অন্দরসজ্জায় রঙের ব্যবহার

দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ কেটে যায়। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে মানুষের পছন্দ অপছন্দ, ফ্যাশন সেন্স। তবে এই ফ্যাশন সেন্স শুধুমাত্র সাজপোশাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তার প্রভাব রয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও। আর এই দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আমাদের বাসস্থান যেটি সর্বক্ষণ সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা আমরা করে যাই।

ঘর সাজানোর জন্য অনেকরকম উপায়ই আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি, যেমন স্বল্প খরচে ঘরের দেওয়াল সাজিয়ে তোলা, গৃহসজ্জায় ইনডোর প্ল্যান্টস, ঘর সাজাতে হস্তশিল্প মেলার সামগ্রীর যথাযথ ব্যবহার ইত্যাদি। আজ এখানে বিবৃত করা হলো যথোপযুক্ত রঙের মাধ্যমে কিভাবে আপনি আপনার ঘরটিকে মনোরম করে তুলতে পারেন।

তবে তার আগে রঙের উত্তাপ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য অবশ্যই সকলের জেনে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু রঙের উত্তাপ! সে আবার কি! ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে রঙেরও উত্তাপ হয়। কোনো কোনো রঙ দেখে মনে হয় এ যেন তাপদাহ, কোনো রঙ আবার দেয় শীতল স্পর্শের অনুভূতি। ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজিস্ট সীমা হিঙ্গোরানীর কথায়, "আমার একজন বিষণ্ণ রোগী ছিলেন যিনি শুধু তাঁর ঘরের রঙ বদলে নিজের বিষণ্ণতা থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছিলেন।" তাই বিষণ্ণতায় ভুগলে ঘরের দেওয়ালে হালকা রঙ ব্যবহার করুন। এই ধরণের রঙ মনকে শান্ত রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 


রঙের উত্তাপ প্রসঙ্গে বলতে গেলে আমাদের চারদিকে যে রঙ তার কোনোটা উষ্ণ, কোনোটা শীতল। উদাহরণস্বরূপ লাল, হলুদ ও কমলা রঙ গরম অনুভূতি দেয়। হলুদ রঙ এবং হলুদের অধিকাংশ শেড নিয়ে আসে খুশির আমেজ। সোনালি রঙেও একই ফলাফল পাওয়া যায়, একই সঙ্গে থাকে ঐশ্বর্যের ধারা। কমলা রঙ আনন্দ নিয়ে আসে। এসব রঙ খুশির অনুভূতির পাশাপাশি নিউট্রাল কালার হিসেবেও কার্যকরী। অন্যদিকে, সবুজ ও নীল রঙ দেয় শীতল অনুভূতি। নীল ও সবুজ রঙ দেখলেই খোলা নীল আকাশ আর খোলা মাঠের সবুজকে মনে পড়ে। তাই একটা ছায়াশীতল অনুভূতি আমাদের স্পর্শ করে যায়। সাদা, অফ হোয়াইট, ক্রিম রঙের ব্যবহার ক্লাসিক, অভিজাত, বিলাসী ইত্যাদি নানা মিশ্র অনুভূতি দেয়।

আগেকার দিনের রেওয়াজ ছিল গোটা বাড়ির প্রত্যেকটা ঘরে একই রঙ হবে। সাদা, ক্রিম অথবা ধূসরজাতীয় রঙেই সাধারণত অন্দরমহলের দেওয়াল রাঙানো হতো। ধীরে ধীরে প্রথায় পরিবর্তন আসে, বাড়ির একেকটা ঘরের চার দেওয়ালের রঙ হয় অন্য ঘরগুলোর রঙের তুলনায় আলাদা। বর্তমানে লক্ষ্য করা যায় ঘরের বাকি তিনটি দেওয়ালে অফ কালার ব্যবহার করে একটি দেওয়ালকে গাঢ় রঙে রাঙানো হয়েছে, অথবা একই ঘরের দেওয়ালগুলোয় ভিন্ন রঙের বাহার। কিছু ক্ষেত্রে আবার নকশা তোলা।

 


বাড়ির প্রত্যেকটি ঘরের দেওয়ালের রঙ আলাদা হলে যেমন দেখতে ভালো লাগে, একই ঘরের দেওয়ালের ভিন্ন রঙও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। তবে সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ঘরের জন্য বাছতে হবে নির্দিষ্ট রঙ। যেমন, বসার ঘরের দেওয়ালের রঙ হতে পারে লাল বা কমলা, এই রঙগুলি জমজমাট পরিবেশের সঙ্গে মানানসই। হইহুল্লোড়, আড্ডায় এই ঘর মেতে থাকে। খাবার ঘরের দেয়ালটিতেও উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করা যায়।

শান্ত ও স্নিগ্ধ প্রকৃতির রঙ পছন্দ হলে ঘরের দেওয়াল হালকা নীল, সবুজ অথবা ল্যাভেন্ডার রঙে রাঙানো যেতে পারে। শয়নকক্ষে সাধারণত খুব বেশি গাঢ় রঙ ব্যবহার না করাই ভালো, এক্ষেত্রে হালকা রঙ আদর্শ। তবে গাঢ় কোনো রঙ নেহাতই পছন্দ হয়ে গেলে সেটি দুই থেকে তিন শেড কমিয়ে ব্যবহার করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

রয়াল আইভরি, চন্দন, অফ হোয়াইট বা আইসি ব্লু ইত্যাদি কিছু রঙ দেখতে উজ্জ্বল লাগার সঙ্গে ঘর বড় দেখানোর পরিবেশ তৈরি করে। মনে রাখা দরকার, উজ্জ্বল এবং কোমল ধরণের রঙ ঘর বড় দেখাতে সাহায্য করে। ছোট ঘরে এরকমই হালকা রঙ ব্যবহার করা উচিত যাতে আলোর খেলাটা খুব স্পষ্ট হয়। ঘর বড় হলে গাঢ় রঙ ব্যবহার করা যেতেই পারে। আসবাবপত্রের রঙের সাথে মিল রেখে দেওয়ালে রঙ করালে বেশি সুবিধা। আসবাবপত্রের রঙ হালকা হলে দেওয়ালেও সেইরকম শেডের রঙ করান। এতে আসবাবের আয়তন ছোট দেখায় এবং ঘরে একটা খোলামেলা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দরজা ও জানালায় দেওয়ালের তুলনায় কিছুটা গাঢ় রঙ ব্যবহার করা যেতে পারে। দেওয়াল গাঢ় রঙের করতে চাইলে সেটি একটা দেওয়ালে করান এবং স্যাটিন কোট করুন, এতে আলো প্রতিফলিত হবে এবং ঘর বড় ও উজ্জ্বল দেখাবে।


শুধুমাত্র আসবাবপত্রই নয়, ঘরের জানলা দরজার পর্দা কেনার সময় মাথায় রাখতে হবে যে ঘরের জন্য সেটি কেনার হচ্ছে সেই ঘরের দেওয়ালের রঙের ছোঁয়া যেন সেই পর্দায় বিরাজ করে। দেওয়ালের রঙ অথবা সিলিংয়ের রঙের শেডের পর্দা কেনাই ভালো যা হতে হবে পাতলা ও স্বচ্ছ কাপড়ের। এর ফলে ঘরে আলো বাতাসের যাতায়াত সঠিকভাবে হবে। ঘরে আলো বাতাস ঠিকঠাক এলে ঘর এমনিতেই বড় লাগবে। কম রঙের ব্যবহার ঘরকে খোলামেলা আউটলুক এনে দেয়।

 


শিশুদের ঘরের রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছেলেদের জন্য নীল এবং মেয়েদের জন্য গোলাপি ঘেঁষা রঙ ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া মেয়েদের ঘরের জন্য গোলাপি ব্যতীত পিচ, বাসন্তী রঙ এবং ছেলেদের ঘরের জন্য নীল ব্যতীত সাদা, প্যাস্টেল পিঙ্ক, মিন্ট গ্রিন বা নিউট্রাল কোনও রঙ বেছে নেওয়া যেতে পারে। একরঙা দেওয়ালের পরিবর্তে বাচ্চাদের আকর্ষণ লাগে এমন বিভিন্ন ছবির বৈচিত্র্য ব্যবহার করা যেতে পারে সেখানে।

শুধুমাত্র একরঙা চার দেওয়ালই নয়, ঘরের মধ্যে একদিকের একরঙা দেওয়াল জুড়ে অনায়াসেই লাল রঙের কলকা তুলে ফেলে যায় অথবা ফুটিয়ে তোলা যায় নীল রঙের ফুলের বাহার। তার জন্য দরকার প্যাটার্নড রোলারের। এই রোলারে হ্যান্ডেলের সঙ্গে একসাথে দু'খানি রোলার লাগানো থাকে। একটি রোলার মসৃণ এবং অপরটি ছাঁচওয়ালা, সেই ছাঁচে বিভিন্ন নকশা করা থাকে। দু'টি রোলার থাকে পরস্পরের সংস্পর্শে। মসৃণ রোলারটিতে রঙ লাগিয়ে সমগ্র রোলার যখন দেওয়ালে রোল করা হয়, মসৃণ রোলার থেকে ছাঁচওয়ালা রোলারের ছাঁচে রঙ লেগে যায় আর এভাবেই দেওয়ালে ফুটে ওঠে চোখজুড়ানো নকশা।

 


আঁকিয়েদের ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ঘরের দেওয়ালটিকে অনন্যসাধারণ করে তুলতে পারেন রঙ ও তুলির সাহায্যে। ভালো আঁকতে না পারলে দুঃখ করার কিছু নেই, সেক্ষেত্রে অন্য কারুর শিল্পীসত্তার সাহায্য নেওয়াই যায়। ঘর ছোট হলে একটি দেওয়ালের কিছুটা অংশে করে ফেলুন ওয়াল পেইন্টিং। ছোট ঘরের পুরো দেওয়াল পেইন্ট না করে বিশেষ কিছু জায়গা যেমন সুইচ বোর্ডের উপরে বা নীচে, দরজা বা জানালার পাশে পেইন্ট করুন। বড় ঘর হলে একটি দেওয়ালের সমগ্রটা জুড়ে আপনার তুলির টান দিতে পারেন, অথবা বিপরীত দেওয়ালে। 

এবার আসা যাক দেওয়ালের আঁকার জন্য রঙ নির্বাচন প্রসঙ্গে। অ্যাক্রিলিক রঙ এক্ষেত্রে যথাযথ। অ্যাক্রিলিক রঙ হয় উজ্জ্বল, স্পষ্ট এবং ভালো মানের অ্যাক্রিলিক রঙ জলরোধক ও আলোরোধকও হয় অর্থাৎ মলিন হয়ে যায় না। এই রঙ যেহেতু দ্রুত শুকিয়ে যায়, তাই আপনি একাধিক স্তরবিশিষ্ট কোনো ছবি আঁকলে প্রথম স্তরের রঙটি শুকিয়ে গেলে দ্রুতই পরের স্তরে আঁকার কাজ শুরু করতে পারবেন।


তবে দেওয়ালে আঁকার আগে কয়েকটি কথা মনে রাখতে হবে। আপনার ঘরের দেওয়াল যেন হয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তার উপর কোনো ধুলোবালি, তেলের দাগ থাকলে চলবে না। নয়তো আঁকার সময় সেসবের সংস্পর্শে রঙ এলে আপনার আঁকা ছবিটি আশানুরূপ নাও হতে পারে। নতুন রঙ করা দেওয়াল হলে তো নিশ্চিন্তে স্বচ্ছন্দে আঁকতে পারেন। কিন্তু দেওয়ালের রঙ অনেকদিন আগে করা থাকলে আগে সেটি পরিষ্কার করে তারপর ওয়াল পেইন্টিং শুরু করুন। দেওয়ালে ময়লা বা দাগ পড়লে লিকুইড ডিটারজেন্ট মেশানো জলকে ফোম বা সুতির কাপড় ভিজিয়ে দেওয়াল মুছে নিন।

এছাড়াও রয়েছে কালার ইলিউশনস। ইলিউশন হচ্ছে দেয়ালে রঙের সাহায্যে নিছক বিভ্রম সৃষ্টি করা যেটি দেখলে অনেকটাই বাস্তব বলে মনে হবে। ঘরের আয়তন অথবা দেওয়াল বা সিলিংয়ের রঙের ওপর নির্ভর করে ইলিউশন করানো হয়। ঘর যদি বড় হয়, তবে একটু গাঢ় রঙের ইলিউশন করা যেতে পারে। শিশুদের ঘরের সিলিংয়ে আকাশি রঙ ব্যবহার করে তাতে রাতের আকাশের চাঁদ তারার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা অথবা দেওয়ালে সমুদ্র বা মাছের ইলিউশনের সাহায্যে ঘরের সৌন্দর্য্যের এক আলাদা মাত্রা বৃদ্ধি পায়। শয়নকক্ষে ছোট ছোট ঘাসফুল, বাঁশঝাড়, পাতা ঝরা গাছ অথবা ঘরের এক কোনায় হাজারো প্রজাপতির পাখা মেলার বিভ্রম সৃষ্টি করা যেতে পারে।


 তবে শয়নকক্ষে ইলিউশনের ক্ষেত্রে নিজের রুচি ও পছন্দের কথা মাথায় রাখা উচিত। ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র, জানালার অবস্থান, আলো এবং তাপমাত্রা বুঝে ইলিউশন করতে হবে। খুব বেশি ডিজাইন বা জটিল প্যাটার্ন ব্যবহার না করে হালকা প্যাটার্ন বেছে শোবার ঘর সাজানো ভালো। যে ধরনের ইলিউশনই ব্যবহার করা হোক না কেন, ঘরের গঠন, ফার্নিচার, সিলিং প্রভৃতির সঙ্গে মিল রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দেওয়ালে ওয়াল পেপার ব্যবহার করে ইলিউশন করার তুলনায় ইলিউশন পেইন্টিংয়ের ব্যবহারিক উৎকর্ষতা অনেক বেশি। এটি অতি সহজেই পরিষ্কার করা যায়। দেওয়ালে কোনো দাগ বা ময়লা লাগলে সাবানজল দিয়েও মুছে ফেলা যায়। দেওয়ালে হালকা রঙ ব্যবহার করলে অনেকক্ষেত্রে সেটির ময়লাভাব বেশি চোখে পড়ে। তবে ইলিউশনে পেইন্টিং থাকার ফলে এটিতে ময়লা চোখে পড়ে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ বা ইলিউশন ব্যবহার করলে ফ্লোরাল কিংবা লতাপাতা নকশার ইলিউশনকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। 

নানা রঙে ঘরের দেওয়াল রাঙিয়ে তুললেও এই রঙ ক্ষতিকর কিনা সেটি মাথায় রাখা একান্ত প্রয়োজনীয়। রঙের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানগুলি কতক্ষণ পর্যন্ত স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তা বোঝার অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে এর গন্ধ। রঙের গন্ধ একেবারে দূর হওয়ার পরই সেই ঘরে বসবাস শুরু করা উচিত। প্রশস্ত দরজা জানলার ব্যবস্থা যেন থাকে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে এবং ঘরে আলো বাতাসের পর্যাপ্ত যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠানের প্লাস্টিক পেইন্ট, ডিস্টেম্পার, ইলিউশন ইত্যাদি রঙ পরিবেশবান্ধব উপায়ে বাজারে এসেছে। তাই রঙ কেনার আগে সবদিক বিবেচনা করেই কেনা ভালো যে সেটি পরিবেশবান্ধব কিনা।

 তাহলে আর দেরি কেন, নিজের পছন্দের কথা মাথায় রেখে ঘরের অবস্থান ও আয়তন অনুযায়ী ঘরের দেওয়ালের জন্য শীঘ্রই উপযুক্ত রঙগুলি নির্বাচন করে ফেলুন। আলো বাতাসকে ঘরে স্বাগত জানান। শত পরিশ্রান্ত হলেও মন সতেজ হতে বাধ্য।

 

কলমে - গীতশ্রী ঘোষাল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন