ঋষি অগ্যস্তর পূর্বপুরুষরা একবার তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিলেন। জানালেন যে তাঁরা অত্যন্ত কষ্টে আছেন, স্বর্গের প্রবেশদ্বার তাঁদের জন্য অবরুদ্ধ। অগ্যস্ত যেহেতু তাঁদের বংশের শেষ বংশধর, সুতরাং শ্রাদ্ধক্রিয়াদি এবং তর্পণাদি করার আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। এই সমস্যা থেকে একমাত্র তিনিই তাঁর পূর্বপুরুষদের বার করে আনতে পারেন। তবে তার জন্য তাঁকে বিবাহ করতে হবে।
অগ্যস্ত পড়ে গেলেন মহা মুশকিলে। তিনি সারাটা জীবনে বনেজঙ্গলে পূজাপাঠ, বেদপাঠ, শাস্ত্র অধ্যয়ন ইত্যাদি করে কাটিয়েছেন। মনুষ্য সমাজ এবং নারীদের থেকে দূরে দূরেই থেকেছেন বরাবর। হঠাৎ করে এভাবে বিবাহ সম্পন্ন করা তাঁর জন্য বড়োই সমস্যার। তাও বিবাহের মনস্থির করে বিবাহযোগ্যা পাত্রীর সন্ধান করতে গিয়ে পাত্রী পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে। উচ্চতার দিক দিয়ে ঋষি অগ্যস্ত ছিলেন কিছুটা খাটো। সেই কারণে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া হলে পাত্রীরা বেঁকে বসতো।
তখন অগ্যস্তর মনে পড়ে এক সর্বগুণসম্পন্না নারী এই জগতেই আছেন, তাঁর বাসস্থান খুব বেশি দূরেও নয়। সেই নারীকে সৃষ্টি করেছিলেন স্বয়ং তিনি। দান করেছিলেন প্রকৃতির নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য, নিষ্ঠা, মনোযোগ, বিবেচনা বোধ, প্রখর বুদ্ধি ও মেধা। সেই নারী ব্যতীত তাঁর যোগ্য জীবনসঙ্গিনী আর কেই বা হতে পারে! তিনি সত্বর যাত্রা করেন বিদর্ভ রাজ্যের দিকে।
অনেকবছর আগের কথা। বহু চেষ্টা, পূজাপাঠ এবং হোমযজ্ঞের পরেও সন্তান লাভ না হওয়ায় বিদর্ভরাজ শুরু করেন এক কঠিন তপস্যা। একদিন ঋষি অগ্যস্ত সেই স্থান দিয়ে যাচ্ছিলেন।রাজাকে তপস্যারত দেখতে পেয়ে কৌতূহলী হয়ে খোঁজখবর নেন, প্রকৃত কারণ জানতে পারেন। তখন ঋষি অগ্যস্ত মহারাজকে বরদান করেন। অগ্যস্তর বরদানে বিদর্ভরাজের কন্যাসন্তান লাভ হয় যে সবরকম গুণের অধিকারিনী ছিল। বিদর্ভরাজের সন্তানলাভের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়।
এদিকে বহুবছর পর নিজের বিবাহের জন্য পাত্রী না পেয়ে অগ্যস্তর মনে পড়ে যায় সেই মেয়েটির কথা। যথাযথ সময়কাল অতিক্রম করে সে এখন বিবাহযোগ্যা। অতএব ঋষি অগ্যস্ত বিদর্ভরাজের সামনে পৌঁছে তাঁর মেয়েকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন।
অগ্যস্তর প্রস্তাবে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান মহারাজ এবং মহারাণী। তাঁদের মেয়ে বিদর্ভের রাজকুমারী। কতো আদরযত্নে লালিত হয়েছেন, মুখের কথা খসতে না খসতেই যা চেয়েছেন পেয়ে গেছেন। সেই মেয়েকে এভাবে বনবাসে কিভাবে পাঠাবেন তাঁরা! আর তাঁদের মেয়েই বা রাজমহলের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে বনজঙ্গলে দারিদ্র্যের মধ্যে কিভাবে দিন কাটাবে! এদিকে অগ্যস্তর প্রস্তাব ফেরাতেও মুশকিলে পড়ে যান। ঋষি অগ্যস্ত দৈবশক্তির অধিকারী, প্রবল ক্ষমতাধর। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিয়ে দিলে তা তাঁদের পরিবারের জন্য এবং রাজ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে।
সমস্যার সমাধান করে দেন রাজকন্যা স্বয়ং। পিতামাতাকে জানান ঋষি অগ্যস্তকে বিবাহ করতে কোনো আপত্তি নেই তাঁর। অভয় দেন যে বিবাহ পরবর্তী জীবন তিনি স্বচ্ছন্দে বনের মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারবেন। কন্যার এমন আত্মবিশ্বাস দেখে তাঁর পিতামাতাও মনে ভরসা পান। তাঁরা বরাবর দেখে এসেছেন শাস্ত্র অধ্যয়ন, পূজাপাঠ এবং বেদপাঠে তাঁদের কন্যা কতোখানি আগ্রহী। ঈশ্বরের আরধনায় বরাবরই যত্নশীল। সেই কারণে কন্যার আত্মবিশ্বাসে তাঁদের মনের বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়। ঋষি অগ্যস্ত এবং বিদর্ভের রাজকন্যার বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যায়। এই রাজকন্যাই ছিলেন লোপামুদ্রা।
বিবাহের পর পিতৃগৃহ থেকে স্বামীগৃহে এসে লোপামুদ্রা পুনরায় শাস্ত্রচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ঋগ্বেদের ১ম মণ্ডলের ১৭৯ নম্বর সূক্তের দ্রষ্টা এই বিদূষী নারী। সূক্তটিতে ছয়খানি মন্ত্র রয়েছে। এই ছয়টি মন্ত্র রাত্রি দেবীকে উৎসর্গীকৃত। এছাড়াও দু'খানি সংস্কৃত ভাষার কবিতাগুচ্ছে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করেছেন তিনি।
তবে লেখনীর মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর মধ্যবর্তী ভালোবাসা, পারস্পরিক টান, যত্ন, মনোযোগ ইত্যাদি ব্যক্ত করলেও ব্যক্তিগত জীবনে এই সবকিছু থেকে ব্রাত্য ছিলেন লোপামুদ্রা। স্বামী অগ্যস্ত তাঁর শাস্ত্রচর্চা নিয়ে সদাব্যস্ত। অগত্যা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে যা যা থাকা অভিপ্রেত সেগুলি ব্যক্তিগতভাবে না পেয়ে লোপামুদ্রা তাঁর কলমের মাধ্যমে সেসব লিপিবদ্ধ করেন, নিজের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে শব্দের রূপ দেন। ড. রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতে, লোপামুদ্রার স্তোত্রে বলা হয়েছে যে পুরুষদের নারীদের সান্নিধ্যলাভ প্রয়োজন। এমনকি অতীতের ঋষিরা দেবতাদের তপস্যা করা সত্ত্বেও জায়াদের প্রতি অনীহা দেখাননি। কিন্তু লোপামুদ্রার স্বামী ঋষি অগস্ত্য তাঁর পত্নীর প্রতি নিস্পৃহতা প্রদর্শন করায় লোপামুদ্রা এ বিষয়ে দু'খানি সংস্কৃত ভাষার কবিতাগুচ্ছে তাঁর মনের হতাশা ব্যক্ত করেন।
ঋষি অগ্যস্ত স্ত্রীর রচিত সূক্ত এবং কবিতাগুচ্ছ পড়তে গিয়ে ব্যাপারটি অনুধাবন করেন এবং স্ত্রীর প্রতি যত্নশীল হন। পরবর্তীতে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হয় এবং তাঁরা তার নাম রাখেন দ্রিধাশ্যু, তিনি পরে একজন বিখ্যাত কবি হয়েছিলেন।
লোপামুদ্রা বৈদিক যুগের একজন উল্লেখযোগ্য নারী। সেসময়ের ঋষিকাগণ অর্থাৎ নারী ঋষিরা বেদপাঠের অধিকারিনী ছিলেন এবং স্তোত্র রচনায় অংশগ্রহণ করতেন। বেদের নির্দেশিত বিধিবিধানের দ্বারা প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগ পরিচালিত হত। বেদ চার ভাগে বিভক্ত — ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। ঋগ্বেদ ১০ টি মল্ডলে বিভক্ত যা ১০২৮ টি বৈদিক সংস্কৃত সূক্তের সমন্বয়। ঋগ্বেদে মোট ১০,৫৫২ টি ঋক বা মন্ত্র বা স্তুতি রয়েছে। ঋগ্বেদে প্রায় ৩০ জন নারী ঋষি বা ঋষিকার নাম পাওয়া যায়, যাঁদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিলেন ঋষি অগ্যস্তর পত্নী লোপামুদ্রা। তাঁর বৈদিক দর্শন, ভাবনাচিন্তা এবং প্রজ্ঞার পরিচয় চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন