মুসলিম সমাজে আজও শিক্ষার হার খুব কম। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা আরও কম। এম ফাতিমা বিবিকে এদের মধ্যে ব্যতিক্রম বলা যায়। তিনি ছিলেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতি এবং প্রথম কোনও মুসলিম মহিলা যিনি ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার উচ্চপদে আসীন হন। শুধুমাত্র ভারতে নয় এশিয়া উপমহাদেশেরও প্রথম মহিলা বিচারক হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। আদালত থেকে অবসরের পর তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন এবং তামিলনাড়ুর (১৯৯৭-২০০১) সাল পর্যন্ত গভর্নর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
জন্মস্থান :
কেরল রাজ্যের পাথানামথিট্টা (Pathanamthitta
), ট্রাভাঙ্কোর।
জন্ম সময় :
৩০ শে এপ্রিল, ১৯২৭।
পিতা :
আন্নাভিত্তিল মীর সাহেব। তিনি একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন।
মাতা :
খাদিজা বিবি।
ছয় বোন ও দুই ভাইয়ের
মধ্যে তিনি সবচেয়ে বড় ছিলেন।
শিক্ষা জীবন:
ফাতিমা বিবির প্রথম
থেকেই পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। ছিল পরিবারের মানুষের সমর্থন। পাথানামথিট্টা ক্যাথলিকেট উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে বিদ্যালয়ের
পাঠ শেষ করেন ১৯৪৩ সালে। এরপর তিনি 'বি.এসসি.' তিরুবনন্তপুরম-এর ইউনিভার্সিটি থেকে কলেজের পাঠ সম্পন্ন
করেন। তাঁর বিষয় ছিল 'কেমিস্ট্রি'।
তিনি কেমিস্ট্রিতে 'এম.এসসি' করতে চাইছিলেন, কিন্তু তাঁর পিতা তাঁকে আইন নিয়ে পড়তে বলেন। তিনি পিতা আন্না চাড্ডির থেকে আইন পড়ার
জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি তিরুবনন্তপুরম সরকারি আইন কলেজে ভর্তি হন। সেখানে
মাত্র ৫ জন ছাত্রী ছিল। পরবর্তীকালে ৩ জন মাঝপথেই
পড়া বন্ধ করে দেন । মনের জোর নিয়ে,
নিজের লক্ষ্য থেকে না সরে ১৯৫০ সালে ফাতিমা বিবি আইন পাশ করেন।
কর্মজীবন:
তৎকালীন সমাজে একজন
মহিলা আইনজীবী হিসাবে কাজ করা এত সহজ ছিল না। তাঁকে পদে পদে বিভিন্ন বাধার
সম্মুখীন হতে হয়েছে। এতকিছু সত্ত্বেও তিনি নিজের কাজ সাহসের সাথে করে গেছেন।
১৪ ই নভেম্বর ১৯৫০
সালে অ্যাডভোকেট হিসাবে তাঁর নাম নথিভুক্ত হয়। ১৯৫০ সালে বার কাউন্সিল পরীক্ষায়
ফাতিমা বিবি শীর্ষ স্থান লাভ করেন। এরপর কেরালার নিম্ন বিচার বিভাগে তাঁর কর্মজীবন
শুরু হয়। ১৯৫৮ সালের মে মাসে কেরালার সাব-অর্ডিনেট জুডিশিয়াল সার্ভিসে মুন্সিফ
হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে সাব-অর্ডিনেট বিচারপতি হিসাবে এবং ১৯৭২ সালে চিফ
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৯৭৪ সালে জেলা ও দায়রা বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।
এছাড়াও তিনি ১৯৮০
সালের জানুয়ারিতে আয়কর আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচার বিভাগীয় সদস্য হিসাবে নিযুক্ত
হন। তারপর ৪ ঠা আগস্ট ১৯৮৩ সালে হাইকোর্টের বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন।
তিনি দক্ষতার সাথে
নিজের কাজ করে গিয়েছেন। দাঙ্গা, বড় বড় হত্যার মামলার
ক্ষেত্রেও পারদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন।তিনি পরবর্তীকালে রাজীব গান্ধী
হত্যার দোষীদের ক্ষমার আর্জি খারিজ করেন।
ফাতিমা বিবি ১৯৮৪
সালের ১৪ মে হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন।
তিনি ১৯৮৯ সালের ২৯ শে
এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।
৬ ই
অক্টোবর ১৯৮৯ সালে সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতির পদ লাভ করেন। সেখানে দক্ষতার সাথে কাজ
করার পর ২৯ শে এপ্রিল ১৯৯২ সালে বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
তামিলনাড়ুর গভর্নর পদ
(১৯৯৭-২০০১):
১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১
সাল পযর্ন্ত ফাতিমা বিবি তামিলনাড়ুর গভর্নর হিসাবে কাজ করেছেন।
অন্যান্য কাজ:
তামিলনাড়ুর গভর্নর
থাকাকালীন তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর (২০০২) হিসেবে দায়িত্ব পালন
করেন। এছাড়াও তিনি পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের
জন্য কেরালা কমিশনের চেয়ারম্যান (১৯৯৩) হিসাবে কাজ করেন এবং জাতীয় মানবাধিকার
কমিশন-এর (১৯৯৩) সদস্যও ছিলেনে।
পুরস্কার লাভ:
তিনি ১৯৯০ সালে 'ডি লিট' সম্মান এবং 'মহিলা শিরোমনী' পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি,'ভারত জ্যোতি' পুরস্কার লাভ করেন।
বিতর্ক:
তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল
থাকার সময় তাঁকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। সেইসময় জয়ললিতা বিপুল ভোটে জেতেন। কিন্তু জয়ললিতার উপর প্রতিবন্ধকতা
লেগে গিয়েছিল। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছিল জয়ললিতা দুর্নীতিগ্রস্থ ছিলেন। জয়ললিতা খুবই
সমস্যাতে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন ফাতিমা বিবি ত্রাতার ভূমিকাতে আসেন। জয়ললিতাকে সরকার
গঠন করতে বলেন। সমস্যা হবে না এটাও বলেন। এটা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। ফাতিমা
বিবিকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তখন জয়ললিতা কেস থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়াও বড় বড় সিনিয়র বিচারপতিদের সাথে
আলোচনা করেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। এই বিতর্কের পরই তিনি ২০০১ সালে রাজ্যপালের পদ থেকে পদত্যাগ
করেন।
বর্তমান জীবন :
তিনি বর্তমানে কেরালার
পাথানামথিট্টায় তাঁর পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করছেন।তিনি চাইতেন মেয়েরা যাতে আইন নিয়ে
পড়ে। আইন পেশায় মেয়েদের সংখ্যা তেমন নেই। তিনি কর্মজীবনে হওয়া লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। এত কঠিনতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তৎকালীন সমাজে যেভাবে নিজেকে
প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
ছবি সৌজন্যঃ আন্তরজাল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন