সন্ধ্যেবেলায় সুধাকর বাবুকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যান তাঁর স্ত্রী সুরভী দেবী। সুধাকর বাবু একটি সরকারি অফিসে চাকরি করেন, প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতে রাত ন'টা-সাড়ে ন'টা বেজে যায়। আজ ওনাকে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ফিরতে দেখে সুরভী দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, "আজ হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলে? শরীর খারাপ করেনি তো?"
ঘড়িতে অ্যালার্ম দিলেও সঠিক সময়ে বাজতে মাঝেমধ্যে গন্ডগোল হয়ে যায়। পরেরদিন সুরভী দেবীই ঘুম থেকে ডেকে দেন সুধাকর বাবুকে। সেইমত তৈরি হয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে বাসে করে হাওড়া স্টেশন, তারপর সেখান থেকে ধানবাদ।
ট্রেনে চেপে কপালজোরে জানলার পাশে বসার জায়গা পেয়ে যান। স্টেশনে পৌঁছে খবরের কাগজ কিনে নিয়েছিলেন। মনস্থির করেন, ট্রেন ছাড়লে সেটি পড়তে শুরু করবেন। বাইরের মুক্ত বাতাস আর সঙ্গে খবরের কাগজ, যাত্রাপথ ভালোই কেটে যাবে তাঁর।
ট্রেন সবে গতি নিয়েছে এমন সময় একজন যুবক হাঁফাতে হাঁফাতে এসে সুধাকর বাবুর সামনের সিটে বসে পড়ে। তাঁর সোজাসুজি জানলার পাশে না হলেও মুখোমুখিই বলা চলে। সুধাকর বাবু জিজ্ঞাসা করেন, "কতদূর যাবে?"
ছেলেটি সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলে, "ধানবাদ।"
"আমিও ধানবাদেই যাচ্ছি, অফিসের কাজে।" বলেন তিনি। "তুমি ধানবাদের কোথায় যাচ্ছ?"
ছেলেটি জানায় সেখানে তার রেলপুলিশের পরীক্ষার সিট পড়েছে। কিছুক্ষণ পর খবরের কাগজটা খুলে সুধাকর বাবু সেটিতে মনোযোগ নিবদ্ধ করেন।
পৃষ্ঠা ওল্টাতে গিয়ে ছেলেটির দিকে চোখ পড়ে। ভদ্র সভ্য চেহারা, জামাকাপড়ে দারিদ্র্যের ছাপ রয়েছে। সুধাকর বাবুর মনে হলো কোনো কিছু নিয়ে ছেলেটি চিন্তিত, উশখুশ করছে। পরীক্ষার টেনশন হয়তো। ট্রেনে কফিবিক্রেতা উঠতে তিনি কফি কেনেন, ছেলেটিকেও দেন। সে তো কিছুতেই নেবে না, তারপর রাজি হয়। কফি পান করতে করতে ছেলেটির সঙ্গে সুধাকর বাবু টুকটাক কথা বলতে থাকেন, এতে যদি সে কিছুটা টেনশন ফ্রি হয়।
দেখতে দেখতে বরাকর পার হয়ে যায়, কালো কোট গায়ে টিকিট পরীক্ষক ওঠেন। সকলের টিকিট পরীক্ষা করতে করতে সুধাকর
বাবুদের দিকে আসেন। সযত্নে রাখা টিকিটটি বার করে সুধাকর বাবু টিকিট পরীক্ষককে
দেখান। তারপরেই শুরু হয় ঝামেলা।
ছেলেটির কাছে টিকিট নেই। টিকিট পরীক্ষক ধমকধামক দিতে সে জানায় হাওড়া থেকে তার বাড়ি অনেকটা দূরের পথ। আগে পৌঁছনোর জন্য ভোর ভোর বেরিয়েও স্টেশনে পৌঁছোতে তার দেরি হয়ে যায়। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে দেখে টিকিট কাটার আর সময় পায় না সে। দৌড়ে গিয়ে কোনরকমে ট্রেন ধরে। পরের ট্রেনটা ধরতে গেলে পরীক্ষার সময় পেরিয়ে যেতো।
সবকিছু শুনে টিকিট পরীক্ষক ট্রেন ভাড়া ও জরিমানা বাবদ টাকার অঙ্ক ছেলেটিকে দিয়ে দিতে বলেন। ছেলেটি কাতরকন্ঠে জানায় তার কাছে ওই পরিমাণ টাকা নেই। ট্রেনভাড়া, বাসভাড়া বাবদ যতটুকু টাকা হয় সেটুকুই সে নিয়ে বেরিয়েছে। অতিরিক্ত আরো দশ টাকা থাকবে হয়তো।
ছেলেটির মুখ দেখে সুধাকর বাবুর বড়ো মায়া লাগে। একসময়ে তিনি ছাত্র পড়াতেন, তাঁর সেইসব ছাত্রদের মতোই মুখের আদল ছেলেটার। টিকিট পরীক্ষককে জানান টাকাটা তিনিই দিয়ে দেবেন। সেইমত টাকা নিয়ে টিকিট পরীক্ষক তাঁকে রশিদ কেটে দেন। সুধাকর বাবু ছেলেটিকে রশিদটা দেন। ছেলেটি তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। সুধাকর বাবুর ফোন নম্বরটা সে নিয়ে নেয় আর কথা দেয় যে ফোনে যোগাযোগ করে তাঁর সঙ্গে দেখা করে সে টাকাটা অবশ্যই ফেরত দিয়ে আসবে।
কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এর মধ্যে সুধাকর
বাবুর বেশ কয়েকবার কর্মসূত্রে ধানবাদ যাওয়া হয়ে গেছে। যাতায়াতের পথে ছেলেটিকে
আর চোখে পড়ে না। ছেলেটি ফোন করেনি,
টাকাও ফেরত
দেয়নি। সুধাকর বাবু মনে মনে ভাবেন,
টাকাটা নাহয়
গেছেই, কথা কেউ রাখে না।
এরকমই একদিন ধানবাদ যাওয়ার পথে টাকার ব্যাগটি খুইয়ে বসেন সুধাকর বাবু। বেশ কিছু টাকা আর টিকিটটা পকেটে ছিল, তাই রক্ষা। তিনি ঠিক করেন ধানবাদে নেমে জি.আর.পি.-তে অভিযোগ জানাবেন। সেইমত গন্তব্যে পৌঁছে জি.আর.পি.-এর অফিসে যান তিনি। কর্মরত অফিসারকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। অভিযোগ নথিবদ্ধ করতে সেই অফিসার তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করেন।
নাম শুনেই অফিসার সটান সোজা হয়ে বসে আবেগঘন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন, "চিনতে পারছেন আমাকে?"
বিস্মিত সুধাকর বাবু মাথা নাড়েন। না, চিনতে পারছেন না।
সেই অফিসার হাসিমুখে বলেন, "আপনার মনে পড়ে বেশ কয়েকবছর আগে একটি ছেলেকে আপনি বিনা টিকিটের হয়রানি থেকে বাঁচিয়েছিলেন? ছেলেটি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল.."
মুহূর্তখানেক ভাবতেই সুধাকর বাবুর মনে পড়ে যায় ঘটনাটা। বলেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে।"
অফিসার স্মিত হাসেন, "সেই ছেলেটি আমিই ছিলাম।" বলে চেয়ার থেকে উঠে এসে সুধাকর বাবুকে প্রণাম করতে যান।
সুধাকর বাবু হইহই করে ওঠেন, "একী করছেন!"
অফিসার বলেন, "আপনাকে একটিবারের জন্য আমায় প্রণাম করতে দিন। সেদিন আপনি ওভাবে সাহায্য করেছিলেন বলেই আমি পরীক্ষায় বসতে পেরেছিলাম আর তার জন্যই আজ এই চেয়ারে বসতে পারছি।"
খুব খুশি হন সুধাকর বাবু। তাঁর করা সাহায্য যে একজনের এতখানি উপকারে আসতে পারে তিনি কল্পনাই করতে পারেননি।
অফিসার বলেন, "আমি অত্যন্ত দুঃখিত আর একইসঙ্গে লজ্জিত যে ওইদিনের পর থেকে আপনার সঙ্গে আর যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। যে কাগজের টুকরোয় আপনার ফোন নম্বরটা লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম সেটি কোনোভাবে হারিয়ে যায়।"
টাকার ব্যাগ খোয়া যাওয়ার অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়ে গেলে চলে যেতে উদ্যত হন সুধাকর বাবু। অফিসার তাঁকে যেতে দেন না। অনেক অনুরোধ করে তাঁকে নিয়ে যান নিজের অফিসের কোয়াটার্সে। তাঁর মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, জলযোগের ব্যবস্থা করেন।
সেই অফিসার ও তাঁর মায়ের যত্নে ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ সুধাকর বাবু তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নেন। অফিসার তাঁকে সেদিনের সেই টাকা ফেরত দিতে আসেন। সুধাকর বাবু কিছুতেই নিতে চান না। অফিসার অনুরোধ করেন, "টাকাটা বড়ো কথা নয়। সেদিন আপনি একজন অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা আপনার অবশ্যই প্রাপ্য। আপনি এটা না নিলে আমি অপরাধবোধে ভুগবো। সেদিনের টাকার অঙ্কটা আপনাকে ফেরত দিয়ে দিলেও আপনার আশীর্বাদ আমার সঙ্গে সারাজীবন রয়ে যাবে।"
অফিসের কাজে অনেকবারই ধানবাদ গেছেন সুধাকর বাবু। কিন্তু সেদিনের ধানবাদ ভ্রমণ এক তৃপ্তির রেশ ছড়িয়ে দিল তাঁর মনে।
কলমে - চি ন্ম য় ঘো ষা ল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন