গৃহসজ্জায় হস্তশিল্প

 


শীতকাল ঋতুটা বাঙালির কাছে বড়োই পছন্দের। অনেক ভালোলাগা জড়িয়ে আছে এই ঋতুর সঙ্গে। শীতের মিঠে রোদের আমেজ থেকে শুরু করে নলেনগুড়ের সুঘ্রাণ, পিঠেপুলির আস্বাদন, চিড়িয়াখানা ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বেড়াতে যাওয়া অথবা দু'দিনের জন্য কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসা, চড়ুইভাতি, এমনই অনেক পছন্দের জিনিসের সমাগম হয় এই শীতকালেই। এগুলির অন্যতম হলো রকমারি মেলার আয়োজন।

পৌষপার্বণ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন মেলা তো আছেই, এছাড়াও রয়েছে বইমেলা। শুধু কলকাতা বইমেলার নাম উল্লেখ করলে সত্যিই অন্যায় হবে। যাঁরা কলকাতা থেকে দূরে বসবাস করেন তাঁরাই বা এমন সুন্দর সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হবেন কেন! তাই বর্তমানে কলকাতা বইমেলা ছাড়াও নানান জায়গাতেই বইমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। বইমেলা ব্যতীত অপর একটি উল্লেখযোগ্য মেলা হলো হস্তশিল্প মেলা। শীতের দুপুর ও বিকেলের আনাচে কানাচে এমনই অনেক হস্তশিল্প মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে যা দেখলে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়।

হস্তশিল্প মেলার মুখ্য আকর্ষণ হলো এটি রকমারি জিনিসপত্রের সম্ভারে পরিপূর্ণ — শাড়ি, কুর্তা, চাদর থেকে শুরু করে গয়নাগাটি, ঘর সাজানোর টুকিটাকি জিনিসপত্র, আসবাবপত্র, সবকিছু। অনেকেই হস্তশিল্প মেলায় ঘুরতে গিয়ে আগে থেকে স্থির করে রাখা দু'চারটে জিনিস কেনার পরিবর্তে ঘর সাজানোর জন্য হাতভর্তি জিনিস নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তারপর চিন্তায় পড়ে যান যে এত সব জিনিস নিয়ে কী করবেন, কোথায় রাখবেন! ঘর সাজাবেন ভেবে তো কিনে নিলেন, কিন্তু আদতে অপচয় হলো নাতো!

এই নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বাঁশ, মাটি, পাট, মাদুরের মতো সাধারণ কিছু জিনিস দিয়ে অনায়াসেই অন্দরমহলের ভোল বদলে ফেলা যায়৷ এই প্রসঙ্গেই জেনে নেওয়া যাক হস্তশিল্প মেলার জিনিসপত্র দিয়ে ঘরে কীভাবে আনা যায় নতুনত্বের ছোঁয়া, সাবেকিয়ানার পরশ।

দেওয়ালে থাকুক ঐতিহ্যের ছোঁয়া :

 


হস্তশিল্প মেলায় এমন অনেককিছুর প্রাচুর্য্য থাকে যেগুলো দিয়ে ঘরের দেওয়ালটি সাজালে তা এক অন্য মাত্রা এনে দেবে ঘরের। মেলায় পাওয়া কারুকার্য করা বেতের ঝুড়ি, নকশা তোলা হাতপাখা অথবা কলকা আঁকা কোনো কাপড়কে ফ্রেম করিয়ে সাজিয়ে ফেলা যায় ঘরের দেওয়াল। মাটির তৈরি শো-পিস বা পাত্র লাগানো যেতে পারে। বিভিন্ন ডিজাইনে ঘরের দেয়াল রং না করিয়ে সনাতনী কোনো ওয়াল আর্ট টাঙিয়ে দেওয়া যায়। হস্তশিল্প মেলায় পাওয়া মধুবনী আর্ট, আদিবাসী ডিজাইনের ছবি অথবা ক্যানভাসের ছবি এনে দেবে সাবেকিয়ানার ছোঁয়া। এছাড়াও রয়েছে পটচিত্র। তালপাতা বা কাগজের ওপরে নক্সা করা এইসব পটচিত্র চিরাচরিত সেই চেনা ঘরকে অচেনা করে দেবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে ঘর যেন সর্বদা ছিমছাম থাকে৷

চাদরে মেঝেতে সাবেকিয়ানা :

 



শুধু দেওয়ালই নয়, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে কার্পেট, সোফার কভার, কুশন কভার, টেবিল ক্লথ সবকিছুই সাজিয়ে ফেলা যায় হস্তশিল্প মেলার সামগ্রী দিয়ে। এই মেলায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পী ও কারিগররা আসেন তাঁদের শিল্প সম্ভার নিয়ে। সেইসব শিল্পীদের বুনন জামাকাপড়, চাদর, সোফা ও কুশন কভার সবকিছুতে ছড়িয়ে দেয় ঐতিহ্যের পরশ। চাদরের ক্ষেত্রে খেশ অথবা খাদির ফেব্রিকের চাদর সুন্দরভাবে মানানসই। মেঝেতে কার্পেট থাকলে এথনিক ডিজাইনের নকশা করা কার্পেট এবং সুন্দর সুন্দর জয়পুরি কার্পেট আদর্শ। টেবিলের জন্য প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায় সুতির কাপড়ের সুন্দর কলকা আঁকা টেবিল ক্লথ। বসার ঘরের সোফার কভারের সঙ্গে মিলিয়ে মেঝেতে বিছানো যেতে পারে মানানসই শতরঞ্জি।

আসবাবপত্রে বাঁশ ও বেত :


সাধারণ সোফার পরিবর্তে বেতের সোফা রাখলে ঘরের সৌন্দর্য্যে একটি নান্দনিক মাত্রা যুক্ত হয়। এছাড়াও বাঁশ বা বেতের চেয়ার বা মোড়া সুন্দরভাবে মানানসই হয়ে যায়, জায়গাও বেশি নেয় না। ঘরের কোণে ছোট একটি বেতের ওয়ার্ডরোব এনে দিতে পারে ভিন্ন আমেজ। সন্ধ্যেবেলায় বারান্দা-বাগানে বেতের চেয়ারে বসে কফি পান করতে করতে পছন্দের গান শুনলেই মনটা সতেজ হয়ে যাবে। বসার জিনিস ছাড়াও বেতের আয়না ঘরকে সৌন্দর্য্যমন্ডিত করে তোলে।

বাঁশ ও বেতের আসবাবপত্রের সৌন্দর্য্যের অন্য একটি দিক হলো বিভিন্ন রঙের ব্যবহার। সাদা, ধূসর, কফি, অফ হোয়াইট ও বার্নিশের প্রচলন এক আলাদা মাত্রা এনে দেয়। এইসব আসবাবপত্রের মেরামতির ঝামেলা প্রায় নেই। বাঁধন খুলে গেলে আবার বাঁধিয়ে রং করিয়ে নিলেই নতুনের মতো হয়ে যায়। যত্নআত্তির কথা বলতে গেলে বেতের আসবাবপত্র সহজে ধোওয়া যায়, আবার রোদে শুকিয়েও নেওয়া যায়। বাঁশের আসবাব হলে শুকনো কাপড় দিয়ে অন্তত দুই দিন পরপর মুছতে হয়।

ঘরের শোভায় মৃৎশিল্প :


ঘর সাজাতে মাটির তৈরি জিনিসের জুড়ি মেলা ভার। আর যেকোনো হস্তশিল্প মেলাতেই রংবেরংয়ের নকশা তোলা সুন্দর সুন্দর মাটির জিনিস পাওয়া যায়। কলকা আঁকা হ্যারিকেন বা মাটির কলসি বা কৃষ্ণনগরের পুতুলের সহজেই জায়গা করে নেয় শহরের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটগুলিতে। ঘর সাজানোর টুকিটাকি সরঞ্জামের মধ্যে রাখা যায় বিষ্ণুপুরী ঘোড়া। বসার ঘরের টেবিল বা সোফার পাশে রাখা যায় মাটির তৈরি পুতুল, খেলনা, কলমদানি, মোমদানি, টেবিল ল্যাম্প অথবা ফুলদানি। এতে খুব সহজেই অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। ঘরকে অতি সহজে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিভিন্ন মাটির সামগ্রী যেমন পুতুল, ঢেঁকি, বাসন, সরা, পাত্র, বাহারি প্রতিকৃতি ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। মাটির তৈরী সুন্দর কোনো ওয়াল হ্যাঙ্গিং অথবা উইন্ড চাইমস ঘরের শোভা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও আছে নকশা তোলা মাটির কলসি। বড় বড় চারটি কলসি চারদিকে রেখে তার উপর কাচ বসিয়ে দিলেই চমৎকার সেন্টার টেবিল হয়ে যাবে।

ঘর সাজাতে টেরাকোটা :


মৃৎশিল্পের প্রসঙ্গে আগে উল্লেখ করলেও টেরাকোটার কথা আলাদা করে না বললেই নয়। হস্তশিল্প মেলায় টেরাকোটার জিনিসপত্র বিশেষভাবে নজর কাড়ে। টেরাকোটার তৈরি গাছের টব বা ফুলদানি বসার ঘরের শোভা বৃদ্ধি করে। টেরাকোটার পুতুল কিংবা ঘোড়া দিয়ে সাজিয়ে নেওয়া যায় টেবিল টপ। আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে মূল দরজার সামনের ফ্রেমে মাটির টেরাকোটার ব্যবহার অত্যন্ত দৃষ্টিনান্দনিক। ওয়াল ডেকোরে ব্যবহার করা যায় টেরাকোটার মাটির পাত্র বা ছোট ছোট ওয়াল পিস। সিলিং সাজানোর জন্য রয়েছে পোড়ামাটির ব্লক, ঘন্টা এবং হাঁড়ি।

তবে টেরাকোটা দিয়ে অন্দরসজ্জার ক্ষেত্রে আলোকসজ্জার ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি আলোর পরিবর্তে সাধারণত হালকা আলো এই ধরনের অন্দরসাজে বেশি মানানসই। সেই কারণে অন্দরে আলোকসজ্জায় স্পটলাইটের ব্যবহার করলে বেশি ভালো দেখায়। সম্ভব না হলে হ্যাঙ্গিং ল্যাম্পশেডের ব্যবহারও করা যেতে পারে।

ঘরের শোভায় পাট :


 
ঘর সাজাতে পাটের ব্যবহার বেশ ভালোরকম ভাবেই পরিলক্ষিত হয়। বসার ঘরে সোফার সঙ্গে মিলিয়ে পাটের তৈরি কুশন কভার আর পর্দা বেছে নেওয়া যেতে পারে। মেঝেতে বিছানো থাকবে রঙিন কার্পেট ও ফ্লোরম্যাট। বসার ঘরের টেবিলের পাশে পাটের তৈরি ল্যাম্পশেড অথবা সেন্টার টেবিলের মাঝখানে পাট দিয়ে বানানো শোপিস রাখলে দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। সেই সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে যে ম্যাট বা রানার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় থাকে, সেটিও পাটের হতে পারে। এই ম্যাটের মাঝখানে একটা মাটির পাত্র রাখলে তা অত্যন্ত নান্দনিক লাগে। দেওয়ালে ঝোলানো যায় পাটের তৈরি ওয়াল হ্যাঙ্গার, ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে রাখা যাবে। এছাড়াও ঘরে রাখা মাটির টবগুলো পাটের ব্যাগের কভার দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে। পাটের শিকায় ঝোলানো এক টুকরো সবুজ বসার ঘরে এনে দিতে পারে সতেজ ভাব। পাটের তৈরি দোলনাও ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ঘরের মধ্যে ছোটখাটো শুকনো ময়লা ফেলতে ওয়েস্টবিন হিসেবে পাটের ঝুড়ি ব্যবহার করা যায়।

 অন্দরসজ্জায় ছৌ :


 
ছৌ নৃত্যের কথা তো সকলেরই জানা। পুরুলিয়ার গাঢ় রঙের এইসব মুখোশ গৃহসজ্জার জন্য একেবারে আদর্শ। মাটি দিয়ে তৈরি এই মুখোশ কাপড় বা কাগজের ওপর দিয়ে, জরি এবং ময়ূরের পালক দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়। আর এই রকমারি মুখোশ দিয়ে বসার ঘর সাজালে তা ঘরের সৌন্দর্য্যে এক আলাদা মাত্রা যোগ করবে।

হস্তশিল্প মেলা আমাদের নিজস্ব। এই মেলায় দূরদূরান্ত থেকে যে সমস্ত শিল্পী ও কারিগররা নিজেদের শিল্পসামগ্রী নিয়ে আসেন সেগুলির প্রত্যেকটিতে থাকে শিল্পীদের হাতের যত্নের ছোঁয়া, তাঁদের নিপুণ তুলির টান। সেইসব জিনিস দিয়ে ঘর সাজালে শুধুমাত্র ঘরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিই হবে না, রুচিশীলভাবে ঘরটি সাজিয়ে রাখলে তাঁদের শিল্পকে সম্মান জানানো হবে।

 


কলমে - গী ত শ্রী  ঘো ষা ল 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন