বৈদিক যুগের নারী - অপালা
অপালা – বৈদিক যুগের স্বনামধন্য এক নারী, ঋগ্বেদ-সংহিতার অষ্টম মণ্ডলের ৯১তম কবিতাটির মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকা। সপ্তর্ষিদের অন্যতম ঋষি অত্রির কন্যা ছিলেন তিনি, এইজন্য তিনি আত্রেয়ী নামেও পরিচিতা ছিলেন। অপালার কবিতা আকারে বেশি বড় নয়, মাত্র সাতটি মন্ত্র বা ঋক রয়েছে সেখানে, অথচ হাজার হাজার বছর ধরে ঋগ্বেদের গবেষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলেছে সেটি। এই কবিতার দেবতা হলেন ইন্দ্র। এখানে বলে রাখা ভাল যে ঋগ্বেদের কবিতাগুলিকে বলে ‘সূক্ত’, সু উক্ত অর্থাৎ, যা সুন্দর ভাবে বলা হয়েছে। অপালার রচনা ৭টা ঋক ছাড়া ঋগবেদ থেকে অপালা সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে ওই ঋকগুলি সহযোগে অপালার কথা বিস্তারিত ভাবে জানা যায় 'জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ' আর ঋষি শৌনকের 'বৃহদ্দেবতা' থেকে।
এই কাহিনী এক কিশোরী ঋষিকন্যার। প্রাচীন কাহিনিসূত্রগুলি বলে চর্মরোগে আক্রান্ত অপালা তার বাবার কুটিরে থাকত। জৈমিনীয় ব্রাহ্মন মতে, অপালার ত্বক ছিল তিলের মতো ছিটছিট ফুসকুড়িতে ভরা। এই অপালা ঘাটে স্নান করতে গিয়ে কুড়িয়ে পায় এক টুকরো সোমলতা।সেটি হাতে নিয়ে সে ভাবে, ইন্দ্রের জন্যে আমি এটিকে পিষে রস নিষ্কাশন করব। বৈদিক আর্যদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যজ্ঞ হল সোমযাগ, অনেক তার উপাচার, অনেক নিয়মকানুন। একটি ছোট মেয়ে কেমন করে একা একা সোমরস দিয়ে ইন্দ্রের উদ্দেশে যাগ করবে— এই প্রশ্নের এক বিচিত্র উত্তর এই কবিতায় ধরা আছে। যজ্ঞে সোমলতা পেষা হয় দু’টি পাথরের মধ্যে, বেদের মন্ত্রে বার বার এসেছে পাথরে সোম পেষার তীব্র ঘর্ষণ-শব্দের কথা— এই শব্দ আকর্ষণ করে ইন্দ্রকে, টেনে আনে যজ্ঞভূমিতে। অপালা কি করলেন? তিনি সোমলতাটিকে মুখে পুড়ে দাঁত দিয়ে চিবোতে লাগলেন।
অপালার দাঁতে সোম পেষার আওয়াজ শুনে আকৃষ্ট হয়ে ইন্দ্র এসে উপস্থিত হলেন। একাকী মেয়েটিকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় সোমলতা পেষা হচ্ছে। অপালা জানালেন তার মুখে, ইন্দ্র চাইলে তার মুখ থেকেই সোমপান করতে পারেন। ইন্দ্র অপালার আহ্বানে তার মুখ থেকেই পান করেন সোমরস। অপালা এবার উচ্চারণ করেন এক আশ্চর্য কবিতা-
‘আমরা জানতে চাই তোমাকে, (কিন্তু) বুঝতে পারি না তো পুরোপুরি। ধীরে, খুব ধীরে, ও সোম, তুমি ইন্দ্রের জন্যে বইতে থাকো।’
নানা সংশয় আর দ্বিধা পেরিয়ে বিবাহবিমুখ অপালা ইন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হন। শস্য, ছাতু, পুরোডাশ আর স্তুতিগান সহযোগে অপালা আপ্যায়ন করে তার দেবতাকে। সন্তুষ্ট ইন্দ্রের কাছে অপালা তিনটি বর চান—
'ইন্দ্র, তুমি তিনটি জায়গায় কেশ বা শস্য উৎপন্ন কর, আমার বাবার মস্তকে, বাবারই যবের খেতে এবং আমার উদরের নীচে, ঊরুসন্ধিতে।'
তৃতীয় প্রার্থনাটি আজকের সময়ে একটু অন্য রকম লাগতে পারে, কিন্তু শরীরের কথা বলতে কখনওই সঙ্কোচে ভোগেননি ঋগ্বেদের নারী-কবিরা।
কবিতার শেষ মন্ত্রে জানা যায় ইন্দ্র অপালাকে তিন বার, যথাক্রমে রথের চাকার, গরুর গাড়ির চাকার এবং জোয়ালের মধ্যবর্তী ছিদ্র দিয়ে টেনে বার করে তাকে সূর্যের মতো উজ্জ্বল ত্বক দেন। জৈমিনীয় ব্রাহ্মণে আরও আছে, অপালাকে ইন্দ্র যখন তিন বার তিনটি ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে বার করেন তখন অপালা যথাক্রমে তিনটি প্রাণীতে পরিণত হন, প্রথমে একটি গোধা বা গোসাপে, তার পরে একটি কৃকলাস বা গিরগিটিতে এবং শেষকালে একটি সংশ্লিষ্টিকাতে। এই শেষ প্রাণীটি ঠিক কী, তা নিয়ে সংশয় আছে। আনন্দ কুমারস্বামীর মতে এটি আসলে অপালারই বিশেষণ, এর মানে, যে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করা যায়। এই ভাবে ইন্দ্র অপালাকে সূর্যের মতো ত্বক দিলেন, আর তার রূপ হল সব রূপের মধ্যে কল্যাণতম, সেই সঙ্গে এও বলছে, অপালার এই সুক্তটি আসলে ইচ্ছেপূরণের গান, যে ইচ্ছে নিয়ে এই গান যে গাইবে, সে ইচ্ছেই তার পূর্ণ হবে—
যৎকাম এবৈতেন সাম্না স্তুতে সমস্মৈ স কাম ঋধ্যতে।
শৌনকের 'বৃহদ্দেবতা' -তেও গল্পটা প্রায় এক শুধু শেষের অংশটি আলাদা। সেখানে আছে- ইন্দ্র অপালাকে তিন বার তিনটি ছিদ্রপথের মধ্য দিয়ে টেনে বার করলে সে তিনটি নির্মোক (ছাল বা খোলস) ত্যাগ করে। সেই নির্মোক তিনটি প্রাণীতে, যথাক্রমে শল্যক (শজারু), গোধা আর কৃকলাসে পরিণত হয়।
বেঙ্কটমাধব তাঁর ঋগ্বেদের ভাষ্যে অপালার সুক্তটির চতুর্থ মন্ত্রের ব্যাখ্যা করার সময় মন্তব্য করেছেন, অপালা নাকি একটি বিবাহিত মেয়ে, চর্মরোগের জন্য যাকে তার স্বামী পরিত্যাগ করেছিল। ঋগ্বেদের সর্বপ্রধান ভাষ্যকার সায়ণাচার্য চতুর্দশ শতকে লেখা তাঁর ভাষ্যে নিজের মন্তব্য যোগ করে বলেছেন, স্বামীপরিত্যক্তা অপালা ইন্দ্রকে নিজের মুখ থেকে সোমপান করান এবং গর্বিত হন এই ভেবে যে স্বামী পরিত্যাগ করলেও ইন্দ্র আমাকে গ্রহণ করেছেন। ভাষ্যকারদের অপালাকে স্বামীপরিত্যক্তা বলে ধরে নেওয়ার কারণ তার কবিতায় ‘পতিদ্বিষ’— এই শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা— এখানে শব্দটির সঠিক মানে ‘পতি যাকে বিদ্বেষ করে’ নয়, বরং ‘যে (মেয়ে) পতিকে বিদ্বেষ করে’ অর্থাৎ এক কথায় বিবাহবিমুখ। অপালা বিয়ে করতেই চায়নি।
ক্ষেত্রেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর আলোচনায় বেশ চিত্তাকর্ষক একটি মত উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে অপালা প্রাচীন বৈদিকযুগের সেই নারীদের প্রতিনিধি যাঁরা বিয়ের পরিপন্থী ছিলেন এবং ইন্দ্রদেবকে নিজের স্বামী বলে মনে করতেন। অপালার এই কবিতাটি ভারতে পরবর্তী ভক্তিযুগের সেই মরমিয়া পদগুলির পূর্বসূরি বলে ক্ষেত্রেশচন্দ্র মনে করেন, যেখানে দেবতাকে, বিশেষ করে কৃষ্ণকে, প্রেমিক তথা স্বামীরূপে দেখেছেন ভক্ত নারী এবং স্বামী হিসেবে কোনও মানুষকে গ্রহণে থেকেছেন অনিচ্ছুক, যেমন মীরাবাই। অপালার কবিতায় বহুবচনের ব্যবহার (ইন্দ্রেণ সঙ্গমামহৈ— ইন্দ্রের সঙ্গে যেন আমরা মিলিত হতে পারি) শুধু ক্ষেত্রেশচন্দ্রকেই নয়, আরও অন্য আধুনিক গবেষককেও এ ভাবেই ভাবিয়েছে। হান্স পিটার শ্মিড তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, অপালা ছিল একটি বয়ঃসন্ধির কুমারী, বিয়ে সম্পর্কে সন্দিহান ও অনিচ্ছুক। তার ত্বকদোষ আসলে বয়ঃসন্ধিকালীন ব্রণ। ঋগ্বেদের আধুনিকতম অনুবাদক স্টেফানি জেমিসন অপালার রোগটিকে কৈশোরোচিত ব্রণ বলেছেন। জৈমিনীয় ব্রাহ্মণের বর্ণনাও সে দিকেই ইঙ্গিত করে। ইন্দ্রের কাছে অপালার চাওয়া বর তিনটি বুঝিয়ে দেয় যে সে ছিল কুমারী, তাই তার বাবার শস্যক্ষেত্রের উর্বরতা সে প্রার্থনা করেছে, স্বামীর নয়।
অপালার সূক্তের নাটকীয়তা এবং লিরিকময়তা এই কবিতাটিকে হাজার হাজার বছর ধরে জনপ্রিয় রেখেছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও তার ছাপ রয়েছে। কল্যাণী দত্ত তাঁর অল্পবয়সে অপালা আর ইন্দ্রের প্রেম নিয়ে একটি সাহসী ডায়ালগ লেখেন ‘সোমলতা’ নাম দিয়ে। একটি অসুন্দর মেয়ের রূপান্তরের কাহিনিতে কুৎসিত মেয়েটিকেই তাঁর ভাল লেগেছিল, তাঁর নিজের ভাষায় “তার বঞ্চনার সঙ্গে নিজেকে হয়তো বা অজান্তে এক করেই ফেলেছিলুম।” সতীনাথ ভাদুড়ির লেখাতেও জায়গা করে নিয়েছে অপালার কাহিনি। ইংরেজি ১৯৬১ সাল, অর্থাৎ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের পূজাবার্ষিকী আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘স্বর্গের স্বাদ’ গল্পটি অপালা আর ইন্দ্রকে নিয়ে লেখা। অপালার মুখ থেকে ইন্দ্র যে সোমপান করেছিলেন সেইটিই ছিল চর্মরোগাক্রান্ত, সক্কলের দুচ্ছাই মেয়েটির কাছে স্বর্গের স্বাদ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন