‘ভারি তেষ্টা পেয়েছে, না রে জগদ্দল? তাই হাঁসফাঁস কচ্ছিস? দাঁড়া বাবা দাঁড়া।’ - মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে পশু-পাখির সম্পর্ক নিয়ে গল্প / কবিতা অনেক দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু যন্ত্রের সাথে মানুষের প্রেম সুবোধ ঘোষের 'অযান্ত্রিক' না পড়লে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারা যায় না।
ছেলেরা গাড়ি নিয়ে খেলবে, আর মেয়েরা পুতুল - এইটাই যেন সমাজের অলিখিত নিয়ম! ইলা মজুমদার অবশ্য সেইসব গতে বাঁধা নিয়ম মানেন নি। ছোট্ট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূর্ণও করেছিলেন। তবে কর্নেলিয়ার মতো সহপাঠীদের বিদ্বেষের মুখে পড়তে হয় নি, বরং ছেলে সহপাঠীরা তাঁকে খুব সাহায্য করেছিলেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
জন্মস্থান : মাদারিপুর গ্রামের, ফরিদপুর জেলার, তখনকার পূর্ববঙ্গ ( বতর্মান বাংলাদেশ )
জন্ম সময় : ১৯৩০ সালে।
ভাই-বোন : তাঁর ছিল ৬ বোন ও ২ ভাই। তিনি ছিলেন তৃতীয়।
পিতা : যতীন্দ্র কুমার মজুমদার ( ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি এম.এস.সি-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। )
মাতা : গৃহবধূ।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী: ইন্ডিয়ান ইস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (আই.আই.ই.এস.টি. শিবপুর ) [Indian Institute of Engineering Science and Technology, Shibpur (IIEST Shibpur)]
বিভাগ : মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
বিবাহিত জীবনঃ
স্বামীর ভূমিকাঃ
ইলা দেবী পেশাগত জীবনে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। পেশাদার মানুষ ছিলেন। নিজের কাজ নিয়ে সচেতন থাকতেন। একজন মহিলা হয়ে একই সাথে দক্ষতার সাথে বাইরের কাজ ও ঘরের কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে তা সহজ হয় যদি পরিবারের মানুষ, বিশেষ করে স্বামী যদি খুবই সাহায্যকারী, সমর্থনকারী হন। ইলা দেবী ভাগ্যবতী ছিলেন। তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, " তিনি ছিলেন উদারপন্থী, অত্যন্ত আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ। বিদেশে শিক্ষিত হওয়ায় তিনি নারীমুক্তিতে বিশ্বাস করতেন। দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো ভাগাভাগি করে নিতেন।"
চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসতেনঃ
মাত্র ১২ বছর বয়সেই সাইকেল চালাতে শেখেন এবং মাত্র ১৬ বছর বয়সে জিপ চালানোও শিখে ফেলেছিলেন। তিনি যখন ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলেন তখন তাঁর পিতা অনুমোদন করেছিলেন। সমাজে এমন কিছু মানুষ সবসময়ই থাকে যারা সবকিছুতেই নেতিবাচক জিনিস খুঁজে পায়। ইলা মজুমদারের আশেপাশেও তেমন কিছু মানুষ ছিল। তাদের ইলা দেবীর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হয়েছিল! মেয়ে হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে! পরবর্তীকালে এই বিষয় সম্পর্কে ইলা মজুমদার গর্বের সাথে বলেছিলেন, " আমি সবসময় চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি এবং যখন লোকেরা বলে মেয়েরা এটা পারবে না, সেইসব কাজ করতে বেশি পছন্দ করি। " ( “I always liked challenges and liked to do what people said girls can’t do” she says with pride. )
খেলাধূলাঃ
ইলা মজুমদার খেলাধূলাতেও ভালো ছিলেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরও খেলাধুলা ছাড়েন নি। কলেজের সব খেলায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তাসের ব্রিজ খেলা খুব ভালো পারতেন।
এপার বাংলাতে আগমনঃ
১৯৪৭ সালের কয়েক বছর আগে উপমহাদেশের অবস্থা খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল। ভারত ভাগ হওয়ার আগে চারদিকে দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে এমনই এক ধর্মীয় দাঙ্গার কারণে ইলা মজুমদারের পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। ১৯৪৬ সালে ঐপার বাংলার সব পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে এপার বাংলাতে চলে আসে।
এরপর তিনি আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। এইখানে ইন্টারমিডিয়েটে ( আই.এস.সি ) প্রথম বিভাগ নিয়ে পাশ করেন।
১৯৪৭ সালে তৎকালীন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, শ্রী নিকুঞ্জ বিহারী মাইতির উদ্যোগে মহিলাদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং সহ শিক্ষার সব ক্ষেত্রের পড়ার দরজা খুলে দেওয়া হয়। মন্ত্রী মশাই ঘোষণা করে দিলেও মেয়েদের ভর্তি করার সময় সমস্যা দেখা দিল। সেইসময় বি.ই কলেজে মেয়েদের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো ছিল না। যে সময় প্রবেশিকা পরীক্ষা হওয়ার কথা সেইসময় ছাত্রীরা পরীক্ষা দিতে পারেন নি। সেইজন্য তার পরের তারিখে বিশেষভাবে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ইলা মজুমদার সেই সাক্ষাৎকার ( Interview ) দেন।
ইলা মজুমদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষায় অত্যন্ত ভালো ফলাফল করলেন। তিনি বি.ই কলেজের ( তিনি "শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ"-এ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার সুযোগ পান। ) পাশাপাশি কলকাতা মেডিকেল কলেজেও নির্বাচিত হন।
ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েও ডাক্তারি না পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং - যেটা এতদিন শুধুমাত্র পুরুষরাই পড়তে পারত, সেইখানে এইবার থেকে মেয়েরাও পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করল।
তৎকালীন শিবপুরের কয়েকশো ভারতীয় এবং ইউরোপীয়ান ছাত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র ছাত্রী, যে শেষপর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়া শেষ করেন।
অজন্তা গুহ ও ইলা মজুমদার দুইজন প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। অজন্তা গুহ দ্বিতীয় বছরে কলেজ ছেড়ে দিয়ে চলে যান।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের জীবনঃ
ইলা মজুমদার যেসময় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলেন সেইসময় মেয়েদের জন্য আলাদা করে কোনো ছাত্রীনিবাস ছিল না।প্রাথমিকভাবে কলেজ কর্তৃপক্ষ অধ্যক্ষের আবাসনের নিচতলায় একটি ঘরে ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই ঘরের সাথে লাগোয়া একটি স্নানাগার ছিল। পরবর্তীকালে পাঠাগারের পাশে একটি আবাসনে ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ইলা মজুমদার পাঠাগারের বাম কোণের একটি ঘরে থাকতেন।
অজন্তা গুহ চলে যাওয়ার পর তিনি ছাত্রীনিবাসে একাই থাকতেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ একজন তত্ত্বাবধায়কের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই তত্ত্বাবধায়ক ছেলেদের ছাত্রনিবাস থেকে খাবার এনে দিত। চা বা অন্যকিছু খেতে মন গেলে বাইরে থেকে নিয়ে আসতেন। যতক্ষণ শ্রেণিকক্ষে (Class) থাকতেন বা খেলা ও অন্যান্য কাজে সংযুক্ত থাকতেন ততক্ষণ আনন্দে থাকতেন। বাকি সময়ে একাকীত্ব অনুভব করতেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, " জীবনটা খুব একাকী ছিল। "
ইলা মজুমদার পুরো ব্যাচের মধ্যে একমাত্র মেয়ে ছিলেন৷ প্রাথমিকভাবে ছেলেরা হতবাক হয়েগিয়েছিল,কিন্তু শীঘ্রই তারা ভাল বন্ধু হয়েগিয়েছিল৷ তিনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন, খোশগল্প করতেন, ঠাট্টা করতেন। ক্রিকেট খেলার সময় বন্ধুদের উৎসাহ দিতেন। ছেলে সহপাঠীদের সাথে স্বচ্ছন্দে মিশতেন, একজন মেয়ে হিসাবে কখনই অস্বস্তি বোধ করেন নি।
বিকেলে, ইলা মজুমদারা আঁকার ক্লাসে যেতেন। সেইসময় তাঁদের নিজেদেরকে আঁকার বোর্ড এবং টি-স্কয়ার ( T-square ) বয়ে নিয়ে যেতে হত। ক্লাস চলাকালীন, শত শত কৌতুহলী ছেলে বাইরে থেকে ইলা মজুমদারদের ক্লাস রুমে উঁকি দিত!
অজন্তা গুহ সবসময় ট্রাউজার ও শার্ট পরে থাকতেন। কিন্তু ইলা মজুমদার শাড়ি পরে থাকতেন।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পুলিন বিহারী ঘোষ কলেজের একমাত্র ছাত্রী ইলা মজুমদারকে শুরু থেকেই স্নেহ করতেন। প্রকৃতপক্ষে কলেজে ইলা মজুমদারের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। আর্থিক অসুবিধার জন্য পড়াশোনায় যাতে না বিঘ্ন ঘটে সেইজন্য কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক সবাই তাঁকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। অবশ্য আর্থিক সাহায্যের দরকার হয় নি। তাঁর বাবাই সমস্ত দায়িত্ব বহন করেছিলেন।
১৯৫১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়া সম্পূর্ণ করলেন। গড়লেন ইতিহাস। এতকিছুর পরও কলেজের প্রিন্সিপাল ভেবেছিলেন ভারত বোধহয় মহিলা ইঞ্জিনিয়ারের কাজের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তাঁকে ভুল প্রমাণ করে ইলা মজুমদার শিক্ষানবিশির জন্য গেলেন ইউরোপের গ্লাসগোতে। সেখানে 'বার অ্যান্ড স্টাইড' সংস্থা থেকে স্নাতকোত্তর শিক্ষা নেন।
কর্মক্ষেত্রঃ
তিনি সেখানকার স্টাফ কোয়ার্টারে একাই থাকতেন তিনি। ৬ মাস চাকরি করার পর ১৯৫৫ সালে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। প্রথমে "দিল্লি পলিটেকনিক"; এবং পরে "কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ জুট টেকনোলজি"-তে; লেকচারার ছিলেন তিনি।
কৃতিত্ত্বঃ
'কলকাতা মহিলা পলিটেকনিক' কলেজ - 'কলকাতা মহিলা পলিটেকনিক' ; গড়ে ওঠে তাঁদের কয়েকজনের উদ্যোগেই। এবং ইলা ছিলেন প্রথম প্রিন্সিপাল।
১৯৬৩ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর, কলকাতার গড়িয়াহাট রোডে বাংলার প্রথম মহিলা 'পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের' ( 'Women's Polytechnic, Kolkata' ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি যখন কলকাতার 'ইনস্টিটিউট অফ জুট টেকনোলজি'-তে লেকচারার ছিলেন তখনই এই পলিটেকনিক কলেজের ভিত তৈরি করেন।
প্রাথমিকভাবে আর্কিটেকচার ও ইলেকট্রনিক্স নিয়েই মূলত শুরু হয় পঠন পাঠন।
সহানুভূতিশীল ইলা দেবী ঃ এইসময়ে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগে। সেই স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বহু হিন্দু পরিবারকে সাহায্য করেছিলেন।
কোকিলা সাহা নামক এক বিধবা সর্বহারা মহিলাকে সঙ্গী করে কলকাতায় নিয়ে এসে নিজের আত্মীয়ের মতো আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং আজীবন নিজের সঙ্গী করেই রেখেছিলেন।
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকারঃ 'গ্লোবাল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড সায়েন্স ইনিভারসিটি, শিবপুর' ( Global Alumni Association of Bengali Engineering and Science University, Shibpur )-এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর কর্মজীবনে ঘটে যাওয়া লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে বলেছিলেন।
তাঁর উক্তিটিই সরাসরি দেওয়া হলঃ
"অবশ্যই, আমি আমার পেশাগত জীবনে সব সময় লিঙ্গ পক্ষপাতের মুখোমুখি হয়েছি। আমার মনে হয় সমাজের মানসিকতা বদলাতে অনেক সময় লাগবে, আর তা সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু যখন বাছাই (প্রমোশনের) সময় আসে,তখন কর্তৃপক্ষ তুচ্ছ অজুহাত খুঁজে বেড়ায়, যাতে একজন মহিলাকে উপযুক্ত জায়গা না দেওয়া হয়।কারণ, তাঁরা মনে করে যে, একজন মহিলা পুরুদের কর্মকর্তা (Boss) হতে পারে না।"
২০১৯ সালে ডিসেম্বর মাসে ৯০ বছর বয়সে পরলোকের পথে পাড়ি দেন।
যিনি আমাদের এত গর্বিত করেছিলেন তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। অনেকেই তাঁর নামও শুনে নি। অধিকাংশ মানুষের কাছে নাম বললে ভাববে, এঁরা আবার কে? কী জন্য মনে রাখব?
আজ নারী শিক্ষার জন্য আমরা কত কিছু করছি। কত রকম প্রকল্প করছি। কিন্তু যাঁরা নারী হয়ে প্রথম আমাদের এত গর্বিত করলেন তাঁদেরই ভুলে গেছি।
আমরা আমাদের লেখার মাধ্যমে ইলা ঘোষ ( মজুমদার ) -এর মতো মহীয়সী নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম।
কলমে - সো মা লা ই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন