সারাটা দিন ধরে কাজকর্ম আর পরিশ্রমের পর অনেকেরই ত্বকের বিশেষভাবে যত্ন নেওয়ার ইচ্ছাটা আর করে না। ভাবেন যে কোনরকমে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই রক্ষে! কিন্তু এভাবে হেলাফেলা করে তাঁরা নিজেদেরই ক্ষতি ডেকে আনেন। কারণ সারাদিনের ক্লান্তির পর আমাদের যেমন রাত্রিকালীন বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনটা আমাদের ত্বকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নাহলেই ত্বকে দেখা যাবে ব্রণর সমস্যা, বলিরেখার আনাগোনা, অতিরিক্ত শুষ্কতা, হ্রাস পাবে ত্বকের উজ্জ্বলতা।
ঘরের কাজ হোক বা বাইরের, সারাদিন ধরে ধুলোময়লা, চড়া রোদ, দূষণ, ঘাম অথবা মেকআপের কারণে আমাদের ত্বক অপরিষ্কার হয়ে থাকে।
এগুলি ত্বকের রোমকূপে জমার ফলে রোমকূপের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ,
রাতে ঘুমানোর সময় আমাদের ত্বকে যে স্কিন রিনিউয়াল ও
রিপেয়ার প্রসেস হয়ে থাকে তা বাধাপ্রাপ্ত হয়, ঠিকমতো হতে পারে না। সেই কারণে তৈলাক্ত,
শুষ্ক অথবা মিশ্র যেকোনো ধরণের ত্বকের জন্য রাতে প্রয়োজন
ক্লিনজ়িং-টোনিং-ময়েশ্চারাইজ়িং। তাহলে দেখে নেওয়া যাক কীভাবে ত্বকের রাত্রিকালীন যত্ন
নেওয়া যেতে পারে।
ক্লিনজ়িং :
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সারাদিনের ধুলোময়লা,
ঘাম, তেল,
মেকআপ ইত্যাদি রোমকূপে জমে ত্বকের ক্ষতি করে। ত্বক
অপরিষ্কার থাকলে রোমকূপের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তাই যেকোনো ধরণের ত্বকের জন্যই
ক্লিনজ়িং অত্যন্ত আবশ্যক। তবে সাবান দিয়ে মুখ পরিষ্কার করা একেবারেই উচিত নয়।
এতে উপস্থিত উচ্চমাত্রার ক্ষার ত্বককে আরও শুষ্ক করে দেয়। সাবানের পরিবর্তে
ক্লিনজ়িং মিল্ক বা জেল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করা বাঞ্ছনীয়। একটা ব্যাপার মনে রাখা
দরকার,
ত্বকের ধরণ অনুযায়ী ক্লিনজ়িং পদ্ধতিও আলাদা হবে। আর মেকআপ
করা থাকলে ক্লিনজ়িংয়ের আগে মেকআপ রিমুভার ওয়াইপস দিয়ে সেটির প্রাথমিক স্তর তুলে
ফেলা জরুরী।
তৈলাক্ত ত্বক — এই ধরণের ত্বকের জন্য ফোম বা জেল-বেসড ক্লিনজ়ার আদর্শ। এতে
ত্বক পরিষ্কারের সঙ্গে ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতাও বজায় থাকবে।
শুষ্ক ত্বক — শুষ্ক ত্বকে আর্দ্রতার অভাব থাকার দরুন ফোম অথবা জেল-বেজড
ক্লিনজ়ার একেবারেই অনুপযুক্ত। ত্বক পরিষ্কার করতে প্রয়োজন ক্রিমযুক্ত ক্লিনজ়ার
যা ত্বককে শুষ্ক করবে না, ত্বকের ময়েশ্চার ব্যালেন্স বজায় রাখতে সাহায্য করবে। এর ফলে ঘুমের সময় ত্বক
প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা পাবে।
মিশ্র ত্বক —
এই ত্বকের অধিকারিণীদের টি-জ়োন অর্থাৎ কপাল,
নাক আর চিবুকের অংশ তৈলাক্ত হয় আর বাকি অংশ শুষ্ক থাকে।
সেক্ষেত্রে মিশ্র ত্বক পরিষ্কার করতে দরকার জেল-বেসড ক্লিনজ়ার। এটি ত্বকের
এসেনশিয়াল অয়েলের স্তর নষ্ট না করেই ত্বক পরিষ্কার করে।
টোনিং :
ক্লিনজিংয়ের পরবর্তী ধাপ টোনিং। মুখ পরিষ্কার করা হয়ে
গেলে তুলোয় টোনার নিয়ে না ঘষে হালকা হাতে চেপে চেপে মুখ মুছে নিতে হবে। ত্বক মসৃণ,
টানটান এবং উজ্জ্বল রাখার জন্য টোনিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টোনার ত্বকে
রক্তসঞ্চালন ভাল করতে সাহায্য করে, ত্বকের পি এইচ ব্যালেন্স রক্ষা করে।
তৈলাক্ত ত্বক — তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে পিউরিফায়িং টোনার উপযুক্ত। এটির
ব্যবহারে ত্বকের তেলময়লা সম্পূর্ণ উঠে গিয়ে ত্বক পরিষ্কার হয়ে যাবে।
শুষ্ক ত্বক — শুষ্ক ত্বকের জন্য ভিটামিন ই যুক্ত হাইড্রেটিং টোনার আদর্শ।
বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে ব্যবহৃত টোনার যেন অতি অবশ্যই অ্যালকোহল ফ্রি হয়,
অন্যথায় ত্বক আরো শুষ্ক হয়ে পড়বে।
মিশ্র ত্বক — মিশ্র ত্বকের ক্ষেত্রেও টোনার খুবই দরকারি। ন্যাচারাল স্কিন
টোনার হিসাবে গোলাপ জল ব্যবহার করা যেতে পারে। তুলোয় করে গোলাপজল নিয়ে মুখ মুছে
নিতে হবে। গ্রিন টি-ও কিন্তু টোনার হিসাবে আদর্শ। গরম জলে গ্রিন টি আধঘণ্টা ভিজিয়ে
রাখার পর ঠান্ডা করে ছেঁকে নিয়ে টোনার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে,
শসা ন্যাচারাল অ্যাসট্রিনজেন্ট ও টোনার। শশার রস ও গোলাপ জল
মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পর জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এটি টোনার হিসাবে দারুণ
কাজ করে।
ময়েশ্চারাইজ়িং :
ত্বক পরিচর্যার শেষ ধাপ ময়েশ্চারাইজ়িং যা ত্বকের জন্য
অত্যন্ত জরুরী। ময়েশ্চারাইজ়ার ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে। রাত্রে শুতে যাওয়ার
আগে মুখ পরিষ্কার করার পর ত্বক জলে সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে মুখে ও গলায় নারিশিং
ক্রিম লাগিয়ে হালকা হাতে আপওয়ার্ড ও আউটওয়ার্ড স্ট্রোকে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করতে
হবে। বাড়িতেও ময়েশ্চারাইজ়ার বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। গোলাপ জল,
গ্লিসারিন ও অ্যালোভেরা জুস একত্রে মিশিয়ে মিশ্রণটি
এয়ারটাইট কন্টেনারে রেখে ফ্রিজে স্টোর করে রাখা যায়। গ্লিসারিন ও গোলাপজলের
মিশ্রণ ত্বক নরম রাখার জন্য দারুণ কার্যকরী।
নারিশিং ক্রিমের পরিবর্তে রাতে ঘুমানোর আগে ময়েশ্চারাইজ়ার
হিসাবে ভালো মানের নাইট ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। চোখের চারপাশের ত্বকের জন্য
লাগাতে হবে ভিটামিন ই সমৃদ্ধ আন্ডার আই ক্রিম। আমাদের চোখের আশেপাশের ত্বক সমগ্র
মুখমণ্ডলের ত্বকের তুলনায় বেশি পাতলা হয়ে থাকে। সেই কারণে তার জন্য বিশেষভাবে
বানানো ক্রিম ব্যবহার করতে হয়।
তৈলাক্ত ত্বক — এই ধরণের ত্বকের ক্ষেত্রে অয়েল ফ্রি ময়েশ্চারাইজ়ার
যথোপযুক্ত। মুখের আর্দ্রতা ধরে রাখে।
শুষ্ক ত্বক — শুষ্ক ত্বকে শীঘ্র বলিরেখা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই
কারণে ময়েশ্চারাইজ়ার ব্যবহারের পূর্বে সিরাম লাগানো একান্ত জরুরী। সিরাম
পুরোপুরি ত্বকে শুষে যাওয়ার আগেই ময়েশ্চারাইজ়ার লাগিয়ে নিতে হবে।
মিশ্র ত্বক — তৈলাক্ত ত্বকের অথবা শুষ্ক ত্বকের ময়েশ্চারাইজ়ার নয়,
মিশ্র ত্বকের জন্য ব্যবহার করতে হবে এমন ময়েশ্চারাইজ়ার যা
এই ধরণের ত্বকের জন্যই তৈরি। মিশ্র ত্বকের বিশেষ ময়েশ্চারাইজ়ার ত্বকের
তৈলাক্তভাব ও শুষ্কভাব ব্যালান্স করে কোনো তৈলাক্ত ভাব ছাড়াই ত্বককে আর্দ্র
রাখবে।
আরো কিছু কথা :
- সপ্তাহে একদিন ফেসমাস্ক লাগানো ত্বকের পক্ষে উপকারী, সেটি শীট মাস্ক বা মাড মাস্ক হতে পারে। ভালোভাবে ত্বক পরিষ্কার করে টোনিংয়ের পর ত্বকের ধরণ অনুযায়ী লাগাতে হবে ফেসমাস্ক।
- মেকআপ পরিষ্কার না করে ঘুমাতে যাওয়া কখনোই উচিত নয়। এতে ত্বকের ক্ষতি হয়।
- শুধুমাত্র রাতেই নয়, নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যাঁদের শুষ্ক ত্বক তাঁদের ক্ষেত্রে সারাদিনে যতবার মুখ ধুতে লাগবে, প্রতিবারই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে
- ত্বককে শুধু বাইরে থেকে পরিচর্যা করাটাই সবকিছু নয়। সুষম আহার, পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান, যথেষ্ট পরিমাণে ঘুম এবং মনের ভেতর থেকে আনন্দে থাকলে তার প্রভাব ত্বকের উপরেও পড়বে।
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন