টিভি ও মোবাইল ফোনের প্রতি শিশুদের আসক্তি দূরীকরণের উপায়

 


 

টিভি ও মোবাইল ফোনের প্রতি সন্তানের মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক নিয়ে ইদানিং অধিকাংশ অভিভাবকই অভিযোগ অনুযোগ করেন। টিভিতে সর্বক্ষণ পছন্দের অনুষ্ঠান দেখা চাই-ই চাই, মোবাইল ফোনে কার্টুন চালিয়ে না দিলে বাচ্চা খাবে না। এহেন অবস্থায় বাচ্চাকে সামলাতে বাড়ির বড়োদের কালঘাম ছুটে যাওয়ার দশা। এক্ষেত্রে যে জিনিসটা ভেবে দেখার আছে তা হলো কোনো অভ্যাস কিন্তু একদিনেই তৈরি হয় না। একটি বাচ্চার যদি নিয়মিত টিভি দেখার বা মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি তৈরি হয় সেটা যেমন একদিনে তৈরি হয়নি, ঠিক সেভাবেই সেই আসক্তি থেকে মুক্তিও একদিনে পাওয়া সম্ভব নয়।

 

সব জিনিসেরই ভালো ও মন্দ দু'টি দিক আছে, মন্দ বলার চাইতে শ্রেয় হলো অতিরিক্ত ব্যবহার বলা। এই অতিরিক্ত ব্যবহারই সব সমস্যার মূলে। টিভি ও মোবাইল ফোনের কারণে বাচ্চাদের বিকাশে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন: 

  • টিভি বা মোবাইল ফোন দেখার সময় আশেপাশের কারো দিকে মনোযোগ দিতে হয় না বলে শিশু আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যেতে শুরু করে এবং তার মধ্যে অনাবশ্যক খিটখিটে ভাব দেখা দেয়।
  • শিশুকালই হলো মস্তিষ্ক উন্নয়নের উপযুক্ত সময়। টিভি ও মোবাইল ফোনে মগ্ন থাকাকালীন শিশুদের তেমন কল্পনা বা চিন্তা করতে হয় না। ফলস্বরূপ শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় ও সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হতে শুরু করে।
  • অনেকক্ষেত্রে এও দেখা যায় যে মোবাইল ফোনের আসক্তির কারণে একটি শিশুর কথা বলতে শেখার দেরি অর্থাৎ speech delay হচ্ছে। এমন সমস্যায় পড়ে অভিভাবকরা চিন্তায় চিন্তায় জেরবার হয়ে পড়েন
  • মাত্রাতিরিক্ত টিভি বা মোবাইল ফোন আসক্তি একটি শিশুর শারীরিক কসরত ও খেলাধূলার সময় হরণ করে। এতে শিশুদের মধ্যে শারীরিক পরিশ্রমে অনীহা দেখা দেয় এবং তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
  • মোবাইল ফোনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে খাদ্যগ্রহণ করলে শিশুর মনোযোগ স্ক্রীনের দিকে থাকায় সে খাবারের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে না এবং সঠিকভাবে চিবিয়ে না খাওয়ায় হজমে সমস্যা তৈরি হয়, সাথে হজম ক্ষমতাও কমে যেতে থাকে। ফলস্বরূপ খাবারের প্রতি অনীহা ও কোষ্ঠকাঠিন্যসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়।
  • দীর্ঘক্ষণ ধরে টিভি বা মোবাইল ফোন দেখার সময় চোখের পলক কম পড়ে এবং এতে চোখের রেটিনার উপর মারাত্মক চাপ পড়ে। ফলে শিশু Dry Eye Syndrome এর কবলে পড়ে যায় এবং দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
  • টিভি, মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি থেকে যে নীল আলো নিঃসৃত হয় সেটি মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ কমিয়ে দেয়, ফলে ঘুম আসতে চায় না। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে এই নীল আলো ঘুমের সময়কে প্রায় তিন ঘণ্টা পিছিয়ে দেয় আর উজ্জ্বল সবুজ আলো পিছিয়ে দেয় প্রায় দেড় ঘণ্টা।
  • এক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন তা হলো এই অতিরিক্ত ব্যবহারের সীমানা নির্ধারণ করা। এমনটা করলে টিভি ও মোবাইল ফোনের কেবলমাত্র সুফলটাই উপভোগ করতে পারা যায়। এগুলির প্রভাব যদি ভালো দিক থেকে বাচ্চার জীবনে রয়ে যায়, ক্ষতি কী!

 

সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি উপায় বিবৃত করা হলো যাতে শিশুটির টিভি বা মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি তৈরি হবে না এবং ভালো কিছু শিখতেও পারবে।

  • ছোটো থেকেই শিশুকে টিভি দেখতে দেখতে খাওয়ানোর অভ্যাস ধরানো একেবারেই অনুচিত, তার চাইতে গল্পের বই পড়ে শোনানো বহুগুণে শ্রেয়। রঙচঙে ছবিওয়ালা তার প্রিয় পশুপাখির গল্প আছে এমন কোনো বই পড়তে পড়তে তাকে খাওয়ানো যেতে পারে।
  • বাচ্চাকে গল্প লিখতে, কবিতা লিখতে উৎসাহ দেওয়া একটি অত্যন্ত ভালো উপায়। এতে তার সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে।
  • একটি শিশুকে নানারকমের খেলনা দেওয়া যায় যা নিয়ে খেলতে খেলতে সে কিছু শিখতেও পারে। যেমন অক্ষর ব্লক, সংখ্যা ব্লক, নানারকমের ধাঁধার খেলা ইত্যাদি।
  • বাচ্চার সারাদিনের জন্য একটি রুটিন বানিয়ে ফেলতে হবে। পড়া, লেখা, খেলা, আঁকা, ছবি রং করা ইত্যাদির সঙ্গে টিভি দেখার জন্যও একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। এই অভ্যাসমত চললে নির্ধারিত সময়ে টিভি দেখার পর বন্ধ করে দিলে দেখা যাবে যে তাতে সে আর কোনো আপত্তি করছে না।
  • শিশু যখন টিভি দেখবে তখন তাকে নানারকম শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান চালিয়ে দিতে হবে যাতে সে ওগুলি উপভোগ করার সাথে কিছু শিখতেও পারে, ছড়ার গান হোক বা অক্ষর সংখ্যা এসব নিয়ে কোনো গান বা ভালো অভ্যাসের উপর কোনো অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকও চালানো যায়। বাচ্চা একটু বড়ো হলে বিভিন্ন ক্যুইজের অনুষ্ঠান চালিয়ে দিলে তার বিশেষ উপকার হবে।
  • বাচ্চার সামনে কোনোরকম সিরিয়াল দেখা এড়িয়ে চলাই ভালো। অধিকাংশ সিরিয়ালই ঝগড়াঝাঁটি ও হিংসাত্মক কার্যকলাপে ভরপুর। ওসব দেখে মনে খারাপ প্রভাব পড়ে এবং অন্যান্যদের সম্পর্কে ত্রুটিপূর্ণ ধারণা তৈরি হয়। এমতাবস্থায় তাকে পাশের ঘরে অন্য কোনো কাজ করতে দিয়ে ব্যস্ত রাখাই শ্রেয়।
  • ছবি আঁকা ও রং করার প্রতি শিশুর আগ্রহ বৃদ্ধি অত্যন্ত লাভদায়ক। রংপেন্সিল নিয়ে একটি শিশু অবলীলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারে। বাচ্চাকে সুন্দর সুন্দর আকর্ষণীয় ছবি দিতে হবে যেগুলো দেখে সে রং করতে উৎসাহী হয়। 

এভাবে একটি বাচ্চাকে সারাদিন একটি রুটিনের মাধ্যমে কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত রাখলে টিভি বা মোবাইল ফোনের জন্য খুব বেশি সময় সে পাবে না। এছাড়াও প্রত্যেক পিতামাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো তাঁদের সন্তানের সঙ্গে দিনের কিছুটা সময় অতিবাহিত করা। এতে অভিভাবকের সঙ্গে তাঁদের সন্তানের মানসিক যোগাযোগ দৃঢ় হয় এবং টিভি ও মোবাইল ফোনের প্রতি নির্ভরতাও তৈরি হয় না। সেক্ষেত্রে যেটা করা যায়: 

  • বাচ্চার সঙ্গে একসাথে কোনো কাজ করলে বাচ্চারা খুব উৎসাহিত হয়, মজা পায়। যেমন বই পড়া, ছবি আঁকা, রং করা, গান গাওয়া, বাগান করা বা কোনোকিছু বানানো ইত্যাদি। আর এই সবকিছুই বাচ্চাকে বেশ খানিকক্ষণ ব্যস্ত রাখতে সহায়ক। 
  • বাচ্চাটির স্কুলের কথা, শিক্ষক শিক্ষিকাদের কথা, বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করতে হবে। স্কুলের গল্প করতে সব বাচ্চাই ভালোবাসে।
  • তাদের পছন্দের কাজগুলি অথবা বন্ধুদের সাথে তারা কী কী খেলা করে সেসবের গল্পও করা যায়। 
  • গল্প বলা একটি শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক। এতে সে অনেককিছু শিখতে পারে, মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। নিজের ছোটবেলার কান্ডকারখানার গল্প, কোনো মজার গল্প, ঈশপের গল্প ইত্যাদি অনেককিছুই আছে শিশুকে বলার জন্য। 
  • বাচ্চার সঙ্গে বসে কিছুক্ষণের জন্য টিভিতে কোনো শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান যেমন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল দেখা যেতে পারে। কোনোকিছু বুঝতে সমস্যা হলে সে জিজ্ঞাসা করে নেবে।
  • ঘরের বাতিল জিনিসপত্র দিয়ে বাড়ির বড়রা বাচ্চার সঙ্গে বসে টুকটাক কোনো জিনিস বানাতে পারেন.
  • ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ শুধু কাজে ব্যস্ত রাখাই নয়, বাইরেও নিয়ে যেতে হবে তাকে। একসঙ্গে হাঁটতে যাওয়া বা পার্কে যাওয়া তার মনকে প্রফুল্ল রাখবে।

বর্তমান যুগে টিভি ও মোবাইল ফোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবকল্যাণের প্রতি এগুলির অবদান অনস্বীকার্য। দিন যতো এগোচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ আরো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই এগুলি থেকে বাচ্চাকে জোরজবরদস্তি দূরে রাখার পরিবর্তে সুস্থভাবে যাতে সে এগুলির ব্যবহার শেখে সেই চেষ্টা করলে সুফল মিলবে এবং এগুলির সঙ্গে একটি সুন্দর শৈশবও পাওয়া যাবে।



কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন