছরের মধ্যে প্রতি তিনবছর অন্তর এবং চল্লিশ বা তার উর্ধ্বে প্রতিবছর অন্তত একবার ডাক্তারের দ্বারা ক্লিনিক্যান পরীক্ষা করা ভীষণ জরুরী।
- প্রাত্যহিক বা এক সপ্তাহ অন্তর হাত দিয়ে বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের স্তনকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি উপরোক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে একটিও সুস্পষ্ট হয় । তবে অবিলম্বে ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। এর প্রভাবে হয়ত ক্যানসারকে এড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু স্তন ক্যানসার প্রাথমিক স্তরে ধরা পড়লে , তার চিকিৎসা অনেকবেশি সহজ ও কম ব্যয়বহুল হয়।
- নিয়মিত মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করা ভীষণ জরুরী এক্ষেত্রে।
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট যোগাভ্যাস বা ব্যায়াম করতে হবে। যদি পূর্বে ব্যায়াম বা যোগাভ্যাসের অভিজ্ঞতা না থাকে, তবে ডাক্তারি পরামর্শ মেনে ধীরে ধীরে এই অভ্যাস গঠন করতে হবে।
- ঋতুজরার পরবর্তী উপসর্গগুলো বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের হরমোন থেরাপির প্রয়োজনীয়তা পড়ে । কিন্তু এই হরমোন থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাবে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এই হরমোন থেরাপি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। একান্ত এই হরমোন থেরাপির সাহায্য নিতে হলে ডাক্তারের কাছ থেকে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরী। স্তন ক্যানসারের ভয় থাকলে কম ডোজের হরমোন থেরাপি কম সময় ধরে নেওয়া যেতে পারে এবং সেটা অবশ্যই ডাক্তারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে স্থির করতে হবে।
- সুষম খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ- স্বাভাবিক জীবনযাপন স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা অনেকটা হ্রাস করতে সহায়তা করে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৮ সালে ভারতে ক্যানসার
আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১.১৬
মিলিয়ন অর্থাৎ ভারতের ১০ জনের মধ্যে একজন রোগী ক্যানসার দ্বারা আক্রান্ত হয়। সব
ক্যানসারের মধ্যে স্তন ক্যানসারের দ্বারা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক। তবে
সুখবর এটাই যে এই স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা করার মতো ব্যবস্থা বর্তমানে রয়েছে। কিন্তু
সর্তকতার অভাবে অথবা সামাজিক সংস্কারের বেড়াজাল অতিক্রম করে অনেক মহিলা তার
শরীরের গোপন অঙ্গের সমস্যা সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা করতে চায় না। দুঃখের বিষয় সাংসারিক
দায়িত্বের নাগপাশে আবদ্ধ মহিলারা নিজেদের শারীরিক সমস্যাকে গুরুত্ব দেয় না।
তাছাড়া স্তন ক্যানসারের প্রভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাথা বা কোনরকম সমস্যা
প্রাথমিক স্তরে হয় না। এরফলে বেশিরভাগ স্তন ক্যানসার একেবারে শেষ পর্যায়ে ধরা
পড়ে এবং তখন চিকিৎসা অনেকবেশি কষ্টসাধ্য
হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে আশার বাণী এটাই যে – বর্তমানে স্তন ক্যানসারের বিষয়ে মানুষের মধ্যে
সচেতনতা গড়ে উঠেছে। নারীর ক্ষমতায়নের প্রভাবে মহিলারা এখন
নিজেদের সমস্যা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোচনা করতে আগ্রহী। এরফলে ভবিষ্যতে
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা অনেক সহজসাধ্য হয়ে যাবে।
কলমে - সু কৃ তি দা স
তথ্যসূত্র –
www.canceratlas.cancer.org
www.cancer.org
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন