''গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।…….তোমাদের শরীর একটু শক্ত হইলে তোমরা গীতা আরও ভাল বুঝিবে।’’
--স্বামী বিবেকানন্দ
কিছুদিন আগে পযর্ন্ত সাধারণত ভারতীয়রা বিশেষ করে অধিকাংশ
বাঙালিরা মনে করতেন
খেলা মানে ফালতু সময় নষ্ট, তারচেয়ে গণিত করা ভালো। কারণ, পরীক্ষাতে ভালো নম্বর প্রাপ্ত
হওয়া জীবনে উন্নতির প্রথম শর্ত। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে খেলার
থেকে পড়াশোনায় সময় বেশী দেওয়া একান্তই দরকারি। বতর্মানে অবশ্য সেইসব ধারণার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে, যা সত্যিই আনন্দের। ভালো খেললেও প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়,
এটাও সকলে বুঝেছে। খেলাধুলার মাধ্যমেও জীবনের উন্নতিসাধন হয় তাও বোধগম্য হয়েছে।
পড়াশোনার পাশাপাশি তাই খেলাধুলাকেও সমান প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
ক্রীড়া মানসিক দৃঢ়তা গঠনে সহায়তা করে। কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গঠনে ক্রীড়া বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিশু বয়স থেকে অভিভাবকদের বিশেষ
সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বুঝতে হবে খেলা আমাদের জন্য খুবই দরকারি একটি ক্রিয়া।
খেলার প্রকারভেদঃ
খেলার প্রকারের উপর ভিত্তি করে একে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা
–
◾বাইরে গিয়ে খেলা ( Outdoor games )
◾ঘরের মধ্যে খেলা ( Indoor games )
খেলা সহজাত প্রবৃত্তিঃ
খেলা মানুষের সহজাত প্রবণতা।
বিশ্বের সব মানুষ খেলা পছন্দ করেন।
শিশু বয়স থেকেই তাই খেলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
খেলার মাধ্যমে সার্বিক বিকাশ ঘটেঃ মানুষের
পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য পড়াশোনার মতো খেলাধুলায় পারদর্শী হওয়াও সমান প্রয়োজন।
পড়াশুনা ও খেলা দুটোই একসঙ্গে করা প্রয়োজন। কথায় বলে, 'পড়াশুনা শিকেয় তুলে দিনরাত খেলা-খেলা করলে যে কেউ নির্বোধ
হয়ে যায়। একইভাবে বলা চলে, কোনওরকম খেলাধুলা না করে দিনরাত পড়াশোনা করলেও মানুষ ক্রমশ
জড় ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
শিক্ষাঃ মনোবিদগণ বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেছেন,
খেলা শুধুমাত্র মজা করা আনন্দ করার জন্য নয়। এর মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক,
প্রাক্ষোভিক, ভাষা অর্থাৎ শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটে।
"বাচ্চাদের স্বাধীনতা ও খেলার সময় দুটোই দেয়া উচিত। খেলাধুলা
কোনো বিলাসীতা নয় বরং এটা প্রয়োজনীয়তা।" —
কে রেডফিল্ড জেমিসন
শারীরিক বিকাশের সম্পর্কঃ শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ,
শিশুর পেশি এবং তাদের সঠিক সঞ্চালনে সক্রিয় খেলা,
যেমন - লাফানো, দৌড়ানো, বল ছোঁড়া ইত্যাদি বিশেষ প্রয়োজন।
শিক্ষাবিদ হারবার্ট স্পেনসার মনে করেন,
খেলার মাধ্যমে শিশুর যে
উদ্বৃত্ত শক্তি (অতিরিক্ত শক্তি) আছে তা ব্যয় হয়।
যার ফলে শিশু মানসিক চাপ, নার্ভাসনেস এবং খিটখিটে আচরণ থেকে
মুক্তি পায়।
খেলার সঙ্গে শিশুর প্রাক্ষোভিক ( Emotions
) বিকাশের সম্পর্কঃ শিশুর
প্রাক্ষোভিক বিকাশের সঙ্গে খেলার বিশেষ ভূমিকা দেখা যায়।
সামাজিক পরিবেশে শিশুদের বহু অসামাজিক কামনা,
অবদমিত ইচ্ছা তৃপ্ত হতে পারে না,
যা অনেক সময় মানসিক রোগের কারণ হয়। খেলার মাধ্যমে এই
অসামাজিক কামনা এবং অবদমিত ইচ্ছা বের হওয়ার সুযোগ পায়, যার ফলে শিশু স্বাভাবিক আচরণ করে। অনেক সময় শিশুদের ইচ্ছা
এবং চাহিদা বাস্তবে পূরণ হয় না। এই ধরণের অপূর্ণতা শিশুদের প্রাক্ষোভিক বিকাশে অসুবিধার কারণ হয়। খেলা এই অসুবিধা দূর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ
উপায়।
যেমন - যে শিশুর পক্ষে বাস্তব জীবনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা
নেই সেই শিশুটি দলগত খেলায় নিজে নেতার ভূমিকা পালন করে তার ইচ্ছা পূরণ করার সুযোগ
পায়।
খেলার সঙ্গে শিশুর সামাজিক বিকাশের সম্পর্কঃ
খেলা শিশুর সামাজিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সহপাঠীদের সঙ্গে
খেলার মাধ্যমে শিশুর সহানুভূতি, সহমর্মিতা, দেওয়া-নেওয়া, একে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া,
একসাথে কাজ করার মানসিকতা, গণতান্ত্রিক মানসিকতা ইত্যাদির বিকাশ ঘটে। এর ফলে শিশুটি
বড় হলে একজন দায়িত্ববান, সক্রিয়, চেতনাসম্পন্ন
নাগরিক হিসাবে সমাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
খেলার সঙ্গে জ্ঞানমূলক বিকাশের সম্পর্কঃ খেলার মাধ্যমে জ্ঞান বিকাশের বহু সুযোগ ঘটে।খেলার মধ্য দিয়ে শিশুরা চিন্তা করতে শেখে,
পার্থক্য নির্ণয় করতে শেখে, তুলনা করতে শেখে এবং অন্যান্য বৌদ্ধিক বিষয়গুলি রপ্ত ( absorb
) করে যা অবশেষে জ্ঞান বৃদ্ধিতে
সাহায্য করে। শিশুরা
যখন বালি দিয়ে পুতুলের ঘর বাড়ি তৈরি করার খেলা করে তখন সে একটি ঘর তৈরি
সম্পর্কে জ্ঞান ( Knowledge ) অর্জন করে। যেমন - ঘরের ছাদ বা চাল, দরজা-জানালা, ঘরে উঠতে সিঁড়ির প্রয়োজন তার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। বিভিন্ন রকম খেলার উপকরণ ব্যবহারের ফলে
শিশুরা বস্তুর আকার, রং, আকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে।
খেলার সঙ্গে ভাষা বিকাশের সম্পর্কঃ অনেক
খেলায় বিশেষ করে দলগত খেলায় খেলার সাথীদের সাথে কথা বলতে হয়, নির্দেশ দিতে হয়, আবার কথা শুনতে হয়, নির্দেশ বুঝে তা পালন করতে হয়,
এর জন্য ভাষা এবং তার অর্থ বোঝার প্রয়োজন অর্থাৎ
খেলার মধ্যে ভাষার বিকাশ হয়।
খেলার সঙ্গে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সম্পর্ক :
“এক
বছর কথাবার্তা বলে তুমি
একজন মানুষ সম্পর্কে যা না জানতে পারবে তার
চেয়ে ঢের বেশি জানতে
পারবে তার সঙ্গে এক ঘন্টা খেললে। " — প্লেটো
কারো ব্যক্তিত্বের ত্রুটিগুলি জানা প্রকৃষ্ট উপায় হলো
খেলার সময় তাকে লক্ষ্য করা। সেখানেই মানুষের আসল রূপটি বেরিয়ে পড়ে। কারণ সেখানে
বহু ক্ষেত্রে তার মেজাজ খারাপ করার, চিৎকার করার, প্রতিপক্ষকে বিদ্রুপ করার এবং প্রতারণা করার সুযোগ থাকে।
খেলাধুলার সময় কেমন করে ভদ্র আচরণ করতে হয় তা শুধু
নিয়মকানুন দিয়েই কাউকে শেখানো যায় না। একজন কী ধরনের মানুষ তা তার খেলার ঢং-ই
বলে দেবে;
খেলার সময় সে যে পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে নিয়মকানুনের কোনও
তালিকাই তার সেই অবচেতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। খেলার
মধ্য দিয়েই অন্যদের সাথে সহযোগিতার শিক্ষা পাওয়া যায়,
অর্জন করা যায়। দলের স্বার্থে ব্যক্তিগত
সুযোগ-সুবিধা কিভাবে বিসর্জন দিতে হয়, সেই নৈতিকতাবোধটিও শেখা যায়।
একজন সত্যিকারের স্পোর্টসম্যান বা খেলোয়াড়ের মধ্যে
আন্তরিকতা, উৎসাহ, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মমর্যাদা, সংযম, নিয়মানুবর্তিতা, রুচি এবং রসবোধ প্রভৃতি সদগুনগুলি বর্তমান থাকে। অর্থাৎ খেলা ব্যক্তির আদর্শ ব্যক্তিত্ব গঠন করতে সহায়তা করে।
খেলাধুলা থেকে জীবনের শিক্ষা
খেলাধুলা থেকে জীবনের একটি মহৎ শিক্ষা লাভ করা যায়। জয়
এবং পরাজয়, সাফল্য
ও ব্যর্থতাকে সমানভাবে নেওয়ার শিক্ষা। জীবনের সব আনন্দ ও দুঃখকে প্রসন্নচিত্তে
বরণ করে নেওয়ার নামই 'স্পোর্টসম্যান স্পিরিট' ( Sportsman Spirit) বা 'খেলোয়াড়ি
মনোবৃত্তি'। 'আর্মচেয়ার স্পোর্টসম্যান' না হয়ে আমাদের সকলকে 'স্পোর্টসম্যান স্পিরিট' শিখতে হবে।
কলমে - স্ব র্ণ ল তা দে বী
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
[
১ ] ড. দেবাশীষ পাল
[
২ ] রামকৃষ্ণ মিশন, উদ্বোধন কার্যালয়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন