ত্বকের বিভিন্ন ধরণের সমস্যার মধ্যে কালো বা বাদামী রঙের দাগ ছোপ হওয়ার সমস্যা খুবই সাধারণ। বর্তমান যুগের ধোঁয়া- দূষণ পরিবেশের অন্যতম কুপ্রভাব হল ত্বকের দাগ হওয়া। ধুলো-ময়লা, প্রখর রোদ ও দূষণের কারণে মুখের ত্বকে দেখা দেয় কালো দাগ বা পিগমেন্টেশনের সমস্যা।মুখে বিভিন্ন কারণে কালো দাগ হতে পারে। মেছেতা, রোদে পোড়া, ব্রন-ফোঁড়া বা অন্য কোনো ত্বকের সমস্যা বা বিভিন্ন জটিল শারীরিক অসুস্থতা থেকে দাগ তৈরি হতে পারে। ত্বকের দৈনন্দিন পরিচর্যার দ্বারা কিছু দাগের সমস্যার থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। সাধারণত বলা হয় পঁচিশ বছরের পর থেকেই নিয়মিত ত্বকের যত্ন নেওয়া উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে এই ধরণের দাগ-ছোপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
প্রথমেই বলব একজন
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া
উচিত। কোন সমস্যা থেকে দাগ তৈরি হয়েছে তা বুঝে সঠিক পদ্ধতি ও
প্রয়োজনীয় ওষুধের দ্বারা দাগ নির্মূল করার ব্যবস্থা তিনিই করতে পারেন।
ত্বকের যত্নের জন্য নিয়মিত কিছু যত্ন
নেওয়া প্রয়োজন। নিয়মিত মুখ পরিষ্কার করা বাধ্যতামুলক করা দরকার। স্ক্রাবিং, ক্লিন্সিং, টোনিং ও ময়সচারাইজিং – এই
চারটি প্রক্রিয়া দৈনন্দিন ত্বক পরিচর্যার তালিকাভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মেছেতার দাগ-
মুখের ত্বকে মেছেতার দাগ হওয়া খুব সাধারণ
এবং তুলনামূলকভাবে বেশী হওয়া সমস্যা। মেছেতার দাগ সহজে দূর করা যায় না। নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি ছাড়া অন্য
কোনো উপায়ে এই ধরণের দাগ দুরীকরন অসম্ভব।ইদানিং কেমিক্যাল পিলিং (Chemical
Peeling), PRP, মাইক্রোনিডলিং (Microneedling), মেসোথেরাপি (mesotherapy), ডার্মাল
ইনফিউসন (Dermal infusion) প্রভৃতি পদ্ধতির ব্যবহারে মেছেতা দূরীকরণের চেষ্টা করা হয়।তবে চিকিৎসা একজন অভিজ্ঞ ত্বক বিশেষজ্ঞই করতে পারেন।
ব্রণর দাগ -
মেছেতার
পরেই আসে ব্রণর কারণে তৈরি হওয়া দাগের সমস্যা। ব্রণের দাগ প্রতিরোধ করার প্রধান পদক্ষেপ হচ্ছে ব্রণের
চিকিৎসা করানো। অধিকাংশ সময়ে ব্রণের চিকিৎসা করিয়ে ব্রণ বেরোনো বন্ধ করতে পারলে,
পরের কয়েক মাস-বছরে দাগ আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যায়। তবে ব্রণ থেকে তৈরি গভীর ক্ষতসহ দাগ বা স্কারের
ক্ষেত্রে এটি খাটে না কারণ স্কার নিজে নিজে কমে না। বেশি স্কার হওয়া এড়াতে অবশ্য
তাড়াতাড়ি ব্রণের চিকিৎসা দরকার।ব্রণের চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ ও মলম দেওয়া হয়,
বিশেষতঃ রেটিনয়েড, তা দাগও কিছুটা নিরাময় করতে পারে। তবে স্কার কোনো ওষুধ বা
মলম দিয়ে সারানো যায়না।কালো-বাদামি দাগের ভালো চিকিৎসা হল কেমিক্যাল পিল (peel)। এতে
মুখে এক ধরণের দুর্বল অ্যাসিড লাগিয়ে দেওয়া হয় যা ত্বকের ভিতর ঢুকে পিগমেন্টকে
ভেঙে দেয় ও উপরের মরা চামড়া তুলে দেয়। নিচ থেকে নতুন উজ্জ্বল চামড়া বেরোয়। স্কার
বা ক্ষত চিকিৎসা করার জন্য কেমিক্যাল রিকন্সট্রাকশন, এবলেটিভ লেজার, মাইক্রোনিডলিং ইত্যাদি চিকিৎসা হয়। এগুলিতে ক্ষতর চারপাশের
কোষগুলিকে স্টিমুলেট করে নতুনভাবে কোলাজেন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়,
যাতে গর্তগুলি ভরে গিয়ে ত্বক মসৃণ হয়ে ওঠে।তবে এই চিকিৎসাগুলিও অভিজ্ঞ ত্বক বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই করানো
উচিত।
এছাড়া অন্য কিছু দাগ হয় যা সাধারণ ঘরোয়া
উপায়ে দূর করা সম্ভব। সেইরকম কিছু উপায় উল্লেখ করা হল ।
এক চা-চামচ কমলার খোসার গুঁড়োর সঙ্গে আধা চা-চামচ মধু মিশিয়ে নিয়ে দাগের ওপর লাগিয়ে ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।ধুয়ে ফেলতে হবে। টানা চার থেকে পাঁচ দিন এই মিশ্রণটি লাগালে দূর হবে ত্বকের দাগ।
আধা চা-চামচ মসুর ডালবাটা ও বেসনের সঙ্গে ডিমের কুসুম ও কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে নিতে হবে। পুরো মুখে ১৫ মিনিট লাগিয়ে রেখে দুয়ে ফেলতে হবে। এতে মুখের ছোপ ছোপ দাগ দূর হবে। কমলালেবুর খোসায় উপস্থিত সাইট্রিক অ্যাসিড ও ভিটামিন সি ত্বকের দাগছোপ দূর করতে সাহায্য করে।
ডাবের জল ফ্রিজে রেখে আইস কিউব করে নিতে হবে। এবার ঘুমানোর আগে দাগের ওপর সেই বরফের টুকরো ঘষে নিতে হবে। বা ডাবের জলে তুলো ভিজিয়ে দাগের জায়গায় ভালো করে লাগিয়ে সারারাত রেখে দিয়ে সকালে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে ব্রনের দাগ, পক্স থেকে তৈরি দাগ, পোড়া দাগ দূর হয়।
অল্প আমন্ড অয়েল গরম করে নিতে হবে। এবার ২ থেকে ৩ ফোঁটা অয়েল আঙ্গুলে লাগিয়ে নিয়ে দাগের জায়গায় কিছুক্ষণ মালিশ করতে হবে। ঘন্টা খানেক রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে।আমন্ড প্রাকৃতিক ব্লিচিং হিসেবে কাজ করে ও দাগ হালকা করতে সাহায্য করে। তাছাড়া এতে ভিটামিন এ এবং ই থাকে যা ত্বককে ভেতর থেকে পুষ্টি যোগায়।
পাকা পেঁপে ত্বকের দাগ দূর করতে বেশ কার্যকর। এর সঙ্গে দুধ ও মধু মিশিয়ে নিয়ে মেখে রেখে হালকা উষ্ণ জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
মুখের কালো দাগ সরাতে ভালো কাজ করে আলুর রস। এক্ষেত্রে আলুর রসের সঙ্গে সামান্য মধু মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে নিতে হবে। শুকিয়ে গেলে পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। আলুতে উপস্থিত ক্যাটেকোলেজ নামক একধরনের উপাদান ত্বক উজ্জ্বল করতে এবং রোদে পোড়াভাব দূর করতে সাহায্য করে।
অ্যালোভেরা জেল বা রস, মুখের দাগের উপর আলতো হাতে মালিশ করে নিতে হবে। প্রত্যেকদিন এর ব্যবহারে মুখের দাগ মুছে গিয়ে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে অ্যালোভেরা থেকে রস বের করে নিতে হবে। এর রস লাগানোর আগে মুখ ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর রস মুখে দিয়ে মাসাজ করতে হবে। এছাড়া অ্যালোভেরা জেল দিয়ে মাস্ক বানিয়েও ব্যবহার করা যায়।রাতে এই জেল লাগিয়ে, সকালে ধুয়েও ফেলা যায়। কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না।অ্যালোভেরা জেল ডার্ক সেলের ডিপিগমেন্টেশন করে আর দাগ কমায়।
শসা ও টমেটো মুখের উজ্জ্বলতা ও আর্দ্রতা বজায় রাখতে দুটোই কার্যকরী। কয়েকটি শসার টুকরো নিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করে নিয়ে, তাতে সামান্য মধু ভালো করে মিশিয়ে মুখে লাগাতে হবে।
টমেটো কেটে মুখে আলতোভাবে ঘষতে হবে। তারপর শুকিয়ে গেলে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।বা টমেটোর রস বার করে নিয়ে, তাতে তুলো ভিজিয়ে মুখে ভালো করে লাগিয়ে রেখে ৩০ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলতে হবে।
টেবিল চামচ অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার ও ১ চা চামচ মধু ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার কালো দাগের ত্বকে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। হালকা গরম জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। যদি শুধুমাত্র কালো দাগের অংশে লাগানো হয়, তাহলে এই প্যাকটি প্রতিদিন ব্যবহার করা যেতে পারে। আর যদি পুরো মুখে লাগানো হয় তাহলে একদিন পর পর ব্যবহার করতে হবে।অ্যাপেল সাইডার ভিনেগারে থাকে ম্যালিক এসিড যা ডার্ক সেলকে এক্সফোলিয়েট করে ভিতর থেকে কালো দাগ দূর করে।
কলার খোসার ভিতরের দিকটি নিয়ে কালো দাগের জায়গায় ৩ থেকে ৪ মিনিট হালকা হাতে ঘষতে হবে। এরপর আরো ৫ মিনিট রেখে দিতে হবে, যাতে কলার খোসার অংশগুলো ত্বক শুষে নেয়। প্রতিদিন একবার করে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।কালো দাগ হালকা করতে ও বয়সের ছাপ দুর করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলে গ্লুকোনোল্যাক্টোন যা কলার খোসাতে পাওয়া যায়।
ত্বকের যত্নে টি ট্রি অয়েল খুব জনপ্রিয়। ত্বকের দাগ কমাতে এই টি ট্রি অয়েল ব্যবহার করা হয়। ১-২ ফোঁটা তেল নিয়ে মুখে কিছুক্ষণ মালিশ করে নিতে হবে। কয়েক ঘন্টা রেখে দিতে হবে।প্রয়োজনে দিনে ১-২ বার এই এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। টি ট্রি অয়েলের হিলিং প্রোপার্টিজের কারণে এটি দাগ কমায় সাথে ব্রণের সমস্যা দুর করে মসৃণ ত্বকের অনুভূতি দেয়। যাদের ত্বক অনুভূতিপ্রবণ তারা টি ট্রি অয়েলের সাথে ২-৩ ফোঁটা অন্য কোন তেল যেমন অলিভ অয়েল বা জোজোবা অয়েল মিশিয়ে নিতে পারেন।
১টেবিলচামচ টক দই ও ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে মাস্ক তৈরি করে নিয়ে, পরিষ্কার মুখে লাগিয়ে ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। ১০ মিনিট পর ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এই মাস্কটি প্রতিদিন একবার করে ব্যবহার করা যেতে পারে। দাগ দুর করে ত্বকের স্বাভাবিক রং ফিরিয়ে আনার জন্য জন্য টকদই ও মধু খুবই উপকারী।
হলুদে থাকে কারকিউমিন নামক একটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট অ্যান্টি-মেলানজেনিকের প্রভাবে মুখের কালো দাগ হালকা করতে সহায়তা করে। হলুদ এবং কয়েক ফোটা জল মিশিয়ে একটি গাঢ় মিশ্রণ তৈরি করতে হবে।এরপর মিশ্রণটি কালো দাগের আশেপাশে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে। প্রতিদিন একবার এই মিশ্রণটি ব্যবহার করা যাবে।
ত্বকে কালো দাগ দূরীকরণে
কিছু প্রয়োজনীয় খাদ্যঃ
শুধু ত্বকের পরিচর্যা বাইরে থেকে করলেই ত্বক সুন্দর ও দাগহীন হয় না। দৈনন্দিন স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাসও ত্বককে দাগছোপ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। তাই খাদ্য তালিকায় স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি ও ব্ল্যাকবেরি প্রভৃতি যোগ করা দরকার। এগুলিতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফলিক অ্যাসিড বর্তমান। ভিটামিন সি ফ্রি-রেডিকেলের হাত থেকে রক্ষা করে কালো দাগ কমাতে সহায়তা করে। এটি রোদে পোড়া ও প্রদাহের হাত থেকে রক্ষা করে।বেরির মতোই বিভিন্ন ধরণের লেবুতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি, যা ত্বকের যত্নে খুবই উপকারী। এটি ব্রণ প্রতিরোধে সহায়ক।এছাড়া ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী ফল হল পেঁপে। এতে ভিটামিন এ, বি, সি, কে, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামে বর্তমান।পেঁপেতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফ্রি-রেডিকেলের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়, যা ত্বকে কালো দাগের জন্য দায়ী। ত্বক উজ্জ্বল করতেও দারুণ কার্যকর পেঁপে।স্বাস্থ্যের পাশাপাশি ত্বকের যত্নে টমেটো বেশ কার্যকর। এতে থাকা ভিটামিন এ ত্বকে নতুন কোষ উৎপাদন করে। টমেটোতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি, যা ফ্রি রেডিকেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং কোলাজেন উৎপাদন বাড়িয়ে ত্বকে তারুণ্য আনে। মিষ্টি আলুতে থাকা রেটিনল অ্যান্টি-এজিং ক্রিম ও সিরামে ব্যবহৃত হয়। এটি বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ, যা ত্বককে বিবর্ণ হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং প্রদাহ থেকে সুরক্ষা দেয়। মিষ্টি আলুতে রয়েছে অ্যান্থোসায়ানিনস, যা ত্বকের কালো দাগ দূর করতে সাহায্য করে।তাই রোজকার খাবারের তালিকায় এই খাবার যোগ করলে বয়সজনিত কারণে ত্বকের দাগ ছোপ দূর করা সহজ হয়ে যায়।
মুখের কালো দাগ তোলার
সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।তাঁদের কথায় "অনেক সময় দাগ
তুলতে গিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি করে ফেলি। অতিরিক্ত ক্রিম মাখলে তা থেকে মুখে জ্বালা হতে
পারে,
তাতে দাগ আরও গাঢ় হয়ে যেতে পারে। ঠিকভাবে পরিচর্যা করুন,
মুখের দাগ চলে যাবে। পাশাপাশি,
মুখে কেন কালো দাগ পড়ছে, সেটা জানাও খুব দরকার। অনেকে মনে করেন সব দাগই এক! আসলে
কিন্তু তা নয়! দাগের কারণ আর ধরনের ওপর নির্ভর করে আলাদারকম চিকিৎসা আর পরিচর্যার দরকার হয়। সমস্যার কারণ
খুঁজুন, তারপর
সঠিক পরামর্শ মেনে তার চিকিৎসা করুন, দাগ নিশ্চয়ই চলে যাবে।"
কলমে - শ্বে তা মি ত্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন